অজ্ঞাতবাস
মৎস্যদেশের
প্রকান্ড এবং অতুলনীয় সুন্দর
রাজপ্রাসাদের অনুপম অন্তঃপুরের একপাশে সুশীতল মর্মরবেদীর উপর একা বসেছিলেন
বৃহন্নলা। এই যে শক্তিশালী, সুদীর্ঘ চেহারার সঙ্গে মেয়েলি হাবভাব সাজসজ্জার
চূড়ান্ত বৈপরীত্য বহন করে করে ক্লান্ত, ভিতরে ভিতরে বিধ্বস্ত
তিনি। কেউ কী কল্পনায়ও ভাবতে পারবে এই প্রকান্ড কিম্পুরুষের সাজের আড়ালে লুকিয়ে
আছেন দ্বাপর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর,পরম সুপুরুষ অর্জুন!
তাঁকে নিয়ে নানা জল্পনা, ধারণা আছে মানুষের
মনে। নারীজাতির মন বোঝা বড়োই কঠিন। মাতৃস্থানীয়া হলেও তাঁদের আচরণে প্রেয়সীর আভাস
দেখতে পেলে তৃতীয় পান্ডব সসম্ভ্রমে এড়িয়ে যান।কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর প্রগাঢ়
রমণীপ্রীতি সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা তৈরী হয়েছে।
সত্যি কথা বলতে কি যোদ্ধার জীবনেই তিনি সবচেয়ে সহজ। সংসার
পর্ব আর সেভাবে পালন করা হলোই বা কবে! দ্রৌপদীর বরমাল্য
পাওয়ায় পরেই ঘটনাচক্রে তাঁকে ছেড়ে সুদীর্ঘকাল থাকতে হয়েছে। সেই সময়ের মধ্যে আরও
তিনটি নারীর পাণিগ্রহণ করতে হয়েছে। দুই অপরূপা, গুণবতী
নাগকন্যা উলূপী এবং মণিপুর নৃপদুহিতা চিত্রাঙ্গদা তাঁকে পতিত্বে বরণ করেছেন। যদিও
অর্জুনের ভূমিকা তাতে নামমাত্রই তবুও এই দুই নারীই তাঁকে ভালোবেসে নারীত্বের
মর্যাদা পেয়েছেন।
কালো
আগুনের মতো কৃষ্ণার ব্যক্তিত্বময় সৌন্দর্যের সঙ্গে চিত্রাঙ্গদার লাবণ্য এবং উলূপীর
স্নিগ্ধ আভিজাত্যের কোনো মিলই নেই, কাজেই তুলনার প্রশ্নই ওঠে
না। বরং অর্জুন সত্যিই মোহিত হয়েছিলেন কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রার শান্ত,কোমল,সলজ্জ রূপে।
নিজের সঙ্গে অনেক
যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত তাঁকে পাওয়ার জন্য আত্মসমর্পণ করলেন পরান সখা কৃষ্ণের কাছে।
মনের কথা জেনে সখাই পথনির্দেশ দিলেন। অতঃপর সুভদ্রা হরণ। সুভদ্রাকে নিয়ে গৃহে
প্রত্যাবর্তনের পরে পাঞ্চালীর দুর্জয় অভিমান ভাঙানো, সেও এক পর্ব গেল বটে।
কপালে দুর্ভোগ থাকলে যা
হয়! ইন্দ্রপ্রস্থে অমন চমৎকার প্রাসাদে কোথায়,সবাই মিলে সুখে
থাকবেন, তা নয় মহারাজ যুধিষ্ঠিরের আবারও পাশা খেলার ডাকে
সাড়া দিয়ে চলে গেলেন হস্তিনাপুরে।তারপর সব হারিয়ে, চূড়ান্ত
অপমানিত হয়ে, পাঞ্চালীকে নিয়ে পঞ্চপান্ডব চললেন বারো
বছরের বনবাসে। সঙ্গে উপরি পাওনা এক বছরের অজ্ঞাতবাস।
নানা
অভিজ্ঞতায় কেটে গেল বারো বছর। এবার অজ্ঞাতবাসের পালা। মৎস্য রাজ্য অতি সমৃদ্ধ,
রাজা বিরাটের আশ্রয় নেওয়াই মনস্থ করলেন যুধিষ্ঠির।
মহারাজ নিজে থাকবেন
ব্রাক্ষ্মণ কঙ্কের পরিচয়ে রাজার সভাসদ হয়ে। রন্ধনপটু ভীম বল্লভ নাম নিয়ে রাজ
পাকশালে পাচক হয়ে গেলেন। মাঝে মধ্যে মল্লযুদ্ধের কসরতেেও খুশি করলেন বিরাট
রাজকে। নকুল গ্রন্থিক নামধারী অশ্ববিশেষজ্ঞ হয়ে
রাজ অশ্বশালার দায়িত্ব পেলেন। কনিষ্ঠ পান্ডব সহদেব গো বিশেষজ্ঞ। তন্ত্রিপাল নাম
নিয়ে বিরাটের সুবিশাল গোসম্পদ দেখভালের কাজ শুরু করলেন তিনি। যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদী
রাজকন্যা। চৌষট্টি কলায় সুদক্ষা। সৈরিন্ধ্রী পরিচয়ে বিরাটমহিষী সুদেষ্ণার চুল বাঁধা,মালা গাঁথা,অনুলেপন প্রস্তুতির কাজে তিনি যোগ দিলেন।
দেবরাজ ইন্দ্রের
আহ্বানে দানব দলন করতে স্বর্গে গিয়ে থাকার সময়ে অর্জুন গন্ধর্বদের কাছে বিশেষ
মনোযোগ দিয়ে নৃত্য, গীত, বাদ্যবাদন শিখেছিলেন। তার
উপর স্বর্গবাসিনী উর্বশীকে মাতৃজ্ঞানে দেখে প্রণয়িনী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করায়
পার্থের অদৃষ্টে জুটেছিল অর্ধনারীশ্বর কিন্নর
রূপে এক বছর সময় কাটানোর বিচিত্র অভিশাপ। তাই অর্জুন নারীবেশ ধারণ করে অন্তঃপুরে
রাজকুমারীদের নৃত্য গীত শেখানো শুরু করলেন। মাথায় সুদীর্ঘ বেণী,কঙ্কণের আড়ালে কিণাঙ্কিত বাহু ঢাকা দিয়ে ফাল্গুনী বৃহন্নলা রূপে
রাজকন্যাদের কাছে সবিশেষ প্রিয় হয়ে উঠলেন নিজ গুণে।মাঝে মধ্যে তীর চালানোর ইচ্ছে
দুর্দম হয়ে ওঠে এই যা কষ্ট।
ইতিমধ্যে বিরাটরাজের লম্পট শ্যালক কীচক সৈরিন্ধ্রীকে জঘন্য
অপমান করায় ভীম তাকে এক রাতে সুকৌশলে নৃত্যশালায় আহ্বান করে এনে প্রবল মল্লযুদ্ধে
বধ করলেন। তারপরেও ভয়ানক অশান্তি। সৈরিন্ধ্রীর
মুখে তার পঞ্চ গন্ধর্ব স্বামীর কথা শুনেও কীচকের ভাইরা তাঁকে পুড়িয়ে মারার
চক্রান্ত করে নিয়ে চললেন শ্মশানে। সে যাত্রায়ও ভীম তাদের হত্যা করে রক্ষা করলেন
কৃষ্ণাকে।
কিন্তু
মহাশক্তিধর কীচকের মৃত্যু সংবাদ শুনে ওঁত পেতে থাকা শত্রুরাজ্য এল ছুটে। হাজির
হলেন ত্রিগর্ত রাজ সুশর্মা এবং তার সাহায্যকারী কৌরববাহিনী।
এসব ক্ষেত্রে যা হয়, চার পান্ডব গেলেন যুদ্ধে।
উন্মনা হয়ে রইলেন ধনঞ্জয়। তিনি রইলেন অন্দরমহলবাসিনী
হয়ে। যুদ্ধের ভেরীর আহ্বানে রক্তস্রোতে উচ্ছ্বাস জাগে তাঁর দেহে মনে। কিন্তু অসহায়।
হঠাৎই চমক কাটে বৃহন্নলার। উচ্ছ্বল নূপুর নিক্কণে
রাজকন্যা উত্তরা হেঁটে আসছেন তাঁরই দিকে। ফাল্গুনী দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে নেন। কন্যাসম
কিশোরী রাজকুমারী এসে জানালেন কৌরব সৈন্যরা বিরাটরাজের গোশালায় হানা দিয়ে হাজার
হাজার গোধন অপহরণ করছে। একমাত্র রাজপুত্র উত্তর ছাড়া কেউ নেই যুদ্ধে যাওয়ার মতো।
রাজকুমার অন্দরমহলে এসে উপযুক্ত সারথী না থাকায় যুদ্ধে যেতে পারছেন না বলে আক্ষেপ
করায় সৈরিন্ধ্রী বৃহন্নলাকে সারথী হিসেবে নিতে বলেছেন। একদিকে দ্বিধা,অন্যদিকে কর্তব্য আর যুূদ্ধের আহ্বান। শেষ পর্যন্ত রাজিই হলেন অর্জুন।
কিন্তু আসল মুশকিল বাঁধালেন স্বয়ং উত্তর।
অন্তঃপুরবাসিনী নারীদের মধ্যে যে বীরত্ব দেখানো
সহম সেটা উবে গেল সুবিশাল কৌরব সৈন্যদের ভয়ংকর চেহারা দেখেই। পলায়নপর উত্তরের
পিছুধাওয়া করে চুলের মুঠি ধরে তাকে ফিয়িয়ে নিয়ে এলেন বৃহন্নলা। তারপর রথ চালিয়ে
শ্মশানের সেই শমী গাছটির কাছে। যে গাছের ডালে তাঁদের সব অস্ত্র, শঙ্খ,কবচ রাখা আছে সযত্নে।
অবাক উত্তর কিন্তু অবিশ্বাসে জর্জরিত। তাঁরই
প্রশ্নে ধীরে ধীরে সত্যের আবরণ উন্মোচন করলেন অর্জুন। তাও উত্তরের বিশ্বাস হয়না। অর্জুনের অন্য দশটি নাম এবং তাদের অর্থ জানতে চাইলন তিনি । অর্জুন সঅর্থ বলে গেলেন নামগুলি। বিজয়-
যিনি জয়ী হন, ধনঞ্জয়- যিনি ঐশ্বর্য জয় করেন। সব্যসাচী - যার দুহাত সমান চলে। গুড়াকেশ-
যিনি নিদ্রাকে,আলস্যকে জয় করেন। শ্বেতবাহন- শ্বেত অশ্ব যাঁর
বাহন।বীভৎসু- যিনি বীভৎস কাজ করেন না।কিরীটী-ইন্দ্র প্রদত্ত মুকুট পরেন
যিনি। পার্থ- পৃথার পুত্র। ফাল্গুনী - ফাল্গুন মাসে যার জন্ম। জিষ্ণু- বিজয়ী।
ইতিমধ্যে ভীষ্ম,দ্রোণ এঁদের কানে এসেছিলঐ বিরাট বেণীবাঁধা,মেয়েলী
পোশাক পরা মানুষটিই অর্জুন এমন গুঞ্জন। কাজেই গণনা করে নির্ণয় করে দেখা গেল
অজ্ঞাতবাসের কাল শেষ হয়ে গেছে। এখন পান্ডবদের চেনা গেলেও আর বনবাসে পাঠানো যাবে না।
কবচ পরে, গান্ডীবধারী ধনঞ্জয় এবার উত্তরকে সারথি করে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে এলেন। প্রথমেই তাঁর শঙ্খ
দেবদত্তে ফুৎকার ধ্বনি করে
শত্রুদের কান ঝালাপালা করে দিলেন।
তারপর সব গুরুজনের প্রণাম আর কুশল জিজ্ঞাসা করলেন বাণের মাধ্যমে। তারপর শুরু
যুদ্ধ। তীরে তীরে নাস্তানাবুদ কৌরবদের জব্দ করার জন্য অর্জুন গান্ডীবে সংযোজন
করলেন জৃম্ভনাস্ত্র। সেই সঙ্গে করলেন শঙ্খনিনাদ। ব্যাস হাই তুলে ঘুমিয়ে পড়লেন রথী,মহারথীরা।
এবার অর্জুনের মনে
পড়ে গেল বিদায়কালে বালিকা উত্তরার সুমিষ্ট আবদারের কথা। রাজকন্যার পুতুলের জন্য
কৈরব বীরদের কাপড় নিয়ে যেতে হবে। ভীষ্ম,দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য আর অশ্বত্থামার কাছে উত্তরকে যেতে বারণ করলেন পার্থ। যদি তাঁরা ঐ
সম্মোহন নিদ্রার কোনো বিপরীত বিদ্যা জানেন এই আশঙ্কায়। কাজেই উত্তর দুর্যোধন, কর্ণ আর দুঃশাসনের
উত্তরীয় সংগ্রহ করে ফিরে এলেন। রথে উঠতে না উঠতেই ভীষ্ম অস্ত্রবষণ শুরু করে বুঝিয়ে
দিলেন অর্জুন একদম নির্ভুল ছিলেন।
এরপর বিজয় গৌরবে
অর্জুন গোধন নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন। সবাই ভাবলেন উত্তর জিতেছেন।কিন্তু রাজকুমার
বললেন এক দিব্য পুরুষ তাঁর স্বপক্ষে যুদ্ধ করে জিতিয়েছেন।
বিরাটরাজও বিজয়ী হয়ে
দেশে ফিরলেন। এরপর পান্ডবদের,প্রকৃত পরিচয় যথাসময়ে পেলেন রাজা। তিনি
কন্যা উত্তরার বিবাহপ্রস্তাব দিলেন অর্জুনের সঙ্গে। কিন্তু শিক্ষক পার্থ শিষ্যাকে
কন্যাজ্ঞান করে এসেছেন এ যাবৎ। তাই এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে প্রিয় পুত্র
সুভদ্রানন্দন অভিমন্যুর সঙ্গে
উত্তরার বিবাহের কথা বললেন। দ্রৌপদীতনয় ছাড়াও দুই স্বাধীনচেতা মায়ের তত্বাবধানে তাঁর আরও দুই পুত্র
উপযুক্ত হয়ে উঠেছেন। উলূপীর সন্তান ইরাবান আর চিত্রাঙ্গদার নয়নমণি বভ্রুবাহন। এখন
আরও পত্নীগ্রহণ তাঁকে আর শোভা দেয় না। কোথাও একটু ক্লান্তিবোধও আছে। বিরাটরাজ
সানন্দে সম্মতি দিলেন উত্তরা অভিমন্যুর বিবাহ প্রস্তাবে। রাজকন্যাও সলজ্জে রাজি
হলেন। মহা সমারোহে শুভ অনুষ্ঠান হয়ে গেল।পান্ডবরা অজ্ঞাতবাসের জীবন শেষ করলেন।শুরু
করলেন অভ্যস্ত পথে চলা। আরও এক নতুন অধ্যায় লেখা আরম্ভ করলেন স্বয়ং মহাকাল।
2 মন্তব্যসমূহ
চমৎকার ❤️
উত্তরমুছুনআহা কি সুন্দর ❤
উত্তরমুছুন