পুরাণ শব্দের অর্থ হল প্রাচীন কথা। শাস্ত্রে আছে -“যস্মাৎ পুরাহি আসীৎ ইদং তৎ পুরাণম্” অর্থাৎ ,যেখানে প্রাচীন কথা বর্ণিত হয়েছে তাই পুরাণ। পুরাকালের সৃষ্টি, ধর্ম, আচার, প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনার সংকলনকে সাধারন ভাষায় পুরাণ বলে।পুরাণের রচয়িতা হলেন মহর্ষি বেদব্যাস।মুলত পুরাণে প্রাচীন রাজরাজড়ার কাহিনি, তাদের যুদ্ধবিগ্রহ এবং দেবতা ও ঋষিদের নানা ঘটনাবলীর উল্লেখ রয়েছে। এই গল্পকাহিনির জন্য ভারতবর্ষ জুড়ে পুরাণগুলি জনপ্রিয়,জনপ্রিয়তার আরেকটি প্রধান কারণ হল এই যে: বৈদিক যাগযজ্ঞে এবং ধর্মীয় বিষয়ে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণদের অধিকার ছিল। পুরাণ সেই সাহিত্য ও ধর্মকে দ্বিজ ও দাস নির্বিশেষে ভারতবর্ষের আপমর জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। কোনও কোনও পুরাণে আছে, যেহেতু নারী ও শুদ্র বেদপাঠে বঞ্চিত,ইতিহাস ও পুরাণ মূলত নারী ও শূদ্রের জন্য রচিত।
“পুরাণ” সাহিত্যকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে- ১) মহাপুরাণ এবং ২) উপপুরাণ। তবে
বর্তমান পুরাণ সাহিত্যে পুরাণ বলতে মহাপুরাণকেই বোঝায়।অষ্টাদশ মহাপুরাণের নামগুলি
হল -১) ব্রহ্ম, ২)পদ্ম, ৩) বিষ্ণু, ৪) শিব, ৫) ভাগবত, ৬) নারদীয়, ৭) মার্কন্ডেয়,
৮) অগ্নি, ৯) ভবিষ্য, ১০) ব্রহ্মবৈবর্ত, ১১) লিঙ্গ, ১২) বরাহ, ১৩) স্কন্দ, ১৪) বামন,১৫)
কূর্ম, ১৬) মৎস্য, ১৭) গরুড় এবং ১৮) ব্রহ্মান্ড। মহাভারতের স্বর্গারোহন পর্বে এবং
হরিবংশে এই অষ্টাদশ মহাপুরাণের উল্লেখ আছে।মহাপুরাণ ছাড়াও অবশ্য আরও ১৮টি উপপুরাণ রয়েছে।
যেমন: আদি, নৃসিংহ, বায়ু, শিবধর্ম, দুর্বাসঃ, নারদ, নন্দীকেশ্বর, উশনঃ, কপিল, বরুণ,
শাম্ব, কালিকা,মহেশ্বর, পদ্মা, দেব, পরাশর, মরীচি এবং ভাস্বর। বৈদিক ব্রাহ্মণগণ বলেন:
বেদ ব্রহ্মার মুখ নিঃসৃত বাণী। বেদ-এর সঙ্গে ব্রহ্মার মুখ থেকে পুরাণও নিঃসৃত হয়েছিল।
ব্রহ্মার মুখ নিঃসৃত বাণী অষ্টাদশ পুরাণে সঙ্কলন করেছেন মহাত্মা ব্যাসদেব । যদ্দুর
মনে হয় ব্যাসদেব বলতে কোনো একজন ব্যক্তিকে বলা হয়নি,সম্ভবত "ব্যাসদেব" উপাধি
বিশেষ।পুরাকাল বলতে ভারতবর্ষে ৩০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ অবধি এই সময়কালের
বিস্তারকেই ধরা হয়। এই সময়টিকে আর্যভারত ও হিন্দুভারতের মধ্যবর্তী কাল হিসেবে গণ্য
করা হয়। পুরাণ রচনার সাথে সাথেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।পুরাণে প্রাক-বৌদ্ধ
শৈবধর্ম বৈদিক আর্যধর্ম, জৈন ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম এবং লোকায়ত বিশ্বাসের সমন্বয়ের কথাও বলা
হলেও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রাধান্য পায়।
পুরাণের পাঁচটি লক্ষণ,"সর্গশ্চ প্রতি সর্গশ্চ বংশো মন্বন্তরানি চ/বংশানুচরিতঞ্চৈব
পুরাণং পঞ্চলক্ষণম্।।”
এখানে,সর্গ – প্রথম সৃষ্টি।
প্রতিসর্গ – সৃষ্টির পর আবার সৃষ্টি।
বংশ – দেবতা ও ঋষিদের বংশপরিচয়।
মন্বন্তর – মনুদের রাজত্বকাল এবং
বংশানুচরিত – বিভিন্ন প্রাচীন রাজাদের বংশাবলীর পরিচয়।
পুরাণের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে বিষ্ণুপুরাণের একটি উল্লেখযোগ্য শ্লোক রয়েছে। সেটি
হল–"র্সগশ্চ প্রতির্সগশ্চ বংশো মন্বস্তরাণি চ।/বংশানুচরতিং চৈব পুরাণং পঞ্চলক্ষনম্
।"অর্থাৎ সৃষ্টি, প্রলয়ের পর নতুন সৃষ্টি, ঋষি ও দেবতাগণের বংশবর্ণনা, মনুগণের
শাসনকাল, এবং রাজগণের বংশের বর্ণনা-এই পাঁচটি বিষয় নিয়ে পুরাণ রচিত।এছাড়াও দানধর্মবিধি,
শ্রাদ্ধকল্প, বর্ণাশ্রমবিভাগ, ইষ্টাপূর্ত ও দেবপ্রতিষ্টা প্রভৃতি বিষয়গুলির কথাও পুরাণগুলিতে
আলোচিত হয়েছে। ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতিষ, শারীরবিদ্যা, ব্যাকরণ, চিকিৎসাশাস্ত্র,
অস্ত্রবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনাও পুরাণগুলিতে স্থান পেয়েছে। পুরাণগুলিতে ব্রহ্মা,
বিষ্ণু ও মহেশ্বর-এই তিনজন দেবতার উপাসনাই প্রাধান্য পেয়েছে। পুরানগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য
হল- এক একটি পুরাণে একটি বিশেষ দেবতার উপস্থিতি দেখা যায়। কোনো কোনো পুরাণে দর্শন,
অলংকার, ব্যাকরণ, ছন্দ ও ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়গুলি নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে।
ব্রহ্মপুরাণ মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগে সূর্য ও চন্দ্র বংশের বিবরণ, পার্বতীরবিবাহ,
জন্ম ইত্যাদির বর্ণনা আছে। উত্তরভাগে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণচরিত, বর্ণাশ্রমধর্ম ইত্যাদির
বিবরণ ।
পদ্মপুরাণ পাঁচ খন্ডে বিভক্ত। সৃষ্টিখন্ড, ভূমিখন্ড, স্বর্গখন্ড, পাতাল খন্ড
ও উত্তর খন্ড। সৃষ্টিখন্ডে পার্বতীর বিবাহ ও তারকাসুরের কাহিনি বর্ণিত আছে। ভূমিখন্ডে
বৃত্র, বেনরাজা, নহুষ, যযাতি প্রভৃতির বিবরণ আছে; স্বর্গখন্ডে কাশী, প্রয়াগ প্রভৃতি
তীর্থস্থান সমূহের বর্ণনাসহ সমুদ্রমন্থন প্রভৃতির কাহিনি রয়েছে। পাতাল খন্ডে রাম ও
রাবনের কাহিনি এবং কৃষ্ণলীলার বর্ণনা রয়েছে। উত্তর খন্ডের বিষয় বিভিন্ন তীর্থের মাহাত্ব্য
এবং একাদশীর ফল। পৌরাণিক যুগে তীর্থস্থানের মাহাত্ম বাড়ছিল। তবে বৈদিক যাগযজ্ঞ একেবারে
পরিত্যক্ত হয়েছিল তা বলা যায় না।
বিষ্ণুপুরাণ–পরাশর ও তার শিষ্য মৈত্রেয়ের মধ্যে কথোপকথনরূপে বিধৃত এই পুরাণ
ছয়টি অংশে বিভক্ত। মূল উপজীব্য বিষয় বিশ্বসৃষ্টি, দেবাসুরের সংগ্রামকাহিনি, বিষ্ণুর
অবতারদের কথা ও কিংবদন্তি রাজাদের বংশবৃত্তান্ত।
পুরাণের নামানুসারে তার আভ্যন্তরীণ মূল ভাবের পরিচয় বোঝা যায়।
পুরাণগুলির ঐতিহাসিক মূল্য অবিস্মরণীয়। পুরাণগুলিতে প্রাচীন ভারতবর্ষের যে
সমস্ত তথ্য পাওয়া যায় অন্য কোথাও তার সন্ধান মেলে না। দেবতা, ঋষি ও মহানরাজাদের বংশপরিচয়
ও তাদের কর্ম সম্বন্ধে সঠিক বিবরন সংরক্ষণ করে রাখাই ছিল পুরাণ সাহিত্যের উদ্দেশ্য।
পুরাণগুলি মানুষের জীবনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। শৈব এবং বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের
প্রধান গ্রন্থ হল পুরাণ। “মার্কণ্ডেয়” পুরাণের অন্তর্গত “চণ্ডী” নামক দেবীমাহাত্ম্য
হিন্দুধর্মের অতি পরিচিত ধর্মগ্রন্থ। ভারতীয় ধর্ম,সমাজ ও সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে পুরাণগুলি
থেকে মূল্যবান উপাদান সংগ্রহ করে অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে।বৃহদারণ্যক উপনিষদে (২/৪/১০)
ইতিহাস ও পুরাণকে চার বেদের তুল্য মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য পুরাণ কে বলা হয়
"পঞ্চম বেদ।" বৈদিক সাহিত্য ধর্মকে কেন্দ্র করেই নির্মিত হয়েছিল।যে কোনো
জাতি নিজেদের প্রতিষ্ঠালাভের জন্য কি কি করেছে,বহিঃশক্রর আক্রমন রোধ করে অর্থনৈতিক
উন্নতির জন্য কিভাবে সংগ্রাম করে নানা সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঘাত-সংঘাতে একটি নব্য সভ্যতা
ও সংস্কৃতির মিশ্রণে নিজেকে প্রতিমুহূর্তে তৈরি করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়েছে
এসব জানতে হলে পুরাণ সাহিত্য প্রাচীন ভারতবর্ষের একটি জীবন্ত ইতিহাস।
পুরাণের স্রষ্টা কিন্তু মানুষ। সৃষ্টির পর থেকে নানা পরিক্রমার মধ্য দিয়ে মানুষ তার
মেধা ও মনন দিয়ে গড়েছে মানবসংস্কৃতি। আর এ সংস্কৃতির প্রসূতজাত এই পুরাণ। এখানে নাভি
ছেঁড়ার কোনো বালাই নেই। ছিন্ন করার কোনো অবকাশ নেই। অতএব কল্পনার সিঁড়ি বেয়ে সামান্য
বাস্তবতার কাছাকাছি আসার নামই পুরাণ, পুরাণকে বলা হয় সৃষ্টির গল্পরূপে, আদিকালের মানুষের
ইতিহাসরূপে। উনিশ শতকে পুরাণকে মনে করা হতো অতিকথা, লোককথা, নীতিগল্প বা ফেবল, রূপক
বা রূপকথা ইত্যাদি রূপে। কিন্তু এ ধারণা পাল্টে যায় বিশ শতকে এসে। পাশ্চত্য মনীষীরা
পুরাণকে মূল্যায়ন করতে শুরু করতে থাকেন ভিন্ন এক আঙ্গিকে। তারা পুরামের নানা সূত্র
অনুসন্ধান করতে চেয়েছেন তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, সমাজ ভাবনা, আচার-অনুষ্ঠান, পোশাক-খাদ্যাভাস
থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক চর্চার নানা অনুষঙ্গের ভেতর। অনেকের মতে সংস্কৃতি ও পুরাণ পরস্পরের বাহন ও
পরিপূরক।
তবে পুরাণে বহু অতিরঞ্জিত কাহিনি আছে,যেসব বর্তমান বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে
মেনে নিতে অসুবিধে হয়।
পুরাণে অলৌকিকতা ও অতিরঞ্জন বহুলাংশে আছে সত্য। তবুও প্রাচীন ভারতের পুরাবৃত্তি,
ভূগোল, জনপদের বিবরণ, লোকাচার, জ্ঞানচর্চা ও ধর্মসাধনা, জীবনচর্যার নানা কথা জানতে
আমাদের পুরাণ পাঠ জরুরি। এই অর্থে পুরাণ ইতিহাস নির্ভর রচনা— ভারতীয় পুরাণ প্রাণবন্ত।
আমাদের দৈনন্দিন ধর্ম, সমাজ, কাজকর্ম ইত্যাদির সঙ্গে এর চিরকালের সুদীর্ঘ সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য
হয়ে আছে। পুরাকালের দেবদেবী আমাদের জীবনে ও সাহিত্যে আন্তরিক স্থান অধিকার করে আছে।
তাছাড়া তুলনা করে দেখলে আমাদের পৌরাণিক কাহিনী বিচিত্রতায় ও চারিত্রিক উৎকর্ষে বৈদিশিক
পৌরাণিক কাহিনীর চেয়ে অনেক উচ্চতর।ইতিহাস, নৈতিকতা এবং প্রকৃতিতে আমাদের অবস্থান নির্দেশক
উপাখ্যানসমূহ—কালের বিপত্তিসমূহ, মঙ্গল এবং অমঙ্গলের পথসমূহ, আমাদের চারপাশের পরিবেশের
সাথে পারস্পরিক কার্যকলাপ পুরাণ ব্যতীত অজানা থেকে যেতো। আমাদের আত্মপরিচয়,আচরণ, কিংবা
অন্য সম্প্রদায়সমূহ থেকে নিজেদের পার্থক্য এসবই পুরাণ পাঠে জানা যায়।কারণ এসব বিষয়ের
ওপর আমাদের পূর্বপুরুষদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরাণের এক বিশেষ ভূমিকা আছে,
যেসব সিদ্ধান্ত দ্বারা আমরা শৃঙ্খলিত না হলেও শর্তাধীন।বিজ্ঞান এবং পুরাণ উভয়েই মানুষের
সম্ভাবনার জায়গা বিস্তৃত করেছে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির মতো আমরা পরবর্তীকালে দেখব যে
পুরাণও, এই পৃথিবীকে বাদ দিয়ে চিন্তা করেনি।পুরাণের নানা কাহিনি আমাদের অনেক কিছুর
সাথে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের কথা শেখালেও দুই মহাকাব্যে নারীর অসম্মানও
প্রকট। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, শকুন্তলা উপেক্ষা, প়ঞ্চস্বামী, সীতার বনবাস, সীতার সতীত্ব
পরীক্ষা রামের সন্দেহ শেষমেশ সীতার অগ্নিপরীক্ষা ও পাতাল প্রবেশ। বেদ-উপনিষদ পুরাণে
মহাকাব্যে নারীর অবস্থান বিশ্লেষণ করলে আধুনিক দৃষ্টিতে যা দেখি বা বুঝি তা মোটেও সুখপ্রদ
নয়। সেই সমাজের নিয়ন্ত্রক ছিলেন মুনি, ঋষি রাজন্যবর্গ। তাঁদের বিধানই ছিল সংবিধান।
মহাভারতের যুগে সমাজ ব্যবস্থা এমন এক শৈলীতে বুনে দেওয়া হল যেখানে নারী শুধুই ভোগ্যপণ্য।
সে সময় পুরুষসমাজ অলিখিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন যে রাজাদের স্ত্রীদের মুনি, ঋষিদের
দ্বারা যখনতখন গর্ভসঞ্চার। অথবা বংশরক্ষার সংকট থাকলে মুনি-ঋষি অথবা বংশেরই অন্য কাউকে
সেই দায়িত্ব দেওয়া। মহাকাব্যে এর ঝুরি ঝুরি নিদর্শন রয়েছে। আর ছিল ‘নিয়োজন’ প্রথা অর্থাৎ
প্রয়োজনে বংশরক্ষার জন্য নিয়োগ করা যেতে পারে। রাজন্যবর্গ ও মুনিরাও এটা খুশি মনেই
মেনে নিলেন। বিবাহ নামমাত্র। মুনিঋষিরা কামতাড়িত হলেই অন্য মুনির স্ত্রীকে সঙ্গমে
ডেকে নিতেন। পুরুষের চাহিদার সঙ্গে তাল রেখে খোলস বদলে নেয় নারীজীবন। কখনও সে দেবী
তো কখনও সে সেবাদাসী। নারী যেন সম্পূর্ণই পুরুষের ইচ্ছের প্রতীক এবং পিতৃতান্ত্রিক
সমাজসৃষ্ট, যাকে নাকি শাস্ত্রমতে বৈধরূপে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আবহমানের বঞ্চনা ও
পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা। মেয়েদের দেবী সাজানোর মিথ্যা আশ্বাসে কখন সেবাদাসী, দেবদাসীর
ভূমিকায় ঠেলে নিয়ে গেছে। প্রাচীন বৈদিক সমাজে সংস্কৃত ভাষায় স্ত্রীজাতির সাধারণ নাম
ছিল ‘নারী’। লক্ষণীয় যে এই নারী শব্দটি কিন্তু ‘নর’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ নয়। সংস্কৃত
নৃ ঈ= নারী। সুপ্রাচীন বেদ সংহিতায় নর শব্দটি প্রচলিত নয়। কারণ সে যুগে নাকি নর শব্দটিই
ছিল না। কিন্তু ‘নৃ’ শব্দটি ছিল। এবং স্ত্রী জাতিকে বোঝানোর জন্য নারী শব্দের যথাবিহিত
প্রচলন ছিল। সেখানে নারী শব্দের অর্থ ‘নেত্রী’।
আমাদের হিন্দু শাস্ত্রে তেত্রিশ কোটি দেবতার উল্লেখ আছে। সেই তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর
মধ্যে বেশির ভাগই পুরুষ অর্থাৎ দেব। কিন্তু সেই দেব-দেবীগণের মধ্যেও ‘একম সত্যম’ হিসেবে
দেবীশক্তিকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। চতুর্বেদ শাস্ত্রের জননী স্বরূপা হিসেবে সেখানে প্রণম্য
হয়ে আছেন গায়ত্রী। ‘মাতা’ হিসেবে তিনি পূজিতা হয়ে এসেছেন। শাস্ত্রীয় যাবতীয় হোম, যজ্ঞ,
পুজোপাঠ, উপনয়ন। সর্বত্রই গায়ত্রী মন্ত্র পাঠের বিধান আছে। তিনি দেবীই নন—বৈদিক শাস্ত্র
মতে তিনি দেবী মাতৃকা। পবিত্র গায়ত্রী মন্ত্রে ‘‘ওম ভূভূর্বস্ব/তৎসবিতুর্বরেণ্যম/ভার্গদেবস্য
ধীমাহি/ধী য়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ’’ স্মরণে এই দেবীমাতাকে আরাধনা করা হয়।ঋগ্বেদের একটি
সূত্রে বলা হয়েছে ‘‘অনবদ্য পতিযুসতেভ নারী’’। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে যে ৫ প্রধান
ধর্মাশ্রয়ী বিভাগ ছিল যথা সূর্য (শতাব্দী প্রাচীন হলেও এখন এর অস্তিত্ব নেই), গণপত্য,
বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত। এখানে উল্লেখ যে এদের মধ্যে শাক্ত ধর্মাশ্রয়ীরাই একমাত্র মাতৃশক্তিকেই
মান্যতা দেন। মাতৃপূজার ভাবনা আমাদের ভারতে বহু প্রাচীন। মাতৃশক্তিকে পরামারাধ্যা জ্ঞানে
ভাবা হয়—এই শক্তি পরাত্মারই পূর্ণশক্তির বিচিত্র পরাশক্তিকে আশ্রয় করেই হয়। সভ্যতার
আদিযুগ থেকে এই মাতৃশক্তি জাগতিক দুর্দশা থেকে মানুষকে রক্ষা করবে এই বিশ্বাস রয়ে গেছে
মানবমনে।
মার্কন্ডপুরাণেও উল্লেখ আছে দেবতাদের মতোই অন্যান্য উপদেবতারাও ঐশ্বরিক মাতৃশক্তির
কাছেই নতজানু হয়ে ছিলেন। দেবী অদিতি-কে সমস্ত প্রধান দেবতা যথা, ইন্দ্র, বরুণ, রুদ্র,
আর্যমন, মিত্র—এঁদের মাতা হিসেবে উল্লেখিত আছে। দেবী সরস্বতীকে জ্ঞান, সাহিত্যসঙ্গীত
এর প্রতিরূপ বলা হয়। দেবী অন্নপূর্ণাকে শস্য সুজলা সুফলার প্রতিরূপ মানা হয়। লক্ষ্মীকে
ধনসম্পদ ও গৃহলক্ষ্মী হিসাবে, বনদেবীকে গাছপালা বনজঙ্গলের প্রতিভূ ইত্যাদি হিসাবে কল্পনা
করা হয়। কখনও দেবতাও ‘অর্ধনারীশ্বর’ রূপে ধর্ম নির্মাণে মূর্ত হন। যেমন বিষ্ণু। বিষ্ণুর
স্ত্রীর নাম ‘শ্রী’। আমরা বলি ‘শ্রীবিষ্ণু’। ভক্তের কাছে দেবতাদের যুগল মূর্তিই বেশি
প্রাণিধান পেয়ে এসেছে বরাবরই।
যেমন রাধে-শ্যাম, সীতা-রাম, শ্রী-বিষ্ণু, উমা-মহেশ ইত্যাদি। ভক্তরাও যুগলমূর্তি
ভজনায় ‘স্ত্রী’ নামটিকেই প্রথমে রাখতে মানসিক ভাবে আশ্বস্থবোধ করেন। হিন্দু বৈদিক প্রার্থনামন্ত্রেও
স্বয়ং ভগবানকে আর্তি করা হয়—‘‘ত্ব্যমেভ মাতা চ পিতা ত্ব্যমেভ’’। অর্থাৎ হে সৃষ্টিকর্তা
ভগবান, আপনিই আমাদের ‘মাতা’ আপনিই আমাদের ‘পিতা’। পৌরাণিক শাস্ত্রে এমনতর নানা উদাহরণ
ছড়িয়ে রয়েছে।
আদি প্রস্তরযুগে সমস্ত পুরুষজাতির কাছে নারীই ছিলেন অলৌকিক দেবীস্বরূপা। এমনকী
সন্তান জন্মের রহস্যকেও বলা হত দৈব-জাদু। নারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হত। কৃষিযুগ শুরু
হওয়ার পরই ফসল উৎপাদনের সঙ্গে নারীর সন্তান প্রজননের এক যোগসাজশ পুরুষের কাছে উন্মোচিত
হল ক্রমশ। আচিরেই পুরুষ আবিষ্কার করল নারী সন্তান ধারণের উপযুক্ত ক্ষেত্রভূমি। এই ঊর্বর
ক্ষেত্রকে উৎপাদনের মাধ্যম করে তুলল পুরুষ। নারীকে সন্তান উৎপাদন ও সন্তান পালনের জন্য
পণ্য মনে করা শুরু হতে লাগল। এটাই ছিল পুরুষের সমাজ গঠনের একটা ধরন। একসময় যেখানে নারীকে
শস্যদাত্রী হিসেবে দেবীরূপে বন্দনা করা হত, তার পাশাপাশি নারীকে ভোগের পণ্য করে তোলার
চতুর পন্থা শুরু করলেন সেকালের যজমান-পুরোহিতরা। তাদের নিদান ছিল অধিক ফলন। নারীর ভূমিকা
পরবর্তী সময় সংস্কারাচ্ছন্ন পুরুষতন্ত্রে ও সমাজে ধর্ষণ প্রতিশব্দে অজান্তেই কখন জড়িয়ে
গেল।
অন্য দিকে আবার সংস্কৃত ভাষায় রচিত মাণ্য শাস্ত্র ও সাহিত্যেও দেখা গেছে পুরাকালে
উচ্চকণ্ঠে বলা হয়েছে নারী যেন বৈদিক শাস্ত্র না পড়ে। বৈদিক শাস্ত্র পড়ার অধিকার খর্ব
করায় এ ক্ষেত্রে বোঝাই যাচ্ছে, সেই সময় অনেক নারীই বৈদিক শাস্ত্রপাঠে যথেষ্ট পারঙ্গম
ছিলেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদেই তো আছে, ঋষি যাজ্ঞবল্কের মতো প্রভাবশালী ঋষিকে বিদুষী গার্গী
ভাব-যুদ্ধে পরাস্ত করেছিলেন। যাজ্ঞবল্কের স্ত্রী মৈত্রেয়ীও স্বামীকে আত্মা ও ঈশ্বর
সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান দান করেছিলেন।
হিন্দুপুরাণে নারীর প্রধান ‘অষ্ট গুণ’ চিহ্নিত ছিল। প্রায় নিশ্চিত ভাবেই বলা
যায়, এই গুণ আরোপ করেছিলেন ভোগসর্বস্ব বহুস্বর পুরুষরাই। সেখানে নারীর কী কী গুণ থাকতে
হবে তার সুচারু ভাবচিত্র কল্পনা করে বলা হয়েছে—
‘‘কার্যেযু দাসী, করণেষু মন্ত্রী,
ভোজেষু মাতা, শয়নেষু রম্ভা,
রূপেষু লক্ষ্মী, ক্ষমায়েষু ধরিত্রী,
সৎকর্মে নারী, কুলধর্মে পত্নী।"
এই সমস্ত শাশ্বত হিন্দুবাদী রূপক পেরিয়ে এসে এই একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের সমাজ
যতই আধুনিক হোক না কেন—নানা অছিলা ও বিধিনিষেধ নারীর ওপর আজও।
যদিহ ঘোরং যদিহ কুরং যদিহ পাপম।
তচ্ছান্তং তম্বিং সর্বমিহ শমন্ত্রনঃ।।
(অথর্ববেদ
১৯/৯/১৩-১৪)
অথর্ববেদের এই প্রার্থনাটি সকলেরই মর্ম স্পর্শ করে। কারণ প্রথমত, সকল মানুষই
জানে এর প্রথমার্ধে পৃথিবীর যে-রূপটি বর্ণনা করা হয়েছে তা একেবারে সত্য, সমস্ত মানুষেরই
অভিজ্ঞতায়। এটি সত্য। ’ইহ’ মানে এই পৃথিবীতে যা কিছু ঘোর, যা কিছু নিষ্ঠুর এবং যা
কিছু অমঙ্গলের–এবং এসবের প্রচুর উপাদান পৃথিবীতে সকলেরই রোজ চোখে পড়ে—তার অবসান হোক।
অর্থাৎ তা শান্ত হোক, তা মঙ্গলকর হোক, সব কিছুই শান্ত হোক।
0 মন্তব্যসমূহ