অযোধ্যা পাহাড়ে একদিন
১
গত আগষ্টে " সোনাঝুরি সাহিত্য উৎসব
-২০১৯" এ প্রথম পুরুলিয়া যাওয়া। হাওড়া থেকে আর্দ্রা-চক্রধরপুর-এ উঠে বসলাম।
ট্রেন লেট। রাত সাড়ে বারোটার পর ছাড়ল। পৌঁছলাম সকাল আটটা নাগাদ। গিয়ে স্টেশানের
কাছাকাছি একটা লজ নিয়ে খানিক বিশ্রাম।
পরদিন ভোরেই
রওনা দিলাম অযোধ্যা পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। অযোধ্যা পাহাড়ের অনেকগুলি চূড়া। ছোটনাগপুর
মালভূমির অন্তর্গত পুরুলিয়ার সবচেয়ে বড় পাহাড়শ্রেণী হ'ল অযোধ্যা। উচ্চতা প্রায় ২০০০ ফুট। গর্গাবুরু
অযোধ্যার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ।৮৫৫মিটার উচ্চতা, এইটি শুনলাম
দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ। বলরামপুর পার করে যেতে যেতে চমৎকার
পরিবেশের ছোঁয়া পেলাম। সেদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে আমরা
নিজেদের মধ্যে নানা কথা বলছিলাম। কথায় কথায় বেগুনকেদার স্টেশানের কথা উঠল। সেখানে
শুনেছি ভূত আছে। শুনে ড্রাইভারদা এতক্ষণপর কথা বললেন। মূলত খুব চুপচাপ মানুষ তিনি।
গম্ভীর টাইপের। লম্বা , ছিপছিপে , চাপ
দাড়ি। বললেন , বাজে কথা-- এসব প্রচার করে কিছু লোক। কোনো
ভূতটূত নেই। সময় পেলে একবার দেখে আসুন ।সমস্যা নেই ।
দূর
থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম পাহাড় কেমন যেন নীলচে মেঘের মতো। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ভরে
যাচ্ছিল মন। এই ভালো লাগার অনুভূতিটা নীলগিরিতে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর দেখতে যাওয়ার মতো।
ধীরে ধীরে আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমরা উঠে গেলাম পাহাড়ের ওপরে। হঠাৎ বিপত্তি। আমি
বেড়াতে এসেছি আর বিপত্তি হবে না , তাও কী হয় ! ড্রাইভার
সাহেব বললে , হর্নটা আর বাজছে না । ওটা ঠিক করতে হবে ।
চিন্তার কথা। পাহাড়ি পথে হর্ণ ছাড়া চলা মুশকিল ।
--কী হবে এখন ?
তিনি বলছেন ,
ঠিক করাতে হবে। বলে কাছেই এক গেস্ট হাউসের ভিতর গাড়ি পার্ক করালেন ।
বললেন , আধঘন্টা মতোন লাগবে। আমি যাবো আর আসবো।
২
আমাদের প্রথম গন্তব্য ময়ূর পাহাড়। চমৎকার পাহাড়
চূড়া থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পাহাড় আর গাছ নীলচে মেঘের মতোই মনে হচ্ছে।
আমি মজা করে বললাম , পরিবেশটা
এমন , যেন দার্জিলিং-এ এসেছি । আকাশে মেঘ , ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। পাহাড়ের ওপর ছোট্ট একটা হনুমান
মন্দির । ওপরে বসার জন্য সুন্দর সুন্দর লাল আর সবুজ রঙের সিমেন্টের বেঞ্চ। কাছেই
একটা ছোট ঘর -- কারো আশ্রম । তালা দেওয়া। স্থানটি পরিষ্কার । কিছু স্থানীয় ছোট ছোট
ছেলেমেয়ে খেলছিল । পয়সা চাইল। দিলাম । বললাম সবাই ভাগ করে নিবি। ওরা আনন্দ করে চলে
গেল ।
তারপর
চলে গেলাম মার্বেল লেকে। চারিদিকে বড় বড় পাথরের মধ্যে লেক। শীতল জলরাশি ।
ধ্যানগম্ভীর , নির্জন। অনেক টুরিস্ট দেখলাম লেকের থেকে পাথর
নিয়ে যাচ্ছে স্মারক-চিহ্ন হিসেবে । অদূরে পাহাড় , রাশি রাশি
গাছ। আমার দুই বন্ধু অদ্ভুত ক্ষমতায় সে পাহাড়ে উঠে পড়ল । ওদের একজন বললে , এখানে নাকি চাঁদের পাহাড়ের শুটিং হয়েছিল। আবার রোদ উঠেছে। প্রচন্ড তেজ ।
আবার ছাতা মাথায় দিতে হল -- পচা ভাদ্রের মেঘভাঙা রোদ । আমি গাড়িতে এসে বসলাম ।
কিছু পর ড্রাইভারদা ডাকলেন। পাশেই গুমটি দোকান। বললেন , চা
খাবেন ?
--চলুন , বলে গিয়ে বসলাম পাতায়
ছাওয়া গুমটি দোকানটায় । সুন্দর মশলা চা খেলাম । কাঁচা ছোলা , শশা , পেয়ারা মাখা , মুড়ি মাখা
পাওয়া যায়। নানা কথা হ'ল। শুনলাম ,
হাতি , হরিণ , চিতাবাঘ ,
ময়ূরের দেখা পাওয়া যায় মাঝে মাঝে। বললাম , এখানে
শিকার উৎসবের কথা শুনেছি অনেক ছোটবেলায়।
--এখনো হয়। তবে আগের মতো এতো শিকার হয় না। বললে একজন । দোকানদার বললে , শীতকালে
আসবেন। খুব ভালো লাগবে।
রাস্তা খুব
একটা ভালো নয়। কাজ চলছে । দূর থেকেই গ্রামের বাড়িগুলি দেখলাম। সুন্দর , সাজানো , পরিষ্কার। ড্রাইভার
সাহেব অদ্ভুত দক্ষতায় নিয়ে এলো বামনি ফলসে। আহা , এ তো
চমৎকার স্থান। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নীচে নেমে দেখতে হয় । গভীর গর্জন । পাশের জনের কথা
শোনা যায় না। আমরা অনেকটা সময় বসলাম। আমার সঙ্গীরা ফলসে নেমে গেল। আমি জলে পা
ডুবিয়ে চুপ করে বসে থাকলাম ।দূরে পাহাড়--- ঝরে যাচ্ছে ঝরনার জল -- সবুজে ডুবে আছে
সব। যেন সভ্য ও আধুনিক জগৎ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসিত আমি বসে আছি রহস্যময় এই ঝরনার
কাছে । বামনি ফলসের সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা আমার নেই ।
এখান থেকে ফিরতে ফিরতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম।
পাঁচ-ছয়বার দাঁড়িয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে ওপরে উঠে এলাম। সময় লাগল । খিদেও পেয়েছে ।
কিন্তু উপায় নেই । ভাত-রুটি-পুরীর মতো খাবার পাওয়া গেল না । তারপর আমদের গন্তব্য
আপার ড্যাম। এখান থেকে পাহার আর নীলাভ জলের সৌন্দর্য অসাধারণ ।
৩
গাড়িতে বসেই লিখে ফেললাম একটি কবিতা । নাম :
ময়ূর পাহাড় ।
" পায়ের ওপর পা রেখেছে সময়।
ঠোঁটের 'পরে ঠোঁট।
জলের ভিতর জল দেখেছ তুমি।
আমি দেখেছি প্রেম।
নির্জনে দাঁড়িয়ে
ছিলাম। ময়ূর পাহাড়
থেকে দেখি দূরে মেঘ--
আকাশে আকাশে বিরহী শ্রাবণ।
টিলায় হয়ত বসছে তোমার আপনজন!
এই যে তুমি গহনকুসুম কবির কাছে থাকো ।
আঙুল খুব মুগ্ধ ছিল যেনো ।
পাহাড় জুড়ে ছোট্ট একটা ঘর।
উঠোন জুড়ে পাথরের বেঞ্চি পাতা।
দূরে তখন মন্দিরে ভগবান।
আমরা তখন আদিম কালের লোক।
পায়ের ওপর পা রেখেছ তুমি ।
বুকের ওপর তোমার ভারী মেঘের মতো বুক।
নরম ছিল। মধুর ছিল । কাঁপন ছিল জানি
হঠাৎ করেই মৃত্যু আসে যদি , হঠাৎ করেই
মৃত্যু আসে পাখির ঠোঁটে ঠোঁট ডোবানোর পর "।
আমার এক
বন্ধু বললে, কবিদের নিয়ে এই এক সমস্যা। কথাবার্তা কিছুই বলে
না। এখানে এসেও কবিতা লিখছে নতুবা ঘুমুচ্ছে। শুনে মৃদু হাসি ছাড়া কিছুই বলার নেই।
সত্যিই তো আমি নিজের মধ্যেই ডুবে আছি , ওদের সঙ্গে কথা হচ্ছে
কম ।
শেষ গন্তব্য ছিল সীতাকুন্ড । সেখানে নাকি
রাম-সীতা-লক্ষ্মণ এসেছিলেন। জনশ্রুতি সীতার জলপিপাসার কারণে রামচন্দ্র তীর ছুঁড়ে
পাথরের বুক চিরে জল বার করে আনেন। সেই জায়গাটি কুন্ডের মতো। স্থানীয়দের কাছে নাম
সীতাকুন্ড । সারা বছর এখানে জল থাকে। আসলে এটি একটি আর্টেজিয় কূপ। আমরা এত ক্লান্ত
ছিলাম আর ড্রাইভার সাহেব যাওয়ার জন্যে উতলা ,
খিদে পেয়েছে প্রবল , শুরু হয়েছে বৃষ্টি -- সব
মিলিয়ে সীতাকুন্ডে যাওয়া হ'ল না। আমার বন্ধুরা বললে ,
আপনি তো সীতাকুন্ডের গল্পটাই বলে দিলেন আজ তাহলে থাক । আবার না হয়
আসা যাবে । ড্রাইভার সাহেব বললে , আপনারা বামনি ফলসে অনেকটা
সময় নষ্ট করেছেন , না হলে সীতাকুন্ড দেখা হয়ে যেত। এ নিয়ে
কিঞ্চিৎ বিতর্ক হ'ল। কী আর করা যাবে। গাড়ির ভেতর থেকে দেখছি
নীল-কালো মেঘ ক্রমশ ছেয়ে ফেলছে আকাশ। বৃষ্টি নামবে।দূর থেকে পাহাড়টাকে আরো
সুন্দর ও গভীর মনে হচ্ছে ।
জল রঙে আঁকা।
গাড়ি চলছে। ধুলো উড়ছে। বিকেলের আলো নিভে আসছে দ্রুত। সিঙাড়া ভাজার গন্ধ নাকে এসে
লাগছে। অথচ শুরু হল মেঘের ডাক। গাড়ি থামিয়ে তেলেভাজা আর মিষ্টি কেনা হল। কিন্তু
লজে পৌঁছোনোর আগেই নেমে গেল বিকেলবেলার বৃষ্টি।
ছবি: ময়ূর পাহাড় , মার্বেল লেক ।
অমিতাভ দাস