সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

মন্দিরা ঘোষ

 

ঈশ্বর 



১.

 

ষোলো বছরের সদ্য বিধবা

আশ্বিনের পাকাধানের গায়ের রং

চার ক্লাস বিদ্যের গনগনে আঁচ শরীরে 

 

নবাব বললেন, 'এ বিধবার গায়ে 

সাদা থান!নিরামিষ আলোচাল!

নৈব নৈব চ!এ অনাচার সইবো না।

প্রাসাদে নিয়ে এসো। 

গঙ্গার তীর মিথ্যেই সেজে উঠলো

চিতার আগুনে 

লাল হয়ে উঠলো রাতের আকাশ।

নবাবের আদেশে রটে গেল যুবতী বিধবার জহরব্রতে অগ্নিপ্রবেশ।

 

ঈশ্বর অস্থির  হয়ে উঠলেন 

 

২.

রাজপথে ল্যান্ডো,ব্রুয়াম, অস্টিন

রাতভর ফিটন গাড়ির খটখট  শব্দ

আর্মানি গির্জার ঢংঢং  ঘন্টাধ্বনি। 

হরিনাম।খোল করতাল।

না,এ যাত্রায় সহমরণ হয় নি।

তাতে কী!কাশীধাম আছে!

 বাঙালি বেধবার একচেটিয়া  যোগানদার। 

কাশীর গলির রূপ রস তো

বাঙালি রাঁড়ের বাসি কাপড়!

স্যাঁতসেঁতে গঙ্গার ঘাটে নিঃসঙ্গ বাবা বিশ্বনাথ

নিঃসঙ্গ ঈশ্বর 

 

৩.

চার বছর  বয়েসেই কন্যা স্বামীহারা

আড়ালে সমানে কেঁদে চলেছেন মা

"আহা কন্যা আমার-"

একাদশী পূর্ণিমা অম্বুবাচী

মা  একটি  একটি  করে দিন মাপছেন 

মাপছেন আতপচাল 

 

তখন চার বছরের ঝিলমিল  

সাদা থানে জড়ো করছে  

এক উঠোন রোদ,

মৌমাছির ডিম, খলসে মাছ।

 

ঈশ্বর  কাঁদছেন। 

মা দেখলেন  তাঁর একমাত্র ছেলের চোখে

 ফোঁটা  ফোঁটা রক্ত!

ঈশ্বর একাই  হাঁটা শুরু করলেন।

 

৪.

গঙ্গার ঘাট

উঠে দাঁড়ালেন অস্থির  ঈশ্বর 

পিছনে হেয়ার, মেরি, সিসিল,

 ডিরোজিও,  কালীপ্রসন্ন। 

ওঁরা বললেন এতো কালের জট!রন্ধ্রে রন্ধ্রে!

সময় তো লাগবেই।

 

ধীরে ধীরে বিডনের স্কুলে মেয়েরা ভর্তি হচ্ছে

ঈশ্বর তবু আনমনা!

ভাবছেন কাশীর দূর্গ

ভাবছেন কাশীর স্যাঁতসেঁতে গলি

কানের ভেতর খোল করতাল

 বিদ্রুপের তালা

 ভ্রুক্ষেপহীন ঈশ্বর 

হেঁটে চলেছেন ছাতা মাথায় 

সাথে  হাজার নারীর আর্তস্বর

 

 

শোভাবাজার ঘাট

প্রাচীন বটের ঝুরিতে অসংখ্য পাখির বাস

ভরে আছে বাতাস পাখিডাকে

হুকো গড়গড়া ঘটিভরা গরম দুধ

রেকাবিতে আফিং

 আড়ালে ছক কষছেন শাস্ত্রী, তর্কলঙ্কা, কাব্যতীর্থ 

মন্ত্রণাগুপ্তি বটতলা থেকে বৈঠকখানা

বেঁটে বামুনের চুনকালির ব্যবস্থা পাকা।

 

ঈশ্বরের রোজনামচায়

ভোরে চারটেই গঙ্গাস্নান 

তারপর সংস্কৃত  কলেজ

ফিরতি পথে ছাপাখানা সাহেবপাড়া

 এক আধ দিন বড়লাট

 

সুযোগের অপেক্ষায় গনু লেঠেল!

তেল মাখানো বাঁশের লাঠি।

পাখির মতো ওড়ে, ছুঁয়ে দিলেই কাজ।

 

৬.

 

শীতের নিস্তব্ধ কলকাতা

গাছের ডালে ডালে পরিযায়ী পাখি

ঘনকুয়াশার রাত

দু একজন মদ্যপের

খিস্তি খেউড়  উড়ছে বাতাসে

বাদুরবাগান ছেড়ে যাচ্ছেন  দীর্ণবিদীর্ণ   ঈশ্বর

পড়ে রইল ছেঁড়া চিঠি,বালি ঘড়ি,

স্বর্ণচাঁপা, বেতের ছড়ি, খুচরো আরো কতো কী!

 

নদীর  জলে  অস্থির কান্নার স্বরলিপি

শিউলি, পদ্ম,টগর, কামিনীর সাথে ভেসে যাচ্ছে

গলিত ছেঁড়া  সর্বহারা ঠিকানাহীন

যুবতী কিশোরী বালিকা বিধবার

লাল নিথর  ডাকসাজ। 

 

নারীকন্ঠের  চিৎকারে গোটা 

বাদুরবাগান জাগছে...

না, আর সাদাথান নয়

একাদশীর উপবাস নয়

কাশীর অন্ধকারও নয়

হাতে ত্রিশূল  খড়্গ কৃপাণ

জয় দয়ার সাগর!

জয় ঈশ্বরের জয়!

 

একা যন্ত্রণাবিদ্ধ ঈশ্বর 

অপমান থুথু  কুৎসায় ঈশ্বর

বর্ণপরিচয়ের ঈশ্বর 

মহানগর  ছেড়ে কার্মাটারের পথে

দামোদর থেকে গঙ্গা 

যাঁর পদছাপ মুছে ফেলতে

জল ও কম পড়ে যায়

 

 হায়!প্রমিথিউস!

 তুমি স্বর্গের আগুন চুরি  করেছিলে

 মানুষের জন্য!

 

 

তথ্যসূত্রঃকমল চক্রবর্তীর 'হে ঈশ্বর'। 




 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ