সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

তৃষ্ণা বসাক

 


পাঠ প্রতিক্রিয়া

 
শ্লোক ও অন্যান্য গল্প
সেবন্তী ঘোষ
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি  ২০২২
প্রচ্ছদ যোগেন চৌধুরী
মূল্য ২৬০ টাকা
 
‘লোকের পায়ের ছাপ মেলেনি, বৃষ্টিতে কাদায় সেটা মিলতই। ডোন্ট ওরি। স্টিল দে আর ইনভেস্টিগেটিং। ... অতটা সময়... লোকটা তো তোমাকে পেয়েও কিছুই করেনি।অ্যাবসার্ড তাই না! ইফ দেয়ার ওয়াজ আ ম্যান! ইফ!’
কেউ দেখুক, না দেখুক, আমাদের জীবনে একজন না একজন অনুসরণকারী থাকেই। যেখানেই যাই, যতদূরেই যাই তারা আমাদের পেছন পেছন আসে। কুকুরের গর্তের মধ্যে যেমন নুন ঢালা হয়, তেমনই আমাদের অস্তিত্বকে গর্তে চেপে ধরে নুন ঢালে তারা। মাটি, কাদা, রক্ত, ঘাম, পুরনো মফস্বল, ছাপোষা জীবন, ভুলতে চাওয়া অতীত- সব উঠে আসে। ঘুঘুডাঙ্গার বাড়ির কুয়োর বালতির মতো তখন অতলে তলিয়ে যেতে হয়।
 
সেবন্তী কম গল্প লেখেন। গত আড়াই দশক ধরে অজস্র কবিতা লিখলেও গল্প তুলনায় কম। সেইসব গল্পের পনেরোটি নিয়ে তাঁর প্রথম গল্প সংকলন প্রকাশ পেল। সংখ্যায় কম , গুণে নয়। প্রতিটি গল্পই বিষয় ভাবনায় এবং প্রয়োগে স্বতন্ত্র।তাঁর গল্প কুয়োর বালতির মতোই, অতলে নামতে নামতে কোথায় যে হারিয়ে যায়। কেমন এক দমবন্ধ হিংসা তাঁর গল্পের আবহে। আগাথা ক্রিস্টি যেমন চরিত্রদের চাপা উত্তেজনার মধ্যে ইশারা দিতেন একটা হত্যা হতে চলেছে, সেবন্তী সেইভাবে হিংসাকে অমোঘ করে তোলেন। ‘গন্ধ’ গল্পের শুরুতেই কোলনের প্রসঙ্গ আর পোর্সেলিনের বাটিতে ডোবানো চাঁপার গন্ধে নীতা যেন তার স্বামী সিধুর পরকীয়ার নিশ্চিত প্রমাণ পেয়ে উল্লসিত হয়। নীতার এই উল্লাস আমাদের স্তব্ধ করে দেয়। আমরা বুঝতে পারি, স্বামীর অন্য নারীতে আসক্ত হওয়ায় নীতা যত না দুখী,  তার বেশি সে হিংস্র। সে আসলে একটা গন্ধ পেতে চাইছে। গল্পের শেষে আমরা বুঝি সেই গন্ধ আসলে রক্তের। যিশুর রক্তের ছিটে লাগা ওফেলিয়া আবার এক হত্যার সাক্ষী হল।
‘এত উপর থেকে সিধুর ভারি শরীরটা যদি ক্যানেলে পড়ে তার তো ভাসার কথা নয়। অগভীর জলের কাদায় গেঁথে যাবে। কৌতূহলী মাছেরা ঘিরে ধরবে। চোখের মণি ঠুকরে খাবে। অচিরেই ওই সাধের শরীর থেকে যাবতীয় সুগন্ধ উবে পচা-গলা দমবন্ধ করা গন্ধ উঠে আসার কথা। ট্রুথ আর পয়জন ঢেলেও ওই গন্ধ চাপা যাবে না’
মান্টো একবার বলেছিলেন কুৎসিত লোক আয়নার সামনে দাঁড়ালে তার প্রতিবিম্ব কুৎসিতই হবে। সাহিত্য তো সমাজের আয়না। সেবন্তীর গল্পেও এই পচা গলা সমাজের বমি উঠে আসা গন্ধ। কিন্তু ভাষার সংযমে তা একইসঙ্গে সুখপাঠ্য। এই সমাজেই হৃদয় নামের সেফটি ভাল্ভ আছে(হৃদয়)। কখনো ফেলে আসা বসন্তের স্মৃতি (মেঘলা), কখনো আবার সিরিয়া থেকে নরওয়ে –অন্তহীন সীমানা পেরোয় ছিন্নমূল মানুষ (সাইকেল), কখনো লিঙ্গসমতার ইচ্ছেপূরণের গল্প (নির্বাসন) –মাত্র পনেরোটি গল্পে বিষয় বৈচিত্রের কমতি রাখেননি সেবন্তী। শুধু কি এই সময়? ‘শ্লোক’ গল্পটি  বলে ভবিষ্যতের এক পৃথিবীর কথা, যেখানে স্বাভাবিক জন্ম আর ফুলের সুগন্ধ –দুইই আর অবশিষ্ট নেই। সেখানেই হঠাৎ ঘটে এক আশ্চর্য ঘটনা। কৃত্রিম কোষ থেকে বেড়ে ওঠা জিন মানচিত্রের ফসল এক শিশু বদলে দেয় ছক। যার চুলের রঙ, ঠোঁটের গড়ন আগে থেকেই পছন্দ করতে পেরেছিল বাবা মা, কিন্তু তার স্মৃতি থেকে ভয় রাগ ঈর্ষা কিছুতেই মুছে ফেলা যায়নি। ওসব নাকি রেসিয়াল মেমরি। ক্রমে দেখা গেল আরো কিছু থেকে গেছে বাচ্চার মধ্যে, যেসব অপশন তারা সিলেক্ট করেনি।  ‘নব দেখে দিবার জলে ঝাপসা হওয়া মুখ, গ্রীবা আর আঠালো তরলে সিক্ত ঊর্ধবাংগ। দেখে তীব্র আকাঙ্খায় দিবার নির্লিপ্ত আর কেজো মুখ জন্তুর মতো আদিম। নব উপলব্ধি করে সেই আঠেরশ নয় সালে জন্মানো চার্লস ডারুইনকে কেন একসময় মানুষেরা ঈশ্বর মনে করত! নব ভাবে ওর মনে হওয়া নামটা দিবাকে জানাবে, অন্তত অনুরোধ করবে যাতে মেয়েটির নাম শ্লোক রাখতে পারে তারা’ আবার কি তবে নতুন করে মানব সভ্যতার উষ্ণ বিনিময় শুরু হবে? অতি সামান্য উপাদানে একটি আধুনিক রূপকথা লিখেছেন সেবন্তী।
এই বইয়ের বড় সম্পদ অনিতা অগ্নিহোত্রীর একটি অসাধারণ ভূমিকা। তিনি যথার্থই লিখেছেন
‘ সেবন্তী যে প্লট তৈরি করে গল্প লিখতে বসেন না তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। শুক্রগ্রহের জ্যোৎস্নায় পথ চিনে নেওয়া তাঁর অভ্যাস। এই পথ চলায় যেমন নিখুঁত তুলির হ্রস্ব টানে ফুটে ওঠে প্রকৃতি, তেমন মানুষের মনের গভীর গোপন তিনি বিদ্যুত ঝলকে দেখিয়ে এগিয়ে চলেন। পাঠককে প্রাপ্তমনস্ক মনে করেন সেবন্তী।।’
এই প্রাপ্তমনস্ক গল্পগ্রন্থ তাই উপহার দিতে পারলেন তিনি। পাঠকের প্রত্যাশা বাড়বে নিঃসন্দেহে।

-------------------------------
 
 স্ক্রিন বেয়ে ঝরে যায় জ্বলন্ত ম্যাট্রিক্স

পার্থ উপাধ্যায়
কবিতা ক্যাম্পাস
মূল্য ৩৫ টাকা
 
‘কম লেখে। এত কম যে মাঝে মাঝে মনে হয় সে অনুপস্থিত। কিন্তু তার কবিতা একটু মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায় কবি যে জগতে কারবার করেন, তা অলমোস্ট মেডেন। কারণ এই কবির ভিতটা গড়ে উঠেছে যে পরিমণ্ডলে সেটা অসচরাচর’ কবি সম্পর্কে এই কথাগুলি বলেছেন গল্পকার সঞ্জীব নিয়োগী এবং কবিতাগুলি পাঠের পর তার সত্যতা মেনে না নিয়ে উপায় নেই।
নাট্যকার পার্থকে আমি চিনতাম। কবি পার্থ উপাধ্যায় আমার কাছে এক আবিষ্কার। কী তীব্র এবং বিস্ফোরক তাঁর কবিতা। এবং এইসব কবিতা এক নিঃশ্বাসে পড়লেও কিছু বাকি থেকে যায়। অপরাধী যেমন অপরাধস্থলে ফিরে আসে, তেমনই পাঠককে বারবার ফিরে আসতে হয় তাঁর কবিতার কাছে।
মাত্র তিন ফর্মার এই চটি বইটি যেন বসন্তের ইস্তাহারের মতো। একইসঙ্গে সংরক্ত ও উদাসীন, যৌন ইশারাময়  এবং অগ্নিস্রাবী।
‘আমি ও উড়হুল ফুল গল্প করছিলাম। নেপথ্যে হাজার শিশির ও আসক্তিময় লালমহল। আকাশ জোড়া উড়ুক্কু মাছেরা পিকক থ্রোন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আবহে ঋতুগন্ধ আর খুকুলাস্য। তোমরা সা পা টিপে গান ধরছ। স্মৃতির মধুপুর আর অথই সারল্য। বালিকা বিদ্যালয়ের ছুটির পর রাস্তায় দশমহাবিদ্যা। জড়ানো উলের গোলা নিয়ে খেলেই যাচ্ছে পমপম। মাইকে হেঁকে গত শতাব্দীর গহরজান ছড়াচ্ছে দামড়া ছেলে’
( বসন্তের অগ্নিপত্রমালা-১)
পার্থ-র কবিতার শরীরে তুমুল নাগরিক নখরা এবং হাইওয়ের যাত্রাপথ-
হে নাগরী দেখ মায়াপথ পাতা
এই ময়লা শহরের পাতায় পাতায়।
রহস্য উপন্যাসের মতো লাগে এই জাগরণ গান, বায়ু
স্বাস্থ্য ও উত্থান-উতরোল এই কোলাহল।
...
আবরণহীন ও সত্য এই গ্রাফিত্তি, ট্রেমেলো ও ঝঙ্কার শিহর-
দেখ এই রাধালিপি, বাৎসল্য ও মায়াময় চলাফেরা।
ঈষৎ অন্ধকারে সরে যাওয়া-
এই আঘ্রাণ।
(হাইওয়ের কবিতা-৫)
একটি অনুযোগ। এই কবিতাগ্রন্থের জন্যে ভালো কোন নাম কি খুঁজে পেলেন না কবি? প্রচ্ছদটিই বা এত চিৎকৃত কেন?
 
পান্তাভাতের জলসাঘর
বিজয় দাস
কলিখাতা
মূল্য ৫০ টাকা

চল্লিশ পাতার ক্ষীণ তনু কবিতার বইটি তিনটি পর্বে ভাগ করা।
-শিব না শব
- শংখের আর্তনাদ
এবং –ধর্ষকচরিত
প্রতিটা পর্বের কবিতার কোন আলাদা শিরোনাম নেই, কেবল ক্রমিক সংখ্যা। তরুণ কবি বিজয়ের কবিতায় ছাপ ফেলেছে সমকালের আকাঁড়া বাস্তবতা।  হিংসা, শোষণের এই বিশ্বে কবির প্রতিবাদ শংখের আর্তনাদের মতো। এই পর্বে এক লাইনের কবিতাগুলি চিন্তা উশকে দেয়।
শহর যখন বদলের সমীক্ষা চায় বেশ্যারাও আততায়ী হয়ে ওঠে
মৃত্যু ক্যানভাসে একটি রঙ্গিন বিন্দু
আমি কাঠঠোকরা হলে তুমি জলরঙা মাছ
১৪
বন্দুকের নল শক্তির উৎস হলে বিপ্লব অপ্রাসঙ্গিক
 
ধর্ষকচরিতের একটি কবিতায়
যুদ্ধের প্রস্তুতি শেষে –
ভালভাবে কুলকুচি করেও দাঁতের গর্ত থেকে একটুকরো
মাংস বার করা গেলনা। পিন দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে
তুললাম- পাকস্থলী, হৃৎপিণ্ড, মাথার ঘিলু। দুধেলা হরমোন
মাদকতা ছড়িয়ে দিল।
 
বিজয়ের কবিতায় বারবার এসেছে মহাভারতের প্রসঙ্গ। যদিও সেসব সবসময় সুপ্রযোজ্য হয়নি। বিজয়ের কবিতায় দার্ঢ্য আছে, অনুভব আছে কিন্তু  তাঁকে আরো পথ চলতে হবে।
পান্তাভাতের জলসাঘর-এমন একটা অসহ্য খারাপ নাম কেন যে দিলেন কবি! প্রচ্ছদও খুব সাধারণ।  

 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ