একটু আগে
গতরাতের স্বপ্নের আবেশ দু'চোখের পাতায় উপসংহার টেনে দিয়েছে৷ দিনের আলো ফুটতেই সেই
রঙিন স্বপ্ন সন্ধ্যামালতীর
গর্ভে লুকিয়েছে৷ হাইতোলা সূর্যের গহ্বর
থেকে বেরিয়ে আসছে কচি রোদ৷ কুয়াশার বালাপোশে মোড়া নগ্ন স্টেশনের বুকে জমে থাকা শৈত্য একটু উষ্ণতার স্পর্শ পেতে
আকুলি-বিকুলি ৷
রাস্তার
ফিসফিসানি, মন্দিরের ঢং ঢং ঘন্টাধ্বনি , ধূপকাঠিপোড়া ছাই , সেই বকুল গাছের নৈরাশ্য বাতাসে মিশে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা সৃষ্টি করে। তারই সঙ্গে সুর টেনে চা
হেঁকে গেল আদিবাসী ছেলেটি , চোখেমুখে যার নতুন দিনের আশা লেপ্টে আছে, চকচক করছে৷ সেই
দ্যূতি দেখে আমার প্রৌঢ়-মন আনমনা হয়ে ওঠে ৷ মনে হল, আমার কিছু অব্যক্ত কথা, ব্যথা,
হতাশা তাকে আড়াল করতে চেয়েছে মাত্র!
আদিগন্ত
সবুজের গভীরে হুটোপাটি করে কাঁচা সোনালি রোদের রোশনি। শিরশিরে বাতাস জড়িয়ে ধরেছে আমাকে পিছনে থেকে, ঠিক যেন আমার কিশোরী
প্রেমিকা! যাকে ছেড়ে এসেছি ত্রিশ বছর আগে এক বিচ্ছিন্ন স্টেশনে! সাঁতরে মধ্য সমুদ্রে পৌঁছে এই স্টেশনই মনের নিভে
যাওয়া আগুনকে উসকে দিল, বালুতটে হয়ত আজও বসে আছে আমার সেই কিশোরী প্রেমিকা !
দূরের
ধানখেতে ছড়িয়ে আছে সীতার মায়ের অলংকার। তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা অড়হড় গাছ দেখে মনে পড়ে আমার জীবনের প্রথম নারী, মা। তাঁর রান্না করা ডালের সুবাস , আমার
বৃষ্টিসিক্ত শৈশবসত্তাকে মোচর দিয়ে জাগিয়ে তোলে৷ হলুদ সর্ষে খেত, মাথায় আঁচল তুলে
বসে থাকা অষ্টাদশী নবোঢ়া! করাতের বিষাক্ত দাঁত একটু একটু করে চিবিয়ে খাবে তার
মজ্জারস৷ তার মৃত্যুহীন খোলস নিষ্পলক দেখবে আকাশ৷ বিচ্ছিন্ন বাবলা গাছের ছায়া কার
উঠোন জুড়ে ছুটে বেড়ায় বোঝা দায়৷ ঝি ঝি করা হিমেল নেশা চোখে সুরমা লাগিয়ে দিয়ে গেল৷
সবুজ বাতির ইঙ্গিতে ছুটে যায় প্রকান্ড অজগর, যার পেটের মধ্যে কিলবিল করে কীট
পতঙ্গ। তার নিঃশ্বাসের কালো ধোঁয়া আর প্রশান্ত স্টেশনটির দীর্ঘশ্বাস
মিলেমিশে একাকার ৷ সাদা বক দম্পতি কাউকে তোয়াক্কা করে না। পতপত্ করে উড়ে যায়
অজানা সন্ধানে ৷ সোনালি রোদের আদর ঘন থেকে ঘনতর হলেও হাওয়াই চটি চটাস্-
চটাস্ করে মাড়িয়ে যায় রোমকূপে জমে থাকা হিমায়িত রক্তবিন্দু৷
লালবাতি সবুজ
হয় ৷ হুইশিল্ বেজে উঠে।
মহারাষ্ট্র
রাজ্যের অমরাবতী জেলার অন্তর্গত ছোট্ট স্টেশন মালখেদ। মনে হল, আবার সেই
কিশোরী প্রেমিকাকে ছেড়ে আমিও একটু একটু করে চলে যাচ্ছি দূরে ৷
শূন্যতাআশ্রিত অপেক্ষাকে স্টেশনে রেখে চলে যাচ্ছি , দৃষ্টি থেকে দৃষ্টির
সীমানা ছাড়িয়ে ...