মিষ্টুর হাতটা ধরে কাচের দরজাটা ঠেলে স্টুডিয়োয় ঢোকার আগে আমার মনে কোনো দ্বিধা ছিল না, আমি রীতিমত সাহসী ছিলাম আমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে। যা করতে চলেছি আমি জানতাম তাতে অনেক বাধা আসতে পারে। আমার ছেলে মিলন, বৌমা মিতালী, কেউ শুনলে বা দেখলে হয়তো হাসবে, আমায় বকবে। হয়তো বা ভাববে আমার মাথার গন্ডগোল হয়েছে, ভীমরতি ধরেছে, না হলে এই বয়সে এমন ভাবনা! কিন্তু সাহস আর উৎসাহ দিয়েছিল শুধু আমার নাতনী ঐন্দ্রিলা, আমার আদরের মিষ্টু।
মিষ্টু আমার কাছে কিছু লুকোয় না, বয়ফ্রেন্ডের কথা, প্রথম চুমুর
কথা, ওর ব্রেক আপের কথা, সব কিছু। আমিও লুকোই না ওর কাছে কিছু, আমার ইচ্ছেগুলোর কথা,
আমার স্বপ্নভঙ্গের কথা, আমার ভুল, আমার ব্যর্থতা, সব কিছুই। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে
পড়া মেয়েটা আমার সব চেয়ে বড় বন্ধু। এটা দুই অসমবয়সী মানুষের মধ্যে এমন এক বন্ধুত্ব
যার মধ্যে কোনো আড়াল নেই, পর্দা নেই, কোনো মুখোশ নেই। সেই ছোট থেকে মিষ্টু আমার সঙ্গেই
থাকে রাতে, মানে ওর দাদু মারা যাবার পর থেকেই, ওর তখন আট বছর বয়স। রাতে আমাকে জড়িয়ে
ধরে ঘুমোয়, নতুন কোন সুর গীটারে তুললে আমাকে আগে শোনায়। এমনকি রাত দুটোর সময় শীতের
রাতে ব্যালকনিতে বসে সিগারেট খাওয়ার সময়েও আমি ওর হাত থেকে শেয়ার করে দিয়েছি আমার
জীবনের প্রথম সিগারেটের টান। হাসতে হাসতে মিষ্টু বলেছিল, “ঠামি আর একবার টানো, আমি একটা পিক তুলে রাখি মোবাইলে। আমার ফ্রেন্ডরা
দেখলে বলবে তোর ঠামি কি কুল!” ছবি তুলব কি, আমি তো তখন কেশে মরছি, চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে
গেছে কাশতে কাশতে।
আজও এখানে আসার ব্যাপারে আমার সাহস কিন্তু সেই মিষ্টুই। ওই জায়গাটা
সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছে, ওই অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করেছে, ওই এসেছে আমার সঙ্গে। ভুল হল
বোধহয়, আমিই এসেছি ওর হাতটা ধরে। রিশেপশনে বসা মেয়েটা খুব সুন্দরী, বছর কুড়ি বাইশ
বয়স হবে, ফর্সা, টানাটানা চোখ। চাঁপা রঙের কুর্তিটার ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে গলার নিচে
একটা ট্যাটু, অনেকটা ভগবান বুদ্ধের ত্রিনয়নের মতো। সে কম্পিউটারে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা
চেক করে নিয়ে একটা এক পাতার ফর্ম বাড়িয়ে দিল। ফর্মটা টেনে নিয়ে মিষ্টু খসখস করে
ফিল আপ করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নাও, সই কর।" রিশেপশনের মেয়েটা হাঁ
হাঁ করে উঠল, “না না, ওনার সই লাগবে না, আপনি তো অ্যাডাল্ট, আপনার হলেই চলবে।"
মিষ্টু ঠান্ডা গলায় অল্প হেসে বলল, “আমার নয়, সইটা ওনার লাগবে।”
-“মানে? জবটা কার হবে?"
-“ঠামির, আই মিন এনার।”
চোখ কপালে তুলে মেয়েটা ইন্টারকমে কাউকে ডাকতে ভেতর থেকে আর্টিস্ট
বেরিয়ে এল। লম্বা সুদর্শন ছেলেটার চুলগুলো একদম ফুটবলারদের মতো করে হাল ফ্যাশনের ডিজাইনার
ছাঁটে কাটা, একটা কালো হাফ টি-শার্ট আর নীল রঙের রিপড্ জিন্স পরনে, পেশীবহুল বাঁ হাতের
সমস্তটা জুড়ে সূক্ষ্ম কাজের রঙিন উলকি প্রথমেই চোখ টানবে সবার। এক গাল হেসে মিষ্টুর
দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “হাই, আয়াম রোহান। বলুন, হাউ মে
আই হেল্প ইউ?” মিষ্টু বলল, “ইনি আমার ঠামি, ট্যাটু করাতে এসেছেন।”
ছেলেটার কপালে একটা ভাঁজ পড়ল, পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলল, “ওয়াও, গ্রেট! বাট
ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, হাউ ওল্ড আর ইউ?”
আমি বললাম, “সিক্সটি ফোর, কেন? কোনো প্রবলেম আছে?”
-“প্রবলেম তো একটা আছে, আপনার স্কিন তো এখন অনেক সফ্ট হয়ে গেছে,
ম্যাডাম। নিডলিং খুব টাফ হবে, বিসাইডস্ আপনার পক্ষেও কমপ্লিকেশনস্ আসতে পারে।"
মিষ্টু বলল, “কিন্তু অনেক এজেড লোককেও তো দেখি…"
-“হ্যাঁ, অ্যারাউন্ড ফিফটি হলে আমি শিওর ট্রাই করতাম, বাট অ্যাট
দিস এজ। আই উড সাজেস্ট ইউ টু বেটার ড্রপ দ্য আইডিয়া। ইট মাইট বি রিস্কি।”
মিষ্টু বোধহয় বুঝতে পারছিল আমি একটু আশাহত হয়েছি, তাই আমার হাতটা
ধরে একটু চাপ দিল। আমি বললাম, “কোনো ব্যাপার নয়, জাস্ট একটা সখ ছিল। জরুরী কিছু তো
আর নয়।”
কাচের দরজাটার বাইরে রাস্তার কোলাহলের মধ্যে এসে দাঁড়ালাম দুজনে।
মিষ্টু আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, “কি রে ঠামি, মন খারাপ হয়ে গেল নাকি?"
আমি ওকে উড়িয়ে দিয়ে ওর মতো করে বললাম, “ধুসস্, কোন ব্যাপার নয়, চিল!” হেসে আমায়
জড়িয়ে ধরে বলল, “দেন চলো, রাখিজ বিউটি সালোন থেকে তোমার চুলটা ট্রিম করিয়ে আনি,
কিছু তো একটা হোক।” আমি সায় দিয়ে বললাম, “চল। আগে সালোন, তারপর সিসিডিতে ক্যাপুচিনো।
আজ সব আমার পেনশনের টাকায়।” দুই বন্ধু হাত ধরে এগিয়ে চললাম উল্টো দিক থেকে আসা ভিড়
ঠেলে সামনের দিকে।
0 মন্তব্যসমূহ