সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সুদীপ মাইতি


"আহা, কি আনন্দ  আকাশে বাতাসে"


" গনশা, একটা চিনি ছাড়া। ছোটো।"
 "ও দেবুদা, আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি?"
ওদিকে আড্ডাতে বসা খোকন, মদন, সৈকতেদের চার পাঁচ জনের দল থেকে কথাটা উড়ে এলো দেবুর দিকে।
"ও , বলবি তো। ভাবলাম তোরা কি আবার চা খাবি? তোদের  বয়স কম । তোদের এতো চা খাওয়াও তো ঠিক নয়। এই তো সেদিন  তোদের বন্ধু যতীনকে চা খাওয়ার কথা বলতে ,সে বললো না দেবুদা আর চা খাবো না। আমি সারাদিনে ওই দুবার চা খাই। একবার সকালে। ঘরে। আর একবার সন্ধ্যের সময়। গনশার দোকানে।  তাই তোদের আর বলিনি।"
কথাটা সুন্দর করে  খোকনদের বুঝিয়ে দিলো দেবু। ভাবলো ব্যাপারটা মিটে গেল। কিন্তু  মদনা ব্যাটা হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলো। বলে উঠলো, "দেবুদা আমি তো সেদিন ছিলাম। যতীন তো ভয়ে সেদিন চা খায় নি। কারণ সে আমাকে বলেছে, তুমি  নাকি এরপরে তাড়াহুড়ো করে চা খেয়ে চলে যাও।  তখন দাম দিতে হয় বাকি জনকে। সেই ভয়ে অনেকের মতো যতীন ও সে পথে হাঁটে নি।"
এই কথা শুনে দেবুদা মদনাকে এই মারে কি সেই মারে।বেশ  চোটপাট শুরু করে দিলো।সেই শুনে পাড়ার বয়স্ক মানুষ   পটলদা ( তার আসল নাম অটল গিরি লোকে ভুলেই গেছে)বলে উঠলো, "আরে ও  দেবু। খালি খালি বাচ্চাদের কথায় রাগছো কেন? ওরা তোমাকে কতদিন দেখেছে? তোমার যে কত বড় হৃদয় সে তো আমি জানি।তুমি এই দোকানে কত জনকে কাপের পর কাপ চা খাইয়েছো এসব কে না জানে। এই আমাকেও কি তুমি ছেড়েছো? আমি পাশে থাকলে, তুমি  নিজে চায়ের অর্ডার দিলে আমাকে প্রায়ই অফার করো। এরকম অনেক বার হয়েছে  আমি হয়তো চা একটু আগে খেয়েছি তাই আর খাবো না বলেছি।কিন্তু আমার চায়ের দাম একসঙ্গে তুমিই মিটিয়ে দিয়েছো।সে সব কথা এই সেদিনের ছোঁড়ারা বুঝবে কি করে?"
গনশা দোকানে বসে এই সব দৃশ্য দেখে বুঝলো , আজ আর দেবুর বেরোনোর রাস্তা নেই।  এ যেন ঘুঘু দেখেছো ফাঁদ দেখোনি অবস্থা। 
বাবা অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই চরে বেড়ানো গনশা দোকানে বসতে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছে। মায়ের মুখ ঝামটা, বোনের পড়াশোনা আর পেটের জ্বালা।সব মিলিয়ে আর উপায় ছিল না। বাবা এমনিতে হাতের গুনে ও নিজের ব্যবহারে এই চা বিস্কুট ও টুকিটাকি প্রয়োজনের দোকানটা গ্রামের এই মোড়ে ভালোই জমিয়েছে। তাই   গনশার এখানে নতুন করে খেটে কিছু  তৈরী করার ব্যাপার ছিল না। যদিও গনশার ব্যবহার ছোট বেলা থেকেই ভালো। ক্লাস টেন দু বারে ডিঙতে না পারলেও গুরুজনদের সম্মান দেয়।  সেই ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় থেকে বিড়ি খাওয়া শুরু করলেও এখনো গুরুজনদের সামনে খায় না।বিড়ি খাওয়া অবস্থায় হটাৎ বড়দের সামনে পড়ে গেলে জ্বলন্ত বিড়িটা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ফেলে দেয়।এবং মুখ লুকিয়ে চলে না গিয়ে বড়দের সঙ্গে  বিনয়ের সঙ্গে তাদের ভালো মন্দের খবর নেয়। তবে  সেই 'ভালবাসার' লোকটি একটু আড়াল হলেই বিড়িটা  মাটি থেকে তুলে মুখে দিয়ে আবার রাস্তায় চলতে শুরু করে। কারণ সেই ক্লাস ফাইভে যার হাত ধরে তার এই বিড়ি টানার অভ্যাস শুরু হয়েছিল সেই ভীমদা তাকে শিখিয়েছিল 'বিড়ির শেষ দিকের টানটাই আসল সুখটান, বুঝলি গনশা'। তাই সেই বেদবাক্য সে আজও মেনে চলেছে। তবে আর একটা খাদ্যবস্তুর সঙ্গেও ভীমদাই গনশার পরিচয় করে দিয়েছিল। সেটা হলো রঙ্গিন পানীয়। আসলে এটা পেটে পড়লে  বেশ ভালো লাগে। এই দোকানে বসলেও সন্ধের মুখে একটু তাকে পেটে ফেলতেই হয়। অনেকদিনের অভ্যাস। বাবা যতদিন দোকানে বসতো  ততদিন গনশার কোনো চিন্তা ছিল না।  এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াতো। আড্ডা মারতে মারতে একটু আধটু পেটে ফেলে দিত। নেশা কাটলে বাড়ি ফিরতো। চুপ চাপ খেয়ে শুয়ে পড়তো। কোনো গোলমাল ছিল না। কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্যরকম।একদিকে বাঁধা খরিরদার রয়েছে। আবার সন্ধ্যের সময়   একটু পেটে না পড়লে খালি মনে হয়, কি যেন হলো না, কি যেনো হলো না।মনটা খালি উড়ো উড়ো করতেই থাকে। তাই গনশা নিজেকে আটকাতে না পেরে   সন্ধ্যায় এক দু চুমুক মেরে দেয়। কাউকে বুঝতে দেয় না ।  এতে খরিরদারদের কিছু অসুবিধা হয় না। বরং  চা বিস্কুট সহ  যারা কিছু  ধারে   খেয়ে যায় তাদের খাতায় লিখতে অনেক সময় গনশা ভুলেই যায়।আর এটা অনেকে ধীরে ধীরে বুঝতে পারার পরে সন্ধ্যের চায়ের আসরটা এখন বেশ বেড়েই গেছে।তবে চারজনের সংসার এতে মোটামুটি ভাবে চলে যায় বলে গনশাও এবিষয়ে কিছু ভাবেনা। বা তার ভাবার উপায় নেই।সন্ধ্যায় পেটে ফেলতেই হবে। না হলে বরং দোকানদানিই ঠিক ঠাক করতেই পারবে না।
ওদিকে পটলদার প্যাঁচে পড়ে দেবু আর বিশেষ এগোতে পারলো না। ভাবলো আর বেশী এগোলে লোকের সংখ্যা বাড়তে পারে। পটলদা মুখে যাই বলুক দেবু ভালো করেই জানে পটলদা একদম ঘুঘু মাল। পটলদার চায়ের দাম কখনই দেবু দেয় নি। সেই রাগে  এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে চাইছে পটলদা। অথচ সেকেন্ড রাউন্ড চা বেশীর ভাগ সময়ই কারোর না কারোর ঘাড়ে  চাপিয়ে চলে গেছে দেবু। আজ যেন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সবাই জড়ো হয়েছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে গনশার দিকে চোখ পড়তেই দেবু বুঝলো গনশাও বেশ মুচকি হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর ব্যাপারটা গুলিয়ে দিতেই গনশা বলে উঠলো, "দেবুদা,  কি সেই এক কাপ চিনি ছাড়া , ছোটো?"  এটা শুনেই দেবুর মাথা গেল গরম হয়ে। ভাবলো এই সুযোগ ।এতজনের মাঝে নিজের হ্যাকাল হওয়াটা গনশার উপর চাপাতে হবে।
বললো ,"শোন গনশা। এদের ও চা দে। তবে তুই তো সন্ধ্যের সময় এ জগতে থাকিস না। আমার নামের খাতায় অন্যের চায়ের হিসাব লিখে দিস।সেটা কি আমি বুঝি না। তাই আজ থেকে প্রতিদিন খাওয়ার পর ধারের খাতায় আমি নিজে লিখে যাবো। তোর উপর ভরসা, আর যেই পারে করুক আমি করবো না।" কথাটা সবার সামনে সব  রাগ জড়ো করে দেবু বলাতে গনশার বেশ খারাপ লাগলো। তবে এটুকু বুঝলো, মাতালকে মাতাল বলাটা যে ঠিক নয় সেটা এই দেবু গাধাটা জানে না। আবার আনন্দও হলো তার। ভাবলো দেবুর খাতায় এবার থেকে ঠিক ঠাকই লেখা হবে।আর দেবুর কথা বিশ্বাস করে যদি আর কেউ কেউ সেই পথ ধরে তবে তার লাভটা ও বাড়বে । সেই সঙ্গে দু পেগের পরিবর্তে তিন পেগ সন্ধ্যেবেলা পেটে ফেলতে পারবে। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ভেবে দেবু  লাল, সাদা সব রকমের চা করাতে মন দিলো।





সুদীপ মাইতি