সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

শ্রীশুভ্র



লজ্জা পাওয়া ও না পাওয়া
শ্রীশুভ্র



লজ্জা পাওয়া না পাওয়া ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত অভিরুচি। তাই নিয়ে ভেবে লাভ কি? আমার লজ্জা আমার কাছেই থাক। কারণ সেটি একান্ত আমারই বিষয়। সমাজের মাঝে ঢাক পিটিয়ে প্রচারের বিষয় কি? কথায় বলে লজ্জা নারীর ভষণ। পারিবারিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারে সেরকমটাই দেখে আসতে অভ্যস্থ আমরা অনেকেই। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে দেখতে পেতাম, এই কথাটির মতো বেহায়া কথা খুব কমই আছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীকে পুরুষের অধীনস্ত রাখার অন্যতম কার্যকরি একটি ফর্মুলা এইটি। শাশ্বতকাল ধরে আবহমান বাংলায় এই একটি ফর্মুলায় বাংলার নারীকে পুরুষের দাস করে রেখে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই বলবেন, এখন দিন পাল্টেছে। ঠিক কথা। আবার পুরোপুরি ঠিকও নয়। কিন্তু বাংলার সমাজ জীবনে এই ঘটনা ঐতিহাসিক ভাবেই যে সত্য, সেকথা অস্বীকার করতে পারি না আমরা কেউই। আর এই ইতিহাস, হিন্দু সমাজের ভিতরেও যেমন সত্য, মুসলিম সমাজের ভিতরেও ততধিক সত্য। এখানে ধর্মীয় বিভাজন সত্যের কোন প্রভেদ ঘটাতে পারেনি। তার একটিই কারণ। কি হিন্দু ধর্ম, কি মুসলিম ধর্ম। দুইটিই পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম। দুই ধর্মেই নারীকে পুরুষের অধীনস্ত করে রাখার ও  নিরন্তর পুরুষের কামনা বাসনা ও লালসা পরিতৃপ্ত করতে ব্যবহার করার ফন্দি ফিকির বর্তমান। লজ্জা নারীর ভুষণ, সেই ফিকিরেরই অন্যতম মুখ্য একটি দিক। লজ্জা দিয়ে নারীর পায়ে বেড়ি পড়িয়ে তাকে, বা আরও সঠিক ভাবে বললে, তার রূপ যৌবন দেহটিকে পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করে ভোগ দখল করার এই এক পথ। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এইভাবে নারীকে লজ্জার টোটকা দিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখে।

ব্রিটিশ আমলেও, উচ্চবিত্ত বাবু সমাজে ঘরে এক বা একাধিক বউ সাজিয়ে রাখা সামাজিক লজ্জার বিষয় ছিল না আদৌ। বরং কুলীন সমাজে সেটি বংশগত আভিজাত্যের প্রতীক ছিল। এবং এরপরেও বাগান বাড়িতে রক্ষিতা নিয়ে ফূর্তি করতে বাবু সমাজকে লজ্জিত হতো না। কিন্তু ঘরের বৌকে লজ্জার ঘোমটা পড়িয়ে পর পুরুষের মুখোমুখি হতে দেওয়া হতো না। এই যে দ্বিচারিতা, না, এতেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে কোনদিন লজ্জিত হতে দেখা যায় নি। হিন্দু সমাজকেও নয়। নয় মুসলিম সমাজকেও। দুই সমাজেই পুরুষের জন্য এক বিধান। আর নারীর জন্য উল্টো বিধান। মুসলিমরা অবশ্য বলতেই পারেন, তাঁদের সমাজে একটি বিবাহ ভেঙ্গে গেলে নারীর দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বিবাহে কোন বাধা ছিল না। যেখানে হিন্দু সমাজে বিবাহ আর আমৃত্যু গোলামীর ভিতর বিশেষ কোন তফাৎ ছিল না। আর এই গোলামীকে ভদ্র কাপড় পরিয়ে সাজিয়ে রাখার জন্যেই লজ্জা নারীর ভুষণ প্রচার করতে হয়েছে।

নারীকে এইভাবে পুরুষের অধীনস্ত করে রাখার, বা আরও ঠোঁটকাটা করে বললে, নারীকে পুরুষের যৌনদাসী করে রাখার মতো চরম অনৈতিক ও বেহায়া সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার আসলেই যে কত বড়ো নির্মম লজ্জার বিষয়, সে বিষয়ে সমাজ কি আদৌ সম্পূর্ণ সচেতন? আজকের দিনেও? মনে হয় না। সমাজ আজও কি লজ্জিত হয় তার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারে? যদি হতো, তবে কি তার সামাজিক প্রতিফলন দেখা যেত না? জানি অনেকেই বলবেন আজকের সমাজ অনেক অগ্রসর। অনেক আধুনিক। সমাজকে উপর থেকে দেখলে সেরকম মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজের আনাচে কানাচে, প্রতিটি সংসারে, ঘরে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলে ছবিটা পাল্টিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। এবং তখন দেখা যাবে, যে সমাজের শুরু পারিবারিক চৌহদ্দি থেকে, সেই সমাজ আজও সম্পূর্ণ পিতৃতান্ত্রিক ভিতের উপরেই দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত। এবং সেখানে আজও নারী মূলত পুরুষেরই অধীনস্ত। 

যে কোন অন্যায় বন্দোবস্ত যখন সামাজিক ধারায় পরিণত হয়ে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারে দাঁড়িয়ে যায়, তখন সমাজবদ্ধ ব্যক্তি মানুষের চেতনায় ও বোধে, শিক্ষায় ও দীক্ষায় লজ্জা বোধের বিপুল ঘাঠতি দেখা দিতে বাধ্য। নারীকে অন্যায় ভাবে ভোগ দখল ও ব্যবহারের রাজনীতিটা শুরু হয়েছিল ঘর থেকেই। পারিবারিক সীমানার চৌহদ্দি থেকেই। সেটাই হাজার হাজার বছরের সমাজিক ধরণ রীতি ও ঘরানা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কালে কালে তার তীব্রতা কমতে পারে। ওপরের ধরণ ধারণের প্রকৃতির ভিতরেও বদল আসতে পারে। কিন্তু মূল জায়গাটি আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক ও সত্য। বাস্তব ও লজ্জার। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সমাজ কিন্তু লজ্জিত নয় ততটা। যতটা মনুষ্যত্বের দাবি।

জীবনের মূল ভিত হলো নরনারীর পারস্পরিক সম্পর্ক ভালোবাসা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা। সেখানেই যখন আমরা নারীকে আমাদের অধীনস্ত করে রেখেও লজ্জিত হই না, তখন জীবনের অন্যান্য অপরাধ অনৈতিক কার্যকলাপ ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের লজ্জা বোধের অভাব যে থাকবেই এ আর নতুন কথা কি? বিষয়টি খোলসা করেই বলা যাক। আগেই বলা হয়েছে, লজ্জা নারীর ভষণ। অনেকটা যেন, পুরুষকে লজ্জিত হতে নাই। লজ্জা পাওয়া পুরুষের বিষয় হতে পারে না। আমাদের সামাজিকতায় এই বোধ যে কতটা গভীরে শিকড় গেড়ে বসেছে, ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। যে ব্যক্তি একজন নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার সাথে জোর করে যৌন সংসর্গ করলো, সেই পাষণ্ড ধর্ষককে নিয়ে সমাজ লজ্জিত হয় না। সমাজ লজ্জিত হয় ধর্ষিতা হতভাগ্য সেই নারীকে নিয়েই। এইটি যে সমাজের ধরণ প্রকৃতি ও ঘরানা, সেই পচা গলা সমাজ থেকে মানুষের বিশেষ কিছু আশা করার থাকে না। সমাজের এই অধঃপতনের একটিই কারণ। লজ্জাকে সমাজ নারীর ভুষণ বলে চালিয়ে এসেছে হাজার হাজার বছর ধরে। আর তলায় তলায় নানান উপায়ে নানান ছলে, ধর্মের নামে রীতির নামে প্রবৃত্তির তারণায় নারীকে নানান ভঙ্গিমায় ভোগ দখল ও ধর্ষণ করে চলেছে আবহমান বাংলায়। তারপরেও সমাজ লজ্জিত নয়। এটাই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ।

এখন এই যে সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার, সেই সমাজ যে অন্য কোন অপরাধেও লজ্জিত হবে সেটা আশা করা নেহাতই বাড়াবাড়ি। ঠিক এই কারণেই আমাদের দেশে সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির ঘূণ। আমরা সব ধরণের দুর্নীতিতেই অভ্যস্ত। আমরা জেনে গিয়েছি, এই দুর্নীতিই সমাজ বাস্তবতা। ফলে গোয়ালা যখন দুধে জল মেশায়, কোন ধরণের লজ্জাই সে অনুভব করে না। শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীর মৌলিক চিন্তাশক্তি গড়ে তোলার বিষয়ের দিকে না গিয়ে শিক্ষার্থীকে নোট মুখস্থ করিয়ে পরীক্ষায় বেশি নম্বর তোলার যন্ত্রে পরিণত করেন, তিনিও কোন ভাবেই লজ্জা অনুভব করেন না। ডাক্তার যখন অতিরিক্ত কমিশনের লোভে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ প্রেসক্রাইব করে রুগীর শরীরের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিসাধন করেন তখনও তিনি লজ্জিত হন না। ইঞ্জিনীয়রের ভুল নকশায় সেতু ভেঙে পড়ে মানুষের মৃত্যু হলেও তাঁকে লজ্জিত হতে হয় না। অফিসের বড়ো সাহেব যখন ঘুস না দিলে ফাইল নড়ান না, কিংবা উকিল যখন ক্রমাগত ডেট নিয়ে নিয়ে মক্কেল শোষণ করেন। কেউই তাতে লজ্জা পান না।  ব্যবসায়ী যখন খাদ্য মজুত করে রেখে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে পণ্যের দর বৃদ্ধি করেন, কোন লজ্জা পান না তিনিও। রাজনীতিবিদ যখন কাটমানি খাওয়ার ক্ষমতায় পৌঁছানোর জন্য মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চাইতে যান, সেই হাসি হাসি মুখের আড়ালেও কোন লজ্জার অন্ধকার ঘনায় না। রাজনৈতিক দল যখন দেশের সম্পদ লুঠ করে নিজেদের ভিতরে ভাগ করে নেওয়ার চৌর্যবৃত্তিকে আড়াল করতে দেশের মানুষকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও বিদ্বেষের আবর্তে ঠেলে দেয়, কোন লজ্জাই অনুভব করে না। দেশের সরকার যখন জনগণকে ধোঁকা দিয়ে নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে সীমান্তে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে সৈনিকদের লাশ নিয়ে রাজনীতি করে, কোন লজ্জাই অনুভব করে না। 

এই যে নির্লজ্জ ভাবে লজ্জা না পাওয়ার লজ্জাজনক বাস্তবতা, যার ভিতরেই আমাদের দুই বেলা ওঠা বসা, সেই আমরা এই বাস্তবতাকেই স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েছি। নিয়েছি এমন ভাবেই যে এই নির্লজ্জ বাস্তবতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মেরুদণ্ডই হারিয়ে ফেলেছি। এতটাই হারিয়ে ফেলেছি যে সেই বিষয়ে লজ্জা পাওয়ার শক্তিও আজ আমাদের মধ্য অবশিষ্ট নাই। নাই বলেই, একটি অপরিণামদর্শী বিবেকহীন সরকার যখন কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিকের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হাজার হাজার মাইল পথ হাঁটায় মাসাধিক কাল ধরে, সেই সরকারের হয়েই আমরাও কেমন নির্লজ্জ ভাবে ওকালতি করি। এইভাবে সমাজে রাজনীতিতে ধর্মে সম্প্রদায়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি অপরাধকে প্রশ্রয় দিতে দিতে আমরা এতটাই অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি যে, লজ্জা নামক অনুভুতিটা আর আমাদের মননে চেতনায় আবেগে খুঁজে পাওয়া ভার। এই আমরাই যখন দেশের পার্লামেন্টের চল্লিশ শতাংশ আসনে দাগী অপরাধীদেরকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে জয়ের আনন্দে আবীর খেলি, কোন রকমের লজ্জা গ্রাস করে না আমাদেরকে।

এই যে লজ্জা অনুভব না করার নির্লজ্জ শক্তির ইতিহাস ও বর্তমান, এর শুরু কিন্তু সেই নারীকে পুরুষের অধীনস্ত করে রাখার ফর্মুলা আবিষ্কারের হাত ধরেই। বেহায়াপানার এই ইতিহাসের শুরু আমাদের ঘর থেকেই। আমাদের পরিবার ও বংশগত ঐতিহ্য থেকেই। আমাদের নির্লজ্জতার উত্তরাধিকার থেকেই। নারীকে ভোগ করার, নিজ দখলে রাখার, নারীর যৌবনে ব্যক্তিগত কামনা বাসনা লালসা চরিতার্থ করার রাজনীতি থেকেই শুরু। যে শুরুর কোন শেষ নাই।






শ্রীশুভ্র


কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত