চাঁদের বীজ বুনে
বুনে
সেইসব নিস্তব্ধ ছবি
হালকা সরের মতো নেমে আসে। আধবোজা দুই চোখ, শান্ত সমাহিত জ্যোৎস্না , কোথাও কোন পাতা
ঝরে পড়ছে না। কোন পৃষ্ঠায় কোন রাতচরা পাখির উদ্বেগ লুকিয়ে নেই। শুধু হালকা অক্ষর ভেসে বেড়ায়
। তাদের ভেতরকার ছবিটা এমন নয় যদিও। এমাথা ওমাথা এক উদ্ভ্রান্ত প্রশ্ন , এক নক্ষত্রকালীন
অনুভূতি ঘনিয়ে ওঠে। সেইসব প্রশ্নের মুখে আঁকা হয় বুদ্ধের উচ্চারণ । বুদ্ধ তো শুধু প্রশ্ন
নন, কবিতার মতোই একটি বিপন্নতা বোধ। সারা পৃথিবীর অগ্নিদগ্ধ চেতনাকে গ্রহণ করছেন। কবির
মতোই একটি একটি শব্দে গেঁথে রাখছেন অনুভব। আর কবি নি্জেকে নিয়ে, এ জগত সংসারের দুর্বোধ্য
বিশ্লেষণ নিয়ে একটি শব্দের কাছে তার নদীটুকু রেখে আসেন। তার বিপন্নতায় যে নৈরঞ্জনা
নদী বয়ে যায়, তার জলের কাছে বসে কবির সময়কে বোঝার সাধনা, নিজের ভেতর নক্ষত্র উপলব্ধির
সাধনা।
একটা ছায়ার নীচে ঘন হয়ে আসছিল সন্ধে
তাকে অপেক্ষায় রেখে বাতাসা ও নয়নতারা
গড়িয়ে পড়েছে ধূলো থেকে
হাঁটু মুড়ে বসেছি চন্দন গন্ধের কাছে, আলোর আড়ালে
পোড়ো বাড়ির অনুষঙ্গে দুলে ওঠা ছায়া
হঠাত তক্ষক ডেকে উঠলে গলে পড়ে যায়
গ্রামোফোন বক্স থেকে লাফ দিয়ে পড়া
কুকুরছানাটি গতজন্ম থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে দৃষ্টি
কুড়ি বছর আগে হারিয়ে ফেলা দুপুর
আসলে ততটা স্মৃতিধার্য ছিল না, যতটা অনিবার্য।
(জাতকের গল্প, অববাহিকার লেখাগুলি)
কবি অনিন্দিতা গুপ্ত
রায়ের “অববাহিকার লেখাগুলি” পড়তে পড়তে বার বার মনে হয়েছে এ এক নিরন্তর স্রোত। তার ভেতর
থেকে আঁজলা ভরে জল তুলে দেখি সেই একমুঠো জলে গোটা জীবনের ছায়া পড়েছে। যে আবহমান জীবন
এক পা দু’পা করে এগোতে থাকে । যার কোন গন্তব্য নেই। যার আধার শুধু একটি বেঁচে থাকা
নয়। বার বার জন্মের মধ্যে সেই আবহমান মনে করিয়ে দেয় এক গুরুত্বহীন আমিকে। এই এক’পা
ফেলছি , এই পা’টি আমি, এই আরেক পা ফেলছি , এ হল তুমি। তৃতীয় পা... ওই তো সে । তাহলে
পদক্ষেপের মাঝের অংশটি শূন্য। সেই শূন্যতাকে আমরা ভুলে থাকি। জীবনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপের
মাঝখানে রচিত হয় কত গল্প। আপাত দৃষ্টিতে সে শূন্য। কিন্তু ওইখানে “চন্দন গন্ধ, পোড়ো
বাড়ি, তক্ষক” থাকে। ওই শূন্য থেকেই “ কুকুরছানা গতজন্ম থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে দৃষ্টি” । আবহমানের
মাঝে এইসব শূন্যতাই গল্প লিখে রাখে। “কুড়ি বছর আগে হারিয়ে ফেলা দুপুর” লিখে রাখে। এই শূন্যতা তাই
এক অনিবার্য জীবন।
ধরা যাক এই কাব্যগ্রন্থের আর একটি কবিতা “ব্রেকফাস্ট টেবিল”, তুমি আমি তোমরার
মাঝখানে যে ব্রেকফাস্ট টেবিল থাকে তার “উদাসীনতার ভেতর উলের রঙিন বল গড়িয়ে দিয়ে শীতঋতু
, ঋতুদাগ রয়ে যাবে অন্য কোনও বসন্তবিলাসে” । এইসব না দেখা গল্প দিয়েই জন্ম জন্মান্তর
আলাদা হয়ে যায়। শুধু “ব্রেকফাস্ট টেবিল” নয় বেশির ভাগ কবিতা পড়তে গিয়ে সাবজেক্ট ক্রমশ গুঁড়ো গুঁড়ো ভাবনায়
ওই শূন্যের মাঝে ছড়িয়ে যায়। ডিফ্যামিলিয়ারাইজেশনের তত্ত্ব মনে পড়তেই পারে। কিন্তু কবিতার
গায়ে তো তত্ত্ব লেখা নেই। আছে অনুভূতির জারণ বিজারণ। আমাদের অনন্ত ব্রেকফাস্ট
টেবিলে তাই সার্ভ হয় জীবনকে বোঝার, পদচ্ছাপকে বোঝার আকুল প্রয়াস । তুমি শব্দটি তাই
একটি একটি বিষয়, যাকে নিয়ে এক নক্ষত্র রাতে কবি তারার নিচে কবি শুয়ে থাকেন একা। ঠিক
তখন,
“ অন্ধ ফকির সুফিয়ানা গাইছে বিহ্বল
ক্রমাগত তক্ষকের ডাক
একটা অন্ধকার বাগানের দিকে
গড়িয়ে ফেলছে শরীরের বাতিল লোহালক্কড়”
(আরশিনগর, অববাহিকার লেখাগুলি)
ফকিরের পথে অন্ধকার
নামে প্রায়শই। দেহের ভেতর তুমি নামক যে দেহাতীত আছে তাকে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। আজীবন
কবি সেই তুমি বা আমি নামক বেদনার ভেতর একাকী বসে আছেন ধ্যানে। যা পেতে চান তা অধরাই
থাকে। শুধু একটা অনিঃশেষ পথ আঁকা হতে থাকে কবিতার ভেতর। তক্ষক শব্দের কতরকম কনোটেশন
হতে পারে। তক্ষক বাধা দিচ্ছে অথবা উন্মুক্ত করে দিচ্ছে সীমারেখা । প্রতিদিন নিজের চাঁদকে
বুনে চলা তো সহজ নয় । বিপন্নতার মাঝে সেইসব মলিন আলো তাই আপন মনে লেখে । নিজের মানচিত্র
লেখে। মনে পড়ে যায় লালনের গান...
“ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর
ও এক পড়শি বসত করে”
চাঁদের পরমা
মিথ ঘিরে থাকে আমাদের
অনুভবের প্রত্যেক আলোয়। শব্দের ইতিহাস ছেড়ে, ডায়াক্রনিক লিঙ্গুয়িস্টিককে বাদ দিয়ে কিছু
ভাবা বা লেখা খুবই কঠিন। এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে একটি অতি চেনা মিথকে আমি নতুন করে অনুভব যদি করি, তবে সেটিও একটি নতুন কাব্যভাষা জন্ম দিতে পারে। এমনও হতে নতুনের আলোয় চিরপরিচিত
মিথটির একটি চমকে দেবার মতো নতুন ভাষ্য নির্মিত হচ্ছে।
“ হুইলচেয়ার থেকে
একে একে উঠে দাঁড়াচ্ছেন মুণ্ডিত মস্তক শ্রমণেরা”
( এক, থাকা না থাকার মাঝখানে ,তেমন জরুরি কিছু নয়)
শ্রমণ শব্দটি যত
কথা এ মুহূর্তে বলে গেল, যতটা গাঢ়তা এনে দিল কবির স্তব্ধতায়, অন্য শব্দ হয়তো এই কবিতা
মুহূর্ত তৈরিতে ব্যর্থ হত। শুধু এই একটি লাইন নিয়ে কত কথা বলা যেতে পারে। আমি এই উঠে
দাঁড়ানো দেখলাম, পড়ে থাকা হুইলচেয়ার দেখলাম। এমন মুহূর্ত কিভাবে লেখা হতে পারে সেটি
ভাবলাম। সমালোচকরা নিউ ক্রিটিসিজমে বলেন শুধু টেক্সট নিয়ে কথা বলতে, কিন্তু যেহেতু
কবিকে চিনি, তার “তেমন জরুরি কিছু নয়” এই বইটির ইতিহাস কমবেশি জানি, তাই শুধু টেক্সট এক্ষেত্রে
একা কথা বলছে না। কথা বলছে কবিতার পরিপ্রেক্ষিতও । আমি তো সমালোচক নই তাই থাকা আর না
থাকার অনুভূতি নিয়ে বিচলিত হই। প্রতিদিনের বেঁচে থাকা আর বেঁচে ওঠা আমাকে নিজের মতো
করে কবিতাকে দেখতে বাধ্য করে। এই বইএর অনেক কবিতাই ব্যাথাতুর আদরের ভেতর রেখে দিই।
কিন্তু পারসোনালাইজেশনের ভেতর থেকে কবিতা অনেক সময়ই কবির ব্যক্তিসীমাকে ছাড়িয়ে যায়।
কিছু ব্যক্তিগত উচ্চারণ ব্যক্তিগত থাকে না, তা সবার হয়ে ওঠে। সেখানে যদি আমিত্ব থেকেও
যায় তবু সেই আমিত্ব পাঠকের আমিকে গ্রাস করে নেয়। কবিতার শুধুমাত্র কবিতা হয়ে উঠতে যেমন
কোনো বিশেষ টুলের প্রয়োজন নেই, তেমনি শুদ্ধ কবিতা- পাঠকেরও অনুভূতির স্রোতের ভেতর ডুব
স্নান দিতে কোন তত্ত্বের প্রয়োজন হয় না । তাই পারসোনাল কবিতাই হোক বা ডিপারসোনালাইজেশনই
হোক কবিতা সবকিছু থেকে দূরে একটি অচেনা টেক্সট হয়েই বেঁচে থাকে। এবং অপেক্ষা করে পরবর্তী
কালের কবিতা পাঠকের জন্য, যারা নতুন ভাবে টেক্সটটিকে বিচার করবে, পাঠ করবে। কিছু কিছু
চমকে ওঠা লাইন নিয়ে ভাবতে থাকি। এই বইটির তিন নং কবিতায় একটি লাইন ...
“অপেক্ষা – শব্দ থেকে মোহ ঝেড়ে এতদিনে ঠিকঠাক”
কতবার যে শুধু এই
একটি লাইনকে ঘুরেফিরে ভাবতে হয়। কখনো শিক্ষার্থীর মতো হাঁটু গেড়ে বসতে হয়, কখনো বা সন্দেহ
করতে হয়। এইখানে কবি নেই, আমি আছি , অগণিত পাঠক আছে। তবে প্রত্যেক লাইনে বা প্রত্যেক
কবিতায় এই আইডেন্টিফিকেশন ঘটে, এমনও নয়। সেখানে একটি সেতু গড়ে নিতে হয়। পড়তে পড়তে অচেনা অভিজ্ঞতা
ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে স্নায়ুতে। গৃহীত হয় মস্তিষ্কে। আমরা তখন কবিকে তার ভাষাতেই বলতে
পারি...
“ জট ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে
গুছিয়ে তুলছ হাতের পাতায়, আমাকে”
কবি যখন হাড় পাঁজর
রক্ত মাংস ছেনে একএকটি নতুন কাব্যভাষা জন্ম দেন তখন সমালোচনার একএকটি বিধিবদ্ধ পথও
ত্যাগ করে এগোতে হয়। একটি কবিতায় ইমোটিভ ভাষার মধ্যে ডায়াক্রনিক ব্যবহার থাকতেই পারে।
থাকতেই পারে নতুন কোন ইঙ্গিত... হাজার হাজার বছর আগে আদি কবি তাঁর প্রথম শ্লোকটি লেখার
পর বলেছিলেন ... কিমিদং ব্যবহৃতং ময়া... এই বিস্ময় কবির আসতেই পারে। তার কাজই তো অচেনা
শেকড় বাকড় খুঁজে বের করা। সেইসঙ্গে পাঠককেও বেরিয়ে পড়তে হয় এক দুর্গম অভিযাত্রায় ।
সে পথে কোন দিকনির্দেশ নেই। নেই কোন সরাইখানার আলো। শুধু নক্ষত্রের গন্ধ নিয়ে যায় অজানা
পৃথিবীতে । এবার আমরা বরং আর একটা কবিতা পড়ি-
“ পাতা থেকে বিচ্ছিন্ন,
পিছিয়ে পড়েছে দিন। তাকে বোঝাও কাঁটাগাছের বিপন্নতা। উল্লাসের আদলে কোশ কীভাবে খুলতে
থাকে আর ফেটে পড়ার অপেক্ষায় একএকটা ভ্রমের লালন। ...... জ্বরের হাত ধরে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে
দিন, স্বাভাবিক যতটা যাপন। তারপর হাঁটতে বেরব, লাটাগুড়ি বাজার পেরিয়ে, ঝিঁঝিঁ ডাক সন্ধে
পেরিয়ে। শেষবেলার গল্পে পদাবলি থেকে আলতাচিহ্ন এঁকে বনবস্তি । বৃষ্টি সেদিনও , অবিচ্ছিন্ন
পথরেখা ধুয়ে নতুনে, বিভাবে। ধুলো শুধু বিরতিপ্রবণ, পায়ের অতল থেকে সন্ধ্যাতারায়...”(
যা লিখেছে হুইলচেয়ার, পাঁচ)
এইসব কবিতায় নিজের
নিবিড়ে চুপ করে বসে থাকতে হয়। কোথাও ক্ষয়, কোথাও নতুন জন্মের চিহ্ন লেগে থাকে প্রতিটি
দিন। লেখার মধ্যে একটি নতুন সম্ভাবনার প্রকাশ ঘটতে থাকে। কী থাকে সেই সেই সম্ভাবনার
পথে? একটা গোটা পৃথিবী , একটা মহাজাগতিক মেঘ অথবা নতুন সম্পর্কের আবেগটুকু। অথবা একটা
হঠাত আবিষ্কার ... নিজেকে... নিজের সাথে নিজের এক ঝলক পরিচয়। জীবন জীবন বলে জড়িয়ে ধরা
সন্ধের আলো। এইসব কবিতার ভাষা নতুন কী পুরনো, সমগ্র কবিতা ভুবনে এটি কি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ
নাকি লাইটহাউসের ঝলক ঝলক আলো, তা বলা তেমন সহজ নয়।
“ কী যেন কী কথার
আঙুল ! তর্জনী তুলে তুলে ভাঁজ থেকে ভঙ্গিমা । নৌকোটি শিখি, আলপথে আলোর দিকে”।
এই আলোটুকু কবি তুলে
দেন পাঠকের হাতে। আলোটুকুই থাকে...
চাঁদের হাওয়া বাতাস
কবিতার একটি লাইন
যদি গোটা কবিতাকে ঢেকে দেয় তবে সে কবিতা ব্যর্থ । শব্দের পর শব্দ জুড়তে জুড়তে ছাড়তে
ছাড়তে একটা স্রোত তৈরি কোথাও। কবিতা কোন গল্প নয়, কোন বিপ্লব বা প্রতিবাদের হাতিয়ার
নয় , একটি একাকী বাতাস ইমেজারির পর ইমেজারি ছড়িয়ে দিচ্ছে। তার ভেতর এক অদ্ভুত অতলান্ত
জীবন চিঠি লিখছে নিজেকে। নিজের অনুভবের প্রত্যেক পাঠকে জানতে চেয়ে নিজেকেই চিঠি লেখা
যায় অজস্র। কেউ বলবেন , কী আছে এত খোঁজার , এত বুঝতে চাওয়ার। আসলে সেই আমি তো আমি নই।
লক্ষ বছরের অনুভব একত্রিত হয়েই এই আমি বোধ। তাই একে জানতে চাওয়ার পথও অসীম। ঠিক যেভাবে
ডি এন এ পাঠও শেষ হয় না বিজ্ঞানীদের । তাই চিঠিও চলতে থাকে। লেখা না লেখা চিঠি জমে
ওঠে প্রাত্যহিকের উল্টো পিঠে।
“ অনবরত লিখে যাওয়া চিঠিগুলির জন্য কোনও
লালবাক্স নেই পথের বিরলে
কোথাও হাহাকারের শব্দ হচ্ছে। তোকে লিখি, লিখে নিই
সমস্ত উত্থান ও পতনের মধ্যবর্তী লিপিগুলো”
(টাইটল সং, পৃষ্ঠা ৫)
“টাইটল সং” বইটি
একটু অন্যরকম। পড়তে পড়তে বার বার কী যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। অনেকপরে বুঝলাম অস্বস্তির সূত্রটা।
বহুদিন আগে এমিলি ডিকিনসনকে পড়েছিলাম। অল্পই পড়েছিলাম। বিদেশী সাহিত্য তেমন জানি না।
নিজের আগ্রহেই একটু আধটু পাতা ওল্টাই। এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় কোন টাইটেল নেই। এই বইয়ের নাম
যদিও টাইটেল সং । কিন্তু শিরোনামহীন কবিতারা অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায় এক একটি পরিপূর্ণ
গান হয়ে ওঠে। এমিলি ডিকিনসনকে যখন পড়ছিলাম, একটা মনখারাপের ছোপ লাগা আধো অন্ধকার ঘর
দেখতে পেতাম। এই বইটিও একটি ঘর। তাতে যে কবিতারা বসবাস করে তারা নামহীন বলেই যেন তীব্র
উপস্থিতি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কত বিচিত্র তাদের চেতনার জগত। এই বইএর একটি কবিতা পড়া যাক।
“ মৃত্যুর রিহার্সাল ঘুমের ভেতর। পুরনো বাঁশের কেল্লা
নড়বড়ে সিঁড়ি ... উপরের অথবা নিচের
নির্দিষ্ট মসৃণতায় মোম পালিশ হাত পা
কেমন গলে গলে অঙ্ক কষছে সিঁড়ি ভাঙার , জুড়ে দেওয়ার
পাসওয়ার্ড খুঁজতে খুঁজতে ভোর, পাখি ডাক
তাকে লিখি , লিখে রাখি... উইল যেমত মৃত্যুকালীন
বেঁচে থাকার সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নতজানু গ্রহণীয়
সপ্তঋষি বসে থাকে দাবার ছকের মুখোমুখি
আর খুব অট্টহাস্যে ওড়ে ইশারা ও হাততালি
থেকে থেকে চিৎকার ওঠে... জাগতে রহো
( পৃষ্ঠা ৩৯)
কবিতার ভেতরের কথা,
পংক্তি , তার শব্দ ব্যবহার এসব নিয়ে সবসময় ভাবার মতো মন থাকে না। একএকটি কবিতা একটি
বিশুদ্ধ ভাবের ভেতর হাত ধরে নিয়ে যায়। তখন তত্ত্ব তথ্য সব কেমন বিচিত্র বলে মনে হয়।
সেইসব অনুভূতি থেকে জন্ম হতে পারে একটি কবিতা অথবা গুনগুনিয়ে ওঠে একটি গান। সারাদিন
সব কাজের ভেতর ওই গান চলতে থাকে, চলতেই থাকে। আর নিয়ে যেতে থাকে এক কাঙ্ক্ষিত শূন্যতার
ভেতর। অনিন্দিতাদি লিখলো... “ থেকে থেকে চিৎকার ওঠে... জাগতে রহো” । ওমনি একটা গভীর
রাত একা একা জেগে উঠলো আমার মাথায়। কোথা থেকে এত শূন্য এল কে জানে। আচিন্তা শূন্যের
মাঝে ওই গানটা সারাদিন বাজতে লাগল...
“ আঁধার রাতের একলা পাগল যায় কেঁদে
বলে শুধু, বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে, বুঝিয়ে দে।
আমি যে তোর আলোর ছেলে,
আমার সামনে দিলি আঁধার মেলে
মুখ লুকালি মরি আমি সেই খেদে।
অন্ধকারে অস্তরবির লিপি লেখা
আমারে তার অর্থ শেখা
তোর প্রাণের বাঁশির তান সে নানা
সেই আমারই ছিল জানা,
আজ মরণ-বীণার অজানা সুর নেব সেধে”।
জীবনকে কত ভালোবেসে , কত
অভিমান জড়িয়ে ধরে এইসব লাইন লেখা হয় তাই শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। কত মানুষের একলা
গান, একলা কবিতা, একলা অর্থ শিখতে চাওয়া সেই প্রাণের বাঁশি মধ্যরাতে মনের ভেতরের পাগলকে
ঘুরিয়ে মারে। কবিতার অর্থ জানি না। কবিতার ভেতরের পাগলকে চিনি, অল্প হলেও চিনি।
ঝরতে থাকা চাঁদ
এই লেখাটা অনন্তকাল
চলতে পারে। এইসব কবিতা নিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় অসংখ্য সময়ের ফ্রেম। কিন্তু এখানে একা
আমি তো লিখবো না। আমি তো শুরু করলাম, যারা এই কবিকে পড়েন বা পড়বেন তারা লিখবেন এর পরের
কথাগুলো। আমি তো গুছিয়েও লিখতে পারিনি। বইগুলোর একটা ক্রম আছে। সেসবও ভাবিনি, এলোমেলো
ভাবে যখন যেটা নিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়েছে বলে গেছি। এরপর আর যখন লেখা হবে তখন মনোযোগী পাঠক
আরো কত যত্ন নিয়ে, ক্রম মিলিয়ে লিখবেন। আমার তো এলোমেলোই ভালো লাগে। যখন যে কবিতা,
যে বই ভালো লাগে তুলে নিই। এইভাবেই আর একটি বই হাতে নিয়েছি। একফর্মার একটি চটি বই।
নাম “আছি”। ইচ্ছে করেই এই বইটি দিয়ে কথাবার্তা শেষ করবো। এক ভয়ানক অতিমারি শেকড় থেকে
নাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের। প্রতিদিন রোগ আর মৃত্যুর বিষণ্ণতা গিলে নিচ্ছে । তার মধ্যেই
জীবন চলছে, মাস্ক আর ফেসশিল্ডের ভেতর দিয়ে একঝলক রোদ ঝলসে উঠছে কোথাও, আর বলছে... আছি
, আছি, আছি রে ...
ঠিক এইভাবেই এই বইটি
এক গভীর জীবনস্বপ্ন থেকে , এক হারিয়ে যাওয়া ঘুমের জগত থেকে অল্প মাথা তুলে কবিতারা
বলছে আছি... ইচ্ছে করছে সবাইকে ডেকে ডেকে বলি... ওঠ ঘুম থেকে এইসব কবিতা পড়ে নাও। তারপর
চলো
“ কাঙালের মত শুধু কথা ভিক্ষা করি, নিমফুল জড়ো করি
ছেঁচে পিষে অমৃতে তিক্ত কষায় মাখামাখি করি
ঠোঁটের ভেতর জেগে ওঠে ঠোঁট , আর গান হয়
আর বৈশাখের দিকে ভেসে আসে অঘ্রাণের আতপগন্ধ
জানি আমি পরমান্ন রাঁধা হবে
তারপর নৈরঞ্জনা বয়ে যাবে বুকের ভেতর
শুধু অন্য কোনও নাম ধরে নির্বাণ দুয়ারে দাঁড়ালে
তুমি তাকে দু’হাতে জড়াবে”
এরপর আর কোন কথা
থাকে না। একটি সুর থাকে শুধু , একটি রেশ। “যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের... মরণের সাথে তার
হয় নাকো দেখা” ... যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের... যে জীবন... জীবন রে...
2 মন্তব্যসমূহ
দারুণ রিভিউ, দারুণ। মূল কাব্য গ্রন্থ কে পড়তে উৎসাহিত করবে। অনেক কথা জয়শীলা উপস্থাপন করলো। তাই, অনেক প্রতিক্রিয়া... তার মধ্যে একটা, এই খুঁজতে চাওয়া অতলান্ত একটা প্রতিবাদ থেকেই তো 🙂
উত্তরমুছুনখুশি হলাম খুব। বন্ধুকে ধন্যবাদ দেবো না...
মুছুন