সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

তরুণ কুমার ঘটক






প্রেম হতাশা প্রতিবাদে পাবলো নেরুদা


স্পেনের জনপ্রিয়তম কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা ১৯৩৪ সালের এক শারদীয় অনুষ্ঠানে পাবলো নেরুদা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত  ভাষণে  বলেন:
“চিরাচরিত ভাষায় যাকে বলে পরিচয় প্রদান তা আমি এখন করব না কারণ চিলির পাবলো নেরুদার মতো এক কবির সম্পূর্ণ  পরিচিতি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়; বরঞ্চ আমার সহজ কথায় তাঁর প্রতি সরল-গম্ভীর মনোযোগ দেওয়া যাক।
আপনারা এক কবির কথা শুনছেন যিনি পৃথিবীর সেই সব  শৃংখলিত মানুষের কন্ঠস্বর যে পৃথিবীটা আমাদের  নয় আর খুব কম সংখ্যক লোকই সেটা বুঝতে পারে। দর্শনের চেয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি তিনি, বুদ্ধিমত্তার চেয়ে বেদনার অন্তরঙ্গ, তাঁর  কাছে কালির চেয়ে রক্ত বেশি চেনা। তাঁর কন্ঠস্বরে বর্ষিত হয় দুর্জ্ঞেয় রহস্যময়তা আর সৌভাগ্যবশত  তিনি নিজেও জানেন না তার কত ব্যঞ্জনা; এক খাঁটি মানুষ তিনি যাঁর কাছে একটা মূর্তির কঠিন চিবুকের চেয়ে উজ্জ্বল মৃত্যুহীন নলখাগড়া এবং সোয়ালো পাখি।
স্প্যানিশ আমেরিকা চিরকাল কত ক্ষমতাবান কত যুগান্তকারী কবির জন্ম দিয়েছে, কত বৈচিত্র্যময় তাঁদের আঙ্গিক। ট্রপিকাল, সমতল এবং পাহাড়ি অঞ্চলের শান্তস্নিগ্ধ কবিদের ছন্দে সুরে  বেগবতী হয়েছে স্প্যানিশ ভাষা। কি মাদকতা এই ভাষায়, এর রূপে পেঙ্গুইন পাখির নিখাদ পারিপাট্য। কিন্তু সব কবির  মধ্যে আমেরিকার আর্তির কথা নেই। অনেকের আছে স্বদেশের মায়া, অন্যদের গায়ে  লেগেছে বিদেশি হাওয়া, সর্বোপরি ফরাসি ঝড়ের প্রবল দাপট। বড়ো কবিদের তা নেই। তাঁদের মধ্যে  আছে আমেরিকার রহস্য, রোমাঞ্চ, ভাবাদর্শ, নিষ্ঠুরতা, রোমাণ্টিক চেতনা আর  কত আলোর  রোশনাই। আছে ডুবন্ত পাহাড়, মাকড়সার জালের সুতোয় বাঁধা জীবন, জাগুয়ার রঙের স্মিত হাসি, লোমশ হাতে লেসের রুমালের ছলনা। আমেরিকার স্প্যানিশভাষী কবিদের  বিশাল অবদান, এঁদের শোনিতে খেলা করে চিরায়ত সাহিত্যের দ্যুতি, এঁরা পুরনো কাঠামো ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেননি, পিছিয়ে যাননি ব্যঙ্গবিদ্রূপে, মাঝপথে হয়তোবা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক রুবেন দারিওর ব্যতিক্রমী উজ্জ্বলতা, এররেরা ই রেইসিগ-এর বিলাপ, কোনদে দে লাউত্রেমোনতের  অ-ফরাসি কাব্যে  বয়ঃসন্ধির বীভৎস  কন্ঠস্বর আর পাবলো নেরুদার  গভীর আবেগ, মর্মস্পর্শী স্নিগ্ধতা এবং মমতা।
তাঁর চোখে বিস্ময়-ভরা পৃথিবী, তাঁর চোখে ঘৃণা আর ব্যঙ্গ যা ভন্ড কবিরা দেখেও দেখেননি। তাঁর হাতে শাস্তির কৃপাণ উঠলেই আঙুলের ফাঁকে এসে পড়ে  আহত  কবুতর।
এই মহান কবির কথা আপনারা শুনুন, তাঁর মনের কথা অনুভব করুন। যে কোনো খেলার মতো কবিতার একটা শুরু থাকে কিন্তু সত্যিকারের কাব্যের শরীরে ছড়িয়ে থাকে এক সুগন্ধময় নির্যাস, একটা দৃঢ় উচ্চারণ, একটা অনুভব যা সবার হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
আমাদের মধ্যে যে পাগলামো থাকে তার এক কণাও যদি  আপনাদের কাজে লাগে তবে তা হবে পরম সার্থকতা। একচোখো চশমার গ্রন্থকীটদের বিদ্যা জাহির করার জন্যে একে খুন করা হয় বটে তবে ওটা বাদ দিয়ে জীবনের কোনো অর্থ  থাকে না
পৃথিবীর যত বিস্ময়, যত উন্মাদনা, প্রাণের যত বেদনা ও ব্যাকুলতা, মানুষের লাঞ্ছনা, প্রতিবাদ এবং বিদ্রোহ কোনো কিছুই বাদ যায়নি পাবলো নেরুদার কবিতায়। অনেক লিখেছেন তিনি। সব কবিতার আলোচনা সম্ভব নয়। বিশেষ কয়েকটি ধারার কথা বলাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
তাঁর আসল নাম নেফতালি রিকার্দো রেইয়েস বাসোয়ালতো। চেক কবি জান নেরুদার  অনুসরণে  ষোলো বছর বয়সে  তিনি ছদ্মনাম গ্রহণ করেন পাবলো নেরুদা। রুবেন দারিওর পরে  লাতিন আমেরিকার কোনো কবি  যদি সর্বজনীন বলে চিহ্নিত হন তাহলে তাঁর নাম পাবলো নেরুদা।
মধ্য চিলির ছোট্ট উপত্যকা শহর পাররাল তাঁর জন্মস্থান; জন্ম তারিখ ১৯০৪ সালের ১২ই জুলাই। জন্মের মাত্র দুমাস পর তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। ‘ইসলা নেগ্রা’ (আক্ষরিক অর্থ ‘কৃষ্ণদ্বীপ’) কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতার নাম ‘জন্ম’ যেখানে পাররাল-এর উল্লেখ আছে। বাবা হোসে দেল কারমেন রেইয়েস মোরালেস দ্বিতীয়বার বিবাহ করে সপরিবারে চলে আসেন দক্ষিণের শহর তেমুকোতে। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকে পাবলো খুবই শ্রদ্ধা করতেন, বলতেন ‘মামাদ্রে’। ‘মাদ্রে’ শব্দের অর্থ মা, মায়ের চেয়েও অধিক ‘মামাদ্রে’। তাঁকে নিয়েও কবিতা আছে পাবলো নেরুদার। তেমুকোর  বৃষ্টি তাঁর সবচেয়ে অন্তরঙ্গ সঙ্গী। স্মৃতিকথায় তিনি বলেন:
‘প্রথমেই বলব, আমার শৈশবে অবিস্মরণীয়  সঙ্গী ছিল বৃষ্টি...’। পাবলো নেরুদার  স্মৃতিকথার শিরোনাম ‘আমি বেঁচেছিলাম তা কবুল করি’
‘প্রথম  ভ্রমণ’ কবিতায় তিনি লেখেন :
‘আমি জানি না কখন আমরা তেমুকোতে চলে এসেছিলাম......কুঠার আর  বৃষ্টির ভেতর  থেকে এই শহর গড়ে উঠেছিল।’ তেমুকোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নোবেল বিজয়িনী কবি গাব্রিয়েল মিস্ত্রালের নাম যাঁর তামাটে মুখমণ্ডলে ‘আদিবাসী ফ(ইন্দিও) রক্ত ছিল উজ্জ্বল’। সেই সময় গাব্রিয়েল মিস্ত্রাল একটি মেয়েদের স্কুলের শিক্ষিকা। তিনি পাবলো নেরুদাকে সাহিত্যপাঠে, বিশেষত  রুশ সাহিত্যপাঠে  অনুপ্রাণিত করতেন। স্কুলের পাঠ শেষ করে পাবলো নেরুদা চিলির সান্তিয়াগো  বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। সেখানেই ছাত্রদের ফেডারেসনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২১ সালে রচিত  প্রথম কবিতা ‘উৎসবের গান’ ছাত্রসংগঠন কর্তৃক পুরস্কৃত হয়। তাদের পত্রিকা ‘ক্লারিদাদ’(স্পষ্টতা) পাবলো নেরুদাকে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক কাজের দায়িত্ব দিয়েছিল। ছাত্রসংগঠনের প্রগতিশীল কাজকর্মে ক্ষিপ্ত  স্বৈরাচারী সরকার  আক্রমণাত্মক  হয়ে তাদের দপ্তর ভাঙচুর করে। এই কুকর্ম প্রসঙ্গে পাবলো নেরুদা লেখেন:
‘ঔপনিবেশিক যুগ থেকে এটাই নিয়ম, আক্রান্তকারী  শাস্তি পেল না, বন্দি হল আক্রান্তরা, বিচার সবসময় ধনীদের পক্ষে।’
ছাত্রসংগঠনের কাজে যুক্ত থেকে পাবলো নেরুদা  সমাজব্যবস্থা এবং রাজনীতিতে ক্রমে  বিশেষ আগ্রহী হয়ে  উঠতে থাকেন। ওই সময় ‘এনার্কিস্ট’ আন্দলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল ছাত্রদের সংগঠন।
সমকালীন ছাত্রকবিদের সঙ্গে তাঁর জীবন ছিল স্বভাবিকভাবেই বেপরোয়া। জীবনের ছকবাঁধা পথে ওরা চলতেন না। কিন্তু পাবলো নেরুদা প্রায় প্রতিদিনই কবিতা লেখার চেষ্টা করতেন। তাঁর নিজের কথায়:
‘... সম্ভবত প্রেম এবং প্রকৃতি শৈশব থেকেই আমার  কবিতার উৎস
বয়ঃসন্ধিক্ষণে এবং যৌবনের  শুরুতে কাব্যিক ‘আমি  প্রকৃতি আর নারীর  শরীরে নিমগ্ন।’ এই ‘আমি’ খাঁটি  লাতিন আমেরিকার  বন্ধনহীন যৌবন, উদ্দাম এবং বিষণ্ণ। যে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাবলো নেরুদার খ্যাতি  স্প্যানিশভাষী  দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল তার শিরোনাম ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা এবং একটি হতাশার গান’তার পরেই বেরলো ‘গোধূলি’। যৌনমদিরতার উন্মেষ আর ইন্দ্রিয়ানুভূতির  দুর্বার  প্রকাশ ঘটল কবিতায়। প্রেমিকাকে ‘তুমি’ সম্বোধনে কবি হৃদয় উজাড় করে শরীরের ব্যাকুলতা এবং নিঃসঙ্গতার রোমাণ্টিক আবেশ উন্মোচিত  করলেন। আর তার সঙ্গে  বাঁধা পড়ল প্রকৃতি, চিলির আগ্নেয়গিরি, সরোবর, তুষারঝড়, নিঃশব্দ অরণ্যের সুরভি। তিনি বলেন, চিলির  অরণ্য না চিনলে  দেশটাকে জানা যায় না ।
সান্তিয়াগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তিনি ফরাসি ভাষার মাধ্যমে শিশু মনস্তত্ব এবং শিশুরোগের একটি পাঠ্যক্রমে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু তা শেষপর্যন্ত  অসমাপ্ত থেকে যায়। সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ তীব্র হতে থাকায় তিনি সিলেবাসের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারেননি।
যৌবনের শুরুতে যে কবিতা লিখে  পাবলো  নেরুদা খ্যাতি অর্জন করলেন তার ভাষা সহজ, সংক্ষিপ্ত এবং উপমায় অব্যর্থ:
‘বাতির মতো স্বচ্ছ, অঙ্গুরীয়ের মতো সরল’। আর প্রেম? ‘এত সংক্ষিপ্ত ভালোবাসা আর বিস্মরণ এত দীর্ঘ’...... ‘শিশিরের ফোঁটার মত কাব্যসুধা ঝরে পড়ে হৃদয়ে’। প্রেমের মধ্যেও  কবি যে বিষাদে কষ্ট পেয়েছেন  তা ক্ষণস্থায়ী একটা বয়সে আবেগের আতিশয্যে বিষণ্ণতা অস্বাভাবিক কিছু নয়; কিন্তু পরবর্তী সময়ে পাবলো নেরুদা বিষণ্ণতার জন্যে আপশোশ করে বলেছেন, ‘আনন্দ, তোমাকে আমি অবজ্ঞা করেছিলাম, কি ভুলই না ছিল  ভাবনায়’।
কিন্তু আত্মগত প্রেম আর ইন্দ্রিয়ের সুখে আটকে পড়েননি কবি। নতুন সৃষ্টির রস আস্বাদনের জন্যে তিনি উদ্বেল হয়ে পড়েন। তাঁর কাব্যরচনার দিগন্ত  প্রসারিত হতে থাকে। ১৯২৬ সালে পাবলো  নেরুদার কিছু কবিতা এবং একটি ক্ষুদ্র উপন্যাস প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের শিরোনাম ‘এক নাগরিক এবং তার আশা’ একটি গদ্যকবিতার  শিরোনাম ‘অঙ্গুরীয়’; এই কবিতা রচনায় যিনি তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেন তাঁর নাম তোমাস লাগো। এই সময়ের কবিতায় পরাবাস্তবতার প্রভাব দেখা যায়। ‘অসীম মানুষের প্রয়াস’ কবিতাটি তার সাক্ষ্য বহন করে। এখন কবির কাব্যভাষা  আর  বিষয় নিয়তই পরিবর্তিত হতে থাকে। অভিজ্ঞতা এবং নতুন আঙ্গিকে রচিত হয় পাবলো  নেরুদার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘মাটির আবাসন’ যার মধ্যে নেরুদার বিশেষ স্বাতন্ত্র্য উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কবি মাটিতে পা রাখতে শুরু করেন। বাস্তব পৃথিবীর প্রতি নেতিবাচক  দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটে এই  গ্রন্থের কবিতায়। চারপাশে দেখা যাচ্ছে অসম্ভব অবসাদ, বিষণ্ণতা আর মৃত্যু। যা ছিল বিশেষভাবে ঐতিহ্যানুসারী উৎসাহব্যঞ্জক তার মধ্যেও বাসা বাঁধে বেদনা:
‘আমার বাড়িতে অসুখ’, ‘পরিবারে বিষাদ’, ‘সোনাটা  এবং ক্ষয়’,’ ভোরের দুর্বলতা’ ইত্যাদি হয় কবিতার শিরোনাম। যৌবনের বিষণ্ণতা পরিণত হয় বিপর্যয়ের অসহায় উদ্বেগে। পৃথিবীর  চক্রাকার ক্ষয় কবিকে মর্মাহত করে। ‘ঘড়ি পড়ে যায় সমুদ্রগর্ভে’ অর্থাৎ ‘সময়’  মৃত্যুপথের পথিক। এমন এক ভয়ংকর পরিস্থিতির  জালে কবি আটকে পড়েন  যার মধ্যে  আশার বিন্দুমাত্র  আলো  চোখে  পড়ে না। সামগ্রিক হতাশায় কবি মুহ্যমান। এই অবস্থা যে বদলে যেতে পারে তাতে বিশ্বাস নেই কবির। লাতিন আমেরিকার সমগ্র কাব্যসাহিত্যে সর্বাপেক্ষা হতাশার  কবিতা পাবলো নেরুদার  walking around , শিরোনাম ইংরাজিতেই  রেখেছেন কবি কবির বক্তব্য:
‘ব্যাপারটা হচ্ছে যে, মানুষ-জন্ম নিয়ে আমি ক্লান্ত’। এই ক্লান্তি,এই বিষাদ, এমন  বিপন্নতা থেকে পরিত্রাণের পথ নেই, এই অনতিক্রম্য হতাশার জন্ম হয় কবির ব্যক্তিগত জীবনযাপনে ১৯২৭ সালে চিলির আরেক কবি গাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের সাহায্যে পাবলো নেরুদা রেঙ্গুনে কনসাল পদে নিযুক্ত হন একেবারে অচেনা দেশে কবি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। কন্সাল-এর সামান্য বেতন সময়মতো  আসে না, প্রেমিকা আলবের্তিনা আসকার-এর চিঠি আসে না, ভাষার ব্যবধান  দুর্ভেদ্য, কবি কারও  সঙ্গে মনের কথা বলতে পারেন না। তিনি যৌনতার তাড়নায় জাভার এক মেয়েকে বিবাহ করেছিলেন কিন্তু প্রেম ছিল না তাদের মধ্যে। একাকিত্বের যন্ত্রণায় কাতর কবি আর্জেন্টিনার বন্ধু এক্তোর এয়ান্দিকে লিখলেন:
‘আমার পতন শুরু হয়েছে, না আছে ইচ্ছেশক্তি, না ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছি।এই পত্রে পাবলো নেরুদা তাঁর কবিতায় সর্বাত্মক হতাশার কথা ব্যক্ত করেন।
১৯৩২ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেলেন নেরুদা কিন্তু শান্তি ফিরে এল না। বাবার সঙ্গে সুসম্পর্ক  তৈরি হল না, স্ত্রীর ভালোবাসায় বঞ্চিত, অর্থাভাবে জর্জরিত কবির উৎকন্ঠা যেমন ছিল তাই রইল। চিলির সরকার  তাঁকে বদলি করলেন আর্জেন্টিনার বোয়েনোস আইরেস শহরে। এখানে  আলাপ হল হোর্হে লুইস বোর্হেস-সহ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। ১৯৩৩ সালে সে দেশে ভ্রমণরত স্পেনের কবি-নাট্যকার  ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার সঙ্গে  পরিচয়  থেকে অন্তরঙ্গতা হতে দেরি হল না।
যে মহাদেশটিকে ‘বোবা’ বলে  তার মুখে ভাষা দিতে চেয়েছিলেন পাবলো নেরুদা সেই লাতিন আমেরিকা বা স্প্যানিশ আমেরিকার বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস ঘটনামুখর। মেক্সিকোর মুক্তিযুদ্ধ, চিলির বাণিজ্যবিস্তার, পেট্রোলের বাজার দখলের সংঘাত, ইউরোপীয়দের অভিবাসন, কিউবার চিনি ব্যবসা, স্বৈরতন্ত্রের উত্থান, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, কিউবার বিপ্লব, বলিভিয়ায় চে গেভারার মৃত্যু, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের প্রচার ও প্রসার, চিলিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাধা, ড্রাগব্যবসার  বাড়বাড়ন্ত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদ---ইত্যাদি ঘটনাবলি  স্মরণে না রাখলে পাবলো নেরুদার চেতনার উন্মেষ এবং তাঁর কবিতার  বিভিন্ন পর্যায়গুলো অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
খাঁটি লাতিন আমেরিকার কবি পাবলো নেরুদা সমাজ এবং রাষ্ট্র সম্বন্ধে উদাসীন থাকতে পারেননি। তাঁর কাব্যিক পথপরিক্রমায় বিশেষ ভুমিকা পালন করল স্পেনের গৃহযুদ্ধ। স্পেনে চিলির কনসাল পদে তিনি বদলি হয়ে এলেন প্রথমে বার্সিলোনায় এবং পরে মাদ্রিদে। ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার সঙ্গে অন্তরঙ্গতার সুবাদে ২৭-প্রজন্মের কবি এবং বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় গড়ে উঠল। ভিসেন্তে আলেইক্সান্দ্রে, রাফায়েল আলবের্তি, মানোয়েল আলতোলাগিররে প্রমূখ কবিদের সান্নিধ্যে আসার ফলে পাবলো নেরুদার সৃজনশীলতার নবজন্ম  ঘটল। স্পেনের  নোবেলজয়ী কবি হুয়ান রামোন হিমেনেস ছিলেন ‘বিশুদ্ধ’ কবিতার প্রবক্তা। পাবলো  নেরুদার সঙ্গে তিনি দূরত্ব রেখে চলতেন। কিন্তু যৌবনের দীপ্তিতে উজ্জ্বল ২৭-প্রজন্মের অধিকাংশ কবি ও বুদ্ধিজীবী ছিলেন প্রগতিবাদী, দেশের  আশা-আকাংক্ষা থেকে  বিযুক্ত হয়ে গজদন্তমিনারে বাস করার স্বপ্ন দেখতে পারেননি এঁরা। স্পেনের গৃহযুদ্ধ ঘটিয়ে দিল এক যুগান্তকারী আলোড়ন। যুদ্ধের শুরুতেই  ফ্যাসিস্ট পুলিশের  হাতে লোরকার হত্যা গভীরভাবে প্রভাবিত করল পাবলো নেরুদাকে। তাঁর আত্মগত  ভাবনা পরিণত  হল মানুষের সমবেত  ক্রোধে। পৃথিবীর শুভ এবং অশুভ  শক্তিকে প্রত্যক্ষ করে স্বীয় কর্তব্যের পথ খুঁজে পেলেন। অতীতের নিষ্ফল কাব্যরচনার  জন্যে আপশোশ হয় তাঁর। ‘নতুন পতাকার জয়গান’ গাইলেন পাবলো নেরুদা। ‘হৃদয়ে স্পেন’ প্রকাশিত হল ১৯৩৮ সালে। রাজনীতির আগুনে উদ্দীপিত  সংগ্রামের দীপ্ত আবেগে কবিতার স্বর হল প্রতিবাদী। এই প্রতিবাদই কবির সংগ্রাম। তিনি লিখলেন:
‘......তারপর এক সকালবেলায়  সবকিছু ঝলসে গেল; সকালবেলায় মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল  বহ্ন্যুৎসব, আর গিলে ফেলল সব,
তখন থেকে আগুন কেবল, বারুদ কেবল তখন থেকে, তখন থেকে রক্ত কেবল।(অনুবাদ শঙ্খ ঘোষের)।
স্পেনের মাটিতে পাবলো নেরুদা দেখেছিলেন ‘রক্ত’। তিনি বলেন:
“ওই সময়টা আমার জীবনে মৌলিক পরিবর্তন  ঘটিয়ে দিয়েছিল। এরপর সারাজীবন ধরে কাব্য এবং জীবনে যা  ঘটেছে তা উৎসারিত হয়েছিল স্পেনের ওই সময় থেকে।”
স্পেনের প্রতি পাবলো নেরুদার প্রেম ছিল অকৃত্রিম। নারীর প্রতি ভালোবাসার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল মতাদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতা। স্মৃতিকথায় পাবলো নেরুদা একটি অধ্যায়ে লিখেছেন কেন তিনি কম্যুনিস্ট মতাদর্শ গ্রহণ করেছিলেন। Elegi un camino).
‘মাটির আবাসন’-এর দ্বিতীয় খন্ড(১৯৩৫) প্রকাশিত হলে দেখা যায় যে, পাবলো নেরুদার একাকিত্ব কেটে গেছে, কিন্তু চারপাশে ধ্বংসাত্মক জগৎ দেখে হতাশা প্রকাশ করেন। ‘তৃতীয় আবাসন’(১৯৪৭) কাব্যগ্রন্থে  হতাশা পরিণত হয় বিদ্রোহে। ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সুবিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সাধারণ সংগীত’(Canto General)। পাবলো  নেরুদার  অন্যতম  শ্রেষ্ঠ এই কাব্যগ্রন্থে পনেরটি অংশে লাতিন আমেরিকার মানুষের জীবন, ইতিহাস এবং রাজনীতির রূপকথা-সদৃশ বৃত্তান্ত  হয়ে উঠেছে এক মহাকাব্য। দ্বিতীয় অংশে ‘মাচু-পিকচুর শিখর’ কাব্যের  শিখর স্পর্শ করে। শ্রমজীবী মানুষের আত্মত্যাগ, অত্যাচারীর অর্থলোলুপতা এবং বাস্তবতার জটিল আবর্ত  আশ্চর্য  ছন্দময়তার বিভায়  আলোকিত হয়ে ওঠে।  প্রবক্তারূপে ‘আমি’  চিরকালের মুক্তিকামী মানুষের জয়গাথা রচনা করেন, শোষকদের পরাজিত করার আবেদনও ধ্বনিত হয়।
এই কাব্যগ্রন্থটি ইয়োরোপ-সহ সারা বিশ্বে  অত্যন্ত সমাদৃত হয়, বিভিন্ন ভাষায়  অনূদিত হয়ে কবিতাটি বিপুল উন্মাদনা সৃষ্টি করে। পাবলো নেরুদা  ভ্রমণ করেন রাশিয়া, চিন এবং ভারত। দ্বিতীয়  স্ত্রী মাতিলদে উরুতিয়ার অনুপ্রেরণায় কবি বিশ্বজনীন  আরও কিছু কবিতা রচনা করেন। এই কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ক্যাপ্তেনের কাব্য’ এবং ‘আঙুর ও  হাওয়া’। পাবলো নেরুদার বিপুল রচনায় কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে স্যালাড, ক্যাক্টাস, মোজা, খরগোশ, নক্ষত্র, আনন্দ, শরৎকাল, পাকস্থলী, মস্তিষ্ক, কবিতা, নারী, কাঠ, বই, টমেটো, ছাপাখানা এবং কী নয়? পৃথিবীর সবকিছুকেই তিনি উদার মনে গ্রহণ  করেছেন, ভালোবেসেছেন  তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তুকেও। এক  গভীর আশাবাদ কবিকে এই পৃথিবীর যাবতীয়  দুঃখদুর্দশা থেকে মুক্ত করার  মন্ত্র রচনায় অবিরাম প্রেরণা জুগিয়েছে।
পাবলো নেরুদা সকল মানুষের কবি । তিনি বলেছিলেন :-
porque  no puedo ser sin ser de todos’’ অর্থাৎ ‘সকলের না হয়ে আমার অস্তিত্ব থাকে না’।
বিশেষভাবে লাতিন আমেরিকার হলেও পাবলো নেরুদা ছিলেন বিশ্বকবি। ১৯৭১ সালে  সারাজীবনের সৃষ্টির স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন  কবি।
 ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর  মাসে মৃত্যু হয় পাবলো নেরুদার কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয় মৃত্যুর পর।  ‘আমি বেঁচে ছিলাম কবুল করি’ শিরোনামে তাঁর  স্মৃতিকথাটি  অমূল্য এক গ্রন্থ, এটি প্রকাশিত হয় মৃত্যুর পর। এই গ্রন্থে তাঁর জীবনকালের অনেক ঘটনা এবং ব্যক্তির কথা জানা যায়।
পাবলো নেরুদার কাব্যে আমরা পাই  আদি এবং অকৃত্রিম মাটির গন্ধ। সারাজীবন তিনি অন্বেষণ করেছেন কবিতার বিষয় এবং শৈলী। এক খাঁটি কবির অন্তর নিয়ে জন্মেছিলেন  পাবলো নেরুদা, তাঁর সৃষ্টির  মধ্যে ভণিতা নেই,  শুরুতে নারীর শরীরের মোহ, প্রকৃতির উদার সৌন্দর্য থেকে ক্রমে কবিমনের উত্তরণ  ঘটতে থাকে এবং পৃথিবীর মানুষের যন্ত্রণায় কাতর হন কবি। তিনি কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে সংগ্রামী মানুষের পাশে দাঁড়ান। আজ যখন চারদিকে  শ্রমিক শ্রেণির প্রতি নিপীড়ণ নেমে আসে তখন পাবলো নেরুদার বাণী স্মরণ করি ‘আমার শিরা আর মুখের সামনে এসো। আমার কথা বলো, আমার রক্তের কথা বলো’ ( Acudid a mis venas y a mi boca. Hablad por mis palabras y mi sangre.)


গ্রন্থসূত্র;
. Antología de la poesía hispanoamericana del siglo xx—Alhambra
2. Veinte poemas de amor  y una canción desesperada---Clásicos Castalia.
3. Federico García Lorca- obras completas (111) p. 249.
4পাবলো নেরুদা— জীবন, সময়, কবিতা— সম্পাদনা- সৌমিত্র লাহিড়ী।
5.পাবলো নেরুদা, অনুবাদে, অনুভবে- রবিন পাল।






তরুণ কুমার ঘটক