অলেখা অধ্যায়
পর্ব-৩
ত্রয়োদশ অধ্যায়
আজ যজ্ঞের
শেষ দিন। পূর্ণ এখন এই বৃহৎ সভা। ফুল ও অগুরুর গন্ধে আমোদিত। মণি, মুক্তা, সুবর্ণের অপূর্ব কারুকাজ
সভাপ্রাকারে। স্তম্ভগুলি সভাগৃহের অত্যুচ্চ আচ্ছাদনকে ধরে আছে। সভাগৃহ ঘিরে রয়েছে অগণিত মনোরম প্রাসাদ। এই বিশাল ভূমি যেন
সম্পদ ও দক্ষতার এক চূড়ান্ত উদাহরণ। সমগ্র জম্বুদ্বীপ থেকে রাজগণ এসেছেন মহার্ঘ উপঢৌকন নিয়ে। তাঁদের অলঙ্কারের
মণি, মাণিক্য ও সুবর্ণের দ্যুতিতে, ঝলমল করছে সভা। অজস্র মানুষের গুঞ্জন এক কলরবে পরিণত হয়েছে। বিদ্বজ্জনেরা
বিভিন্ন বিষয়ে পরষ্পরের সঙ্গে আলোচনা ও বিতর্কে রত। নকুল ব্যস্ত ছিলেন অতিথি আপ্যায়নে। তাঁর কানে এল কোনও
এক রাজপুরুষ পাশের ব্যক্তিকে বলছেন,- এমন আশ্চর্য সভা দেখা এক অভিজ্ঞতা বটে! সারা
জীবনেও ভুলব না। নকুলের হঠাৎ মনে হল, জীবনের যে কত স্তর, কত বৈপরীত্য। তাঁর মনে পড়ছিল শৈশবের কথা। সেদিন তাঁরা কি কেউ ভাবতে পেরেছিলেন যে কয়কটি
বৎসরের ব্যবধানে এমন সমারোহময় কোনও দিন আসবে। হঠাৎ দেখলেন এক মধ্যবয়সী ব্যক্তিকে ভীম সমাদরে
অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসছেন তোরণদ্বার থেকে । দেখামাত্র তাঁর মনে অদ্ভুত এক অস্বস্তি হতে লাগল। কে এই ব্যক্তি?
কোনও বিশিষ্ট নৃপতি তো নিশ্চয়! কিন্তু কোন দেশের? ভীমের সঙ্গে পরিচয় রয়েছে যে বোঝা
যাচ্ছে তা। নকুল নিশ্চিত, কোথাও দেখেছেন তাঁকে। এক ব্রাহ্মণ সেদিকে তাকিয়ে পাশের জনকে অস্ফুট স্বরে, বলে
উঠলেন,-“চেদি রাজ শিশুপাল। জরাসন্ধের ধামাধরা ছিল যে, তা সে অক্কা পেতে মুষড়ে পড়েছে কেমন? চেহারা দেখছ
না!” বিস্মিত হলেন নকুল। চেদিরাজের সঙ্গে
কখনও পরিচয় হয়নি তাঁর। কিন্তু মনে হোল আগে দেখেছেন তাঁকে। কবে? কোথায়? সেই
দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় কি? বিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপের সকল রাজা, রাজপুত্রই এসেছিলেন
নাকি তখন। অত জনের মধ্যে এঁকেই কি বিশেষ ভাবে মনে রইল? আশ্চর্য তো! তাঁকে সুদর্শন বলা যায় না। মুখে পরিশীলিত ভাব নাই। বলিষ্ঠ শরীর। কিন্তু সুস্থ নয় যেন। জরা ও অতি ভোগের কারণেই সম্ভবত এখন শিথিল হয়ে
পড়েছে মাংস পেশী। এই ব্যক্তি নিঃসন্দেহে ক্রোধী ও দাম্ভিক। লাল আভাযুক্ত চোখ। চোখের তলার
মাংসপিন্ড। ঠোঁটের ভাব স্খলিত। এঁর অবয়ব বলে দিচ্ছে ইনি অসংযমী জীবন যাপন করেন। প্রচুর অলঙ্কার সর্বাঙ্গে। এঁর পাশে পাশে যিনি প্রবেশ করলেন, তিনি নিশ্চয়
চেদিরাজপুত্র। কুণ্ঠিত মুখের এক তরুণ। স্পষ্টতই ব্যক্তিত্বহীন। এমন প্রবলপ্রতাপ পিতার শাসনে থাকলে যেমনটি হওয়ার
কথা।
মৃত
জরাসন্ধের সেনাপতি ছিলেন এই ব্যক্তি। এঁর সম্বন্ধে বহু আলোচনা শুনেছেন তিনি। অতি দুর্জন। নৃশংস। ভীম গিয়েছিলেন চেদিরাজ্যে যুধিষ্ঠিরের বশ্যতা স্বীকারের
দাবি জানিয়ে। কৃষ্ণের পরামর্শ অনুযায়ী ভীম ততদিনে হত্যা করেছেন জরাসন্ধকে। অতএব শিশুপালের প্রতিপত্তিও
তখন স্তিমিত। তাই ভীমকে সেদিন প্রতিরোধ করতে সাহস
পাননি চেদিরাজ। বিনা বাক্যব্যয়ে কর প্রদানের অঙ্গিকার করেছিলেন।
হঠাৎ নকুলের মনে পড়ল, তাঁকে সভার বাইরে যেতে হবে একবার। এক সেবককে
গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দেশ দিতে ভুল হয়ে গেছে। দ্রুত ফিরেও আসতে হবে! তিনি জানেন, এখন
অনুষ্ঠানের শেষ ভাগ,অর্ঘ্য প্রদানের সময় আসন্ন। বাইরে বেরোবার সময়ে দূর থেকে তাঁকে লক্ষ্য করলেন
ভীম আর বিরক্ত স্বরে হাঁক পাড়লেন,-“আসল সময়ে কোথায় চললে বল তো? দেরি কোরনা যেন।”
এত বিশাল এ
প্রাঙ্গন যে যত দ্রুত পায়েই চলুন তিনি, সেই দেরি হয়ে গেল, কর্ম সেরে ফেরার সময়ে। অর্ঘ-প্রদান হয়ে গেল না তো?
তাঁর উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল ঐ মুহূর্তে। চলার বেগ বাড়িয়ে দিলেন তিনি। ওই যে প্রবেশদ্বার দেখা যাচ্ছে এখন। কিন্তু
দ্বাররক্ষীরা কোথায়? কাউকে দেখতে পেলেন না নকুল। তারাও কি দ্বার অরক্ষিত রেখে যজ্ঞস্থলে চলে
গেছে? দৃশ্যের অপেক্ষা, শব্দ অনেক বেশী দ্রুতগামী। তাই দরজার কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই তাঁর কানে এল
কলরব। এত চীৎকার, বহু
মানুষের মিশ্র চীৎকার। আতঙ্ক, ক্রোধ ও উত্তেজনার। কটু বাক্য! কথাগুলি বোঝা যাচ্ছে না স্পষ্টভাবে। তার মানে কোনও সংঘাত বেধেছে
নিশ্চিত।প্রহরীরা তা প্রতিহত করতে গৃহ মধ্যে চলে গেছে। মাত্র কয়কটি মুহূর্তে কীভাবে বদলে গেল সভার আবহ! ত্রুটি হয়েছে কী তবে? কী
ত্রুটি? কার ত্রুটি? বিস্ময়ে, উদ্বেগে নকুল ছুটতে শুরু করলেন।
শূন্য তোরণপথে ঢুকলেন নকুল। ভীষণ শব্দ করে ভারি গোলাকার কোনও বস্তু গড়িয়ে পড়ল। আর্তনাদ, হাহাকার,
জয়োল্লাস! আর তখনই ভেঙে পড়ল তাঁর স্মৃতির অন্ধকার স্তুপটা। আবার সব দেখতে পেলেন নকুল। সেই একদিন অশ্বশালায় হঠাৎ যা দেখেছিলেন! শেষবারের
মতো আস্ফালন তুলে একপাশে হেলে পড়ল শিশুপালের কবন্ধ শরীর! কৃষ্ণের চক্র ছিন্ন করেছে
মুন্ডটাকে।
চতুর্দশ
অধ্যায়
এখন সে একটি
পাথরের পুতুল যেন। যার দৃষ্টি নাই,শ্রুতি নাই, স্পর্শ বোধও নাই যার। তার ক্ষুধা পায় কিনা, সে বোঝে না। তার বাল্যসখী কল্পা
ও লোলা প্রতিদিন রাজপুরীতে আসে। সিদ্ধ অন্নের মন্ড দুধ মিশিয়ে তার মুখে তুলে দেয়। সে প্রতিবাদ করে না। শূন্য চাহনিতে দূর
আকাশের দিকে তাকিয়ে গিলে নেয় তা। কিন্তু স্বাদবোধও নাই তার। এখন গ্রীষ্ম কাল। চেদিরাজ্যে আবহাওয়া যথেষ্ট উষ্ণ,কিন্তু সে স্নান
করার ইচ্ছা প্রকাশ করে না। কারণ এই উষ্ণতা অনুভব করে না সে। নিজের ভিতরে কোনও তীব্র শোকও অনুভব করে না। শারীরিক ও মানসিক
অনুভূতিগুলি অসাড় হয়ে গেছে তার। দিন ও রাত আসে পর্যায়ক্রমে। রাজার মর্মান্তিক মৃত্যু সাধারণ মানুষকে বেদনাহত
করে না। তাদের দৈনন্দিন
জীবনে তারা চায় শুধু নিরাপত্তা। রাজা শিশুপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ধৃষ্টকেতু এখন
সিংহাসনে বসেছেন। শিশুপালের হত্যার কারণ ছিল যারা, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। তাই রাজপুরীর
বিপন্নতার আবহ ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে। নূতন এক উৎসবের আয়োজনও শুরু হয়েছে। রাজকুমারীর বিবাহের আয়োজন।
সে শোনে। কিন্তু স্পষ্ট করে
বোঝে না কিছু। রাজকুমারীর বিবাহ? কে রাজকুমারী? করেণুমতীর মনে হয় একবার। কিন্তু তার মধ্যে কোনও প্রশ্ন জেগে ওঠে না আজকাল
তেমন তীব্রভাবে। এই ক্ষীণ কৌতূহলও খুব তাড়াতাড়ি মুছে যায়।
সে প্রায়ই
দেখে, এক বৃদ্ধ আসেন তার কাছে। তাঁকে খুব পরিচিত মনে হয় তার। কিন্তু কোথায় যে তাঁকে আগে দেখেছে, তা মনে করতে
পারে না সে। কেন যে তিনি তার সামনে বসে এত কথা বলেন, তাও সে বুঝতে পারে না। অদ্ভুত সব কথা বলে
চলেন তিনি। বড় বিরক্ত লাগে তার। কিন্তু এত ক্লান্তি তার শরীরে ও মনে যে, এই বিরক্তি প্রকাশ করার উদ্যমও জাগে
না। বৃদ্ধ বলেন,-“রেণু, বল তোমার পিতার নাম কী? বল কোন রাজকূলে তোমার জন্ম?
আর তোমার ভ্রাতার নাম? তুমি কী জান নিহত হয়েছেন তোমার পিতা? কৃষ্ণের সঙ্গে অস্ত্র
যুদ্ধে? পান্ডবদের সেই রাজসূয় যজ্ঞসভায়? বল বল জান তুমি? রেণু রেণু রেণু---’’
কী চিৎকার
করে বুড়োটা! কেন সে কী বধির? আর এত প্রশ্নই বা কিসের জন্য? পিতার নাম? ভ্রাতার
নাম? কী এসে যায় এত সব নামে? এত যুদ্ধ, যুদ্ধে কে কাকে হত্যা করল, এ কথা জেনে কী
তার পাঁচটা পা গজাবে? তার চোখের সামনে একটি অদ্ভুত চিত্র ভেসে উঠল। পাঁচ পেয়ে একটা
মানুষ। হেসে ফেলল সে।
সে আনত মুখে
বসেছিল। নিজের হাতের সুবর্ণ
বলয়টি ঘোরাচ্ছিল আপন মনে। পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে মুখ তুললো। তারপর তার কপালে ফুটে উঠল বিরক্তির কুঞ্চনরেখা। বুড়াটা আজ আবার
আসছে। কেন আসে এ যখন তখন!
আজ কিন্তু তার কক্ষের সামনে দিয়ে চলে গেল সে। ভিতরে ঢুকলো না। আপদ শান্তি হোল! সে নিজের বলয়টি ঘোরানোর বেগ
বাড়িয়ে দিল। আরো আরো আরো বেগ----কেন তার এমন অস্থির লাগছে! কতক্ষণ সময় চলে গেল এইভাবে। হঠাৎ তার চোখের
দৃষ্টি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। চারদিকে তাকাতে লাগল সে। ঠোঁট চাপল দাঁত দিয়ে। এমন কটু গন্ধ আসছে
কোথা থেকে? আরো বাড়ছে যেন! কারা অমন চীৎকার করছে? আর্তনাদ! বহু মানুষের মিলিত
পায়ের শব্দ! সে উঠে দাঁড়াল। অজানা আশঙ্কায় বিপর্যস্ত লাগছে তার। বিকৃত ভয়ার্ত চীৎকার করতে করতে কারা এসে যেন
ঢুকল তার ঘরে। অনেক---অনেকগুলো মুখ! আগুন আগুন –এই একটাই শব্দ সে বুঝতে পারল সম্মিলিত কোলাহলের মধ্যে থেকে। তাকে কারা যেন তুলে
নিল মাটি থেকে। বহন করে বাইরে নিয়ে গেল। দূরে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সে দেখল আকাশ কালো হয়ে
উঠেছে ঘন ধোঁয়ায়। প্রাসাদের অন্দর মহলের পিছনে যে উদ্যান আছে সেখানে আগুনের লেলিহান শিখা।
আর্তনাদ করে
উঠল করেণুমতী। এক জোরালো ঝাপটে ফিরে এল তার স্মৃতি। জ্বলে উঠল স্তিমিত হয়ে যাওয়া বোধ শক্তি। তার ভাই ধৃষ্টকেতু?
ধৃষ্টকেতু কোথায়? আগুন কী গ্রাস করেছে তাকে? সদ্য ফিরে আসা এই তীব্র বোধ তাকে
উন্মাদিনীর মতো তাড়িয়ে নিয়ে গেল, জ্বলন্ত আগুনের দিকে। তাকে মাঝপথে প্রতিহত করল কারা যেন। জালবদ্ধা বাঘিনীর
মতো আঁচড়ে কামড়ে দিতে লাগল সে যাকে সামনে পেল তাকেই। কিন্তু নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। আর্তনাদ করতে লাগল সে, -ভাই—ভাই—ভাই—কোথা গেলে তুমি?
“শান্ত হ শান্ত হ বোন’’- প্রিয় কণ্ঠস্বর শুনে তাকাল সে সূচিবিদ্ধবৎ। ধৃষ্টকেতু ও আচার্য
বীতিহোত্রের মুখ স্নিগ্ধ কৌতুকে উজ্জ্বল। এক তীক্ষ্ম আনন্দ এক মুহূর্তের জন্য দিশাহারা করে ফেলল তাকে। তারপরেই আকুল স্বরে
বলে উঠল,-“অত পুঁথি---সব সব ছাই হয়ে গেল---তবে---’’
“না কন্যা,
ভয় নেই। অক্ষত আছে তোমার
পুস্তক ভান্ডার।“- বীতিহোত্র স্নিগ্ধ স্বরে বললেন। তার মাথায় হাত রাখলেন সস্নেহে।
ধৃষ্টকেতুর সঙ্গে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় হোল তাঁর। তার এই দিশাহারা আতঙ্কের মুখ দেখে যেন আস্বস্ত
হয়েছেন তাঁরা।
------------
করেণুমতীর
মুখে এখন অল্প লজ্জিত হাসি। একটু যেন অপ্রতিভ সে। সে এখন ক্রমশ ফিরে আসছে, জীবনের অভিমুখে। সে এখন বুঝতে
পেরেছে শোক নয়, ভয়ানক নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক থেকে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে
পড়েছিল। তাকে একটি তীব্র
আঘাত দিয়ে স্বাভাবিকতায় ফিরিয়ে আনতে ধৃষ্টকেতু ও বীতিহোত্র মিলিতভাবে ঐ কপট
অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা করেছিলেন। আর সেই আঘাতে ফিরে এসেছে তার চেতনা। মহাকাল ক্ষয় করে শোককে। পিতা শিশুপালের সঙ্গে তার অনেক দূরত্ব ছিল এবং
তাঁর প্রতি ছিল অবরুদ্ধ এক বিতৃষ্ণা। কারোর কাছেই প্রকাশ করেনি কখনও। কিন্তু নীরবে থেকে গিয়েছিল তা। ক্ষীণ শোকবোধটুকু রক্তসম্পর্কের সংস্কারজাত। সে শোক আর বিশেষ আলোড়িত করেনা
আজ তাকে।
তারপরেই
কিন্তু সে শোনে তার আসন্ন বিবাহের কথা। প্রস্তাব এসেছে বরপক্ষ থেকে। জম্বুদ্বীপের শ্রেষ্ঠ রূপবান মানুষটি তার স্বামী
হবেন। অত্যন্ত জ্ঞানীও
তিনি। আশ্চর্য সব গুণের
অধিকারী। কিন্তু বীতিহোত্র যখন বললেন, মানুষটি পান্ডবদের চতুর্থ ভ্রাতা, নকুল, তখন
কিন্তু সে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। তার পিতৃহত্যাকারীদের কুলবধূ হবে সে! তার অন্তরের তীক্ষ্ণ
ন্যায় অন্যায়ের বোধ চীৎকার করে উঠেছিল সেই মুহূর্তে। বীতিহোত্র এই প্রতিক্রিয়াই প্রত্যাশা করছিলেন। শান্ত স্বরে
বললেন,-“শোন কন্যা, নৈর্ব্যক্তিক হও। মূঢ়জনই শুধু আবেগে ভেসে যায়। ন্যায় এবং অন্যায়কে দেখ বৃহত্তর পটভূমিকায়। ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত
সম্পর্কের ভিত্তিতে নয়। সমগ্র জম্বুদ্বীপের ভাগ্য যার সঙ্গে যুক্ত। তুমি বিদুষী, বুদ্ধিমতী। নিজস্ব সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, চিন্তা ও
অনুভূতির গভীরতায় নিমজ্জিত হলে বুঝবে, প্রয়োজন ছিল এ হত্যার। কটু বাক্য বটে, কিন্তু সত্য বাক্য এটি।’’ তিনি একের পর এক যুক্তি ও প্রতিযুক্তি দিয়েছিলেন। বহু অজানা তথ্য
উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তার সামনে। কত অসহায় মানুষের ভাগ্যবিপর্যয়ের কাহিনী, কত অকারণ নৃশংসতার
উপাখ্যান, কত নারীর অশ্রুপাতের জন্য দায়ী ছিলেন চেদিরাজ। আবেগ ছিল না তাঁর কাহিনীতে। ছিল শুধু প্রমাণ সহ তথ্যের হিসাব। শেষে তিনি বলেছিলেন,-“ভেবে দেখ আর একটি কথা। পান্ডবরা অনায়াসে গ্রাস করতে পারতেন চেদিরাজ্য। কিন্তু তা করেননি। ধৃষ্টকেতুকেই দিয়েছেন
সিংহাসনের উত্তরাধিকার।”
করেণুমতী
আবার নিশ্চুপ হয়ে যায়। কিন্তু এবার সে চিন্তাহীন নয়। তার মধ্যে প্রবাহিত হয় দ্বিমুখী তরঙ্গ। তাদের সংঘর্ষ হয় পরষ্পরের সঙ্গে। বারবার সেই সংঘাতে
প্রতিমুহূর্তে আরো বেশী করে ক্লান্ত হয় সে। ক্লিষ্ট হয়। অবশেষে আত্মসমর্পণ করে নিয়তি নামের এক রহস্যময় শক্তির কাছে। এবং নিজের গভীরে
যেন এক ধরনের মলিন শান্তি পায়। বিবাহের আয়োজন আরো গতি পাচ্ছে। নিষ্ঠুর রাজার মৃত্যুকথা ভুলে, আনন্দমুখরিত হয়ে উঠছে
চেদিরাজ্য, আসন্ন উৎসবের উত্তেজনায়।
ক্রমশ বিশেষ
দিনটি আসে আর বিবাহ সভায় ঘটে তার জীবনের আশ্চর্যতম ঘটনাটি। বরবেশে সজ্জিত নকুলের মুখের দিকে তাকায় সে। সঙ্গে সঙ্গে রক্তাম্বরা করেনুমতীর মনে হয় সে যেন
এ সভা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।সভার সমস্ত কলরোল কত দূর থেকে ভেসে আসছে। অতি ক্ষীণ। তাকে ঘিরে রয়েছে
যেন ছায়া মানব মানবীরা। সকলই অলীক। শুধু দুটি চোখের অপরূপ দৃষ্টিতে স্নাত হচ্ছে সে। সে ঐ দৃষ্টির অভিঘাতে ঈষৎ কম্প্র যেন। আর অফুরন্ত এক
নির্ঝরিণীর মতো তাকে প্লাবিত করে প্রবাহিত
হয়ে চলে সেই স্নিগ্ধ চাহনি! পঞ্চভ্রাতার মধ্যে তুলনায় দুই মাদ্রীনন্দন অল্পখ্যাত। কিন্তু করেনুমতী
ভাবে সে কখনও দেখেনি এমন উজ্জ্বল এক পুরুষকে।
পঞ্চদশ অধ্যায়
আগে তাঁর
চিত্র দেখে মুগ্ধ হয়েছিল করেণুমতী। চাক্ষুষ দেখা ইন্দ্রপ্রস্থে এসে। অনিন্দ্যসুন্দরী এই নারীকে অপলক চোখে দেখছিল সে। আজন্ম অনেক রূপবতী রমণী দেখেছে
সে। কিন্তু সে
নিঃসন্দেহ হয়ে গেল যে, ইনি প্রকৃতির এক
আশ্চর্য সৃষ্টি। তাঁকে প্রথম দেখার মুহূর্তটিতে এমনই ভেবেছিল করেণুমতী। তিনি যে তার সপত্নী, তা জেনেও কোনো সূক্ষ্ম
বিদ্বেষ জাগেনি মনে, বরং সেই প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তে অদ্ভুত এক উত্তেজনা অনুভব করছিল সে। অপরূপ রূপবতী এই
রমণীর কথা সে কত শুনেছে। তাঁর বিচিত্র দাম্পত্যজীবনের কাহিনী সমগ্র জম্বুদ্বীপে একদা কী আলোড়নই না
তুলেছিল! আর সেই নারী আজ তার চোখের সামনে। একই সঙ্গে তার জ্যেষ্ঠা যাতা ও সপত্নী। তিনি স্নেহের ভঙ্গিতে আলিঙ্গন করলেন তাকে। কি অপূর্ব সুরভিত
তাঁর দেহ। উষ্ণ কোমল তাঁর স্পর্শ। সে অবনত হোল তাঁর পায়ের কাছে। আর দেখল তাঁর তাম্রবর্ণের পায়ের পাতায় নখগুলি
পর্যন্ত কী সুচারু। যত্নচর্চিত। লাক্ষ্মারসে রঞ্জিত। তাম্র পাত্রে সাজানো দশটি নিখুঁত রক্তবর্ণের মণি যেন!
ইন্দ্রপ্রস্থের
অন্তঃপুরে প্রথম কিছুকাল সে এমন মোহমুগ্ধ হয়ে রইল। মিলন রজনীতে, ক্রমশ স্বামীর সঙ্গে অপরিচয়ের
দূরত্ব যখন কমলো, সে দ্রৌপদী সম্বন্ধেই উচ্ছ্বসিত হয়ে নানা প্রশ্ন করতে লাগল। নকুল স্মিত মুখে তার সমস্ত
প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। কিন্তু কালক্রমে এই অপরূপার সঙ্গে করেণুমতীর অন্তরঙ্গতা
তৈরি হোল না। সে ক্রমশ লক্ষ্য করল,দ্রৌপদী মধুরভাষিণী,কর্তব্যপরায়না ও শালীন। কিন্তু তাঁর চারিপাশে রয়েছে এক
অদৃশ্য প্রাচীর। সেই প্রাচীর পেরিয়ে তাঁর সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে তোলা সহজ নয়। এই রাজগৃহে তাঁর অসীম প্রভাব। মাতা কুন্তী
নির্লিপ্ত থাকেন সাংসারিক বিষয়ে। দ্রৌপদীরই নির্দেশে পরিচালিত হয়, এই বিপুল রাজপরিবার। রাজনীতি সম্বন্ধেও
তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান। তাঁর ব্যক্তিত্ব অতি দৃঢ়। কোনও কোনও সময়ে তা যেন প্রায় মমতাহীন। এমনই মনে হয় করেণুমতীর। তিনি উচ্চকণ্ঠে কথা বলেন না কখনই। কিন্তু তাঁর আদেশ লঙ্ঘনের কথা
কেউ ভাবতেও পারে না। সে আরো বুঝল এই নারী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। কর্মপটু। বুদ্ধির যে অংশ সংসারে
ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগে, সেখানে তিনি অতি নিপুণ। তবু করেণুমতী একটি কথা মনে মনে না বলে পারল না।
বিদ্যার
গভীর স্তরে ইনি প্রবেশ করেননি নিশ্চিত। বুদ্ধি ও হৃদয়কে প্রতিদিন উন্নত করার সাধনা নাই তাঁর। তিনি অত্যন্ত অহঙ্কারী। কিন্তু ভাগ্য তাঁকে
যা দিয়েছে তাই নিয়েই তিনি অহঙ্কারী। নিজের আশ্চর্য সৌন্দর্য, মহাবীর অনুগত পঞ্চস্বামী, পঞ্চ
পুত্র, অতুল ঐশ্বর্য, রাজপরিবারের প্রভাব, এই সমারোহময় প্রাসাদ, পরিজন,দাসদাসী। এগুলি তো তাঁর
অর্জিত সম্পদ নয়। করেণুমতীর মনে হয় প্রয়াস দ্বারা যা অর্জন করতে হয়, তার অহঙ্কার যেন অপেক্ষাকৃত
যুক্তিসঙ্গত। এবং সকল অহঙ্কারী ব্যক্তির মতো তাঁর ভুবনও এক অনতিব্যাপ্ত বৃত্তের মধ্যে সীমিত। এর বাইরের
বিশ্বজগৎ, তাঁকে বিশেষ আলোড়িত করেনা।
এমন ভাবনার
শেষে করেণুমতীর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। তার কীই বা আসে যায় তাতে!
বড় সুন্দর
এই জীবন। কতকাল ধরে এক গ্লানিময় অন্ধকার আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাকে। এখন তার চতুর্দিক আলোকে প্লাবিত। অভূতপূর্ব এক আলো!
এমনকি শৈশবেও পিতৃভবনে এমন আনন্দে সে থাকেনি। নকুলের মতো এমন আত্মজন পায়নি কখনো, যাঁর সঙ্গে অনায়াসে
কত রকমের ভাবনা বিনিময় সম্ভব।
নারীর ষষ্ঠ
ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতা সহজাত। সে অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ বলে তার এই আশ্চর্য শক্তি আরো তীক্ষ্ণ। সে কিভাবে যেন বুঝে নিয়েছে, প্রথমা পত্নী সম্পর্কে নকুলের মনে
কোথাও একটি অস্বাচ্ছন্দ আছে। যদিও তিনি কখনও প্রকাশ করেননি তা। আর
করেণু ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। সে কখনই এমন প্রসঙ্গ তোলে না।
পিতৃগৃহে
করেণুমতীর রক্তের সম্পর্কিত একমাত্র জন, ধৃষ্টকেতু তরল স্বভাবের মানুষ। ভাইবোনের সম্পর্কে
পারস্পরিক স্নেহ ছিল। একজনের রোগে,বিপদে ছিল অন্যজনের উৎকণ্ঠা, কিন্তু তাদের মানসিক ব্যবধান ছিল
দুস্তর। বীতিহোত্র, তার
শিক্ষাগুরু তার মনে জ্ঞানের তৃষ্ণা জাগিয়েছিলেন প্রথম। তাঁর আলোর মতো স্নেহ ঘিরে থাকত তাকে। কিন্তু গুরু শিষ্যা
সম্পর্ক বশত স্বাভাবিক কুণ্ঠার কারণে, প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলোচনা সম্ভব ছিল না তাঁর
সঙ্গে।
আর এখানে সে
পেয়েছে মাতৃত্বের প্রতিমূর্তি কুন্তীকে। সে শৈশবেই মাতৃহীনা। পিতার সপত্নীদের মধ্যে সে মাতৃরূপ খুঁজে পায়নি। সে কতবার শুনেছে, তাঁদের গোপন
ব্যাভিচারের কাহিনী। কত গুপ্ত হত্যা, ষড়যন্ত্র! সুক্তিমতীর রাজপ্রাসাদের প্রাচীরের গায়ে যেন
অদৃশ্য অক্ষরে পাপের উপাখ্যান লেখা থাকত। কিন্তু এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্যরকমের। কুন্তী তার জননী প্রতিমার
শূন্যস্থানটি পূরণ করেছেন। নকুলের মুখে তাঁদের বাল্যকালের ক্ষুদ্র কত স্মৃতিচারণা
শুনেছে সে। আর তখনই এই মহীয়সীর ভাবনায় তার মন শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছে বারে বারে। কোন্নারী আপন পুত্রের সমান আসন দিতে পারে সপত্নী
সন্তানকে?
করেণুমতী
এখন একাকী পতিসমাগমের অপেক্ষায়। শয্যার কোমল আস্তরণটি নিয়ে খেলা করছে। দুহাতে মুঠো করে ধরছে, আবার ছেড়ে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে তার মনে উত্তেজনা। ক্রমশ নিস্তব্ধ হয়ে
আসছে এই বৃহৎ প্রাসাদ। গভীর রাত! নকুল এবারে শয়ন কক্ষে আসবেন। রাজপ্রাসাদে রাত্রি হয় অনেক বিলম্বে। করেণুমতীর মনে হচ্ছে কী দীর্ঘ এই অপেক্ষার কাল!
এই সুগন্ধি কক্ষে, নকুল যখন তার শরীর গ্রহণ করেন, মনে হয় এ দেহ এক বাদ্য যন্ত্র,
তিনি শ্রেষ্ঠ শিল্পীর মতো ঝঙ্কার তোলেন তাতে। সেই নিঃশব্দ আনন্দ ধ্বনি রাত্রির নক্ষত্রখচিত
নিঃসীম আকাশে ছড়িয়ে যায়, ক্রমশ ব্যাপ্ত হয়ে যায় বিশ্বচরাচরে। তার মনে পড়ে আচার্য বীতিহোত্রের মুখে শোনা,
বহুদূরের আশ্চর্য কোনও দেশের কথা, যেখানে এই মুহূর্তে সকাল! সেদেশেও কি পৌঁছে গেছে
তার এ আনন্দ? গভীর এক আনন্দ-বিস্ময়ে সে তখন একটি বালিকার মতো হয়ে যায়। বারবার আকস্মিকভাবে
আলিঙ্গন করে স্বামীকে। বারবার দ্রুতবেগে চুম্বন করতে থাকে তাঁকে। যেন এইভাবে চুম্বনের একটি মালা পরাতে চায় তাঁর
গ্রীবা, ওষ্ঠ, কর্ণমূল ঘিরে।
গতকাল
ঊষাকালে নকুল তার মুখখানি দুই করতলে ধরে চুম্বন করছিলেন তাকে। সেই সুগন্ধী অধর, দীর্ঘ সময় ধরে পান করছিল তার
জীবন রস। তারপর বলেছিলেন,-“এ রাত্রি কেন অনন্ত হয় না? আলো বেদনা দেয় আজকাল আমাকে জানো
কী তুমি? আলোর রেখা একটি তীক্ষ্ণ তরবারির মতো আমাকে তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। করেণুমতী তুমি
অদ্বিতীয়া। আমি তোমার মতো এমন কাউকে দেখিনি।’’
করেণুমতীর
মনে হয়েছিল এ কোনও অতিশয়োক্তি নয়। মনোহারী মিথ্যা নয়। এ তাঁর অনুভবের কথা। শিহরিত হয়েছিল সে। কিন্তু তখন তার মনে একটি নিভৃত ইচ্ছাও জেগেছিল। সাধারণী নারীর মতো
এক কুটিল ইচ্ছা। যদি নকুল নির্জনে তার নিকট দ্রৌপদীর সম্বন্ধে দু একটি বিরুদ্ধ বাক্য বলতেন!
কিন্তু অভিজাত পুরুষেরা অমন করেন না। আর একটু কেন অল্প
পরিশীলিত হলে না তুমি হে নকুল? এ চিন্তা মনে জাগা মাত্র সে ধিক্কার দিয়েছিল নিজেকে।
কিন্তু আজ
সমস্ত দিন ধরে তার মনে বেজে চলেছে এক অশ্রুত সঙ্গীত। একটি সম্ভাবনার কথা জেগেছে তার মনে। কাউকে বলেনি। আজ প্রথম বলবে নকুলকে। হয়তো---হয়তো--। কতদিন সে বাতায়ন পথে দেখত একটি
কন্দুক নিয়ে একাকী প্রাঙ্গণে খেলা করছে শতানীক। দ্রৌপদীর গর্ভজাত নকুলের পুত্র। করেণুমতী
নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকত তার দিকে। শতানীক যেন নকুলের বাল্যরূপ। সে কম কথা বলে। কিন্তু ধীমান। বুদ্ধিদীপ্ত তার চোখের চাহনি। মুখে মিষ্ট হাসিটি
লেগেই থাকে। এই অল্পদিনেই করেণুমতীর গভীর স্নেহ জেগে উঠেছে তার প্রতি। শুধু সে স্নেহে মিশে থাকে এক মৌন বিষাদ। অসহ যন্ত্রণায় তাকে
বিদীর্ণ করে কেন জন্ম নিল না এই বালক! তার নিজের গর্ভে একদিন নকুলের সন্তান
জন্মাবে। কিন্তু কে জানে কেমন হবে সেই শিশু। করেণুমতী চায় এক পুত্র। যে শিশু হবে এই রকমই, প্রিয় নকুলের প্রতিবিম্ব। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল সে।
গত কদিন ধরে
কর গুণে হিসাব করছে সে। আজ এক চান্দ্রমাস পূর্ণ হোল, সে ঋতু দর্শন করেনি। তবে কী---তবে কী---? অবশ্য সে জানে এটি সকল
সময়েই যে গর্ভাবস্থার লক্ষণ এমন নয়। অন্য অনেক কারণেই ঋতুচক্র অনিয়মিত হতে পারে। তাই আশা নিরাশার দোলাচলে সে
এখন। আশা তাকে স্বপ্ন
দেখায়। হয়তো---হয়তো সত্যই
সে গর্ভবতী। কত কল্পনাই না মনে জাগে তার। সে স্থির করে রেখেছে, যদি তার একটি পুত্র হয়, তবে তার নাম
রাখবে নিরমিত্র। কোথাও শুনেছিল এই নাম। নামটি ঝঙ্কার তোলে তার মনে। নকুলের পুত্র নিরমিত্র।
কিন্তু মাঝে
মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় তার। তখন নকুলের ঘুমন্ত মুখের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে সে। মনে হয় এই,সুন্দর,
জ্ঞানী ও কোমল হৃদয় মানুষটিকে এত আপন মনে হয়। তবু এখনও তাকে সম্পূর্ণ জানে না সে। এক রহস্যময়তা ঘিরে আছে এঁকে। তার মনে পড়ে যায়
মাতা কুন্তীর মুখে শোনা নকুলের সেই অদ্ভুত কাহিনী। কখনও
কখনও ইনি নাকি ভবিষ্যৎকে চোখের সামনে দেখতে পান। কিন্তু ঘোর ভেঙে গেলে, তাঁর আর কিছু মনে থাকে না। সে এমন অবস্থায় তাঁকে কখনও
দেখেনি। কিন্তু ভাবলেই,
কেমন এক আতঙ্ক ও বিস্ময় গ্রাস করে তাকে। করেণুমতীর আজ মনে
পড়ছিল কুন্তীর মুখে শোনা সে সব উপাখ্যান। আকুল এক মহাপ্রশ্ন গ্রাস করে করেণুমতীকে। এ ভুবনে কী হয়? কেন হয়? কেমনভাবে? এই বিশাল ধরণী
জুড়ে কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। তার ইচ্ছা করে
নকুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে। যদি তিনি তার সামনে খুলে দিতে পারেন ভাবীকালের
অন্ধকার যবনিকা। আজ থেকে বহু বর্ষ পরে কি হবে? সে কি হবে সন্তান গরবে গরবিণী এক মাতা? বহু মানুষের জন্য, পৃথিবীর এক শুভ পরিবর্তনের
জন্য প্রয়াস করবে কি তার অনাগত কালের পুত্র?
এই প্রবল ইচ্ছা পূরণ হবে কী তার জীবনে? করেণুমতী নিজের বক্ষ স্পন্দন শুনতে
পায়।
এই গৃহের
চারটি প্রাচীরের ঘেরাটোপ ছাড়িয়ে সুদূর অজানা কালের পটভূমিতে সে দেখতে চায় পৃথিবীকে। কিন্তু তার সামনে দোলে ধূসর
পর্দা এক। সে জানে নকুলকে প্রশ্ন করলে কোনও
উত্তর পাওয়া যাবে না। সহসা কোন্মুহূর্তে যে ফুটে উঠবে তাঁর সামনে
ভবিষ্যতের চিত্রমালা তা তিনি নিজেও জানেন না। তিনি আত্মগত ভাবে বর্ণনা করবেন সে ছবির। কিন্তু ভুলে যাবেন পর মুহূর্তেই।
তার এমন সব
ভাবনার মধ্যে দ্বার খুলে প্রবেশ করেন নকুল। করেণুমতীর অবাক হয়ে দেখে তাঁর মুখের ভাব বড় উদ্বিগ্ন আজ। তখনই সে সব ভুলে যায়। কল্পলোক থেকে নেমে আসে বাস্তবের ভূমিতে। শয্যা থেকে ছুটে এসে তাঁর
বাহুতে হাত রেখে বলে,-“আপনি কি অসুস্থ?”
নকুল বলেন,-“এক অশুভ চক্রান্তের খবর পেয়েছি আজ বিকর্ণের গোপন পত্রে। আমাদের একমাত্র শুভাকাঙ্খী কৌরব ভ্রাতা। আমার প্রিয় বান্ধব।”
“কৌরব ভ্রাতাদের চক্রান্ত? আপনাদের বিরুদ্ধে?”-করেণুমতী প্রশ্ন করে।
“হ্যাঁ। তবে এ তার অনুমান। সে এখনও নিঃসংশয় হয়নি। দুর্যোধন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময়ে বিকর্ণকে
অংশ গ্রহণ করতে ডাকে না কখনই। কিন্তু সে যেন আভাস পাচ্ছে এক মহা অশান্তি ঘনিয়ে ওঠার। রাজসূয় যজ্ঞে আমাদের বিপুল
সম্পদের পরিচয় পেয়ে ঈর্ষায় জর্জরিত হয়ে আছে দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণেরা। আমাদের সর্বস্বান্ত করতে চায়।”
“অনেক দিন আগে আমার আচার্যদেব বীতিহোত্র এমনই আভাস
দিয়েছিলেন।”- চিন্তিত মুখে করেণুমতী বলে।
“যে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিই আজ মনে করেন সেই
যজ্ঞে আপন সম্পদের অমন উন্মুক্ত প্রদর্শন অনুচিত হয়েছিল আমাদের পক্ষে। কিন্তু অতীতকে তো আর পরিবর্তিত
করা সম্ভব নয়। ”
“আপনার কী মনে হয় যুদ্ধ ঘোষণা করবে তারা? আপনার
অন্য ভ্রাতারা কী বলছেন?”
“আমি এই পত্রের কথা এখনই প্রথম তোমাকে বললাম। কেউ জানে না এখনও।”
সেই
উদ্বেগের মধ্যেও মুহূর্তের জন্য, করেণুমতীর
মনে ঝিকিয়ে ওঠে অদ্ভুত এক গর্বিত সুখের আলো। নকুল কথাটি অন্য কারোর সঙ্গে আলোচনার আগে তাকে
জানিয়েছেন! তাকেই!
নকুল অন্যমনস্ক
ভাবে বলে চলেন,-“এখনই সম্মুখ সমর হয়তো নয়। তারা জানে এই মুহূর্তে আমরা অধিক বলশালী। কিন্তু পরে শক্তি সঞ্চয়
করে---জানি না---জানি না ভাগ্য কুরুকূলকে কোন পথে নিয়ে যাবে? যুদ্ধ ঘটনাটি জয়ী ও
বিজিত দুই পক্ষের জন্যই বড় ভয়ানক। দুর্যোধন অতি কুটিল। কোনো কুট কৌশলে আমাদের বিধ্বস্ত করে দিতে পারে। ঈর্ষা ভয়ঙ্কর রিপু। আর উচ্চস্তরের ব্যক্তিদের
পারষ্পরিক ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে সমাজের সর্বস্তরে। অসংখ্য মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে পড়ে তাতে। মহাযুদ্ধের ফল মৃত্যু,
দারিদ্র, ব্যাভিচার! বহুক্ষেত্রে এমনই দেখেছি। মূর্খের মতো আপন সম্পদের প্রদর্শনকামীতা,
প্রতিপক্ষের ঈর্ষাকে জাগিয়ে তোলার নির্বোধ আমোদ, প্রতিহিংসাপরায়নতা সম্পূর্ণ
সমাজের জন্যই অমঙ্গল ডেকে আনে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংযম অভ্যাস করা নিতান্তই প্রয়োজন। বৃহত্তর স্বার্থে----”
বলতে বলতে
হঠাৎ স্থির হয়ে যান তিনি। তাঁর কথা বন্ধ হয়ে যায়। শূন্য দৃষ্টি। পরমুহূর্তেই মুখে ফোটে তীব্র
যন্ত্রণার ছাপ। আহত পশুর মতো গোঙাতে থাকেন নকুল। তাঁর মুখের ভাব দেখে করেণুমতী
আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
“কিসের যন্ত্রণা? আমি এখনই ডেকে আনি পরিচারকদের!”-আকুল হয়ে বলে করেণুমতী। সবলে আলিঙ্গন করে যেন, এইভাবে
লাঘব করতে চায় স্বামীর অজানা কষ্ট। কিন্তু তখনই গভীরতর আতঙ্কে উপলব্ধি করে নকুল তার উপস্থিতিই
অনুভব করতে পারছেন না।
বিষাদে,
ত্রাসে তাকিয়ে আছেন নকুল, অনেক অনেক দূরে---। তাঁর স্তিমিত ভয়ার্ত স্বর শুনতে পায় করেণুমতী।
“ যুদ্ধ শেষ হোল। বিজয়ী হয়েছে পান্ডবগণ। কৌরবভ্রাতারা নিহত আজ সকলেই। বিকর্ণও। পান্ডুপুত্রেরা জীবিত রয়েছে। কিন্তু মৃত্যু বড় কাঙ্খিত আজ তাদের! সম্মুখে ঐ
রক্তাক্ত রণক্ষেত্র। পূতীগন্ধময়। ওখানে আত্মীয়, বধ করেছে আত্মীয়কে। শত্রু শত্রুকে। আর বন্ধু বন্ধুকেও। তীক্ষ্ণ দাঁতে শবমাংস ছিঁড়ে খায় শৃগাল, কুকুরেরা। নিশাচর পক্ষীরা ওড়ে রাত্রির
আকাশে। ওরাও মাংসলোলুপ। বিশাল রণভূমিতে জ্বলন্ত মশাল
হাতে কৌরব ও পান্ডব পক্ষের নারীরা উন্মাদিনীর মতো খুঁজে ফিরছে স্বামী,
সন্তান,পিতা, ভ্রাতাদের গলিত দেহ। ওখানে শুয়ে আছে
ওরাও সকলে।শতানীক,শ্রুতকর্মা,শ্রুতকীর্তি,সুতসোম,প্রতিবিন্ধ্য—দ্রোপদীর গর্ভের ফসলগুলি। আর--আর যৌধেয়,সর্ব্বগ,অভিমন্যু, ঘটোৎকচ,সুহোত্র,
নিরমিত্র---পান্ডবপুত্রেরা সকলেই—”
ক্ষুধার্ত
বাঘিনীর মতো নকুলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে করেণুমতী। “স্তব্ধ হোন---স্তব্ধ হোন---আর
উচ্চারণ করবেন না---” তার নখ বসে যায় নকুলের ওষ্ঠে অধরে। নকুলের সম্বিৎ ফেরে তখন। গভীর বিস্ময়ে তিনি বলেন,-“কী হয়েছে করেণুমতী? এমন বিচলিত
কেন তুমি? আমি কী ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?’’
সে
উন্মাদিনীর মতো বলে ওঠে,-“বলুন কী বললেন আপনি? কী বললেন? কে নিরমিত্র? বলতেই হবে
আপনাকে? নিরমিত্র কে?”
নকুল অল্প
হাসেন। প্রত্যয়ী কণ্ঠে
বলেন,-“নিরমিত্র নামে কেউ নেই। স্বপ্ন দেখেছ করেণুমতী। কোনও দুঃস্বপ্ন। জাগ্রত অবস্থার দুঃখ, উদ্বেগগুলি ঘুমের মধ্যে
স্বপ্নের রূপ নিয়ে ফিরে আসে। আমিও বুঝি তন্দ্রার ঘোরে এক দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। জেগে উঠে সব যেন একাকার হয়ে
গেল।”
সদ্য শোনা
অস্পষ্ট সেই বার্তার স্মৃতি আতঙ্কের কালসর্প হয়ে দংশন করে করেণুমতীর বুকে। হিমশীতল। নকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। নিজের বসন উন্মোচন করে। স্পর্শ করে যোনি। উন্মাদিনীর মতো খোঁজে রক্তদাগ। হে ঈশ্বর মিথ্যা হোক গর্ভধারনের অনুমান! মিথ্যা
হোক! চাপা স্বরে আকুল কান্না কাঁদে সে। সে এখন এই সুদৃশ্য কক্ষে নেই। এক রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে সে এখন। মহা শ্মশান থেকে ভেসে আসা
বাতাসে কম্প্র তার হাতের মশালের শিখা। এখন থেকে প্রতি মুহূর্তে সে কি তবে বাস করবে অনাগত সেই
ভয়ঙ্কর রাত্রে। খুঁজে চলবে তার অজাত সন্তানের মৃত মুখ।
নকুল
হাসেন,-“কিসের উদ্বেগ প্রিয়ে? কেন এমন চঞ্চল হয়েছ? জান না স্বপ্ন কল্পনার বুদ্বুদ
মাত্র।“ আবেষ্টন করেন তিনি পত্নীকে।
প্রাসাদ
শৌধের বাইরে বিস্তীর্ণ নগরী ঢেকে থাকে ভিখারিণীর মলিন বসনের মতো অন্ধকার দিয়ে। রাত আরো গভীর হয়। কী এক ব্যাখ্যাহীন অস্বস্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন
নকুল আরো কতক্ষণ। কোনো কথা হয় না দুজনে। তারপর নকুলের
নিদ্রা আসে। নিদ্রা বিধাতার আশীর্বাদ। সমস্ত দুঃখ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় তা। বিস্মৃতিও আশীর্বাদ।
সপ্তদশ অধ্যায়
(কুন্তীর কথা)
বড় ক্লান্তি
এখন। শরীর মন জুড়ে। রাজসূয় যজ্ঞ শেষ হয়েছে, সেও তো কতকাল হয়ে গেল। কত ঘটনা ঘটল আমার জীবনে। বহু দুর্দিনের শেষে আজ আমার
সংসার ভরে উঠেছে, যে সংসারকে প্রতিনিয়ত প্রহরা দিয়েছি অতন্দ্র দৃষ্টিতে। স্নেহ দিয়ে, শ্রম দিয়ে, কখনও
বা কূটবুদ্ধির প্রয়োগে সংসারের ভাঙন প্রতিহত করতে চেষ্টা করেছি। আমার পুত্রেরা এমন বৃহৎ এক
অনুষ্ঠানের আয়োজন করল কত দেশ বিজয়ের শেষে। কত সমারোহ। কত সমৃদ্ধি আজ তাদের। দ্রৌপদীর পরেও আরো পুত্রবধূরা গৃহে এসেছেন। পৌত্রদের জন্ম হয়েছে একে একে। পঞ্চপুত্র, পুত্রবধূগণ, পৌত্ররা সকলেই আমার
প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু শান্তি নাই তবু।
রাজসূয়
যজ্ঞে কি ভয়ঙ্কর ভাবে কৃষ্ণের চক্রের আঘাতে নিহত হোল দুরাচারী শিশুপাল, চেদিরাজ। অমঙ্গলের সূচনা দেখে বুক কাঁপে
আমার!
তারই কন্যার
সঙ্গে বিবাহ প্রস্তাব করলেন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা। কি কুটিল রাজনীতি। কিন্তু এ পরিবারে করেণুমতীর বধূ হয়ে আসা এক গভীর
প্রাপ্তি আমার জীবনে। বড় উজ্জ্বল, বড় স্নিগ্ধ এই মাতৃহীনা কন্যা। আমার ভারী অনুগত। সকল পুত্রবধূগুলির প্রতিই আমার গভীর স্নেহ। হয়তো অপূরিত কন্যাতৃষ্ণাই এর
কারণ। করেণু সর্বদাই
আমার কাছাকাছি থাকে। তার মুখের বুলি,-‘জননী উপাখ্যান শুনব। আপনার শৈশবের কথা, আপনার পঞ্চপুত্রের শৈশবের কথা বলুন সব। সেই শতশৃঙ্গ পর্বতে আবার একদিন
যেতে পারি না আমরা সকলে মিলে। খুব উঁচু বুঝি সে পাহাড়? আকাশ খুব গাঢ় নীল? অনেক অনেক পাখি
ছিল সে আকাশে? ঝর্ণার জলে স্নান করতেন আপনারা?”- কত যে প্রশ্ন তার। কখনও আবার তার মুখে ফুটে ওঠে
মিটিমিটি দুষ্ট হাসি। গলার স্বর নামিয়ে মুখটি খুব কাছে এনে প্রশ্ন করে,-“আর শতশৃঙ্গ পাহাড়ের ঋষিরা,
তাঁরা তো নিয়মিত স্নান করতেন না! অত দাড়ি গোঁফ, আমি জানি ঋষিদের গায়ে খুব দুর্গন্ধ
হয়, আমাদের সুক্তিমতীর প্রাসাদে একবার—”- কথা শেষ হয় না তার হাসির প্রাবল্যে। ভেসে যায় আমার কপট তিরস্কারের চেষ্টাটুকু। আবার কোনো কোনো উদাস অপরাহ্নে
তার চোখে ঘনিয়ে আসতে দেখি, স্মৃতির মেঘ-ছায়া। সে বলে, তার মৃতা জননীর কথা, তার ভাই, তার
আচার্য বীতিহোত্রের কথা। কখনও বলে তার দুরাচারী পিতার কথাও। তখন তার মুখে ফুটে ওঠে গভীর যন্ত্রণার ছাপ। বহু শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছে সে। জগতের কত আশ্চর্য কথা শুনি তার
মুখে।
পৌত্রেরা
কাছে আসে। কত প্রশ্ন, কত কথা তাদের। তাদের মুখে আমি দেখি আমার পুত্রদের শৈশব বেলা। কোন পুনরাবর্তনের পথে ফিরে এল
আবার!
কিন্তু এই পূর্ণ সংসারের মধ্যে থেকেও কেন এত অশান্তি আমার মনে। সেই রাজসূয় যজ্ঞের পর থেকে
শুরু হয়েছে যা। আমার চারিদিকে এক গভীর শূন্যতা । আতঙ্ক শুধুই অনির্দিষ্ট আতঙ্ক এক। কত কি অশুভ চিন্তা জাগে সর্বদাই। প্রতিদিন আমি আকাশের শূন্য পটে দেখি কে যেন নিপুণ হাতে অমঙ্গলের অদৃশ্য ছবি আঁকছে। স্বপ্ন দেখি কোথায়
কোন মহাশ্মশানে একাকিনী ঘুরছে কিশোরী পৃথা। গভীর রাত্রি। চিতার লাল আগুনের শিখা জ্বলছে চারিধারে। পৃথার দুহাতে বুকের কাছে ধরা কাপড়ের পুঁটুলি। ক্ষীণ কান্নার শব্দ আসছে সেখান থেকে। আর পৃথার দু চোখ থেকে ঝরে পড়ছে
অবিরল অশ্রুধারা। নিঃশব্দ সে রোদন। অন্ধকার নদী হয়ে বয়ে যাচ্ছে সে অশ্রু। কূল দেখা যায় না তার। পৃথা
হাতে ধরা কাপড়ের পুঁটুলিটি ভাসিয়ে দিল অকূল সে নদীতে। শেষ বারের মতো ককিয়ে উঠে থেমে গেল কান্নার শব্দ। আর বীভৎস অট্টহাসিতে ভরে উঠল
চরাচর। মহাশ্মশানের চিতার
আগুন লকলক করে বেড়ে বুঝি আকাশ ছুঁতে চাইছে উদ্দাম নৃত্যে।
কত বার
দেখেছি, আজও দেখি এই স্বপ্ন। হ্যাঁ আমার কিশোরীবেলার ক্ষণিক ভুলে, চপলতায় জন্ম
দিয়েছিলাম যে শিশুর, ত্যাগ করেছিলাম যাকে সমাজের ভয়ে, সে আজ অঙ্গরাজ্যের অধিপতি কর্ণ। আমাদের জ্ঞাতিশত্রু দুর্যোধনের প্রিয় সহচর। শুনেছি
পঞ্চপান্ডবের প্রতি ঘোর বিদ্বেষ তার। লোকলজ্জায় ধ্বংস করতে গিয়েছিলাম যে শিশুকে, আজ
পুনরাবর্তনের পথে ফিরে এসে সে হয়ে উঠেছে বিধ্বংসী। তার আজন্ম সকল বঞ্চনার ক্রন্দন এত কাল ধরে
হিমায়িত কঠিন হয়ে রূপ ধরেছে মারক অস্ত্রের। রাজসূয় যজ্ঞের কালে কুরু ভ্রাতাদের মুখে দেখেছিলাম তীব্র
ঈর্ষা আর ক্রোধ। হায় আমার পুত্র মহাবীর কর্ণ তাদের সহায়। অনুভব করেছি, মুহূর্তের ভ্রান্তিতে কি দুর্দৈব
ঘনিয়ে আসে। আমি নিশ্চিত বুঝেছি, জননী হয়ে আমিই এই ভ্রাতৃবিরোধের বীজ বপন করেছিলাম না
জেনে সেই অবোধ কিশোরীবেলায়। সেই বিষ বৃক্ষের চারা আজ মহীরুহ হয়ে উঠেছে। তা উৎপাটিত করার শক্তি কার বা
আছে! নিয়তি ক্রুর হাসি হাসছে। আমরা যে নিয়তিকে নির্মাণ করি প্রতি মুহূর্তে, ছোট বড় কত না
ভ্রান্তির উপকরণ দিয়ে।
এই পরিণত
বয়সে এসে মনে হয়, ‘ভয়’ মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। সেই আতঙ্কের শাসনে আমরা যখনই সত্য থেকে বিচ্যুত হই, তখনই নেমে আসে ঘোর অমঙ্গল।
কুরু
রাজবংশের রাজপুত্র পান্ডুর সঙ্গে বিবাহ হোল আমার ও মদ্র রাজকুমারী মাদ্রীর। অল্প কাল পরেই জানতে পারলাম,
স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন যাপনে অপারগ তিনি। হয়তো বিষম গ্লানিতেই রাজ্যত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন
একদিন। আমরা তাঁর দুই
স্ত্রী, অসহায় ভাবে তাঁর অনুগামিনী হলাম। কি কঠিন সে জীবন। সহ্য করেছি সব। অবশেষে শতশৃঙ্গ পর্বতের তপোবনে এসে কুটির বেঁধে
বসবাসে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। মনে সর্বদাই জেগে থাকত তাঁর ক্ষোভ। জনক হতে চাওয়ার আকুতি। শুধু
নিয়োগ প্রথায় বংশরক্ষা সম্ভব ছিল। একে একে আমার ও মাদ্রীর জীবনে আহ্বান করে আনা হোল উজ্জ্বল
সব পুরুষদের। ধর্ম, পবন, ইন্দ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয়। কালক্রমে, আমি ও মাদ্রী দুজনে মিলে হয়ে উঠলাম পাঁচটি
সন্তানের জননী। সে সব মিলন ছিল কঠিন নিয়ম মেনে। যান্ত্রিক ভাবে। সন্তান উৎপাদনের জন্য। তার মধ্যে ছিল না এতটুকু রোমাঞ্চ, আবেগ। কিন্তু নিঃসন্দেহে বলতে পারি আজ, একমাত্র কর্ণই
ছিল আমার আনন্দজাত সন্তান।
তখনকার একটি
দিনের ঘটনা আজও ভুলিনি। আমাদের পুত্রেরা তখন শিশু। কি মধুর তাদের মুখের আধো আধো বুলি। আমরা
তখন শতশৃঙ্গ পর্বতে এক তপোবনের অরণ্য কুটীরে। অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম এই শান্তিময় জীবনে। রাজবৈভব থেকে অনেক দূরে মাথার
উপরে উদার আকাশ আর আদিম বৃক্ষময় পর্বত শৃঙ্গগুলি ঘিরে থাকত আমাদের। নিজের অজান্তেই বিলাসব্যসনের
অভ্যাসগুলি, ভোগপিপাসা ক্রমশ খসে পড়ছিল। মনের মধ্যে তখন অদ্ভুত পরিবর্তন! বাৎসল্য রসে সর্বদাই আমি
পূর্ণ হয়ে থাকতাম। আপন-পরের ভেদ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল যেন। মাদ্রেয় আর কৌন্তেয় এ দুই শব্দের কোনো পৃথক অর্থ ছিল না
আর! নিজেকে মনে হোত পঞ্চপুত্রের মাতা। শুধু কোনো কোনো নিদ্রামগ্ন রাত্রের অন্ধকার বিদীর্ণ করে কত
দূর থেকে ভেসে আসত, এক সদ্যোজাতের ক্ষীণ কান্না। আবার সকাল হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত অতীত।
এই সময়ে
একদিন আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটেছিল। তখন ঘোর বর্ষা ঋতু----দুদিন অবিশ্রান্ত বারিপাতের পরে
নিস্তেজ সূর্যের আলো দেখা দিয়েছিল আকাশে। আমি ও নকুল ছাড়া আর
কেউ ছিল না কুটীরে। আমি গৃহকর্মে ব্যস্ত আর সামনের উন্মুক্ত আঙিনায় আপন মনে খেলা করছে সে। আধো আধো ভাষায়
ঋষিদের মুখ থেকে শোনা শ্লোক বলছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল। দূরের পর্বত চূড়ার
দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু শূন্য সে দৃষ্টি। কোনও শিশুর চোখে আমি অমন চাহনি দেখিনি কখনো। মনে হোল তবে কী
অসুস্থ সে? ব্যাকুল হয়ে ছুটে গেলাম তাকে কোলে তুলে নিতে। কিন্তু সে যেন আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। এক ঘোরের মধ্যে
হঠাৎই সে বলতে শুরু করল,---পিতা নাই---মাদ্রী মা-ও নাই---ওরা কেউ নাই---কোথায় ওরা?
শুধু কুন্তী মায়ের সঙ্গে আমরা পাঁচ ভাই চলেছি---চলেছি---তো চলেইছি---পথে কত ঘর আর
গাছ-- নদী আর পাহাড়---আমরা চলেইছি---তারপর একটা জায়গায় এসেছি আমরা---বিরাট উঁচু
উঁচু ঘর সেখানে---ঘরের মাথায় ঘর---তার উপরে আবার ঘর---এমন করে ক—ত উঁচু ---ভয় করে ঘাড়ের উপর
ভেঙে পড়বে না তো? সবচেয়ে উঁচু যে ঘর---বাপ্রে কত কত বড়----একটা মাঠের চেয়েও
বড়---গাছের চেয়েও উঁচু---ঝলমল করছে তার চুড়ো। তার দেওয়াল জুড়ে আঁকা রয়েছে ফুল আর পাখি, হরিণ
আর হাতি, মানুষ আর মাছ—ঝক্ঝক্করছে লাল, নীল, সবুজ পাথর---মস্ত বড় বড় সব
দরজা-----হাতি বেরোচ্ছে, ঘোড়া বেরোচ্ছে---আর কত লোক---সাজগোজ করা---চক্চকে
জামা-কাপড় পরা---ওরা সবাই আসছে আমাদের ঘিরে ধরল। কত কি জিজ্ঞেস করছে। আচ্ছা ও কে এক বুড়া? কি সুন্দর দেখতে। সাদা দাড়ি---মাথায় খুব
উঁচু---ওই যে কোলে তুলে নিলেন আমাকে---মাটি থেকে কতখানি উঁচুতে উঠে গিয়েছিলাম
আমি---উনি বলছেন--- এ ঘর আমার পিতার পিতা---তারও পিতা---তারও পিতা---আরো আরো কত কত
আগে তৈরি ---উনি বলছেন---আমরা এবার থেকে এখানেই থাকব---
আমি
রুদ্ধশ্বাসে শুনছিলাম। কি যেন ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম তার কথার। তারপরই সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ছটফট করতে লাগল---যেন কত কষ্ট পাচ্ছে---আমি তার
মাথায় মুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগলাম। এক সময়ে শান্ত হোল। তখন যেমনকার তেমনি। বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম তাকে, বাছা কোথায়
গিয়েছিলি---কী দেখেছিলি---বল তো আবার---সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল---তার আর কিছু
মনে নাই।
আমার মন
তখনই বলছিল এ প্রলাপ নয়---সে বুঝি ভবিষ্যতের ছবি দেখেছে। পৃথিবীতে কত আশ্চর্য ঘটনাই তো ঘটে। বলিনি কাউকে। এমনকি মাদ্রীকেও নয়! আরো কত পরে কত ভয়ংকর ঘটনা
ঘটেছিল। স্বামী পান্ডু ও
মাদ্রীর সেই অস্বাভাবিক মৃত্যু। তপোবনের ঋষিদের নির্দেশে আমরা যখন হস্তিনাপুরের পথে যাত্রা
করেছিলাম, তখন বেদনার চেয়েও বেশী যেন আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম বিস্ময়ে। তার সেদিনকার বলা কথাগুলিকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখলাম জীবনে। আমি বুঝলাম যে বৃদ্ধ মানুষটির
কথা বলেছিল সে তিনি পিতামহ ভীষ্ম।
পরে আরো
কয়েকবার এমন সব দৃশ্য দেখেছে সে। ঘোর কেটে যাবার পরে আর কিছুই বলতে পারত না। কিন্তু ভবিষ্যতের সঙ্গে মিলে
গেছে সেই সব উক্তি।
“জননী”-
হঠাৎ এই ব্যাকুল ডাকে আমার চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে গেল। মুখ তুলে আমি দেখলাম করেণুমতী এসে দাঁড়িয়েছে
দ্বারে। তার মুখে ত্রাস,
উদ্বেগ। আমি সহসা দেখলাম
তার দেহে মাতৃত্বের অর্ধস্ফুট লক্ষণ। সর্বদা নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকি বলে লক্ষ্য করিনি আগে। একটি প্রাণকে বহন করছে সে
নিজের মধ্যে। এখন এ কন্যার বিশেষ পরিচর্যার প্রয়োজন। কিন্তু এত ভয় কেন
ওর মুখে?
সে ত্বরিতে
এসে আমার চরণ দুটি ধরে ভূমিতে বসল। তারপর মুখটি উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে আকুল হয়ে
বলল,-“মা,, চতুর্থ পান্ডব যা দেখেন তার সব ঘটনাই কি সত্য হয়? বলুন জননী—বলুন---”
আমার প্রাণ
কেঁপে উঠল। কি এমন অশুভ দৃশ্য দেখেছে নকুল যা শুনে ভয় পেয়েছে এই বালিকা? কেমন ভয়ঙ্কর সেই
অনাগত দিনের ছবি?
সে
আচ্ছন্নের মতো বলে যেতে লাগল,-“না মাতা কিছুতেই হয় না—মানুষ তো প্রলাপও বকে কখনও---বলুন বলুন জননী—এমন কি হতে পারে—হয়তো কাকতালীয়বৎ কিছু কথা মিলে
গিয়েছে—কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সর্বদাই মিলে যাবে তাই না?—বলুন---বলুন আপনি জননী, শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষবিদের কত কথাও তো মেলে না—আপনি তো অনেক দেখেছেন—বলুন—”
অজানা
আতঙ্কের হিমস্রোত নেমে যাচ্ছিল আমার মেরুদন্ড বেয়ে। আমি বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। তার সুকুমার মুখখানি এমন ভীষণ
ক্রোধে বিকৃত হয়ে উঠতে কখনও দেখিনি আগে। ক্রুর নিয়তির বিরুদ্ধে এক অসহায় ক্রোধ।
আমি নিজেকে
সংযত করলাম,- “বৎসে, নিজের শরীরে অভ্যন্তরে তুমি কি কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছ?”
“হ্যাঁ,
মাতা। গত চান্দ্রমাসে
ঋতুস্রাব হয়নি। খাদ্যে রুচি নাই।”
“আমি
নিশ্চিত বৎসে, তুমি গর্ভিণী হয়েছ। কত আনন্দের দিন আজ। পরবর্তী প্রজন্ম তোমার দেহে আশ্রয় লাভ করেছে।”-এমনই বিক্ষিপ্ত তার মন, যেন আমার কথার অর্থ তার চেতনা পর্যন্ত পৌঁছায়
না। আসন্ন মাতৃত্ব
তাকে আনন্দ দিচ্ছে না কেন? তার মনের গহীনে কোন জটিলতা সংক্রামিত হচ্ছে? “কিন্তু মাতা, চতুর্থ পান্ডবের সেই ভবিষ্যৎ
দর্শন—যে কথা বলেছেন কতবার?”
“না বৎসে মানুষের জ্ঞান সীমিত, তার অনুভবের
স্তরও তো খুব বিস্তীর্ণ নয়। মানুষ স্বভাবে আতঙ্কপ্রবণ। তাই অশুভ চিন্তাই বেশীর ভাগ সময়ে জেগে থাকে তার
মনে। কখনও স্বপ্ন কখনও
বা অলীক কল্পনা রূপে প্রকাশ পায় তার বাক্যে, তার দর্শনে। মনের গতি বড় বিচিত্র। বহু ভবিষ্যৎ বাণীই তাই সূক্ষ্ম অনুমান মাত্র। বৃথা অমঙ্গল কল্পনায় সময়ের
অপচয় কোর না।”- শান্ত স্বরে আমি বলি। আমার কণ্ঠস্বরে কি যথেষ্ট প্রত্যয় ফুটে ওঠে? আমি বুঝি না। শুধু বুঝি, শান্ত করতে হবে এই
বালিকার মনের আন্দোলন। যা তার শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক।
পর
মুহূর্তেই তার মুখে আমি স্বস্তির ছাপ দেখলাম। আতঙ্কমোচনের শান্তিতে আমার পায়ে মাথা রেখে সহসা
প্রবল ক্রন্দনে ভেঙে পড়ল সে। আমার পায়ের পাতা দুটি ভেসে যেতে লাগল তার চোখের জলে।
ক্রমশ
0 মন্তব্যসমূহ