আয়না
প্রায় এক ঘন্টা ধরে সাজছে, তবুও কিছুতেই যেন মেকআপটা ঠিক লাগছেনা রাণুর। এই
নিয়ে তিনবার মুছেছে ও চোখের কাজলটা, বার দুয়েক গালটা ঘষে ঘষে
ফাউন্ডেশনটা তুলেছে, লিপিস্টিকটাও বদলেছে বার তিনেক। না,
তাতেও পোশায়নি। কিছুতেই যেন মানাচ্ছেনা তাকে!
অস্থির হয় রাণু। মনে মনে প্রমাদ গোনে। এই বুঝি
অপূর্ব এসে তাগাদা দিলো তাকে। সাত পাঁচ ভেবে উত্তেজিত হয়ে ওঠে রাণু। তাড়াতাড়ি আবার
ঠিক করে সাজতে বসে। আসলে আয়নার সামনে আসা ওর অনেকদিনই বন্ধ হয়ে গেছে। প্রয়োজন
পড়েনা। ও তো কোথাও বেরোয়না। চাকরি করেনা। অপূর্বর সাথেও কোথাও বেড়াতে বা খেতে
যায়না। কিন্তু, আজ
অপূর্ব এসে ওর হাত ধরে যখন বলল যে এই অফিস পার্টিতে সবাই নিজের স্পাউস নিয়ে যাচ্ছে,
তাই ওর ইচ্ছে রানুকেও নিয়ে যাওয়ার, তখন ও আর
আপত্তি করতে পারলনা। তখন তো হ্যাঁ বলে দিয়েছিল, কিন্তু এখন
বুঝতে পারছে, আয়নার সামনে না আসার অভ্যাস ওকে সাজগোজেও অপটু
করে তুলেছে।
রাণু এবার কন্সিলারটা হাতে ধরে। চোখের কাছে যে
অংশটায় পোড়া দাগটা সবথেকে স্পষ্ট, সেখানে হাল্কা হাতে লাগাতে থাকে। কিন্তু, কিছুতেই
যেন ঠিক হচ্ছেনা। রাণু মুখের পোড়া অংশগুলোতে হাত বোলায়। প্রায় পুরো মুখটাই পুড়ে
গিয়েছিল ওর। আয়নায় মুখটা দেখতে দেখতে রাণুর মনে পড়ে যায় সেই দিনটার কথা। রাস্তা
দিয়ে যাচ্ছিল ও। হঠাৎ কে যেন ওর পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে গাড়ি করে পেরিয়ে গেল, আর কিছু একটা ছুঁড়ে দিল ওর মুখের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে, ওর মুখটা যেন পুড়ে যেতে লেগেছিল। উফ, সে কি
যন্ত্রণা! চোখে মুখে সে কি বীভৎস জ্বালা! যেন জ্বলন্ত চুল্লিতে কেউ ঢুকিয়ে দিয়েছে
ওর মুখ! আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। কষ্ট হয়, রাগে ফেটে যায়
হৃদয়। রাণুর মনে পড়ে, কেস চালিয়েছিলেন বাবা। দোষী সাব্যস্ত
হয়েছিল পাড়ার গুন্ডা রতন। কিন্তু, স্থানীয় নেতার সাথে
ঘনিষ্ঠতা থাকায় শাস্তি হয়নি তাদের।
রাণু সেদিন ভেবেছিল ওর জীবন বুঝি শেষ। এ জীবনে
আর কিছু করবে সে আশাই ও ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু,
তারপর অপূর্ব যেচে এসে যখন ওকে বিয়ে করতে চাইল, তখন রাণু অবাক হয়েছিল খুব। সে কারো করুণার পাত্র হতে চায়নি। কিন্তু পরে
বুঝেছে, করুণা নয়, অপূর্বর মনে তার
জন্য আছে ভালোবাসা।
অপূর্ব কোনোদিন ওকে অসম্মান করেনি। ওর অ্যাসিডে
পোড়ার ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। শুধু,
রাণুকে বলেছে ওর সাথে বেরোতে। কিন্তু, রাণু
রাজি হয়নি। কেমন করে হবে? বেরোতে গেলে তো সাজতে হবে। আর
সাজতে গেলে আয়নার মুখোমুখি হতে হবে। নিজের মুখোমুখি হতে হবে।
রাণুর আজও সাজতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। অনেক চেষ্টা
করছে নিজেকে আবার আগের মত সুন্দর করে তোলার,
কিন্তু পারছেনা। বিকৃত মুখটা ওকে ব্যঙ্গ করছে। রাগে ও অস্থির হয়ে
ওঠে। এই আয়নাই যত নষ্টের গোড়া। ভেঙেই ফেলবে এটাকে। রাণু ফাউন্ডেশনের শিশিটা হাতে
ধরে ছুঁড়তে যাবে, অপূর্ব ভেতরে ঢোকে। “কোথায়
প্রিন্সেস”? তারপর রাণুর দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বলে, “কি করছো ওটা হাতে নিয়ে? এখনো রেডি হওনি?”
রাণু ছলছল চোখে তাকায় পর দিকে, “আমাকে সুন্দর করে তুলবে, এমন
কোনো মেকআপ নেই”।
অপূর্ব বুঝতে পারে। ধীরে ধীরে কাছে এসে দুই হাত
দিয়ে রাণুর মুখটা তুলে নেয় ও। ওর চোখে চোখ রেখে বলে, “তোমার মেকআপের দরকার কি। তুমি তো এমনিই সুন্দর,
আমার প্রিন্সেস”।
রাণু ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে অপূর্বর দিকে। কি
শান্ত, স্নিগ্ধ অপূর্বর দৃষ্টি। কত
সততা তাতে। রাণুর ক্ষোভ আস্তে আস্তে দূর হয়ে যায়। অপূর্বর চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে ও
ভাবে, জীবনের সেরা আয়নাটা যে ওর পাওয়া হয়ে গেছে।
চৈত্রী ঘোষ হাজরা