Solarplexus/নাভীযজ্ঞ/পাঁচ সেকেন্ড
অন্তিমপ্রয়ানের
এ এক অলঙ্ঘ্য নির্দেশিত নিয়ম। তাই মেরুদন্ডীয় বিদ্যুত্ আবেশের প্রবল ফোয়ারায়
উর্দ্ধগামী হতে হতেই যেসবশেষ অবশিষ্ট স্মৃতির রেশ, যেগুলিকে
প্রাণশক্তিতে অন্তর্হিত হতে দেখেছিল,তাও এবার হারিয়ে ফেলে
চিরকালের মত স্মৃতিহীন হয়ে গেল। আর এই হলুদ ক্ষেত্রটিতে তার জন্মসুত্রে পাওয়াউষ্ণতা
আদি পার্থিব প্রাণীজঠর থেকে ক্রমবিবর্তিত হয়ে অর্বুদ অর্বুদ শরীর বেয়ে এই শরীর
অব্দি ক্রমানুসারে সঞ্চিত হয়ে ছিল। এই চরম পরমউষ্ণতা এখন তার পার্থিব অস্তিত্ব
নিমেষেই গলিয়ে ফেলতে লাগল। সে দেখল এই স্বর্ণময় বৃত্তকুণ্ডে তার অতিচেতন ক্ষমতা,তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় চিরতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যেমন যেমন দ্রবীভুত হচ্ছে
তেমনি তেমনি হলুদবৃত্তটি পুরোপুরি সোনারঙের হয়ে যাচ্ছে। তার ক্ষণিক বোধ হলো
প্রকৃতি এই হলুদবৃত্ত মাধ্যমে যে অতিচেতনা তাকে জন্মলগ্নে দিয়েছিল সেটির
বিন্দুমাত্র ব্যবহার হয়নি।
নাভীপ্রদেশের এই হলুদ বৃত্তকুণ্ডটি থেকে দুটি চুলের মত
কিন্তু প্রায় শূন্য পরিধির সূক্ষ্ম হলুদ আলোকরশ্মি বেরিয়ে সাপের মতো সর্পিলাকারে
আন্দোলিত হচ্ছে। একটি নিম্নমুখী হয়ে পৃথিবীর পরিমণ্ডলে ঢুকে যাচ্ছে আর একটি
উর্দ্ধমুখী অসীমে বিলীয়মান।এবার সে নিশ্চিত হল,পৃথিবীতে নিম্নগামী সংযোজক আলোকরেখাটি এবার ছিন্ন হলে সে অসীমের টানে
অসীমে বিলীন হয়ে যাবে। সে দেখল পৃথিবীগামী আলোক রেখাটিতে অসংখ্য দীপ্ত আলোক গাঁঠ।
এই গাঁঠগুলো নানা অপার্থিব রঙের।সে চিনতে পারলো ওই আলোরেখাটিতে গাঁথা
সূক্ষ্ম রঙীন পুঁতিগুলিকে।অর্বুদ অর্বুদ বংশানুক্রম,
মনুষ্যপ্রজাতিক্রম, প্রানীজ বংশানুক্রম ও নানাধরনের
জৈবসৃষ্টির ক্রম এই রঙীন আলোগ্রন্থিগুলি। সে বুঝতে
পারলো এই ক্রম থেকে বিচ্যুত হবার সময় হয়েছে।এই ক্রমের থেকে বিচ্ছেদ হলেই তার
চিরতরে পৃথিবী থেকে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। সে এখন অনুভুতিহীন।এখন সে সাক্ষী
মাত্র। কিন্তু এখনো এই মূহুর্তে হৃদয়াবেগ রয়েছে। সেই আবেগ দিয়েই অনুভব হলো অর্বুদ
অর্বুদ প্রাণীদের এইরকমপ্রচণ্ড দাউদাউ জঠর আগুনবৃত্তগুলিকে সজল পৃথিবী মাতৃভাবে কেমন ধারণ করে আছে। সূর্যের
আর কী এমন অসহ তাপ তার চেয়ে অযুতগুণ তাপ এই স্নেহময়ী পৃথিবী সহন করে আছে। তাছাড়া
সূর্যের দহনশীল তাপ তো আধিভৌতিক। তা কেবল পদার্থকেই পোড়ায়। তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি
দহনশীল অধ্যাত্মিক লীনতাপ। এক মানুষী মায়ের তেমনি মায়াময় উত্তাপ ঘেরা অগ্নিজঠরে
তার জন্ম, আরমানুষী মায়ের সেই প্রানীজ জঠর ধারণ করে পৃথিবী মা। এইভাবে
বংশানুক্রমে প্রজাতিক্রমে অসংখ্য অগ্নিগর্ভ ধারণ করে যায় মা পৃথিবী। তার সমস্ত
তথ্য প্রোথিত রয়েছে হলুদ বিদ্যুত্ কুণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা এই আলোকরশ্মিতে।আর কয়েক
মুহূর্ত পরে এই অতিসূক্ষ্ম আলোক সংযোজনটি ছিঁড়ে যাবে ও সে পৃথিবীচ্যুত হয়ে যাবে।
আর তখনই উর্দ্ধমুখী সর্পিল আলোকরেখাটি মহাকাশে তার পার্থিব অস্তিত্ব নিয়ে ধাবমান
হবে।
সারাজীবন ধরে যত শস্য প্রাণীমাংস ও উদ্ভিদ তার মুখ দিয়ে
এমনকি শ্বাস দিয়েওসে গ্রাস করেছিল, সেগুলোর লীনশক্তি
বংশ সুত্রে পাওয়া উষ্ণতার সাথে এবার উর্ধে অসীমে বিকীরণ হতে দেখল। পৃথিবী থেকে
বিচ্ছেদ হওয়ার মুহূর্তটি এবার শুরু হোলো। এখন পৃথিবীচ্যুত হওয়ার আগে তাকে তাপশক্তির
হিসেব মিলিয়ে যেতে হবে। নিখিল জগতের স্থিতির একমাত্র প্রাথমিক নিয়মটি তার মহাবোধে
ধরাপড়ল। ব্রহ্মান্ডে কোনো কিছুই সৃষ্টি হয়না কোনোকিছুর ধ্বংসও হয়না। তা
পদার্থভিত্তিক হোক বা লীনভিত্তিক হোক।
উজ্জ্বল
হলুদ বৃত্তকুণ্ডে প্রায় অদৃশ্য একটি লাল ত্রিকোণ আকারের সংকেত তার সামনে ভেসে
উঠলো। সেটি তাকে সম্পুর্ণ বোধগম্য করতে হলো। এটি একটি অনিবার্য নিয়ম। তার পুং
অহংকার বোধটি এই সংকেতে রয়েছে।এইখানেই পুরুষ ভাব ও প্রকৃতি ভাবের
ভেদন ছিল।জীবনযাপনে
তার পার্থিব শরীর পুরুষ হলেও যদি এই লাল ত্রিকোণের সংকেত প্রকৃতি ভাবের থাকতো তবে
তার ব্যাক্তিস্বত্তা নারীকেন্দ্রিক হতো। সংকেত অসম্পূর্ণ থাকলে সে হতে পারতো
পুরুষত্বহীন। কিংবা উভয়লিঙ্গ বোধের এক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু এখন যাই থাকুক। সংকেতটি
তার বোধে আসা মাত্রই সেটি হলুদ তড়িতাধানে ডুবে গেল। এবং সেই মূহুর্তে লিঙ্গবোধের
অহংকার চিরতরে লয় হোলো।ত্রিকোণটি ছিল নিম্নমুখী। জন্মলগ্নে ভূমিষ্ট হবার ঠিক
মূহুর্তে এই রক্তবর্ণ সংকেতের সাক্ষাত্কারে সে তার পুরুষভাবটি মননে পেয়েছিল।এখন
মননহীন হয়ে সেই সংকেতটি পড়ে তার পুরুষভাবটি বিসর্জন দিয়ে দিতে হলো।
হলুদ বিদ্যুত্ বৃত্তে পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়েও
সে কিন্তু বুঝতে পারলো এখনো সে পৃথিবীচ্যুত হয়নি। বৃত্তের
গভীরে পৃথিবীগামী অদৃশ্য আলোরশ্মীর গায়ে বসানো অর্বুদ অর্বুদ পূর্বজ আলোগ্রন্থির
সাথে সেও সেঁটে রয়েছে সেটা প্রত্যক্ষ করল।সে বুঝল পৃথিবী থেকে তার বিচ্ছেদ
হলেই অর্বুদ অর্বুদ নিজবংশানুক্রম মনুষ্যপ্রজাতিক্রম প্রানীজ বংশানুক্রম ও নানাধরনের
জৈবসৃষ্টির ক্রমের সংকেত বহনকারী এই আলোরশ্মিটি নিভে যাবে। তার সাথে
সাথে এই বর্তুলকার হলুদকুণ্ডটিও অসীমের টানে মহাব্রহ্মে বিলীন হয়ে যাবে।এই বিদ্যুত্
কুণ্ডটি একটি সূর্যমুখী ফুলের মতো এবং তাতে হলুদ পাপড়ির মত দশটি আত্মিকগুণ সম্পন্ন
সোনা রঙের প্রাণশিখা। কুণ্ডটির ধারক আলোরশ্মীটি যেন পুষ্পদন্ড। সে এইবার
বুঝল এই হলুদ বর্তুলকার ক্ষেত্রটিই ছিল তার পার্থিব বুদ্ধির আধার এবং দশটি
প্রাণশিখা সেই বুদ্ধির দশ রকমের গভীরতম পবিত্র প্রকাশ। তরল হলুদ
তড়িত্ প্রাণরসে ডুবে যেতে যেতে সে প্রত্যক্ষ করল পাপড়িগুলির কয়েকটি উজ্জ্বল
সুবর্ণ জ্যোতিশিখা আর কয়েকটি জ্যোতি কালো শুকনো মৃতপ্রায় পাপড়ির মত,প্রায় নিভন্ত। যে পাপড়িগুলি উজ্জ্বল তরতাজা
সেগুলির একটি হোলো এমন ইচ্ছাশক্তি যা অন্যের প্রাণরক্ষা,অসহায় ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ প্রাণী উদ্ভিদকে রক্ষা ও উদ্ধার করতে সমর্পিত। আরএকটি
উজ্জ্বল প্রাণশিখা হলো এমন বুদ্ধিবৃত্তি যা সমর্পণ ও বিশ্বাস ঘেঁষা শান্ত গভীর
অন্তর্মন থেকে উঠে আসা স্থির সিদ্ধান্ত। দু চারটে প্রাণশিখা পাপড়ি একটু
ম্লান কালো হয়ে আসছে। সেগুলো হোলো আত্মবিশ্বাস স্বাধীনচেতনা ও আত্মসংযম।আর যেগুলো
কুঁকড়ে ছোট হয়ে কালো হয়ে গেছে সেই পাপড়িগুলি হোলো তার অজ্ঞান ক্রোধ একগুঁয়েমী
ছলেবলে নিজেকে যেকোনো ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মিথ্যেকে প্রশ্রয় করা আর লোভের
ক্ষিদে।
বৃত্তবদ্ধ
লাল ত্রিকোণ সংকেতটি সম্পুর্ণ মুছে গেছে। দশটি সুবর্ণ ও কালো প্রাণশিখা হলুদ
কুণ্ডে অদৃশ্য। ওই
হলুদ তড়িত কুণ্ডে তার নিরাকার পার্থিব অস্তিত্ব সম্পুর্ণ গলে গিয়ে একটি অদৃশ্য নিরাকার
পরম কণাশক্তি হয়ে পার্থিব সর্পিল সম্পর্করশ্মিতে সেঁটে ছিল। এবার
সেটাতে ভয়ংকর টান অনুভব করল। আর সঙ্গে সঙ্গে মহাকাশ জুড়ে এক অতি
সূক্ষ্ম আলোড়ন অসীম থেকে অসীমে ছড়িয়ে গেল। তারকাছে পৃথিবী একটি অর্থহীন
মৃত্যুপুরী বোধ হলো। সেটি ক্রমশ তার বোধ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল।
উর্দ্ধমুখে এক প্রবল টানে সে এক তড়িত
কণাশক্তি হয়ে আলোর চেয়ে অযুত অযুতগুণ বেগে যেই অসীমের দিকে ধাবিত হতে যাবে ঠিক সেই
মূহুর্তে এক অজানা প্রেমাবেগ বৃত্তে আটকে গেল। অতিক্ষুদ্র
পরম তড়িতকণা হয়েও তার বোধব্যাপ্তির কোনো তারতম্য হয়নি।সে বুঝতে
পারলো এটি একটি হৃদয়বৃত্তদ্বার এবং হৃদয়বৃত্তির ছাঁকনি।সম্পুর্ণ শ্রাবিতশুদ্ধ
না হওয়া অব্দি এখানে থাকতে হবে। যেহেতু পৃথিবীসহ বস্তুমাত্রার
মহাবিশ্ব এখন তার সংলগ্ন নেই পার্থিব সময়ের কোনো প্রশ্নই নেই।তাই বিশুদ্ধ
হৃদয়াবেগের পরিমাপ অব্দি সে এই বৃত্তবদ্ধ হয়ে রইল।(ক্রমশঃ)