সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সাগর বিশ্বাস




গ্রন্থ গ্রন্থবৈরিতা



ফ্রান্সিস বেকন বলেছিলেন, “রিডিং মেকেথ ফুল ম্যান, কনফারেন্স রেডি ম্যান অ্যান্ড রাইটিং পারফেক্ট ম্যান কথাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মানুষের পরিপূর্ণতা লাভের জন্য লেখা এবং ড়া সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা মতবিনিময়ের কোনও বিকল্প নেই প্রাচীন মানুষ যতকাল লিপি আবিষ্কার করতে পারেনি ততকাল জ্ঞানচর্চা ছিল নিছক শ্রুতি স্মৃতিনির্ভর তারপর যখন তার লিপিবদ্ধকরণ  ক্রমে মুদ্রণযন্ত্রের সাহায্যে স্থায়িকরণে সমর্থ হল, তখন থেকেই সভ্যতার হাজার দুয়ার খুলে গেল জ্ঞানের চর্চা প্রয়োগের অবিকল্প মাধ্যম হল  গ্রন্থ গ্রন্থাগার কিন্তু জন্মের পর থেকে তার বিরুদ্ধে আক্রমণও সংগঠিত হয়েছে বার বার সে ধারা আজও বহমান

 গ্রন্থবিদ্বেষীদের যদি কোনও নামের তালিকা বানাতে হয় তবে প্রথমেই যে নামটি উঠে আসবে তিনি অ্যাডলফ হিটলার অন্ধ জাতীয়তাবাদ গনতন্ত্রের জনমোহিনী প্রচার চালিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তার দল জার্মানির শাসনক্ষমতা দখল করেছিল পরবর্তী ইতিহাস বিশ্ববাসী দেখেছে ব্যক্তিপরিচয়ে হিটলার বই লিখতেন, গান শুনতেন, প্রেমের ভাষায় কথাও বলতেনকিন্তু ক্ষমতার দম্ভে নিজের চেয়ে বড় হয়ে ওঠা মানুষটি কিভাবেবিশ্বত্রাসহয়ে ওঠেন, তা ইতিহাস ও রাজনীতির পাকমাত্রই জানেন গত শতকের তিনের দশকে তার সরকারের উদ্যোগে জার্মানির গ্রান্থাগারগুলি থেকে লক্ষ লক্ষ বই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে ১৯৩৩ সালে বার্লিনে লক্ষাধিক মানুষের সামনে মাত্র একদিনেই কুড়ি হাজার বই জ্বালিয়ে প্রচারমন্ত্রী গোয়েবস জনতাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘অতীতের এইসব অশ্লীল জঞ্জাল পুড়িয়ে আজ রাতে আপনারা একটা বিরাট প্রতীকী কাজ করলেন আপনাদের এই ব্যাপক, শক্তিশালী  এবং সংকেতধর্মী কাজ সারা বিশ্বের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেবে যে, পুরোনো মূল্যবোধের দিন শেষ ভগ্ন স্তুপ থেকে উঠে আসবে নতুন দিনের ফিনিক্স পাখিএভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন গ্রন্থ নিশ্চিহ্ন করেছিলো তথাকথিত জাতীয়তাবাদের নামে গঠিত হিটলারের  ফ্যাসিবাদী সরকার


তবে এমনকৃতিত্বেরঅধিকারী কেবল হিটলার নন খ্রিস্টপূর্ব ৪১১ অব্দে এথেন্স শহরে পিথাগোরাসের পুঁথি পুড়িয়ে যে পুস্তকবিদ্বেষের শুরু, তা ইওরোপ থেকে ক্রমশ মধ্যপ্রাচ্য হয়ে সারা বিশ্বেই পরিব্যাপ্ত হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে আলেকজান্দ্রিয়ায় যে বিশাল গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে তার পিছনে রাজশক্তির অবদানই ছিল সর্বাধিক টলেমিরা রাজনৈতিক স্বার্থে জ্ঞানচর্চার মনোপলি করতে চেয়েছিলেনপরবর্তীকালে ইসলামিক শাসনব্যাবস্থায় আবার রাজনৈতিক স্বার্থেই সে গ্রন্থসম্পদ প্রশ্নের সামনে উঠে আসে ইসলামের মহাগ্রন্থ কুর-হানের-এর আনুসারী না হলে এত বিশাল গ্রন্থসম্ভারের উপযোগিতা কী? ১৫৬২ সালে মেক্সিকোয় স্প্যানিশ দখলদারেরা ধারাবাহিকভাবে মায়া সভ্যতার আকর গ্রন্থগুলি নিশ্চিহ্ন করতে থাকে এ কাজ চীনারা করেছে তিব্বতে, সিংহলের জাতীয়তাবাদীরা তামিল গ্রন্থাগারগুলিতে, খেমেররোজ পার্টি কম্বোডিয়ার গ্রন্থাগারে, দ্বাদশ শতকে  তুর্কীরা করেছে ভারতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে(১১৯৩) ১৯১৪ সালে জার্মানরাও তাদের গ্রন্থাগারে সঞ্চিত তিন লক্ষ পাণ্ডুলিপি ধ্বংস করে দেয় খুব বেশিদিনের কথা নয়, গত শতকের সাতের দশকে নকশালপন্থী আন্দোলনকারীরাবুর্জোয়া শিক্ষার প্রতীকঅভিযোগে বহু গ্রন্থাগার তছনছ করেছে ১৯৯৮ সালে আফগানিস্তানের তালিবানেরা পঞ্চান্ন হাজার বই পুড়িয়ে দিল চিলিতে গার্শিয়া মার্কেজেরক্লা্ন্ডেস্টাইন ইন চিলির বারো হাজার কপি পোড়ান হয় তুরস্কে পুড়েছে ওরহান পামুকের বই কিছুদিন আগে আমেদাবাদে পোড়ান হয়েছিল অরুন্ধতী রায়েরদ্য গ্রেটার কমন গুড আর বাংলাদেশে তসলিমা নাসরিনের বই জ্বালানোর ঘটনা তো সকলের জানা তাঁরদ্বিখন্ডিতএদেশের মতো ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডেও পুড়েছে ব্রিটিশ মুসলিমদের হাতেআর ইসলাম দুনিয়া এবং আমেরিকার পারস্পরিক বিদ্বেসসূ্ত্রেই আমরা দেখতে পাই সেনানিবাসে কুর-আনের পাতা পোড়ে (আফগানিস্তান) কিংবা গুলির মহড়ায় কুর-আন হয় টার্গেট (বাগদাদ, ২০০৮) ২০১০ এর সেপ্টেম্বরে তো ফ্লোরিডায় এক চার্চের প্যাস্টর (টেরি জোন্স) রীতিমত আগাম ঘোষণা করে কুর-আনের বহ্নুৎসব করতে চেয়েছিলেন সুখের কথা, আমেরিকার নাগরিক সমাজ ও সরকারের শুভবুদ্ধি সে উদ্যোগ সফল হতে দেয়নি

কিন্তু কেন? বই তো একটি শান্ত, কঠিন, নিষ্প্রাণ বস্তু তার বিরুদ্ধে এত হিংস্রতার কারন কী? প্রয়োজনটাই বা কোথায়? রবীন্দ্রনাথের চোখে সমুদ্রের শত শত বছরের কল্লোলকে ঘুমন্ত শিশুর মত চুপ করিয়ে রাখলে যে নীরব মহাশব্দ বন্দি হয়ে থাকে, তাই গ্রন্থাগার নীরব হলেও ওই মহাশব্দের সুগভীর ভূমিকা আছে তাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব দুই মলাটে আবদ্ধ ওই মহাশব্দই সর্বকালে মানুষের দর্শন ও মননকে সমৃদ্ধ করেছে, তার চিন্তা ও চেতনার প্রসারণ ঘটিয়েছে, তার যাবতীয় নির্মাণ ও সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছে-এক কথায় সভ্যতার চক্রযানকে গতিশীল রেখেছে মুদ্রিত, অমুদ্রিত যাবতীয় রচনাই মানুষের অর্জিত সভ্যতার রত্নগর্ভ ফসল অরওয়েল লিখেছেন, ‘হু কন্ট্রোলস দি পাস্ট কন্ট্রোলস দি ফিউচার, ‘হু কন্ট্রোলস দি প্রেজেন্ট কন্ট্রোলস দি পাস্ট তাই দেখা যায়, বিশ্বের স্বৈরাচারী শাসকেরা বারবারঅতীতকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে, নিজেদের সুবিধেমত মতবাদ প্রতিষ্ঠাকল্পেবর্তমানকে করায়ত্ত করার চেষ্টা করেছে গ্রন্থসংহার তারই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এ বিষয়ে ধর্মীয় মৌলবাদীরাও কম অসহিষ্ণু নয় ব্লাসফেমির অজুহাতে তারা কিছু কম হাঙ্গামা বাধায়নি কত লেখা, কত লেখক, কত প্রতিষ্ঠান তাদের রোষানলে দগ্ধ হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও তাই নেপোলিয়ন জানতেন যে মাত্র চারটি বৈরী সংবাদপত্র হাজার হাজার বন্দুকের চেয়েও শক্তিশালী কিন্তু সে তত্ত্ব পৃথিবীর বহু স্বৈরশাসক, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কিংবা আধিপত্যবাদী  শাসকচক্র মানেনি ইতিহাস তার সাক্ষী হয়ে আছে তাই মনে হয়, মুক্তচিন্তার পৃথিবী আজও মানুষের নাগাল থেকে অনেক দূরে

তবে আশ্বাসের কথা এই যে, মানুষের জন্য যা খাটেনা তাকে খাটানোর অপচেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে বারবার হতে বাধ্য ইতিহাস সময়মত সবই কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেয় বুঝিয়েও দেয়




সাগর বিশ্বাস