পুতুলের বিয়ে
“সোনামণি কোথায়
গেলি মা, তাড়াতাড়ি এসে খেয়ে নে। আমাকে আবার কাজে বের হতে হবে, দেরি হলে বউদিমণি রাগ
করবে…,” মেয়ের খাবার বেড়ে রেখে নিজেও একটি থালায় ভাত আলুসেদ্ধ আর হলুদ বর্ণের একটুখানি
ট্যালটেলে ডাল নিয়ে মঞ্জুরানি খেতে বসে গেল। পাশে রাখা ছোট্ট রং চটা মোবাইলের সুইচ টিপে সময় দেখে নিজের মনেই বলে উঠল, “ইস্, আটটা পঞ্চাশ বেজে গেছে, আজও ন'টার মধ্যে ঢুকতে
পারব না, আর আজও মুখঝামটা খেতে হবে… কই রে সোনা আয় তাড়াতাড়ি, স্কুল যাওয়ার ইচ্ছে নেই না কি?”
“আসছি মা, তুমি খেয়ে নাও, আমি এই কবিতাটা শেষ করেই আসছি। স্কুলে গিয়ে পড়া দিতে না পারলে
সুপ্রীতি দিদিভাই রাগ করবেন…,” সোনামণি ঘর থেকেই পড়তে পড়তে বলে উঠল।
“আগে খেয়ে নে না, আমি খাবারটা বেড়ে ফেলেছি। আবার কিছুতে মুখ দেবে…,” খেতে খেতেই বলল মঞ্জুরানি।
“তুমি ঢাকা দিয়ে রেখে দাও, আমি পরে খেয়ে নেব…”
“উফ্, এই এক মেয়ে হয়েছে, পড়া পেলে কিছু চাই না। তুই কি বড় হয়ে মাস্টারনি হবি না কি?” মেয়ের কোনো জবাব না পেয়ে নিজের খাওয়া
শেষ করে এঁটো থালাটি কলপাড়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “তোর ভাতটা গামলা দিয়ে ঢেকে রাখলাম, খেয়ে নিস আর যাওয়ার
আগে ঘরে তালা দিয়ে চাবিটা পাশের বাড়ির কাকিমাকে দিয়ে যাস।”
“ঠিক আছে মা, আমি জানি, তুমি চিন্তা কোরো না…”
মঞ্জুর আর সময় ছিল না, থালাটি মেজে এনে রান্নাঘরের মেঝেতে উপুড় করে দিয়ে হাত মুছতে
মুছতেই চটিতে পা গলাতে লাগল, মেয়েকে আর একবার চিৎকার করে বলল, “খেয়ে নিস সময় মতো…,” বলতে বলতেই বেরিয়ে
গেল বেড়ার দরজা ঠেলে, আলগোছে সেটি ভেজিয়ে দিয়ে পা রাখল রাস্তায়।
হঠাৎ পেছন থেকে ছুটতে ছুটতে এসে সোনামণি বলল, “মা আমাকে দশ টাকা দেবে?”
“কী হবে টাকা?” মঞ্জু একটু আশ্চর্য হল, সাধারণত মেয়ে অকারণে টাকা চায় না।
“আজ রিনির জন্মদিন, স্কুল ফেরার পথে কাকিমা যেতে বলেছেন। ওর জন্য একটা চকোলেট কিনে নিয়ে
যাব মা…,” সোনামণি একটু সংকোচের সঙ্গেই জানায়।
“তাই না কি? বলিস ওকে, মা তোকে অনেক আশীর্বাদ করেছে, বড় ভালো মেয়ে…,” আঁচলের খুঁট খুলে দশটা টাকা বের করে মেয়ের হাতে দিতে দিতে বলল
মঞ্জু।
“কাকু কাকিমাও খুব ভালো মা, আমাকে খুব ভালোবাসে…,” টাকাটি নিতে নিতে বলল সোনামণি, “আজ ফিরতে আমার একটু
দেরি হবে…”
“ঠিক আছে, সময় মতো চলে যাস স্কুলে…,” বলেই পা বাড়াল রায় বাড়ির উদ্দেশ্যে।
“আচ্ছা মা…”
আর একবার মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখল মঞ্জু, ন'টা দশ বেজে গেছে, যদিও রায় বাড়ি পৌঁছতে তার দশ মিনিট মাত্র সময় লাগবে, “কিন্তু ন'টা পেরিয়ে
গেলেই বউদি খুব রাগারাগি করে…,” নিজের মনেই ভাবল সে। রায় বাড়ির ছোট বউ শহরের স্কুলে চাকরি করে, তার আট মাসের বাচ্চার দেখাশোনার দায়িত্ব মঞ্জুরানির, মাস গেলে পায় আড়াই
হাজার টাকা। বর সুবল গেছে মহারাষ্ট্রে, রাজমিস্ত্রির কাজ করতে, পুজোর সময় আসবে একেবারে। প্রতি বছরই গ্রামের অন্য আরও কয়েকজনের সঙ্গে যায়
বাড়তি কিছু রোজগারের আশায়, কয়েকবার গিয়ে একটি পাকা ঘর ও ছোট রান্নাঘরটি তুলতে পেরেছে। এবার এসে ছাদ ঢালাই করার ইচ্ছে আছে, তাই গত পুজোর পর সেই যে গেছে, আর আসেনি। স্বামী-স্ত্রীর কত স্বপ্ন, মেয়ে বড়ো হচ্ছে, এরপর ওর কথা ভাবতে হবে। সুবলের খুব ইচ্ছে মেয়ে পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হবে, বড়ো চাকরি করবে, ঠিক রায় বউদির মতো, তারপর তারা পায়ের উপর
পা তুলে দিয়ে খাবে। মঞ্জু শুনে হাসে, “মেয়ে শুধু চাকরি করলে হবে, ওর বিয়ে দিতে হবে না!”
সুবল মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, সে হবে তখন, “আগে তো ও পড়াশোনা করুক…”
“আর মেয়েটাও হয়েছে বাপের মতো নাচুনে, তবে পড়াশোনায় খুব মাথা, প্রতিবার ফার্স্ট নয়তো সেকেন্ড হয়, স্কুলের দাদাভাই-দিদিভাইরাও খুব ভালোবাসে ওকে…,” এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই আনমনা হয়ে গেছিল
মঞ্জু, সম্বিৎ ফিরে পেতেই দ্রুত পা চালাল, দেরি হয়ে গেলে বউদি বিরক্ত হয়, কাজ ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু কাজ চলে গেলে এখন হবে না, আরও কিছু বছর তাদের স্বামী-স্ত্রীকে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতে হবে, সোনামণিকে দাঁড় করাতে
হবে নিজের পায়ে…
প্রতিদিন অন্ততপক্ষে সন্ধ্যে ছ'টা পর্যন্ত তাকে থাকতে হয় ওখানে, বউদি ফিরলে তবে তার
ছুটি। দুপুর বেলা একবার খাবার ও-বাড়িতেই পেয়ে যায় সে, আর সোনামণি তো স্কুলেই
মিড-ডে মিলে ভাত খেয়ে নেয়। তাই আর দুপুরের খাবারের কথা ভাবতে হয় না তাকে। একবারে রাতে ফিরে দুটো ভাতে ভাত ফুটিয়ে নিলেই হয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যে বেলা ফিরে দেখল, সোনামণি তখনও ফেরেনি। মঞ্জু হাত-পা ধুয়ে কাপড় ছেড়ে তুলসীতলায় প্রদীপ দেখিয়ে, একফালি বারান্দায় একটি
চাটাই পেতে বসতেই লাফাতে লাফাতে সোনামণি এসে হাজির। মাকে বসে থাকতে দেখে ছুটে এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “মা আজ না খুব আনন্দ
হয়েছে, কত কিছু খাইয়েছে কাকিমা…”
“সব শুনব, আগে জামাকাপড় ছেড়ে হাত-পা ধুয়ে আয়…”
“পরে যাব, আগে তুমি দেখ, আমার কাছে কী আছে…”
“কী”
সোনামণি ব্যাগ থেকে টেনে বের করল লাল জামা পরা একটি চোখ পিটপিট করা পুতুল, “জান, কাকু দুটো পুতুল কিনে
এনেছিলেন, একইরকম, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে— একটা রিনির জন্য আর এটা আমার জন্য, আমাকে দিয়ে বললেন, আর ক'দিন পর তো তোমারও জন্মদিন, তাই আগাম উপহার দিয়ে দিলাম। ওরা খুব ভালো মা…,” আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চোখ।
“হ্যাঁ, সত্যিই ওরা খুব ভালো, যাও এবার স্কুলের জামা বদলে ফেল…”
সোনামণি বইয়ের ব্যাগ তুলে নিয়ে, পুতুল হাতে নাচতে নাচতে চলে গেল ঘরে। আর মঞ্জু ভাবতে বসল, “এবার সোনামণির জন্মদিনে একটু পায়েস রান্না
করে দিতে হবে, আর রিনিকেও ডাকতে হবে। ওরা কত কিছু খাওয়ায়, কত জিনিস দেয়, আমি তো কিছুই করতে পারি
না…”
সোনামণি আর রিনি গ্রামেরই স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। রিনির বাবা প্রকাশবাবু স্থানীয় পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার। ওর একটি বছর সাতেকের ছোটো ভাই আছে, সে গ্রামেরই প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস টু-তে পড়ে। আর ওর মা বৈশালী পঞ্চায়েত অফিসের ক্লার্ক। শিক্ষাদীক্ষা এবং আর্থিক অবস্থায় দুই পরিবারে আকাশ-পাতাল তফাত
থাকলেও ওনারা সোনামণিকে খুবই ভালোবাসেন। রিনি আর সোনামণি সেই প্রাইমারি স্কুল
থেকেই অভিন্নহৃদয় বন্ধু, পড়াশোনাতেও দু'জনেই খুবই ভালো, পালা করে এ এক বছর ও অন্য বছর ফার্স্ট অথবা সেকেন্ড
হয়। এর জন্য তাদের মধ্যে কোনো হিংসে বা বিরোধ নেই। সোনামণি অত টিউশন নিতে পারে না বলে একদিকে যেমন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিশেষ করে পড়া দেখিয়ে
দেন, অন্যদিকে রিনিও সাহায্য
করে। প্রকাশবাবুও দু’জনকেই উৎসাহ দেন ভালো করে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর
জন্য।
সব ঠিক চলছিল, সোনামণি তার স্কুল, পড়াশোনা, বন্ধু আর চোখ পিটপিট করা পুতুল নিয়ে খুব খুশি। দু'বন্ধু মিলে ঠিক করেছে
তারা তাদের পুতুলের বিয়ে দেবে। কিন্তু হঠাৎ ছন্দপতন ঘটল নির্বিঘ্নে অতিবাহিত হওয়া জীবনযাত্রায়। একদিন স্কুল থেকে ফিরে সোনামণি তার মা’কে বলল, “মা, কাল থেকে স্কুল ছুটি…”
“কেন? গরমের ছুটির তো এখনও দেরি আছে!”
“গ্রীষ্মের ছুটি না, একটা অসুখ এসেছে, করোনা তার নাম। খুব না কি ছোঁয়াচে, হলে মানুষ মরেও যাচ্ছে, তাই বড়দিভাই বললেন, আজ থেকে স্কুল ছুটি, সবাই বাড়িতে থেকে পড়াশোনা
করবে। আবার কবে স্কুল খুলবে সেটা সরকার থেকে জানিয়ে দেওয়া হবে…”
“তাই না কি? এ কেমন অসুখ, আগে তো নাম শুনিনি! অবশ্য সেদিন ও-বাড়ির বউদিও এরকমই কী যেন একটা বলছিল, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি…”
“তাই দাদাভাই-দিদিভাইরা ছুটির কিছু পড়া দিয়ে বাড়িতে পড়তে বলে দিয়েছেন, আর বলে দিয়েছেন বাড়ি
থেকে না বের হতে। যদি কোনো কারণে বের হতে হয় তাহলে নাক-মুখ ভালো করে
ঢেকে বের হতে হবে আর অন্যের থেকে ছ'ফুট দূরে থাকতে হবে।”
“কী যে সব অসুখ আসে, বুঝি না বাবা…”
পরের চার-পাঁচদিন সোনামণির কোনো মতে কেটে গেল, তবে খুবই মন খারাপ নিয়ে। স্কুল বন্ধ থাকলে তার একদম ভালো লাগে না, দাদাভাই-দিদিভাইদের থেকে পড়া বোঝা হয় না, বন্ধুদের সঙ্গে খেলা
হয় না, রিনির সঙ্গেও প্রতিদিন দেখা হয় না। কয়েকদিন বাদে দেশজুড়ে ঘোষণা হল
পূর্ণ লকডাউন। সকলের মতো মঞ্জুও খুব অবাক হল, “এ কী রোগ রে বাবা, সবাই কি সব কাজকর্ম
ফেলে ঘরে ঢুকে বসে থাকবে!”
সাত-আট দিন পর মহারাষ্ট্র থেকে ফোন এল, ওখানে সব কাজ বন্ধ, মজুরি মিলছে না, জমা টাকা থেকে কয়েকদিন চললেও বেশিদিন চলবে না, “তারপর কী হবে? ট্রেন বন্ধ, বাড়িই বা ফিরবে কীভাবে
সুবল?” মঞ্জু খুব চিন্তায় পড়ে গেল। এদিকে রায় বাড়ির বউদি জানিয়ে
দিয়েছে, “আপাতত আর কাজে আসতে হবে না মঞ্জু। এত ছোটো বাচ্চার এত কাছে তো এখন
তোমাকে আসতে দিতে পারব না, আর দূর থেকে বাচ্চার দেখাশোনা করা
যাবে না। স্কুলও এখন বন্ধ আছে, কাজেই আমি নিজেই বাচ্চার কাছে থাকতে পারব। যখন আবার সব ঠিক হয়ে যাবে, স্কুল খুলবে, তখন এস।”
বিনা মেঘে যেন বজ্রপাত হল, হঠাৎ করেই কাজটি চলে গেল, মঞ্জু পড়ল মহা আতান্তরে। সোনামণির স্কুল নেই, কাজেই মিড-ডে মিলের খাবারও নেই। তার দুপুরের খাবার রায় বাড়িতে হয়ে যেত, সেটাও বন্ধ। ওদিকে সুবলের কাজ বন্ধ, হাতে টাকা নেই, বাড়িও ফিরতে পারছে না, চিন্তায় মঞ্জুর ঘুম উড়ে গেল। কয়েকদিন পর খবর এল, বাড়ি ফিরবে বলে সুবল ও গ্রামের আরও কয়েকজন হাঁটতে
শুরু করেছে আরও অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিকের মতো।
“কোথায়, কতদূর মহারাষ্ট্র?” মঞ্জু জানে না, শুনেছে না কি অনেকদূর…
প্রায় মাসখানেক পর সুবল ফিরে এল বাড়িতে দু'পায়ে দগদগে ঘা নিয়ে। পথশ্রমে হা-ক্লান্ত, না খেতে পাওয়া কঙ্কালসার দেহ ও না-কাটা বড়ো বড়ো চুল-দাড়ি, মানুষটাকে আর চিনতে
পারা যায় না। বাবাকে দেখে সোনামণি খুব খুশি। ঘরের মানুষ ঘরে ফিরেছে, দু'দিন কাটল মঞ্জুর আনন্দে চোখের জল ফেলে। সুবল একটু সুস্থ হতেই
শুরু হল চিন্তা, “তিনটা পেট চলবে কী করে?”
“তুমি চিন্তা কোরো না, দেখি এখানেই কোনো একটা কাজ জুটিয়ে নেব…,” আশ্বাস দিতে চেষ্টা
করল সুবল। কিন্তু সুরাহা হল না, সব বন্ধ, কাজ কোথায়? পরের কয়েকটা মাস সামান্য কিছু সরকারি সাহায্য, কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের
বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে এক-আধ বেলা খেয়ে কোনোমতে দিন গুজরান হচ্ছিল? কিন্তু এভাবে কতদিন? কাজের খোঁজে বের হতে
শুরু করল সুবল ও মঞ্জু। সপ্তাহে এক-আধ দিন দিনমজুরির কাজ
পেলে নিজেকে ধন্য মনে করছিল সুবল, অন্যদিকে রায় বাড়ির কাজটি আর সহজে পাওয়া যাবে না বুঝতে পেরে, মঞ্জু গেল জমিতে অনভ্যস্ত
হাতে ধান রুইতে।
এদিকে স্কুল বন্ধ, দাদাভাই-দিদিভাইদের কাছে পড়া বুঝে নেওয়ার উপায় নেই, অনলাইন ক্লাস করার মতো ফোন বা ইন্টারনেট নেই। কারও বাড়ি যাওয়া যাচ্ছে না বলে রিনির সাহায্যও নেওয়া যাচ্ছে
না তেমনভাবে, সোনামণি ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে শুরু করল পড়াশোনায়। কিছুদিন পর মঞ্জু এসে বলল, “এখন তো তোর স্কুল নেই, সারাদিন বাড়িতেই থাকিস, আমার সঙ্গে মাঠে চল, ধান রোপণ করলে বেশ কিছু বাড়তি টাকা পাওয়া যাবে, সংসারের অবস্থা তো দেখছিস!”
মায়ের কথায় জল এল সোনামণির চোখে, কিন্তু বাড়ির অবস্থা সে জানে। অগত্যা মায়ের পিছু পিছু চলল জমিতে। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি
ফিরে ছোট্ট মেয়েটির শরীর আর চলে না, ঘুমে ঢুলে পড়ে। প্রায় দিনই মঞ্জুকে জোর করে তুলে
রাতে খাওয়াতে হয়। অনেক পড়াশোনা করে বড়ো হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর
স্বপ্ন ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যেতে থাকে সোনামণির কাছে। কখনও সুযোগ পেলে নিজের বইপত্রগুলো নাড়াচাড়া করে দেখে, চেষ্টা করে যাতে পুরোনো
পড়াগুলো ভুলে না যায়। কিন্তু চর্চার অভাবে ধুলো জমতে থাকে
এতদিনের সাধনায়। মাঝে মাঝেই মা'কে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মা স্কুল কবে খুলবে? আমি পড়াশোনা করব মা…”
কদাচিৎ রিনির সঙ্গে দেখা হলেও একই কথা দু’জনেই দু'জনকে জিজ্ঞেস করে, “স্কুল কবে খুলবে রে? আবার আমরা আগের মতো
একসঙ্গে পড়াশোনা-খেলাধুলো কবে করব?” জল আসে দু'জনেরই চোখে।
বছর ঘুরতে চলল, স্কুল খুলল না, পরীক্ষা হল না, তবে নতুন ক্লাসে উঠে গেল দু'জনেই। নতুন বই-খাতাও পেল, “কিন্তু পড়া দেখিয়ে
দেবে কে?” মন খারাপ হয়ে যায় সোনামণির। রিনি তাও কিছুটা ক্লাস করতে পারে, কিন্তু তার সে উপায়
নেই। মাঝে মাঝে রিনির কাছে দুঃখ করে, “আমার বোধ হয় আর পড়া হবে না রে, সব ভুলে যাচ্ছি যে আমি… কবে খুলবে স্কুল?” কিন্তু স্কুল আর খোলে
না…
একদিন রাতে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেল বাবা-মায়ের চাপা স্বরের আলোচনায়। আধো ঘুমে অস্পষ্ট ভাবে
কানে এসে পড়ল, “ভালো পাত্র, হাতছাড়া করা উচিত হবে না। পড়াশোনা, চাকরিবাকরি এসব আমাদের
ঘরের ছেলে-মেয়েদের জন্য না,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল মঞ্জু, “তুমি আর অমত কোরো না…”
“মেয়েটা আমার পড়ালেখায় খুব ভালো, ভেবেছিলাম অনেক পড়াব, বড়ো মানুষ হবে, সব স্বপ্ন ভেঙে গেল…,” কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল সুবলের গলা।
কেঁপে উঠল সোনামণি, উড়ে গেল তার চোখের ঘুম, ধড়মড় করে উঠে বসে, ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল, “তোমরা এসব কী বলছ? কার বিয়ে? আমি বিয়ে করব না, আমি পড়াশোনা করতে চাই, নিজের পায়ে দাঁড়াতে
চাই।”
তাকে এভাবে উঠে বসতে দেখে প্রথমে দু'জনেই হকচকিয়ে গিয়েছিল, পরে একটু সামলে নিয়ে
কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে, কিন্তু সোনামণি নাছোড়বান্দা হয়ে ধরে, “আমাকে সত্যি কথা বল
মা, তোমরা আমার বিয়ে দিয়ে
দিতে চাও? আমাকে আর পড়াবে না? আমি তোমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না…”
শেষ পর্যন্ত সুবল তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, “আমরা তোকে পড়াতেই চেয়েছিলাম মা, তুই তো জানিস। কত স্বপ্ন ছিল আমাদের! কিন্তু এখন বাড়ির অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছিস, আমার বা তোর মা কারও
কাজ নেই, সামান্য যা মজুরি পাই তাতে চলে না। তোকেও তো জমিতে যেতে হচ্ছে, এই বয়সে খেটে খেটে
হাড় কালি হয়ে যাচ্ছে। তাও যদি কোনোভাবে চলত, কিন্তু স্কুল কবে খুলবে কেউ জানে না।”
মঞ্জু সঙ্গে যোগ করে, “এরা ভালো ঘর, অল্প জমিজমা আছে, তোকে না খেয়ে থাকতে হবে না। আর আমরা কথা বলেছি, ওরা বিয়ের পরেও তোকে পড়তে বাধা দেবে না। স্কুল খুললে তখন পড়বি।”
“আমি খেতে চাইব না মা, আমি এক বেলা করে খেয়ে থাকব। তোমরা আমাকে পড়তে দাও, আমার বিয়ে দিও না…,” আছাড়িপিছাড়ি করে কাঁদতে লাগল সোনামণি।
মঞ্জু আর সুবলের চোখ দিয়েও জল গড়িয়ে পড়ল, কিন্তু তারা বড় অসহায়। একমাত্র মেয়ের চোখে অবিরল ধারায় জল পড়তে দেখে কষ্টে তাদের বুক ভেঙে গেলেও এত
বড়ো সুযোগ হাতছাড়া করা সম্ভব নয় তাদের মতো হতদরিদ্র মানুষদের পক্ষে। অভাবের সংসারে একটি পেট কমলেও অনেক সুরাহা হয়। আর সাত দিন পরে বিয়ে, সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী কোনো জমায়েত করা যাবে না
বলে বিয়ের খুব বেশি খরচ লাগছে না। সুবল-মঞ্জু লেগে পড়ল আয়োজনে। সোনামণি একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রকাশবাবুকে ধরে
পড়ল, “কাকু বাবা-মা আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে, তুমি আমাকে বাঁচাও, আমি পড়তে চাই…”
প্রকাশবাবু ছুটে এলেন, বোঝাতে চেষ্টা করলেন সোনামণির বাবা-মা'কে, “সোনামণি পড়াশোনায়
খুব ভালো, ওকে পড়তে দাও।”
সুবল প্রকাশবাবুর হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, “আমিও মেয়েটাকে পড়াতেই চেয়েছিলাম দাদা, কিন্তু জানেন তো আমাদের
এখন কী অবস্থা? তাও স্কুল খোলা থাকলে একটা কথা ছিল, তারও তো ঠিক নেই কবে খুলবে! পড়াশোনা তো এখন বন্ধই হয়ে গেছে…”
“কিন্তু এত ছোট মেয়ের বিয়ে দেওয়া উচিত নয়, ওর শরীর-মন এখনও তৈরি হয়নি। আঠেরো বছরের আগে মেয়ের
বিয়ে দিচ্ছ, জানতে পারলে পুলিশ ধরবে…”
“আমি জানি, কিন্তু পুলিশ কি খেতে না পেলে খাওয়াবে? ওর পড়াশোনার ব্যবস্থা করবে? আমি আপনাকে অনুরোধ করছি
দাদা, এই কথাটা আপনি এখন কাউকে বলবেন না, ওর বিয়েটা ভালোভাবে হয়ে যাক, এত ভালো পাত্র সহজে পাব না।”
নিরাশ হয়ে ফিরে এলেন প্রকাশবাবু! বিয়ে হয়ে গেল! পরদিন সকাল বেলায় রিনি
চুপিচুপি দেখা করতে এল সোনামণির সঙ্গে, তখন মেয়ে বিদায়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। রিনিকে দেখে অঝোরে কাঁদতে লাগল সোনামণি, রিনিরও দু'চোখ ভরে গেল
জলে। কাঁদতে কাঁদতেই সোনামণি বলল, “আমার আর পড়া হল না রে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোও
হল না,” তারপর বাক্স থেকে রিনির জন্মদিনে পাওয়া লাল জামা পরা চোখ পিটপিট করা পুতুলটি বের
করে রিনির হাতে দিয়ে বলল, “আমার মেয়েকে তুই নিয়ে যা, ভেবেছিলাম তোর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব। কিন্তু এখন আর আমি ওর বিয়ে দিতে চাই না, তুই ওকে অনেক পড়াশোনা
শেখাস…”
জলে ভেজা চোখ মেলে পুতুল হাতে নির্বাক নিশ্চল রিনি দাঁড়িয়ে রইল দোরগোড়ায়, ততক্ষণে সোনামণি পা
বাড়িয়েছে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে…
0 মন্তব্যসমূহ