আমার পুরাণ ভাবনা
(শিব-দুর্গা-কার্তিক-গণেশ ) পরিবার
মূল গল্পে ঢোকার আগে কিছুটা গৌরচন্দ্রিকা প্রয়োজন। আগে সেগুলো সেরে আসল গল্পে ঢুকব।
সেটা ধান ভাঙতে শিবের গীত না বলে শিব বলতে ধানের ভিতও বলা যেতে পারে।
প্রথমেই বলি- ঈশ্বর বা প্রকৃতির শুভ সত্ত্বা একটা বিশাল ব্যাপার। কোনো কল্পনার মধ্যে
দিয়ে তাঁর অস্তিত্ব বুঝতে সুবিধে বলে হিন্দু ধর্মে মূর্তির মধ্যে দিয়ে সহজ পথটা তৈরি
করা হয়েছে।
পুরাণের সঙ্গে কিন্তু ঈশ্বরের কোনো যোগ নেই। পুরাণ কিছুটা সেকালের উপন্যাস যার মধ্য
দিয়ে তখনকার সমাজ অর্থনীতি ইত্যাদি বোঝা যায়।সেখানে দেব-দেবী, রাক্ষস, দৈত্য-দানব,
ইন্দ্র নামক দেবতার রাজা সব রূপক। আমরা যেমন যেসব কথা লিখলে বিপদ তা রূপকের আড়ালে লিখি
আর বোঝো গুণী যে জান সন্ধান বলে ছেড়ে দিই আর পাঠকেরা সমঝদারকে লিয়ে ইশারা হী কাফি বলে
বুঝে নেয়, পুরাণ কথা ঠিক তেমন। রূপকের খোলস ছাড়ালে দেখা যাবে সেদিনের সমাজ আর এখনকার
সমাজের বেশি পার্থক্য নেই।
এই লেখায় শুধু শিব পরিবার নিয়েই আমার ভাবনা বলব। তার আগে বিষ্ণু নিয়ে একটি দুটি কথা
বলে নিই। কারণ, ওইটুকু দিতেই হবে।
বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী বিষ্ণু থেকে জগতের সৃষ্টি। আবার শিব পুরাণ অনুযায়ী শিব থেকে।
ভক্তরা হয়ত যে যার আরাধ্যকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে দেখাতে চেয়েছে।তবুও সৃষ্টিক্ষণের যে বর্ণনা
রয়েছে তা কিন্তু বিগ ব্যাং থিয়োরির কাছাকাছি। অর্থাৎ, কল্পনায় এরকম কিছু একটা হয়ত ছিল।
যাইহোক, যে পুরাণে যাকেই প্রথম সৃষ্টিকর্তা হিসেবে দেখানো হোক না কেন, এটা প্রশংসা
যোগ্য যে উভয় পুরাণেই শিব আর বিষ্ণুর পারস্পরিক বিরোধের কথা নেই।বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধার
কথাই রয়েছে। শিব সর্বদা নারায়ণের ধ্যান করেন আর বিষ্ণুর হৃদয়ের অর্ধেক জুড়ে শুধু শিব।বাকি
অর্ধেক জুড়ে লক্ষ্মীদেবী সহ সমস্ত জগত। উভয় পুরাণেই দেখা যাচ্ছে উভয়েই জগত কল্যাণকারী।
কিন্তু চরিত্র গত দিক দিয়ে কিছুটা ফারাক রয়েছে। বিষ্ণুর সাজপোশাক দামী আবরণ আভরণে।
লক্ষ্মীদেবী তাঁর চরণ সেবা করেন। তিনি অভিজাত কূল শিরোমণি। তাই একটু একপেশে তাঁর আচরণ।
উচ্চ কূলোদ্ভব দেবতাদের অনেক অন্যায় তিনি মার্জনা করেন। বিশেষত ইন্দ্রের। কার্য সিদ্ধির
জন্য বিষ্ণু চতুরতার আশ্রয় নেন। এভাবেই তিনি দেবতাদেরই পুরো অমৃত পাইয়ে দেন। বলা হয়,
অসুরেরা অমৃতর মর্যাদা বুঝবে না।অথচ, সৃষ্টি রক্ষা করতে যে-শিব হলাহল পান করল, সেই
হলাহল যাতে শিবের কণ্ঠের নীচে না নামে সেজন্য যে-পার্বতী নিজের স্তন্য দুগ্ধ পান করালেন,
সেই শিব ও পার্বতীর মতামত অমৃত বিতরণের সময়ে নেওয়া হল না।স্পষ্টত,বিষ্ণু অভিজাতদের
প্রতিভূ।একজন অসুর ছদ্মবেশে সেই অমৃত নিয়ে নেয় বলে সুদর্শন চক্রে গলা কাটা গিয়ে সৃষ্টি
হয় রাহু ও কেতু। এখনও কি দেখা যায় না যে জাতি ধর্ম অর্থ কৌলিন্য না থাকায় অনেক মানুষ
অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন! আর, বঞ্চিত থাকেন বলেই এগোতে পারেন না। এভাবেই ক্রমাগত একটা
খারাপ চক্রের মধ্যে পড়ে যান। খুব কমই পারেন সেই চক্র ভেদ করে বেরোতে, এগোতে। অনেক লড়াইয়ের
পরে প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও কিন্তু আদিবাসী বা উপজাতি তরুণ তরুণীরা এমন উপহাসের শিকার
হন যে, কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন সেই নজিরও বিরল নয়।
তাই অসুররা, রাক্ষসরা, নাগেরা অর্থাৎ নীচ কূলোদ্ভব সকলে শিবের আরাধনা করেন। শিব নির্লিপ্ত,
নিরপেক্ষ। আটজন ইন্দ্রকে( ইন্দ্র দেবরাজ পদের নাম। কোনো একজন মাত্র ব্যক্তি নয়। শিবের
এক জামাতা নহুমও একবার কিছু সময়ের জন্য ইন্দ্রত্ব পান এবং যথারীতি ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে
দাম্ভিক হয়ে ওঠেন। পরে ঋষিদের শাপে সর্প রূপ ধারণ করতে হয়) তিনি বন্দী করেছিলেন।
শিবকে ঘিরে থাকেন নন্দী ভৃঙ্গী গণ প্রেত অর্থাৎ সমাজ পরিত্যক্ত অভাগা মানুষেরা। তাদের
কোনো বাসস্থান নেই। শ্মশানে বাস। শিব তাদের সঙ্গে থাকেন। তাঁর কোনো সম্পদ নেই। মরে
যাওয়া বাঘের ছাল, হাড়গোড় দিয়ে তৈরি গয়না আর একটা পোষা সাপ তার সাজগোজ। কিন্তু সে নৃত্যগীতে পারদর্শী।
সে নটরাজ। ক্রুদ্ধ হলে তাণ্ডব নৃত্য করেন। ধরা যাক, এখনকার যুগের লম্বা চুল কানে দুল
ফাটা জিন্স পরা যুবক যে, গান করে কবিতা লেখে সমাজসেবা করে, সব গুণ আছে কিন্তু
তথাকথিত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে না।
এমন শিবের প্রেমে পড়লেন দক্ষ কন্যা সতী। দক্ষ হলেন এক প্রজাপতি। প্রজাপতি হল একটি পদ, যার ওপর সৃষ্টি
সঞ্চালনা আর তার জন্য নিয়ম তৈরির ভার। দক্ষ হলেন ব্রহ্মার পুত্র। ত্রিদেবের সহমত্যে
তিনি প্রজাপতি পদ পেয়েছিলেন। কিন্তু কন্যার সঙ্গে সমাজ বহির্ভূত শিবের প্রণয় মানতে
না পারলেও বিবাহে স্বীকৃতি দিতেই হয় পিতা ব্রহ্মা ও আরাধ্য বিষ্ণুর আজ্ঞায়। সেই বিবাহের
পরিণতি হয় বিনা আমন্ত্রণে পিতার যজ্ঞে উপস্থিত হয়ে স্বামী নিন্দা শুনে সতীর প্রাণত্যাগে
। এখানেও কি আজকের যুগের সঙ্গে মিল পাচ্ছি না? অভিজাত বাড়ির মেয়ে প্রেমে পড়ে গুণবান
সাধারণ পরিবারের ছেলেকে জেদ করে বিয়ে এবং বিয়ের পরে কোনো অনুষ্ঠানে বাপের বাড়ি গিয়ে
প্রতি পদে অপদস্থ হওয়ার ঘটনা কি দুর্লভ?
সেই সতীর আবার জন্ম হয় হিমালয় কন্যা রূপে। তিনি আবার শিবের প্রেমে পড়েন। কিন্তু সতীর
বাপের বাড়ির যাবার জেদের পূর্ব অভিজ্ঞতার জন্য এবারে শিব সহজে রাজি হন না বিবাহে। পার্বতীকে
অনেক পরীক্ষা দিতে হয় ত্যাগ তিতিক্ষার। সর্বত্যাগীর উপযুক্ত অর্ধাঙ্গিনী হবার পরীক্ষা
দিয়ে তিনি বৃক্ষ থেকে ঝরে পড়া পর্ণ আহার করাও ত্যাগ করে হন অপর্ণা।
এই বিবাহে আবার পিতা অরাজি না থাকলেও মাতার ঘোর আপত্তি ছিল। কিন্তু এই বিবাহ অত্যন্ত
সুখের হয়। সুন্দর একটি পরিবার গড়ে ওঠে। কিন্তু কার্তিক আর গনেশ কি শিব পার্বতীর যৌথ মিলনের
সন্তান?
এবারে আসি কার্তিক গণেশের জন্ম কথায়।
কার্তিকের জন্ম শিবের বীর্য পৃথিবীতে ঝরে পড়ার ফলে। নদীতে তখন কৃত্তিকারা স্নান করছিলেন।
তারা পালন করেন বলে নাম কার্তিক।
তাহলে বোঝা গেল যে এই জন্মের সঙ্গে পার্বতীর কোনো যোগ নেই।
কার্তিকের জন্ম প্রয়োজন ছিল কারণ ব্রহ্মার বরে তারকাসুরকে একমাত্র শিব পুত্রই বধ করতে
পারবে।অথচ সতীর মৃত্যুর পর সতীর দেহ নিয়ে শিব পাগলের মত ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তাঁর
স্থিরতার জন্য বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে খণ্ড খণ্ড করে সতীর দেহই নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। নারদের
কারসাজিতে অনেক কাণ্ড করে পার্বতীর কঠোর তপস্যায় শিবের আবার পার্বতীর সঙ্গে বিয়ে হল। কিন্তু বিয়েতে
বসানো গেলেও কিছুতেই শিবের বৈরাগ্য কাটছিল না এবং শিব পার্বতী মিলন হচ্ছিল না। ইন্দ্রের
স্বর্গ রক্ষার তাড়নায় মদন শিবকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে গিয়ে বেচারা ক্রোধাগ্নিতে
ভষ্মই হয়ে গেলেন। ফলে দেবতা মুনি ঋষিদের অনেক কাকুতি মিনতিতে তারকাসুর বধের জন্য শিবের বীর্যবিন্দু
থেকে কার্তিকের জন্ম। এখানে কিন্তু কোথাও পার্বতীর সঙ্গে মিলনের উল্লেখ নেই।
গণেশের জন্ম কীভাবে? পার্বতী স্নান করার সময় গায়ের মাটি জমিয়ে একটা পুতুল তৈরি করলেন।সেটা
প্রাণ পেয়ে হল গণেশ। অর্থাৎ, এই জন্মের সঙ্গে শিবের কোনো রকম যোগ নেই। এমন কী, গণেশের
জন্মের সময়ে শিব কৈলাশের বাইরে ছিলেন বলে এসব কিছুই জানতেন না। ফিরে এসে তক্ষুনি তাঁর
পার্বতীর সঙ্গে সাক্ষাত করা খুব প্রয়োজন ছিল।কিন্তু পার্বতী তখন স্নান কক্ষের বাইরে
গনেশকে পাহারায় রেখে গেছেন। কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। সে আদেশ পালন করতে গিয়ে
শিবের রুদ্র রূপের কোপে গণেশের নিজ মুণ্ডটি গেল। হাতির মুণ্ড বসল। পরে শিব নিজ ভুলের
খণ্ডন করতে আর পার্বতীর ক্রোধ লাঘব করতে গনেশকে প্রথম আরাধ্য হিসেবে ঘোষনা করেন। বলেন,
হাতির মত হবে তাঁর স্মরণ শক্তি।
অর্থাৎ কার্তিক গণেশ সহোদর নন। এমন কী এক পিতার ঔরসজাতও নন। পার্বতীকে গণেশ জননী বলে
সম্মোধন করা হয়।কখনই কার্তিক জননী নয়।আবার গনেশকে পার্বতীনন্দন বলে সম্বোধন করা হয়
বা গৌরী পুত্র। অপরদিকে কার্তিককে বলা হয় শিবপুত্র কার্তিকেয়।কার্তিককে কৃত্তিকারা
এবং গঙ্গা পালন করেন। গৌরী নয়।
গণেশের জন্মের কথা শিব জানতেনও না। পার্বতী কিন্তু কার্তিকের কথা জানতেন। তাহলে কি
ধরে নেওয়া যায় যে এটা পার্বতীর প্রতিশোধ? সম্পূর্ণ নিজস্ব পুত্র সন্তান তৈরি করে?
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, সতীর প্রাণত্যগের পর দক্ষ যজ্ঞর সময়ে নন্দেশ্বরও শিব নিন্দা সহ্য
করতে না পেরে দক্ষের মুণ্ডু কেটে দেয়। পরে দক্ষপত্নীর কাকুতি মিনতিতে শিব যজ্ঞবেদীতে
পড়ে থাকা ছাগমুখ দক্ষ রাজার শরীরে বসিয়ে প্রাণ ফিরিয়ে দেন।
যাইহোক, এবারে মোটামুটি একটা সমঝোতায় এসে সকলে মিলে বসবাস করার পালা। কিন্তু বিচক্ষণ
শিব বুঝলেন যে, বাড়ির কর্তা বেশিরভাগ সময়ে বাইরে কাটান। তাই নিজের ঔরসজাত নয় এমন সন্তানকে
সারাক্ষণ চোখের সামনে সহ্য করতে হবে না। কিন্তু গৃহিণী ঘরে থাকবে। সারাক্ষণ চোখের সামনে
নিজের গর্ভজাত নয় এমন একটা সুন্দর বালক আর নিজের গর্ভজাত কুদর্শন বালক ঘুরে বেড়ালে
সংসারে অশান্তি অনিবার্য। তাই দুটি বালকের বিশ্ব ভ্রমণের ব্যবস্থা হল। আড়ালে কি শিব
কার্তিককে একটু টিপে দিলেন দেরি করে ফিরতে নাকি অভিমানী কার্তিক অবস্থার আঁচ পেয়ে নিজেই
ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে বেড়াতে লাগলেন আর গণেশ টুক করে বাবা-মাকে এক পাক দিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ
সেরে ফেললেন! গণেশ অবশ্য অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও বুদ্ধিমান। নিজ প্রজ্ঞা বিনয় বিচক্ষণতা
দিয়ে সহজেই শিবের স্নেহের ভাগীদার হলেন এবং অত্যন্ত প্রিয় হলেন।
এবারে দুজনের বিয়ের পালা। সম্মন্ধ এল। কার্তিকের ফিরতে দেরি হচ্ছে এই অছিলায় ঋদ্ধি
আর সিদ্ধি ( মতান্তরে ঋদ্ধি আর বুদ্ধি) দুই বোনের সঙ্গেই গণেশের বিয়ে হল। কেন? এক বোনকে
কি কার্তিকের জন্য অপেক্ষা করানো যেত না? নাকি এটাও পার্বতীর
প্রতিশোধের অংশ? নিজের কুরূপ ছেলের সঙ্গেই দুই সুন্দরীর বিয়ে দিলেন।
কার্তিক ফিরে এসে ব্যাপার বুঝে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি আর বিয়েই করবেন না। হয়ত বুঝলেন
গণেশ জননী যখন তাঁকেই মানতে পারছেন না তখন সেই পরিবারে তাঁর স্ত্রীর কী হেনস্থা হবে।
এরপর কার্তিক দক্ষিণ ভারতে চলে যান ধর্ম প্রচারের জন্য। সেখানে তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি
ছড়িয়ে পড়ে। তিনি নারীর বেদ পাঠ এবং স্বামীর থেকে স্বতন্ত্র ভাবে ধর্মাচরণের অধিকার
স্বীকৃত করেন। নিম্ন বর্ণের মানুষের বেদ পাঠের অধিকারকে স্বীকৃতি দেন। তিনি আর কোনোদিন
কৈলাশে ফিরে যান নি। মতান্তরে দেবসেনা নাম্নী ইন্দ্রসভার এক নর্তকীকে পরে কার্তিক বিবাহ
করেন। কিন্তু অধিকাংশ মতে, কার্তিক যেহেতু দেবতাদের সেনাপতি ছিলেন।তাই দেবতাদের সেনাদলই
ছিল তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়ার মত। সেটাকেই দেবসেনা বলা হয়েছে। অভিমানী কার্তিক দেবতাদের
প্রয়োজনে যুদ্ধ করেন আর সুদূর দক্ষিণে কৈলাশ থেকে অনেক দূরে থাকেন। পিতার ওপরেও তার
অভিমান। একবার দেবরাজ পদ শূন্য হওয়ায় নারদ বিষ্ণু সহ অনেক দেবতাই সেই পদ কার্তিককে
দেবার পক্ষে হলেও শিব রাজি হননি। গণেশ প্রথম আরাধ্য বলে কার্তিকের ইচ্ছে ছিল দেবরাজ
হবার। কিন্তু শিব বললেন, দেবরাজ পদের সঙ্গে সর্বদা থাকে স্বর্গচ্যূত হবার অনিশ্চিতি
আর ক্ষমতা প্রাপ্তির ফলে অন্যায় কাজের প্রলোভন। তাই কার্তিকের শুধু সেনাপতি হিসেবেই
থাকতে হবে। স্বর্গ রক্ষা করার ভার থাকলেও নিস্পৃহ।
কিন্তু পার্বতীর তো মনে অশান্তি। তিনি ভাবছেন সুদূর বিন্ধ্যপর্বতের দেশে কার্তিক কি
শুধুই ধর্ম ও শিক্ষা বিস্তার করছেন ? নাকি গণেশের বিরুদ্ধে দল পাকাচ্ছেন। ওরকম সুন্দর শিষ্ট
ছেলে তার ওপর শিবপুত্র। জনগণের সিমপ্যাথি আছে ওর জন্য। যদি ও গণেশের বিরুদ্ধে
যায় তবে গণেশ এঁটে উঠবে না।
ফলে তিনি এক অভিনয় শুরু করলেন।কার্তিকের জন্য নাকি বুক ফেটে যাচ্ছে। বাবা গণেশ তুই
দাদাকে বুঝিয়ে নিয়ে আয়। আসলে কি একটু টিপে দিলেন যে ব্যাপার বুঝে আয় আর নিজের
ফিল্ড করার চেষ্টা কর।
গণেশ দাক্ষিনাত্যে গেল। প্রথমে কোথাও পাত্তা পেল না। এরকম কদাকার একজনকে
শিব পার্বতীর সন্তান কার্তিকের ভাই বলে কেউ মানতে চাইল না। তখন কার্তিকের
হস্তক্ষেপেই গণেশ গ্রহণযোগ্যতা পেল। যতই হোক, শিবের আপন পুত্র। তার মন অনেক উদার। ভাই
কিন্তু বশ হয়ে গেল । তবু কার্তিক কিছুতেই আর সংসারের জটিলতায় ফিরলেন না।
গণেশ কৈলাসে ফিরে সব মাকে রিপোর্ট করল।কিন্তু মায়ের মন। তাঁর মোদকপ্রিয় বইপত্র নিয়ে
মজে থাকা আলাভালা ছেলেটাকে ঠেলে ঠুলে পাঠিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু সে কাজের কাজ কতটা করল
কে জানে । ফিরে এসে আবার দাদার গুণগান করছে।
অতএব পার্বতী এবার নিজেই চললেন সরজমিন তদন্তে। তবে শিবের অজ্ঞাতে ছদ্মবেশে। মল্লিকা
নামে দক্ষিণ ভারতে গেলেন। অনার্যদের মধ্যে অনার্য নারী হিসেবে রইলেন। কিন্তু শিবের
ইনফর্মেশন সিস্টেম তো কিছু দুর্বল নয়। তার ওপর বেচারা কার্তিককে নিয়েও তিনি চিন্তায় থাকেন।
ফলে তিনিও অনার্য পুরুষ সেজে পার্বতীর পেছন নিলেন। নাম নিলেন অর্জুন। পার্বতী শিবকে
দেখেই বুঝলেন যে শিব যতই ধ্যান গাঁজা এসব নিয়ে থাকুক, সন্তানের ক্ষতি সহ্য করবেন না।
তখন একটা আপোস রফায় দুজন মিলে কার্তিকের কাছে গেলেন। কার্তিক দুজনকেই শ্রদ্ধা জানালেন। সেখানে মল্লিকার্জুন
নামে শিব পার্বতীর মন্দির হল। অনার্যরূপেই তাঁরা ওখানে পূজিত
হলেন।কিন্তু কার্তিক আর ফিরতে চাইলেন না। শিবও বললেন - ও দাক্ষিনাত্যে শিব মাহাত্য
প্রচার করুক। কৈলাসে ফেরার প্রয়োজন নেই। ওকে দক্ষিণ ভারতেই প্রয়োজন। এখানে অনেক
কিছু কাজ করবার আছে।
তাহলে এই যে আস্তে আস্তে গণেশ পুজোর ঘটাপটা এত বৃদ্ধি পেল আর কার্তিক পুজো টিমটিম করে
চলছে, এ কী বিমাতার কলকাঠির জয় আর ভোলেভালা পিতার রাজনীতি বিহীনতার পরাজয়?
( প্রত্যেকটি ঘটনা পুরাণে উল্লেখিত। ব্যাখ্যা নিজস্ব এবং পুনর্নির্মাণ মাত্র। ঈশ্বরবিশ্বাসীরা
কুপিত হবেন না। আমিও ঈশ্বর বিশ্বাসী।কিন্তু পুরাণ আমার চোখে সেযুগের উপন্যাস ছাড়া কিছুই
নয়। ঈশ্বর এসব কিছুর অনেক উর্ধ্বে। সর্বব্যাপী মহাশক্তি। সেই শক্তি ভাবার ক্ষমতা দিয়েছে
তাই ভাবি। ভাব প্রকাশের ক্ষমতা দিয়েছে তাই ভাব প্রকাশ করি)
0 মন্তব্যসমূহ