বিষপাড়ার হাঁড়িকথা: সম্পাদনা :অঞ্জন দাস ও বিপ্লব ভূঞ্যা
সংকলনে আছেন সত্তর দশক থেকে এক দশকের কবিরাও। বহু খ্যাত থেকে অল্প
খ্যাত এবং অখ্যাতরাও। কবিদের নির্বাচনেও নিশ্চয়ই একটা রুচির বার্তা দিয়েছেন
সম্পাদকদ্বয়। গ্রন্থের পরিচিতি অংশে এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন :"তবু কিছু
অক্সিজেন তুমুল মহামারী তুচ্ছ করে ক্রমশ জমাট বাঁধে আমাদের একান্নবর্তী কবিতার
সংসারে। চাঁছা জীবনের ফিলোসফি কিছু মন্থন নিয়ে আমাদের ছোট্ট পরিসরে সময় ধরতে
চাই। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই 'বিষপাড়ার হাঁড়িকথা'য়
সাত থেকে এক দশকের কলমে কলমে আমাদের আগ্রহ সাজিয়েছি। সমস্ত ঈগল আজ আমাদের বুকের
কাছাকাছি থাকে। কাউকে ধরেছি, আমাদের সীমিত সাধ্যের জন্য। অনেকে বাকি থেকে
গেলেন।" এই অংশটুকুতে দুটি বাক্যাংশ আমাদের মারাত্মকভাবে স্ট্রাইক করে তা হল
"চাঁছা জীবনের ফিলোসফি" এবং "সমস্ত ঈগল আজ"। 'চাঁছা' শব্দের
অর্থ: ছাল ছাড়ানো; উপরের অংশ ঘষে ঘষে তুলে ফেলা। এই করোনা মুহূর্তে আমাদের অনেক
কামনা-বাসনা, স্বপ্নকে চেঁছে ফেলা হয়েছে। জীবনকে ত্যাগ-তিতিক্ষার মায়াহীন
নির্বেদে উজ্জ্বল করা হয়েছে। অনেকটা গৌরবের মালিন্য, চাহিদার বর্জন করা মনোভাবে
যে কাব্যবোধের ইশতেহার কবিতা রচনা করেছেন তাতে যে ছলনা নেই, সত্যান্বেষণের বার্তা
আছে। জীবনের ঘনিষ্ট তাপের প্রতিফলন আছে তা বলাই বাহুল্য। দ্বিতীয় বাক্যাংশে
"সমস্ত ঈগল আজ" কথাটিতে স্রষ্টার সেনসিটিভনেস্ অর্থাৎ শোষণ ক্ষমতা, ধারণ
ক্ষমতা, অনুধাবন ও অনুভাবন করার বোধকেই বোঝানো হয়েছে। শব্দশিকারি সেই ঈগল কবিই
তো!
এই
'চাঁছা' ও 'ঈগল' এর সপক্ষে আমরা দু'জন বিখ্যাত মানুষের দুটি কথা শুনে নিই:
১, প্লেটো:
"Poetry is nearer to vital truth than history." কবিতা ইতিহাসের চেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ সত্যের কাছাকাছি।
২, স্যামুয়েল
বেকেট:"Poets are the sense, philosophers the intelligence of
humanity." কবিরা হলেন মানবিক বোধসম্পন্ন জ্ঞানী ও দার্শনিক।
তখন
আর সন্দেহ থাকে না তরুণ সম্পাদকদ্বয়ের বিচক্ষণতা সম্পর্কেও। কবিদের তালিকায় যাঁরা
আছেন এবং তাঁদের লিখিত কবিতাটি যে উপরোক্ত কথার সমর্থনে কার্যকরী তা যেকোনো
পাঠকেরই প্রতীতি জন্মাবে।কাব্যের যেকোনো পৃষ্ঠা খুলুন। যেকোনো কবির কবিতাটি পড়ুন।
কাব্যের শেষের কবিতাটি লিখেছেন মেহেবুব গায়েন। তাঁর কবিতাটির কিছু অংশ দেখা যাক:
"আজ চুয়াল্লিশ
পেরিয়ে
রাধাকৃষ্ণের রঙ
খেলছিলাম অঞ্জনের সঙ্গে,
হলুদ পলিথিন
মোড়া আবির
দুই গালে ছুঁয়ে
দিল মেহবুব,
আমি আটের অপুতে
ফিরছিলাম,
সকাল ম্যাজেন্টায়
বন্ধুরা খেলছিল রঙ,
এক উপন্যাস চোখ
মেলে আমি আড়ালে ওদের ফেলা রঙ কুড়িয়ে
আনন্দ
মাখলাম,"(দোলনা বেয়ে কাঁচা রোদ)
কবিতার
প্রথমে কবির বয়স, তারপর রাধাকৃষ্ণের রঙের উল্লেখ। খেলার সঙ্গীটি অঞ্জন। পলিথিনের
প্যাকেট মোড়া আবির। নিজের গালে নিজেই আবির লাগিয়ে 'মেহবুব'কে ভাগ করে দিলেন দুই
সত্তায়। এক মেহবুব 'আটের অপু'। আর এক মেহবুব চুয়াল্লিশের যুবক। পথের পাঁচালির সেই
অপু। তার পুরো উপন্যাসের চরিত্রেই নিজে প্রবেশ করলেন। আর রঙ কুড়িয়ে নিয়ে আনন্দ
মাখলেন। নিজের জীবনের এই আচরণে যে stream of consciousness এর রূপান্তরের ব্যাপ্তি
এবং সত্যতার উপলব্ধিকে ধারণ করে কবি যে অনুভূতির প্রকাশ ঘটালেন তা ছলনাহীন ,সে তো
মানবিক প্রজ্ঞাই তা না বললেও চলে।
কাব্যের
মাঝখানে আছে অরুণ ভট্টাচার্যের কবিতা 'জন্মদিন'। তার কিছুটা অংশ এরকম:
"এবারেও
এসেছিল জন্মদিন অস্ফুট শব্দে মালগাড়ির মত, তখনও আমি স্টেশনে দাঁড়িয়ে।
ধূসর খয়েরি তার
শরীর ধুলোমাখা পৌষের মত।"
তিনটি
অসম পংক্তিতে অরুণ ভট্টাচার্য জন্মদিনকে উপলব্ধি করেছেন। জন্মদিন তো মালগাড়ি।
তিনি এই দিনটিকে স্টেশন মনে করে অপেক্ষা করেন। কীসের অপেক্ষা? অপেক্ষা তো চলে
যাবার। একটা জীবনকে কালের স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার। প্রতিমুহূর্তে জীবন বিপন্ন,
রঙচটা ধূসর খয়েরি হয়ে চলেছে। জৌলুসহীন এই রুপটিই কবি বোধ করেছেন। কবিতা যা নয়
তাকে মিথ্যার কফিন দিয়ে ঢাকা যায় না। এ কবি সেটাই দেখালেন।
কাব্যের
প্রথমেই আছে শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা 'সাঁকো'। কবিতার প্রথম অংশটি এরকম:
"সন্ধ্যার
কাছে যেমন এলাম, তেমনি
আরতির কাছে আসতেও
ভুলিনি।
মহাদেশ পেরিয়ে
এই ছায়া-ছায়া বাংলায়
আসতে খুব কষ্ট
হয়েছে।
একটার পর একটা
শহর লাফ দিয়েছি, আর
হাঁটু খুলে পড়ে
গেছে রাস্তায়, ধড়ফড় করেছে বুক,
স্রোতের ভারে
চমকে উঠেছে ছবির মতো একেকটা নদী,
একেকটা জঙ্গল
হতভম্ব,
তবু অতিক্রমের
খামতি নেই।"
জীবনের
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে করতে আমরা জীবনের সন্ধ্যায় এসে পৌঁছাই। সন্ধ্যার ভয় থেকেই
আসি ঈশ্বরের কাছে। কত মানুষ জীবনের সঙ্গে যুক্ত তারা সবাই মহাদেশের মতো। তাদের
অভিব্যক্তি বা সংযোগ মাধ্যমও বিচিত্র। কিন্তু একান্ত নিজের কাছে যখন ফিরে আসি, তখন
তো নিজেরই আচার, নিজের সংস্কৃতি, নিজেরই বাংলা। ক্লান্ত বিপন্ন জীবনের ভার বইতে
বইতে অবসন্নও। কয়েকটি প্রতীক: হাঁটু খুলে পড়া, ধড়ফড় বুক। এক একটা মুহূর্ত ছবির
নদীর মতো তবু ভয়ঙ্কর। 'জঙ্গল' জটিল জীবনযাপনের বাধার সংকেত যার পরিণতি হতভম্বও।
অবশেষে
সন্ধ্যা
আর
আরতি।
আরতি
আর সন্ধ্যা।
জীবন এবং ঈশ্বরের
মাঝে সাঁকো। কবি যে সত্যিই তাঁর বোধকে এভাবে ব্যাখ্যা করলেন তার মাঝখানে কি ছলনা
আছে? না, নেই বলেই জীবনের উষ্ণতা, শূন্যতা, দীর্ণতা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
কাব্যের
প্রতিটি কবিতাতেই আছে জীবনের এই অমোঘ বার্তা। কবিদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের সন্নিবেশ
এবং শৈল্পিক সিদ্ধির পরিচয়। আছেন মৃদুল দাশগুপ্ত, শঙ্কর চক্রবর্তী, সুধীর দত্ত,
রাহুল পুরকায়স্থ, মলয় গোস্বামীর মতো কবিরা। আছেন বিকাশ গায়েন, মাসুদুল হক,
নন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শঙ্খশুভ্র পাত্র, দুঃখানন্দ মণ্ডল, বেবী সাউ, নিলুফা
জামান, রাজেশ্বরী ষড়ঙ্গী, মলয় পাহাড়ি, খুকু ভূঞ্যা, অতনু রায়, তনুশ্রী
কার্তিকের মতো কবিরাও। পরান মণ্ডল, রিমি দে, ঋত্বিক ত্রিপাঠী, তাপস বৈদ্য, সুমন
মল্লিক আরও বহু কবি। আমি না ভালোলাগা কোনো কবিতা খুঁজে পাইনি। সংকলনটি সকলেরই
আগ্রহ বাড়াবে। বাংলা কবিতা পাঠকের কাছে এ এক অনন্য উপহার।
---------------------------------------------------------------
#বিষপাড়ার হাঁড়িকথা: সম্পাদনা :অঞ্জন দাস ও
বিপ্লব ভূঞ্যা, প্রকাশক শব্দরঙ, কাঁথি, পূর্ব মেদিনীপুর, মূল্য:২০০ টাকা।
0 মন্তব্যসমূহ