একটি দেবভোগ্য খাদ্যর জন্মকথা অথবা, একটি দেবশিশুর জন্মকথা
অতঃপর
জয়া ও বিজয়া মন্দিরে পুষ্পসম্ভারের আড়ালে লুক্কায়িত সদ্যতরুণী কন্যাটিকে
আবিষ্কার করিয়া যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হয় এবং মুহূর্তকাল বিলম্ব না করিয়া পার্বতী
সমীপে সেই বার্তা বহন করে। কৌতুহলী পার্বতী এক্ষণে কন্যাটিকে অবলোকন করিয়া
ভ্রুকুঞ্চিত করেন। কিঞ্চিৎ স্থূলা, বৃহদাক্ষী অথচ চক্ষু প্রোজ্বলতাহীন, মুখমণ্ডলে আলগা লালিত্য কিন্তু দেবসুলভ সুষমাহীন, এ কন্যা তো এ দেবলোকের
কেহ নহে! কে এ! এই স্থলে কীরূপে! এ মন্দিরে তিনি ও তাঁহার সখীদ্বয় বিনা একমাত্র
প্রবেশাধিকার দেবাদিদেব-এর। এমন কী, নন্দী ভৃঙ্গিও কদাপি প্রাঙ্গন অতিক্রম করিয়া মন্দিরদ্বারে
আসে না।
তিনি
তাঁহার সুমিষ্ট অথচ সুকঠিন স্বরে প্রশ্ন করিলেন, "কে তুমি, কন্যা?"
কিয়ৎক্ষণ
নীরবতা।
দেবী
পুনরায় কহেন, "নিরুত্তর থাকিয়ো না। এ কৈলাসধাম, শিবগৃহ। আমি শ্রীচণ্ডিকা। আমার প্রশ্নে তুমি নিরুত্তর
থাকিতে পারো না। কে তুমি, এই ঊষাকালে, আমার গৃহমন্দিরে? লুক্কায়িত কেন?"
ঈষৎ
তীব্র কণ্ঠে কন্যাটি উত্তর দেয়, "আমি মনসা, বাসুকি ভগিনী। জনশ্রুতি, আমি শিবদুহিতা। তাই মাতা আমাকে এই কৈলাসধামে শিবসকাশে
প্রেরণ করিয়াছেন একবার সন্দর্শনের নিমিত্ত। কিন্তু সেই পরম পুরুষের দর্শনমাত্র
আমি কামতাড়িতা, অধীরা।
সেই মহাপুরুষ আমার মনোবাঞ্ছা পুরনে সম্মত কিনা আমার জ্ঞাত নয়, তিনি নীরব ছিলেন। তদ্যপি
তিনি আমাকে আমার মাতৃগৃহে পুনঃপ্রেরণ করিবেন ব্যক্ত করেন এবং কিয়ৎক্ষণ আমাকে এই
পুষ্পরাজির অন্তরালে লুক্কায়িত রাখেন, কারণ, তিনি আপনার অপ্রীতিসাধনের শঙ্কায় শঙ্কিত। আপনার কি এ উচিৎ
কর্তব্য, দেবী
চণ্ডিকা, এই পরম
কাম্য পুরুষকে একাকী কুক্ষিগত করিয়া রাখা?"
পার্বতীর
মুখমণ্ডল ক্রমশ পিঙ্গলবর্ণ ধারণ করিতেছিল। নাসিকা স্ফুরিত, ওষ্ঠাধর ঈষৎ কম্পিত, চক্ষুদ্বয় অগ্নিবর্ষণ করিতেছিল। শান্ত অথচ কঠিন
স্বরে দেবী কহিলেন, "তুমি আমার ঘৃণারও যোগ্য নও। যত্রতত্র কামতাড়িতা? ধিক্! তুমি তো
দেবনর্তকীগণেরও অধম, নটী হইবারও উপযুক্ত নও! আর, কী কহিলে? শিবদুহিতা? শিব!" উচ্চারণমাত্র দেবীর তৃতীয় নয়ন অগ্নিক্ষেপণ
করিল এবং মুহূর্তের ভগ্নাংশে তা নিক্ষিপ্ত হইল কন্যাটির চক্ষে। সে চক্ষু মুদ্রিত
করিল আতঙ্কে, কিন্তু
তৎপূর্বেই তাহার একটি চক্ষু পুড়িয়া গিয়াছে। সে অর্ধমৃতর ন্যায় পড়িয়া রহিল।
দেবীর
রোষানলে ত্রিভুবনে কম্পন শুরু হইল। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে প্রবল আলোড়ন উপস্থিত হইল। তড়িৎশিখায়, ঝঞ্ঝাবাত্যে প্রলয় নামিল
ভূলোক, দ্যুলোক, গোলোকে। বিপুল আস্যে
অট্টহাস্য করিতে লাগিল ভয়ালরূপা প্রকৃতি। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহার সমস্ত শক্তি
প্রয়োগ করিয়া বজ্র সম্বরণ করিলেন। তখন ঘূর্ণিবাত্যার উপশম হইল, কিন্তু অঝোর বর্ষণে আকাশ
বোধ করি ভাঙিয়া পড়িল; মহাশক্তি মহাদেবীর রোষানল বোধ করি অশ্রুরূপে গলিয়া গলিয়া
পড়িতে লাগিল।
পদতলে
পড়িলেন দেবাদিদেব মহাকাল। কাতর মিনতি করিলেন, "ভ্রান্তি দূর করো! দূর করো, মহাদেবী! দয়া করো, দয়া করো, প্রেমনেত্রে চাহো সেবকে!"
"তোমার হস্ত আমার চরণকে কলুষিত করিতেছে, নটরাজ! আমাকে তুমি স্পর্শ
করিবে না, এক
মুহূর্তের জন্যও না!", অশ্রুভাঙা অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর উচ্চারিত হইল।
"এই ভ্রান্তি কি তোমায় শোভা পায়, মহাশক্তি? ত্রিভুবনে তুমি ভিন্ন
অন্য কোন নারীতে আমার জ্ঞানোদ্রেক হয় না, প্রাণোদ্রেক হয় না, কামোদ্রেক হয় না! এ কথা তোমা অপেক্ষা উত্তমরূপে আর
কে জানে? তোমার
জ্ঞাত আছে, দেবী, একমাত্র সতী আর তুমি
ব্যতীত, এই
ত্রিলোকে আর কোন নারী এই শ্মশানচারির মনোলোকে, জ্ঞানলোকে, ধ্যানলোকে প্রবেশ করিবার ক্ষমতা রাখে নাই, রাখিবেও না। সতী আমার
অতীত, তুমি
আমার অনিবার্য অধুনাকাল এবং ভাবীকাল। তুমিই সেই অনন্যপূর্বা শেষতমা নারী আমার, দেবাদিদেব যাঁর মহিমার
কাছে শ্রদ্ধায়, প্রেমে, কামে পদানত।
আমার
অন্নপূর্ণা, কোন
একদিন এমনই শ্রাবণের ধারায় তুমি যখন ত্রিলোকে অন্নসঞ্চারে ব্যাপৃতা, তখন এমনই এক মুহূর্তে
তোমাকে আকুল কামনা করিয়া আমার শক্তিহানিরূপ বীজপতন হয়। তাহা ধারণ করিবার আধার, শক্তি আমার, তুমি তখন কোথায়! সেই
শক্তিবীজ নলবাহিত হইয়া পৌঁছয় বাসুকিগৃহের সন্নিকটে। বাসুকিমাতার অঙ্গস্পর্শ করে
সেই বীজ, তিনি
গর্ভবতী হন। সেই গর্ভজা মনসা।
আর, আমার প্রতি কামতাড়িতা? শৈবায়নী, এ কি নূতন কিছু? মূঢ়া তরুণী সে! এই আচরণ
কি তোমার অদৃষ্টপূর্ব? ত্রিজগতে আমি কাম্য, তুমি কাম্যা। অসংখ্য মুগ্ধ এবং ব্যর্থ প্রার্থী
প্রার্থিনী কি অতিস্বাভাবিক নয়?"
অশ্রুর
দমকে কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছিলেন মহামায়া। অঝোর বর্ষণে প্লাবিত চারিপাশ। সেই
প্রস্ফুটিত মুখশ্রী ধারাস্নান করিয়া অপরূপা ফুল্লকুসুম। সেই অনিন্দ্যসুন্দর
দেহবল্লরীর প্রতিটি খাঁজ দৃশ্যমান। এক্ষণে সত্যই কামার্ত হইয়া উঠেন দেবাদিদেব।
সিক্ত মৃণালবাহু মৃদু আকর্ষণ করিয়া স্বীয় প্রাবৃট শালপ্রাংশু বক্ষতলে আনীত
করিলেন প্রেয় দেহখানি। ওষ্ঠাস্বাদন করিলেন গভীর আশ্লেষে। ঘন মৃদঙ্গনিন্দিত কণ্ঠে
উচ্চারণ করিলেন, "মহাদেবী, এই ঘোর শ্রাবণের ধারায়, এই প্রবল জলোচ্ছ্বাসে, আমি তোমাকে এইক্ষণে কামনা করি। আমাকে তৃষ্ণার্ত রাখিও
না, প্রিয়া!"
দেবীর
মুখমণ্ডলে সেক্ষণে প্রভাতের বালার্কের অরুণ আভা। নয়ন মুদ্রিত। কোমল উচ্চারণ শোনা
যায়, "তা কীরূপে হইবে, মহাদেব? তোমার অন্নভোগের আয়োজন করি নাই যে এখনও, নাথ!"
"অদ্য আর কোন কর্ম নয়, প্রিয়সখি, অদ্য অন্নভোগের আয়োজন তোমার সুযোগ্য সঙ্গিনীদের দায়িত্বে
হউক? তোমার
জয়া, বিজয়া?"
এতক্ষণে
শিশুর ন্যায় হাসিয়া উঠিলেন পার্বতী! "কী যে কহো, দেব! তোমার সন্তুষ্টিসাধন কিসে, তাহা উহারা কীরূপে জ্ঞাত
হইবে, চন্দ্রকেশ? আমি উহাদের তাহা জ্ঞাত
করিবই বা কেন? এতে যে
অসূয়া আমার! তোমার সন্তুষ্টি যে আমার অধিকার, প্রিয়!"
অত্যন্ত
অনিচ্ছায় হাতের বন্ধন শিথিল করিলেন পশুপতি। কহিলেন, "আমার সন্তুষ্টিসাধন যাহাতে, সেই কার্যেই তো তোমাকে আহ্বান করিতেছিলাম, প্রিয় নারী! এই মুহূর্তে
অন্নভোগে আমার সন্তুষ্টি নহে! কী আছে অদ্য তোমার ভাণ্ডারে, অন্নপূর্ণা? কী আছে, শ্রেষ্ঠা?"
"আছে অতি সুগন্ধি আতপ তণ্ডুলকণা, আছে সর্বশ্রেষ্ঠ
স্বর্ণমুদ্গ, আছে
...."
"তিষ্ঠ, তিষ্ঠ, অপর্ণা। বাক্য সম্বরণ করো। আর কিছু নাহি প্রয়োজন। দুই
দণ্ডকাল সময়ে প্রস্তুত করো তোমার অন্নভোগ, ঐ তণ্ডুল মুদ্গ মিশ্রণে। তোমার অমৃত হস্তে প্রস্তুত
এই মিশ্রদ্রব্য আজি হইতে দেবভোগ্য। যুগে যুগে কালে কালে এই দ্রব্য ভোগদানে
দেবার্চনা করিবে ভূলোকবাসী অনন্তকালাবধি। যাও, প্রিয়ে, আমি শয্যা প্রস্তুত করি।
ত্র্যম্বিকা
তাঁহার ত্রিশূলধারিণী হস্তে তণ্ডুলে যত্নে মিশ্রিত করিলেন পিষ্ট আর্দ্রক, হরিদ্রা, জিরিকা ইত্যাদি বিবিধ
সুস্বাদু উপকরণ। মুদ্গাপেক্ষা তণ্ডুল নিলেন কিয়ৎ পরিমাণে অধিক। মাপে মাপ মিলাইয়া
নিলেন সিন্ধব মাধ্বী সমপরিমাণে। ততক্ষণে কামজর্জরিত অস্থির মহাকাল তাঁহার
মেঘমন্দ্রস্বরে উচ্চারণ করিলেন, "ভুলিও না, প্রিয়া, ঠিক দুই দণ্ডকাল। এ মুহূর্ত নয় অকারণ কালক্ষেপণের। শয্যা
প্রস্তুত। আজি আমরা মেঘশয্যায় পরস্পরকে গ্রহণ করিব। অবলোকন করো, ঐ শৈলেন্দ্রশিখরকে
অবগুণ্ঠিত করিয়া পুঞ্জীভূত মেঘরাশি, ঐ আমাদের আজিকার নভোশয্যা। তোমার অনন্ত হস্তজাত যে সুখাদ্য
গ্রহণ করিয়া আজি আমরা মেঘশয্যারোহন করিব, তাহা যুগান্তরে পরিচিত হইবে 'খেচরান্ন' নামে।
দেবী, ত্বরা করো, ধারণ করো আমায়।
তাড়কাসুর-এর অন্যায্য আক্রমণে মহাশঙ্কায় প্রহর গণিছে সপ্তলোক। সর্বপ্রকার অসুরকে
প্রতিহত করিতে সুরলোক কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করিতেছে তাঁহাদের সেনাপতিকে, দেবসেনাপতি। যে হইবে
অপরাজেয়, অপ্রমিত
শক্তিধর। মহাশক্তি, আর বিলম্ব করিয়ো না অদ্য, বীজধান প্রস্তুত শীষে, তাহা প্রোথিত করিবার জন্য উন্মোচিত করো তোমার
মেদিনী!"
----------------------------------------------------------------------
তথ্য
সহায়তা :: বিবিধ পুরাণ আধারিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্য, মনসামঙ্গল কাব্য, শিবায়ন কাব্য, কুমারসম্ভব কাব্য
0 মন্তব্যসমূহ