পর্ব -- ৬
কিভাবে বুঝবেন আপনি ডিপ্রেশনের পথে পা বাড়িয়েছেন --
আপনি কি আদৌ ডিপ্রেশনের পথে পা বাড়িয়েছেন?খেয়াল করে দেখুন তো
এই ভাবনাগুলো বা লক্ষণগুলো কি আপনার মধ্যে আছে? যেমন --
বৈরাগ্যভাব, একাকীত্ব, প্রচণ্ড রাগ, মনে পড়ে না শেষ কবে খুশি
হয়েছিলেন। এছাড়াও স্নান, খাওয়ার মতো রোজকার কাজ করতেও অনীহা হয়। নিজেকে ঘৃণা করা,
সেই থেকে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ভাবনা। সারাদিন মাথা যন্ত্রণা করা।
বিষণ্ণতার কারণে মনের মধ্যে কিছু অনুভূতির সৃষ্টি হয়। যেমন --
(১) হতাশা বোধ হয়। মনে হয় যে সামনে ভালো কিছু নেই।
( ২) নিজের সব কিছু নেতিবাচক মনে হতে পারে। তার দ্বারা ভালো
কিছু হবেনা মনে হয়। অর্থাৎ আত্মবিশ্বাস কমে যায়। আর এসব তার দৈনন্দিন জীবনাচরণে
প্রভাব ফেলে।
এর বাইরেও কিন্তু কিছু লক্ষ্মণ পরিলক্ষিত হয় । যেমন --
(১) নানা ধরণের শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয় ।
(২) হাত পা জ্বালা করে , কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হওয়ার অনুভূতি
কিংবা ভীষণ মাথা ধরা এবং কোষ্ঠকাঠিন্য।
আসলে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে জীবন ধারণ বোধটাই কঠিন হয়ে যেতে
থাকে যেটি নির্দিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি করে।
ডিপ্রেশনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। ডিপ্রেশন
থেকে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অনিদ্রা, ব্লাডপ্রেসার, ক্যানসারসহ বহু জটিল রোগ
দেখা দিচ্ছে সঙ্গে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে যাচ্ছে। ডিপ্রেশন থেকে যেমন মারাত্মক
ধরণের অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে তেমনই নানা রকম অনৈতিক কাজও চলছে। আরেকটা বিষয় বিশেষ
ভাবে উল্লেখযোগ্য, তা হল নেশার যে এত রমরমা অবস্থা তার কারণও ডিপ্রেশন।
ডিপ্রেশনে আক্রান্ত কিনা বুঝতে হলে বেশি কিছু করার দরকার নেই
শুধুমাত্র নিচের কয়েকটি বিষয়ের উপর লক্ষ্য রাখলেই দেখা যাবে, ডিপ্রেশন কীভাবে
সর্বব্যাপী হয়ে গেছে , নিজের অজান্তেই ।
(১) দিনের বেশিরভাগ সময় মন খারাপ থাকে ।
(২) যেসব কাজে আগে মনের মধ্যে আনন্দ জাগত, সেসব কাজে আনন্দ ও
আগ্রহ কমে আসে ।
(৩) নিজেকে নিয়ে নেগেটিভ চিন্তা করা বা নিজেকে দায়ী মনে হওয়া
সবকিছুতে ।
(৪) সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া ।
কোনো কিছু ঘটনা বা ভাবনার কারণেই সেইসব মানুষের মধ্যে
বিভিন্ন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে। জীবনের প্রতি ঘৃণা বা উদাসীনতার জন্ম
নেয়। মনে হয় অনেক কিছু পাওয়ার ছিল, করার ছিল, কিন্তু হল না। অতএব এই জীবনটা
অর্থহীন। একে বয়ে নিয়ে যেতে হবে, কিন্তু আর কত দিন?
কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় এই খুব খুশি কখনও উদাসী।
সকালে ভালো বিকালে খারাপ। আজ বেশ আনন্দে আছে কাল মানসিক যন্ত্রনায় গুমরে মরছে।
জীবনটাকে ভালোভাবে উপলব্ধি করতেই পারে না। কখনও ভাবে এই জীবনটা জীবন নয়। কখনও ভাবে
এইতো বেশ আছি, ভালো আছি।
কিছু
কেউ বললে যদি সেটি ভালো বলে তো ঠিক আছে কিন্তু বিরূপ সমালোচনা করলে সে এতোটাই রেগে
যায় যে খুব তাড়াতাড়ি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
কেউ অন্ধকারকে ভয় পায়, কারো আবার কোনো জন্তু, পোকা, জল ,
আগুনের ভয় বা অজানা আতঙ্ক। বার বার হাত-পা ধোওয়া, স্নান করা, ঘ্যান ঘ্যান
করা ইত্যাদি।
আবার কারো মধ্যে দেখা যায় অহেতুক চিন্তা ও উত্তেজনা,
একটুতেই ঘাবড়ে যাওয়া, আবার একটুতেই ভেঙে পড়া।
কেউ আবার কাজে ও চিন্তায় ধীরগতি হয়ে যায়। কাজ করার ইচ্ছা হয়
না। উৎসাহের অভাবে অল্প বয়সেই ক্লান্তি অনুভব করে। কাজ করার ক্ষমতা আছে কিন্তু
ইচ্ছার অভাবে কিছুই করতে চায় না। অলসতা যেন গ্রাস করে ফেলেছে। এমনকি খেলাধুলা বা
পড়শোনার ক্ষেত্রেও উৎসাহের অভাব হলে বুঝতে হবে ডিপ্রেশন হয়ে আছে।
এসব ছাড়াও আরো যেসব বৈশিষ্ট্য দেখা যায়
যেমন ---
(১) ময়লা পোশাকেই থাকতে চায়, স্নান করতে চায় না।
(২) অনেকের ক্ষেত্রে খাবারের স্বাদে পরিবর্তন হয়। ফলে খাবার
বেড়েও যেতে পারে , তেমনি আবার কমেও যেতে পারে কিন্তু সব মিলিয়ে শরীরের ওজন কমে
যায় অনেকের ক্ষেত্রে। কেউ মোটা হয়ে যায়।
(৩) ঘুমের ব্যাপারেও অনিয়ম । কখনও কম ঘুমায়, কখনও সবসময় শুয়ে
থাকতে ভালোবাসে।
আবার দেখা যাচ্ছে ঘুম হচ্ছে কিন্তু ঘুম থেকে যে শক্তি আসার কথা
শরীরে তা না এসে উল্টো ক্লান্তি অনুভূত হচ্ছে। সেটিও বিষণ্ণতার লক্ষ্মণ হতে পারে।
(৪) হরমোন চেঞ্জ। হরমোনের পরিবর্তন হতে থাকলে ডিপ্রেশন
আসে। বয়ঃসন্ধিকালে এই ধরনের অবস্থা লক্ষ করা যায়।
(৫) নানা চাহিদা। চাহিদার শেষ নেই। একটা পেলে আর একটা
চায়। কখনও একটাতে বা একটুতে সন্তুষ্ট নয়। বার বার বিভিন্ন ধরনের আবদার বা বায়না
করতে থাকে।
(৬) ক্রোধ বা রাগ খুব । যে ধরনের বিচার বা চিন্তা চলবে তা যদি
নেগেটিভ হয় তাহলে ক্রোধ জন্ম নেয়। অনেকে বলেন, ক্রোধ ছাড়া চলে না। এটা ভুল। ক্রোধ
শুধু ক্রোধ নয় , এ যেমন নিজেকে জ্বালায় , আবার অন্যকেও জ্বালায়। ফলে , ক্রোধ
প্রশমিত হলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। ডিপ্রেশনের শিকার হতে হয়।
(৭) ইমোশনাল হওয়া ভালো কিন্তু অতি ইমোশনাল ভালো নয়। এ হল
ডিপ্রেশনের লক্ষণ। ইমোশনাল ব্যক্তি বার বার চেষ্টা করে অন্যকে আকর্ষিত করতে। যখন
পারে না বা নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে যখন ব্যর্থ হয় তখন ডিপ্রেশনে
আক্রান্ত হয়ে যায়।
(৮) আত্মহত্যা হল মানসিক ব্যাধি যা ডিপ্রেশন থেকে জন্ম নেয়।
ডিপ্রেশনের শেষ অবস্থায় পৌছালেই আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত হয়।
ছেলে-মেয়ে, ছাত্র-ছাত্রী, শিশু থেকে বয়স্ক সবাই ডিপ্রেশনের
শিকার হয়ে থাকে।
ডিপ্রেশনের জন্য আমরাই দায়ী। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যেমন মা-বাবা
দায়ী, যুবক-যুবতীদের ক্ষেত্রে তারা নিজেরাই দায়ী, বয়স্কদের ক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজ
দায়ী। সব কথার শেষ কথা হল ডিপ্রেশন যেহেতু মানসিক রোগ সেহেতু ওই রোগের আক্রমণকে
অনুভব করে, নিজেই নিজের শিক্ষক হতে পারলে বহুলাংশে উপকৃত হওয়া যায়। এছাড়া মনের
একাগ্রতা দ্বারা ডিপ্রেশন কেন হচ্ছে যদি বোঝা যায় , মনকে রিড করতে পারলে
ডিপ্রেশনের কারণও জানা যাবে।
এই জন্যে মেডিটেশন ভীষণ জরুরী, তেমনি একা সম্ভব না হলে
ভালো ডাক্তারের সুপরামর্শ তাড়াতাড়ি সেরে উঠতে সাহায্য করে। তবে অনুসন্ধানে জানা
গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেকে নিজে লুকানোর বা ঠকানোর চেষ্টা করলে পরবর্তী কালে
তা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। তখন কাউন্সেলিং বা স্টেপ বাই স্টেপ ট্রিটমেন্ট, নিয়মিত
ব্যায়াম ও রাজযোগ মেডিটেশন অভ্যাস করলে এবং মনকে পরিবর্তন করার পদ্ধতি জানা থাকলে
ডিপ্রেশন সহজেই দূর করা যায়। অন্যথা শেষের সেদিন বড়োই ভয়ঙ্কর হবে।
পর্ব -- (৭)
ডিপ্রেশন কাটাতে প্রাণ খুলে
কাঁদুন
আমরা যখন কাঁদি তখন আমাদের চোখ থেকে জল পড়ে। এই চোখের জলের
কোনও রঙ নেই। এই কান্না দেখতে একই রকম হলেও , কান্না দু'রকমের এবং এর কাজও দু'
রকমের। আবেগের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশের একটি হচ্ছে চোখের জল , আর স্বাভাবিক ভাবে
সেটাই হওয়া উচিত। আনন্দের আতিশয্যে কিংবা গভীর শোকে চোখ থেকে বেরিয়ে আসে লোনা জল।
এরপরই শরীর আর মনটা কিছুটা যেন হালকা হয়।
পেঁয়াজ কাটতে গিয়েও আমাদের চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসে, এই
চোখের জল কিন্তু আলাদা।
পেঁয়াজ কাটার সময় চোখের যে জল বের হয়, তা কিন্তু আবেগে
কান্নাকাটি করার সময়ের যে চোখের জল তার তুলনায় একেবারেই আলাদা।
পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি কান্নাকাটি করেন। এর কারণ পুরুষ
মানুষের মানসিক গঠন। আবেগাপ্লুত হলেও, তাদের চোখে সহজে জল আসে না। বরং, সে
বহিঃপ্রকাশটা অনেক সময় রাগের মাধ্যমে ঘটে। কারণ, তারা ভেতরের অনুভূতি প্রকাশে
নারীদের মতো সাবলীল নন। তবে মাঝে-মাঝে পুরুষদেরও উচিত ভেতরের এই আবেগকে বা কষ্ট-
যন্ত্রণাকে চোখের জলের মাধ্যমে একটু হালকা করে নিতে ।
সদ্যজাত কোনও শিশু কাঁদলেও তার চোখে তেমন কোনো জল থাকে না। এর
কারণ, ভূমিষ্ঠ হওয়ার এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত নবজাতকের চোখে অশ্রুবিন্দুর মৌলিক
গঠনটি সম্পন্ন হয় না।
সবচেয়ে মজার তথ্যটি হচ্ছে, যখন
কেউ কাঁদেন তখন তার চোখ দিয়ে যে জল পড়ে সেই জল প্রথম ডান চোখ থেকেই গড়িয়ে পড়ে।
গবেষকরা এখনও পর্যন্ত এর কোনও যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে পান নি।
একজন ডাচ গবেষক সমীক্ষা করে
দেখেছেন, পাশ্চাত্য দেশগুলো, যেখানে মহিলারা সমাজের উঁচু তলায় বাস করেন এবং যাদের
মানবাধিকার তৃতীয় বিশ্বের দেশে বসবাসকারী মহিলাদের তুলনায় অনেক বেশি, তারাও কিন্তু
আবেগে বা কষ্টে চোখের জল ফেলেন।
কান্না তিন রকমের হয়।
বেসাল টিয়ার : যেটা আপনার চোখকে পরিষ্কার রাখে এবং চোখের
লুব্রিকেশনের মাত্রা ঠিক রাখে।
রিফ্লেক্স টিয়ার : পেঁয়াজ কাটার সময় বা চোখে কিছু একটা হঠাত্
ঢুকলে এই কান্না বের হয়।
ইমোশনাল টিয়ার : মানুষ যখন আবেগে কাঁদে।
গবেষণায় দেখা যায়, কিছু মানুষ স্বাভাবিক কারণেই অন্যদের তুলনায়
বেশি কাঁদেন।
অনেক সময় স্নায়বিক কারণে কান্না বা হাসি থামতে চায় না। যদি
এমনটা হয়, তবে চিকিত্সকের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। এটা স্ট্রোক,
অ্যালঝাইমার্স, মাল্টিপল সেক্লরোসিসের লক্ষণ হতে পারে। আমরা অনেক সময় অনেককেই
দেখেছি কথায় কথায় কেঁদে ফেলেন। আবার অনেকেই আছেন কান্না কিছুতেই থামাতে পারেন না।
আবার অনেকেই আছেন কাঁদতে পারেন না। সমস্ত যন্ত্রণা বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে
থাকে। কেমন দমবন্ধ লাগে নিজের কাছে নিজেকেই।
তবে কষ্ট বা মন খারাপকে বুকের মধ্যে চেপে রাখার চেয়ে কেঁদে
হালকা হয়ে যাওয়া উচিত।
কাঁদলে স্ট্রেস হরমোন শরীর থেকে বেরিয়ে যায় এবং এন্ডরফিন বা
যেটাকে 'ফিল গুড' হরমোন বলা হয় তা শরীরে নির্গত হয়। এ জন্যই বোধ হয় বলে , কাঁদলে
মন অনেক হাল্কা থাকে। এখন তো লাফিং ক্লাবের পাশাপাশি উইপিং ক্লাবও হচ্ছে।
যেখানে আপনি বিজ্ঞানসম্মতভাবেও কাঁদতে পারবেন।
তবে এপ্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, পুরো
জীবনটা শুধু সুখেই কেটে যাবে , এই ভাবনাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। ছোটখাটো
দুঃখ-কষ্ট জীবনে আসবেই, হতাশাও আসবে । আর এরই নাম জীবন।
অবসাদ কাটাতে নিজেকে একা ভাবা বন্ধ করুন।
আমাকে কেউ ভালবাসে না, কেউ আমায় বোঝে না, এই চিন্তাটা
মারাত্মক। আপনিই আপনার সব থেকে ভাল বন্ধু। মানুষ নিজেকেই সব থেকে বেশি ভালবাসে।
তাই কে ভালবাসল, কে বাসল না, ডোন্ট কেয়ার।
আর বিচ্ছেদ বা ব্রেক-আপকে মেনে নিতে চেষ্টা করুন। সময় নিন, বদল
আনুন রোজকার রুটিন। যেটা পেলেন না তার কথা না ভেবে যা পেয়েছেন তাই নিয়ে ভাবুন।
সারাদিনে নিজের জন্য একটু সময় রাখুন। ওই সময়টা শুধু আপনার। ওই
সময় আপনার যেটা করতে ভাল লাগে সেটাই করুন। নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
0 মন্তব্যসমূহ