হেমন্তের বনে তার পায়ের শব্দ
রবিবারের
সকালবেলা রোদের মধ্যে দিয়ে প্রেতের মতো ফিরে ফিরে আসে লাল মেঝের বারান্দা,বাবার রেজারের ব্লেডের ধার।কেটে ফালা ফালা করে দেয়
আমার এই নতুন সাজানো গোছানো জীবনের সমস্ত মানেগুলো। কোথায় যাবো আমি? ঘুম থেকে ওঠার পর এই এক প্রশ্ন সমস্ত শরীর জুড়ে জেগে থাকে। যাওয়া শুধু
মনের নয়,শরীরেরও একথা বুঝে নিতে বেশ অনেকটা বয়স কেটে গেলো। হয়ত
ফিরে যাওয়া কঠিনের মধ্যে থেকে আরও একটু সহজে যাওয়ার নাম বেঁচে থাকা।
রবিবার
সকালবেলা নিজেকে তন্ন তন্ন করে দেখি একটাই প্রশ্ন জেগে থাকে। কোথায় যাবো আমি? পথে থেকে পথে,মত থেকে মতে
শুধু যাওয়া আর যাওয়া। কিছুই ছুঁতে না পারা। হয়ত একদিন একটা বন্ধ দরজার কাছে থমকে
যেতে হবে। হাতের অল্প আঘাতে জেনে নিতে হবে ওপারে কেউ আছে কিনা।
ওপারে কে
থাকে?
একটা ফাঁকা
শব্দ সারা ঘর জুড়ে,হয়ত
আমারই। বালতির থেকে জল উপচে পড়ছে ছলাৎ ছলাৎ।পাখার একটা সোঁ সোঁ শব্দ অতিক্রম করে দূর থেকে একটা গান ভেসে আসে। সেই
গান আমার এই শূন্য ঘরের ভেতর বয়ে যেতে যেতে একটা ঝড় হয়ে যায়। নিস্তব্ধ ঝড়। যার
হাওয়া নেই,শব্দ নেই।খালি একটা অস্থিরতা আছে
ছুটিয়ে মারার। আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায় স্মৃতিতে। বলে,এই দেখো
ফুরিয়ে যাচ্ছে সব,ধরে রাখো,লিখে নাও। আমি
এই ব্যর্থ দুহাতে আর ধরে রাখতে পারি কতদূর? ঝড় জবাব দেয় না। ঝড়ের
জবাব দেওয়ার কোন দায় নেই।
কিছুই পায়না
যে তার নিজের মতো করে একটা পাওয়া থাকে। যে পথ ফুরিয়ে গেছে সে পথের এক অন্তহীনতা
রয়েছে। সেই পাওয়ার মধ্যে থাকি,সেই ফুরোনো পথ দিয়ে হেঁটে যাই অনন্ত ঘুমের ভেতর। ক্ষমা করে করে যাই নিজেকে,
পারলে আরেকটি নতুন পথ পাই।
তাই সভ্যতায়
আর থাকা হল না। আগুনের পথ কেবল আলোর মধ্যে রেখে চারিদিকে অন্ধকারের নেশা জাগিয়ে
তোলে। অথচ যে আগুন দাহ্যগুণ ছেড়ে এসে বসেছে পলাশের মায়ায় সে আমার ঘরের।
পুজো আসে যেন
বহুদূর প্রবাস থেকে ফেরা কোন বন্ধুর মতো। এবার ধীরে ধীরে সে খুলে দেবে তার
বাক্সটা। বের করে আনবে হেমন্ত শীত বসন্ত কত উপহার। সে সব আমারই,তবু কেন যেন কোন উপহারের মধ্যে নিজেকে পাই না। নিজেকে
পাই সব ছেড়ে চলে আসা পথিকের মধ্যে। জগতের সেই ডাক যে পেয়েছে তার কোন উপহারেই কোন
মন নেই। সে জানে যন্ত্রণা আছে,ক্ষয় আছে,মৃত্যু আছে তবে সবথেকে বড় আছে যা তা হল ভালোবাসা।
এই ভালবাসার
কাছে আমি মাথা নত করেছি। কোন অধিকার বা অধিকারহীনতা নয়,এ এক বোধ আমাকে সদা জাগ্রত রাখে। আমাকে শূন্য থেকে
বারবার শুরু করায়,সমস্ত অর্থহীনতার মাঝে একটা বাঁচার মানে
দেয়।
আমাকে ফিরিয়ে
নিয়ে যায় সেই দিনের ভেতর যেখানে সমস্ত না পাওয়ার মাঝে মানুষ আশ্চর্য ভালো বেঁচে
নিতে পারে। রবিবারের সকাল,মাঠের
ঘাসের ডাক,দুপুরের খাঁ খাঁ করা দুপুর যেন দুলে দুলে ভরিয়ে
দিচ্ছে আমার হৃদয়ের শূন্যতাকে।
বিকেলের সেই
পাড়া বেড়ানো মায়া,অদূর
মুসলিম পাড়ার বিকেল চারটের মসজিদ সুর যে কতদূর নিয়ে যেতে পারে তার তল পাই না।
তল পেতে চাই
এই জীবনের সামান্য। যেমন এই লোক দেখানো জীবনের প্রতিটি চাওয়া পাওয়া সমীকরণ ছেড়ে
চলে যেতে চাই একটি লম্বা শাদা খাতার মতো জীবনের কাছে।লিখে যেতে চাই আমার জীবনদলিল।
লিখে যাওয়া ছাড়া এ জীবনে বড় কোন পথ আমি পাইনি।
সেসব ছেপে
প্রকাশ পাক বা না পাক কলেজ স্ট্রিট বা শান্তিনিকেতনের প্রকাশকের কাছ থেকে। তবু মনে
হয় একদিন তার ভেতর থেকে আমার প্রতিটি বিপন্নতার সাথে নিজেকে আশ্চর্য মিলিয়ে কেউ
খুঁজতে আসবে আমায়। বনের ভেতর একটা ঘর,চারিদিকে বেড়া আর একটা পোষ্য আপনমনে ঘাস খায়। মানুষের যাতায়াত বন্ধ হয়ে
যাওয়ায় সে ঘরের চারিদিকে বেড়ে উঠেছে ঘাস। সে ঘাস পায়ের শব্দ ফেলে হেঁটে যায় বাতাস,তেমনই একদিন আসবে কেউ। জানবে জীবনের এক অন্য পথ যারা পেয়েছি একদিন আকাশ
থেকে।
বিদায় আমার
প্রকাশ্য লেখার আত্মা। বিশ্বাসএকদিন কেউ খুঁজে নিতে আসবে,শরতের এই শেষ চিঠি হাতে। হেমন্তের বনে তার পায়ের
শব্দ শুনে আমি জেনে নেবো সমস্ত ভুলের মাঝে একটি ভুল আমার অক্ষয় আশ্রয় হয়ে আছে
কেউ আসবে
হয়ত রোহিণী।
দীপ শেখর চক্রবর্তী