মেয়েটি
সকাল হলেই ২৪ এর ফারা গোনে!...
'২৪' ভানুর জীবনে একটা মস্ত বড়
অভিশাপ! সামাজিকতা-পারিবারিক দায়িত্ববোধ তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে মেয়েটাকে! 'বিবাহ' তার কাছে অনেক পরিচিত তবে জটিল একটা
সমীকরণ।জোর করে দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার অপ্রীতিকর সম্পর্ক একটা। ভানুর কাছে বিয়ে
ভয়মিশ্রিত একটি শব্দ।
'ভালোবাসা' কি তা ইহজীবনে জানতে পারলনা ভানু,তবে সোহাগে মোড়া একটা মায়াবী সম্পর্কের খোয়াব বোনে মেয়েটি মনে মনে। স্বপ্ন
বোনে বৈবাহিক প্রেমের। ভানু বাস্তব জগত থেকে চোখের পাতায় যে সকল অভিজ্ঞতার নুড়ি
কুড়িয়েছে তার থেকেই সে জানে আর মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে 'বিবাহ'
একটা অভিশাপ। ভানুর জীবন এভাবেই দ্বন্দ্বের দোলাচলে দোদুল্যমান!
হাতে
শাখা-পলা ওঠার দুদিন পর থেকেই সংসার নামক কারাগারে বন্দী হওয়া নারীপ্রাণের অস্ফুট
কান্না আর কেউ শুনতে পাক বা না পাক,ভানু ঠিক শুনতে পারে।ভানু কি জ্যোতিষী? ত্রিনয়নী? পুরুষবিদ্বেষী?না, আসলে ঠিক তা
নয়। ঘরে ঘরে হওয়া অত্যাচারের খবর জানে বা রাখে সক্কলেই শুধু পরনিন্দায় লিপ্ত
নিন্দুকের দল সমাধানের বুলি আওড়াতে চায় না।তারা পারে শুধুই 'চারদেয়ালের
কথা চারদেয়ালেই থাকা ভালো' এমনতর গা বাঁচানো কথার স্রষ্টা
হতে।
প্রথাগত
নিয়মের আগলে বন্দী ভানুর মা-বাবাও প্রতিষ্ঠিত,ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সুপাত্রের অন্বেষণ করছে ভানুর জন্যে। সমাজের আর পাঁচটা
লোকের মতো হরিপদ বাবু এবং অন্নদা দেবীও মেয়েকে ২৪ এর নামতাটা ভালো করে শিখিয়ে
দিচ্ছেন নিত্যদিন। বিবাহ-পরিবার-সংসার-সন্তান-দায়দায়িত্ব এ সবই তো শুনছে ভানু রোজই
তবুও, ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো কালো পর্দা হয়ে বর্তমানে চোখ
ঢেকে দেয় তার।
ভানু উচ্চশিক্ষিত। ভালো-মন্দ বোঝার জ্ঞান নূন্যতম হলেও তার
আছে। মা-বাবা তার কাছে একমাত্র সম্বল আর ঈশ্বরে ভক্তিই ভানুর সহায়। সবই তো আছে ভানুর
জীবনে,নেই শুধু একটা মনের মানুষ।
--
জেদী,গোঁয়ার মেয়ে একটা। ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘুরছো সারাদিন। কিছু
বলি না বলে না? তোমার বয়সী মেয়েরা তাদের সন্তানদের স্কুলে
নিয়ে যাচ্ছে। আর তুমি ঘরে বসে অন্ন ধ্বংস করছো খালি। অনেক দিন তো হল,এবার যাও নিজের সংসার সামলাও। হরিপদ বাবুর এসব কথাগুলো খুব বিষাক্ত ঠেকে
ভানুর কাছে!
মেয়েটা
বারংবার তার অগোছালো জীবনে মনের মানুষের মূর্তি গড়ার চেষ্টা করে তার বাবার
আদলেই।বাবা তার চোখে এমন সার্থক পুরুষ যে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয় সংসারের দুই
নারীকেই। তবে ২৪ এর ফারা ললাটে অঙ্কিত হওয়ার পর থেকেই বাবার এই বীভৎস রূপ দেখে 'সব পুরুষই একরকম' এরকম ভাবনা লালন করতে শুরু করেছে
ভানু!
ভানুর
জীবনে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বন্ধু-বান্ধবদের সংখ্যা ছিল অনেক। আজ তারাই
তার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন। ভানু তাদের প্রত্যেকের থেকে অনেক এগিয়ে। কলমের খোঁচায়
যুগান্তকারী লেখা ফুটিয়ে তুলতে পারদর্শি মেয়েটা। 'বড় লেখিকা হয়ে গেছিস তো' এমনতর বাক্য বর্ষন করে ভালো
বন্ধুরাও আজ জীবনের গতিপথ থেকে বিদায় নিয়েছে ভানুর! ওরা শুধু কথা শোনাতে জানে,টিকে থাকতে জানে না।ভানু জীবনে কখনও উচ্চ-নীচ বিচার করে বন্ধুত্ব
করেনি। বন্ধুত্ব হয়েছিল মনের টানে। তবে,শেষপর্যন্ত কেউই পাশে
রইল না!
ভানুর খোলা জানলা আর
দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ সঙ্গী করে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হচ্ছে
প্রতিদিন। জাগতিক অদৃশ্য শৃঙ্খলগুলি যতই ধেয়ে আসছে ভানুর দিকে 'মানতে তোমাকে হবেই' এই কঠোরতা নিয়ে,ততই যেন ভানুর জেদের পারদ ক্রমবর্ধমান। জেহাদ ঘোষনা করছে মেয়েটি মনে
মনে।ক্ষুরধার লেখনী শক্তির গুণে দিন রাত পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ভানু।
ভানুর মা অন্নদা দেবী মেয়ের পাশে আছেন ঠিকই,তবে
পুত্রসন্তান হলে ভালোই হত, এই যে অতৃপ্তি তা আজও তাকে কুরে
কুরে খায় আর সুযোগ পেলেই, মেয়েকে কথা শোনাতেও ছাড়েন না
তিনি। কিই বা করবেন! সমাজ-সংসারের বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েকে সমর্থন করা সবসময় সম্ভব হয়ে
ওঠেনা তার পক্ষে। স্বামীর সাথে গলা তুলে তিনিও মেয়েকে ভারী ভারী শব্দ প্রয়োগের
মাধ্যমে কোনঠাসা করতে পিছপা হন না মাঝেমধ্যেই। আর ভানু নিমবাক্যগুলো গলাধঃকরণ করে
মেঝেতে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকার প্রয়াস করে নিরন্তর। মা'কে প্রিয়
সখী হিসেবে পাওয়ার প্রচেষ্টা ভানুর মৃত্যুর অন্তিম ক্ষন পর্যন্ত থাকবে,তবে তা সফল হবে কি না জানা নেই! হয়তো সত্যিই এক জীবনে সবটা পাওয়া কারওর
ভাগ্যেই লেখা থাকে না!
ভানু জানে বর্তমানকালে চাকরী পাওয়াটা, কতটা
কষ্টসাধ্য। প্রতিযোগিতা-ছল-চাতুরী এসবের উপর নির্ভর করেই টিকে আছে একটা ভালো চাকরী
আর মোটা মাইনে। ভানু দেনা-পাওনার সম্পর্কে জড়াতে চায়না,চায়
নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠা পেতে। ভানু কারওর নিকট মাথা নীচু করতে রাজি
নয়।মানিব্যাগে থাকুক না একটাকা,তবুও চরিত্র যেন থাকে ষোলো
আনার মত খাঁটি।ভানুর এসব উন্নত চিন্তাভাবনার কদর করার মতো মানুষ - শূণ্য!তবুও ভানু
বিশ্বাসী- শূণ্যতে তো শেষ নয়,শূণ্যেই তো শুরু। ভঙ্গুর আঁশ
বিন্দু থেকে সংগৃহিত আশারকনাগুলি দিয়ে ভানু নিজেকে গড়ার অদম্য প্রয়াস চালিয়েই
যাচ্ছে। ভাঙছে বটে তবুও সে বিশ্বাসী- ব্যর্থতাই সৃষ্টির অনুপ্রেরণা যোগায়।
বাস্তবের
ভোর যখন ভানুর স্বপ্নে বাঁচা চোখে কড়া নাড়ে, তখন আবারও সবটা জলের মতো পরিস্কার হয়ে ওঠে। আসলে বিবাহে আছে
দাসীবৃত্তি-নিত্য মনোরঞ্জনের খেল আর বেলাশেষে নিথর শরীরটা নিয়ে যৌন লীলায় মেতে
ওঠার নিকৃষ্টতা! অচেনা এক পুরুষকে বিবাহ করে বলিদানের ভেলায় ভেসে আজীবন মুখোশ পড়ে অভিনয় করাটা ভানুর পক্ষে
কখনই সম্ভবপর নয়। ভালোবাসা সেখানে রোজ অস্ত যায় সূর্যাস্তের আগেই! ঘোলাটে হয়ে যায়
পীড়িতি চার দেয়ালের আঁশটে বাদবুতে!
ভানু ঘুম ঘুম চোখে 'সুবর্ণলতা' বুকে চেপে শুয়ে থাকে। সর্বক্ষন একটাই দ্বন্দ্বে বাঁচে - কোনটি ঠিক আর কোনটি
বেঠিক? আর পাঁচটা মেয়ের মতো সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করা কী
সম্ভব ভানুর পক্ষে? নাকি একাকীত্বেই মুখ গুজে বাঁচবে বাকীটা
জীবন? নিঃস্ব হয়ে বাঁচাটাই হয়ত শ্রেয়। আর যাই হোক সেখানে
নতুন করে হারানোর কোনও ভীতি থাকে না।
ভানুর কাছে চারদেয়ালের থেকে অনেক প্রিয় ঝুল বারান্দা। প্রকৃতির
সাথে কোলাকুলিটা সেখানেই সম্ভব। আর সেখানেই ভানু বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পায়।
সামাজিক
দৃষ্টিকোণ থেকে,ভানুর জীবন বয়সের এমন
নির্জন প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে যেখানে গলির বাঁকও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আর গাছের পাতারাও ন্যুব্জ, যৌবনের কালবেলায়!
ভানু লিখিত নিয়মাবলীর গর্ভে আর স্বীয় ভাবনার উদার অঙ্গনে জিরিয়ে
নেওয়া এমন এক অচীন পাখি,যার ডানাদ্বয়ে বাস্তবের স্বেদবিন্দু
জমলেও পরাণ তার স্বাধীন স্বেত বাতাস মাখবে বলে জড়াজাল ছিড়ে 'পালাই।পালাই।'
সমাজের বুকে নারীর স্বাধীনতা নাড়ি কাটা থেকে ছিন্ন হলেও, ভানুর মতো অদম্য ইচ্ছাশক্তির অধিকারিনীরাই হয়তো পারে চিরাচরিতের বুকে
সমানুপাতিকতা আঁকতে ।
সুস্মিতা বোস