‘মন তব রহস্য অপার’। এই মন না থাকলে কি কবি কবিতা লিখতে পারতেন? ‘একটি কবিতা অর্ধেক লিখে’ তিনি উঠে পড়েন। তাঁকে বাজারেও যেতে হয়। কবিতাকে বলেন, ‘শোনো, চলো আমার সঙ্গে বাজারে’। তারপর তিনি মনকে বোঝান, তাঁকে যদি কবিতা ‘সত্যি ভালোবেসে থাকে, ঠিক ফিরে আসবে’।
অক্ষরবৃত্ত প্রকাশনা থেকে সদ্য
মুদ্রিত, প্রসিদ্ধ কবি অংশুমান করের নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘পুনরাগমনায় চ’-এর শুরু হচ্ছে
এভাবেই। মোট পঞ্চাশটি কবিতার সমাহার রয়েছে এ বইতে। #একশব্দে কবিতা শিরোনামে লিখিত কবিতাটিকে
খানিকটা পরীক্ষামূলক ভাবা যেতে পারে। অংশুমান করের কবিতার সঙ্গে যাঁরা পরিচিত তাঁরা
জানেন, তাঁর কবিতার চলন সহজ জলের মতো। আবেগী এবং মননে ভরপুর। এই গ্রন্থের কবিতাগুলিও
সেই ধারা বজায় রেখেছে। ‘জল’ কবিতার শেষে যেমন লিখছেন, ‘শুধু চোখের কোণে আটকে থাকে যে-জল/তার
কাছে মানুষ আজও অসহায়’।
একজন কবি হয়ে তিনি যা উপলব্ধি
করতে পেরেছেন, পাঠককে খানিকটা সাবধানবাণীর ঢঙে বলতে পেরেছেন সেই কথা—‘তোমার তিন আঙুলের
মধ্যে যাকে ধরে রয়েছ/সে কলম নয়, একটা রাজহাঁস, একটা উড়োজাহাজ, একটা পিস্তল’। এই কবিই
আবার লিখছেন ‘ছেলেবেলায় একটি চঞ্চল পিঁপড়েকে/বিনা দোষে মেরে ফেলার জন্য/আজ নিজেকে দোষী
মনে করে এক যুবক’। তিনি মনে করেন, ‘পৃথিবীর সব খেলনা বানানো হয় কেবল ছোটোদের জন্য/তাহলে
ভুল ভাববেন’। কারণ নিজেই জানিয়েছেন তিনি—ছোটোরা খেলনাকে মনে করে মানুষ/আর বড়োরা মানুষকে
খেলনা’। কবি কি তাই বলে বড় হবেন না? বড় হবে না এক শিশু? শোক, দুঃখ জীবনের ধারাপাত হয়ে
আসবে, যাবে।
‘তোমার ভেতরে কোনও কোনওদিন ভেসে
উঠত/এক টলটলে পুকুর/আর ছলছল করে উঠত আমাদের আঁখি’। এই অশ্রু হল নিতান্ত হাতের লেখার
জন্য শোক। ‘অভ্র আর ইমোজিতে মত্ত’ নব্য যুগের হাওয়ায় ভেসে যাওয়া হাতের লেখাগুলির উদ্দেশ্যে
এই শোক। শোক লেগে থাকে তারার গায়ে। সান্ত্বনার মতো ফুটে থাকে মৃত মানুষেরা তারা হয়ে।
সত্যি বলতে কী, ‘মানুষ জানে যে, মরে যাওয়ার পরেও তারারা আরও বেশ কিছুদিন পৃথিবীকে আলো
দিয়ে থাকে’। সত্যি বলতে কী, ‘দুঃখ আর কেউ নয়, আনন্দের রোগা ছোটো ভাই’।
তবুও শোক, দুঃখ কাটিয়ে প্রেম
আসে। ‘মূক ও বধির একটি ছেলে/ প্রেমে পড়েছে/ মূক ও বধির একটি মেয়ের’—এই দৃশ্য দেখতে
দেখতে বোঝা যায়, ‘স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেছে যে-মানুষ,/সে আসলে বাজ-পড়া তালগাছ/দাঁড়িয়ে আছে,
কিন্তু মরে গেছে’। আমরা স্বপ্ন হারাতে চাই না, প্রেম হারাতেও না। বাঁচতে বাঁচতে ‘নিচু
হয়ে কুড়িয়ে নিতে নিতে যাই’। এভাবেই একদিন হয়ত আমরা পেয়ে যাব হলদে পাখির পালক। আর সেদিনই
বুঝব ‘মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে তফাত সামান্যই’।
ছেলেবেলা বুকে পুষে রাখা কবির
ধর্ম হলে প্রকৃতি তার প্রেমিকা। দুঃখ তার বন্ধু আর একাকিত্ব তার হাতিয়ার। ‘নিঃসঙ্গ
মানুষ’ কবিতাটি মাত্র চার লাইনের। এই চারটে লাইন এখানে দিলাম-
তুমি আর কেউ নও
ভাতের হাঁড়িতে ফোটা, মাটি থেকে উঠে আসা চাল
রাঁধুনি দুঃখটি ঝানু, অল্প টিপে বুঝে যায়
প্রস্তুত হয়েছ কি না সহ্য করতে শোক, গালাগাল।
এই কবিতার কাছে বারেবারে ফিরে
যাবে পাঠক, যেন ‘একটি স্টেশন তার জন্য ফুটিয়েছে কৃষ্ণচূড়া’। অকারণ, অর্থহীন মনে হতে
পারে অন্য কারোর, কিন্তু তাতে কী আসে যায় কৃষ্ণচূড়ার, কী আসে যায় কবি/পাঠকেরই বা?
‘পুনরাগমনায় চ’ কাব্যগ্রন্থের
একেবারে শেষে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট কবিতার সমষ্টি রয়েছে। যা পড়ে আত্তীকরণের দায় পাঠকের
হাতেই ছেড়ে দিলাম। সব শেষে এই শিরোনামের কবিতার কথা বলি। ‘এতদিন জল ছিল। দেখা যেত না।/এখন
জল নেই। দেখা যাচ্ছে।/কুয়োটিকে মনে হচ্ছে লেখা ছেড়ে গেছে যাকে/সেই কবি’। ফিরে ফিরে
আসুক কবিতা, কবির জন্মান্তর হোক, প্রতিটি জীবনেই সে কবি, আদ্যন্ত কবিতার কাছে এই প্রার্থনা
থেকে যায় পাঠকের।
--------------------------------------------------
ধানসিঁড়ি প্রকাশনীর মানভূম জার্নাল পৌষালী চক্রবর্তীর লেখা এক অন্য আঙ্গিকের কাব্যগ্রন্থ। মানভূম এই বইয়ের প্রাণকেন্দ্র। ঘাটবেড়া পাহাড়, বেরসার বন, আম্রুহাঁসা নদীকে আলিঙ্গন করে ৫৭টি কবিতার সমাহার রয়েছে মানভূম জার্নালে।
‘আহ্নিক গতি ছন্দে ডেকে ওঠে তুৎ পাখি
অনাবিল মানবের ভূমে নত এই সহজ সভ্যতা’।
শালবৃক্ষের কথা শুনতে কান পাতলাম এরপর। বরং দেখে ফেললাম, আকাশে আকাশে ক্ষমা/তবু
কী সুতীব্র ফাঁস!/নিরন্ন উপবাসে দোলে/ ‘উমত শবর’-এর লাশ’।
মানুষের জন্ম হয়, দেবতারও। ‘বুড়হা-বুড়ির
পাহাড়। লল্লাট ধান্যবনে কোল পাতা ছল।/সরু দাগ শিরিঙ্গি নদীর। মুখ ঢেকে শুয়ে আছে পুরা
প্রত্নস্থল’। আর তারপরেই আবার লেখা হয়—‘কে ছিল এখানে কবে? যেন এক মৃতের নগর…ছায়া গৃহকোণ
ছিল; মায়ামৃদু বধু না কি বিনত শ্রাবক?’
কেউ যেন আমার কানে কানে বলে যায়,
‘লক্ষ্যভ্রষ্ট তির কুড়াও/ তূণীর ভরে তোলো তুমি, মেয়ে… জীবনের অনেকগুলো দিন কাটিয়ে সম্বিত
ফিরল বুঝি আমার। তূণীর ভরে তোলা হল না তো! আর কি সম্ভব? জিজ্ঞাসাই বুঝি অনন্ত এখন।
মন শান্ত হয়ে এলে দেখি, ‘শীতল মাটির ঘর, চোখপুরা কাজ/নকশী আঙিনা জুড়ে ফসলের আঁচ’। কিন্তু
সত্যিই কি দেখি ঐ দৃশ্য? আজকের শহুরে জীবনের হারিয়ে যাওয়া কল্পনার মতো তুৎ পাখি উড়া
দিয়েছে কখন! টুসুর বিলাপ ওঠে সেখানে। ধমসা ভাসান বাজায় না কেউ। করম রাত্রি জুড়ে মাদলে
মাতন ওঠে দ্রিমি দ্রিমি…
মানভূম জার্নালের কবিতাগুলি পড়তে
পড়তে আস্ত এক আদিবাসী গাঁও চোখের সামনে এসে পড়ে। শাল, মহুয়ার গন্ধ আর ধামসা, মাদলের
সুরে আচ্ছন্ন হওয়া ছাড়া পাঠকের কোনো উপায় নেই। বাতাসে বসন্তের গন্ধ লেগে আছে এখানে,
শীত যাই যাই করছে, সে বোধহয় বুঝে উঠতে পারছে না, বসন্তকে এবার জায়গা করে দিতে হবে।
এই আবহে বসন্ত যাপন কবিতার কথা উল্লেখ করতেই হয় বিশেষ করে।
‘আজকাল পলাশ ফোটার শব্দে/খুব ভয় করে।/মনে হয় প্রপাতের নীচে গিয়ে মুখ লুকাই’।
বসন্ত আসার শব্দে ভয় করার কারণ
কী? কবি বসন্তকে ভয় করেছেন, এমন কথা শুনেছি কি আমরা এর আগে? এই বসন্ত যাপন প্রকৃত পক্ষে
কবিতার থেকে বেরিয়ে আসা এক বাস্তব চিত্র। ভয়ের কারণও তাই।
‘ভীষণ ভয়ের জল না পাওয়ার কাল/আসার কথা বলাবলি হচ্ছে’।
চরম এক ধাক্কায় পাঠককে শুধু না মধুমাসকেও কবি খাদান প্রান্ত থেকে উঠে আসতে
দেখেন। ‘ছাইরং জমি তার বহুনন্দিত পঞ্ছী শাড়ি/কল্কা ওঠা নকশি পলাশ, ফ্যাকাশে সবুজ ডুরে’।
এরপর আবার সেই রুক্ষ বাস্তব-
‘বোরিং গাড়ি ঢোকে/হাঁ মুখ রক পাইথন এক;/খরা শুষে নেবে’। আর তারপরেই খনিক
বিরতি দিয়ে একটি লাইন—পোস্তবাটার মতো গাঢ় মেঘ করে উপদ্রুত অঞ্চলে’। আমি নিশ্চিত পোস্তবাটার
মতো গাঢ় মেঘ, এই উপমা একমাত্র কোনো নারীর পক্ষেই লেখা সম্ভব। কবিতার তিনটি অংশেই ছত্রে
ছত্রে বৈপরীত্য ঘন হয়ে আছে। মাদলের মাতন যখন মাথুর অভিলাষ জাগায়, তখনই ‘করুণ বিধবা
কেঁপে যাচ্ছে তীক্ষ্ণ সুরে/আদিগন্ত বাঁশি। নাচনির হাড়ে গড়া’।
ছো-নাচ পালায় দুর্গা সিং মুড়াকে দুর্গতিনাশিনী সাজে নেচে যেতে দেখি। এই
সব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় হাড়িরাম কালিন্দী আসেন। তেল হোলদার উপকথা আসে। পড়তে পড়তে মনে
হয়, সত্যিই যেন আমি বা আমাদের মতো শহরবাসী এই কবিতাগুলি পড়তে এসেছি ‘ভুল জুতো পায়ে’।
আমাদের টায়ার সোলের চপ্পল নেই, ‘আমাদের পদভার কর্কশ ও সোচ্চার’। এই অশ্রুত, অলিপিকথা
সোনার জন্য আমাদের কান প্রস্তুত নয়।
‘উড়ন্ত ধুলোর ঝড়ে
খুঁজে দেখো রামচন্দ্র-শর
সীতাকুণ্ডে ডুবে গেছে
অশ্রুত অলিপিকথা,
মানুষের ঘর’।
সবশেষে পাঠকের উদ্দেশ্যে আবার
পৌষালীর কবিতার লাইন ধরেই বলব, ‘পাথর সরিয়ে দেখো/শোনা যাবে অলিপিকাহন’। মানভূম জার্নাল
শিরোনামের কবিতাটিতে দেখি-
‘বৌয়ের মাটিমাখা হাত থেকে একে একে
ফুটে উঠছে দেওয়ালি পুতুল’। আলোর সম্ভাবনা রেখে যাচ্ছে কবিতা, আর আলো ফোটার আগে তার
প্রস্তুতি—‘কোজাগরি চাঁদের মতো ফুলে উঠবে দুধ ও রুটি’।
পৌষালীর কবিতা অনুভবের পথ আর বাস্তবকে
ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলেছে। চলতে চলতে রুখুসুখু পথের গাঢ় নির্জনতাকে আলিঙ্গন করেছে, মানুষ আর
প্রকৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে মানভূম জার্নাল। তীক্ষ্ণ ধী আর অনুভবসম্পন্ন এই কবির আগামী
লেখাগুলি আরও শ্রী ও সমৃদ্ধি পাক, এই কামনা রইল।
-----------
0 মন্তব্যসমূহ