ফাঁকা তেমাথা মোড়ে পড়ে আছে
একরাশ আধমরা জোনাকি। বৃন্দা বুড়ির মনে হলো, বুড়োর শ্রাদ্ধের দিনের নিবুনিবু যজ্ঞি
কাঠগুলো কেউ যেন ছড়িয়ে দিয়েছে। যেদিন বুড়োর শ্রাদ্ধ,সেদিন দু ব্যাটার কী ঝগড়া। তার বাটপাড়টা সেই
বুড়ির ঘাড়েই পড়েছিল।পিন্ডদান শেষে সাজানো পিণ্ডের উপর ছিতরে থাকা নিভন্ত অঙ্গার। তার উপরেই ওরা
ছুঁড়ে ফেলেছিল জমির দলিল। বুড়ি আগুনে হাত পুড়িয়ে সেটা উদ্ধার করেছিল। তার কদিন আগে
শ্মশানে সেদিনও চিতাভস্ম থেকে এইরকম অর্ধমৃত জোনাকি আলো ধকধক করে জ্বলছিল নিভছিল। বুড়োর নিভন্ত চিতা থেকে অস্থি
টুকরো ওঠানোর জন্যেও ঝগড়া! বেটার বউদুটো সেখানেও ছিল মজুদ। আমি নয় তুই আমার নয় তোর
এই করতে করতে শেষে সেটাও চিতা ভস্ম থেকে তুলে দিতে হয়েছিল সেই বুড়িকেই।দুই ব্যাটার ধুন্ধুমার বচসা। অবশ্যই জমি ভাগ
নিয়ে।পরান বুড়ো মারা যাবার পর
এমনিই পরপর কয়েকটা আগুনে পূর্ণচ্ছেদ পার করে দীর্ঘ পাঁচ বছর বৃদ্ধা পেনশন ভাতায়
দিনগুজরান হচ্ছিল বৃন্দার। সে আর বউ বেটারা সব ভিনু। ওরা একটা আলিশান বাড়িতে থাকে
আর বুড়িকে একটা ঝোপড়িতে দিন কাটাতে হয়।আর এবার হঠাৎ নতুন করে বুড়ির অশান্তি।
তিনদিকের রাস্তার শেষ
কোথায় বৃন্দা জানেনা। রাস্তাগুলো যদি তার জীবনের অন্ত অব্দি যায়? সেটাই মনে ভয়। একদিকের
রাস্তার মাঝে রেলস্টেশন পড়ে। সেই অব্দি কয়েকবার গেছে। সেখান থেকেই মনে হতো দুনিয়া
বুঝি শেষ। তারপর অন্য জগতে যাত্রা। অন্য দুটি রাস্তায় পড়ে শ্মশ্মান আর নদী। ওই
দুটি পথকেও তাই অন্যজগতে বহমান মনে হয় বৃন্দার। তেমাথাতে তিনদিক দিয়েই কাকভোরের
শীতল বাতাসের গায়ে লাগা ও স্পষ্ট তারতম্য বুঝতে পারলো বৃন্দা বুড়ি। মনেহোলো তিনদিক
দিয়েই পরান বুড়ো এসে জড়িয়ে ধরছে তাকে।বুড়োর ঠান্ডা হাওয়া শরীর। চিরটাকাল ওর দেহ
ঠান্ডা।গরম হয়ে সুখ দিলনা জীবনে।ওর গত হওয়ার আটবছর কেটে গেছে। এখন সে যদি দেখা
দেয় তো বৃন্দা চিনবে কী করে? হাত পা মুখ পেট তলপেট সব আলাদা আলাদা করে মনে
করার চেষ্টা করে হয়রান হয়ে গেল।আজ দুটোরাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি। এখন
চরম অমীমাংসার মীমাংসা করতে চেয়ে ভয়ে হাতপা অবশ হয়ে যাচ্ছে। এক হাতে একটা ভাঙা
কুলো আর একটা কাগজের পোঁটলাতে কিছুটা ছাই। ডানহাত দিয়ে নিজেরই বাঁহাত ধরে চমকে
কেঁপে ওঠে বৃন্দা। এটা কার হাত? হাড়ের উপর ঝুলে যাওয়া চামড়া। তেনার নয়তো? সাথে রয়েছে কুবলি বোনঝি। খপ করে ওর হাত চেপে ধরে
বৃন্দা। কুবলিও ভয়ে কেঁপে ওঠে।রেগে এবারে খলখলিয়ে ওঠে। -মর মর। খামচাচ্ছিস কেনে লো? অতই যদি ভয় আঁধার ভোরে
কেনে যাচ্ছিস? ভূত খেদতে না আমাকে
সাঁতাতে?
বৃন্দাবুড়ি জবাব দেয়না। বৃন্দা আড়চোখে কুবলিকে
দেখে। এতো কুঁজো যে ঘাড় মুখ সমান। বছর তিরিশেক ভরন্ত পুষ্ট গতর। লোকে কি বলে কি
নজরে দেখে সে আমল দেয় না। বদরাগী কিন্তু বুকে প্রেমরস উথলে পড়ে। রোজ কপাল রসকলি
কাটে আর বৃন্দা মাসির খবর রোজ নেওয়া চাই।
কুবলি একবার রাধে রাধে
বলে হাত ছাড়িয়ে তফাতে হাঁটতে থাকে। হাড় কাঁপানো ভোরের বাতাস। ভাঙা কুলো ধরা বুড়ির হাত
থরথর করে কাঁপে।তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। জোরে হাঁটা যাচ্ছে না। শরীরটা নুয়ে নুয়ে মাটি
ছুঁতে চাইছে যেন। বুড়ো বেঁচে থাকতে থাকতেই
সংসারের সমস্ত কাজ করতে করতে কোমর ভেঙ্গেছে। দুবছর হলো শরীর জবাব দিতে শুরু করতেই ছেলে
বউরা নিজের নিজের সম্পত্তি বুঝে নিয়ে আলাদা হয়েছে। টিনের থালাঅব্দি চুলচেরা
ভাগ। দুভাগ হয়নি শুধু তিরিশ
বছরের পুরোনো তোষক। বয়েসকালে মানুষটা এমন
ত্যাগী হলো যে স্বর্বস্ব দুজনব্যাটাকে দিয়ে দিল,শুধু পরনের ধুতি ও বুড়ির পরনের কাপড় বাদে।
কুবলি খিলখিল করে হেসে
উঠল।-তুই আর আমি দুজনাই কুব্জি। হি হি হি। রাধে রাধে। দুই
কুবি নিশা ভোরে গুড়গুড় করে চলল ভূতের জনম মাস পালতে। হি হি হি। দেখ কালাসোনার কি লীলা। তোর বেটা বউ কুবো করেছে
তোকে সংসারের সব খাটাখাটনি তোর ঘাড়ে চাপিয়ে, আর আমাকে করেছেন কৃষ্ণ গো। আজ ভোররাতে তুই চললি
তেমাথায় তোর সোয়ামির ভূত খেদতে,আর আমি যাচ্ছি আমার নাগরের কামনায়।
-নাগরের কামনায় কি লো? নাগোর কুথায় পাবিস? বৃন্দা অবাক হয়ে যায়।
-তুই ভাবছিস কি? ওই ছাই আর ভাঙা কুলো ফেলতে তোকে সঙ্গে লিয়ে
যাচ্ছি? না। আমি কেনে যাচ্ছি বলত? কুবলি চুপ করল। কিন্তু উত্তরের অপেক্ষায়
না থেকে আবার সে সরব।-দেখ বুড়ি,আমার গতরটা বাঁকা কিন্তক
জুয়ান বটে কী না বল? আমারো গা গসগস করে। আমারও রস টপকায়। শ্রীহরি আমাকে যে এত প্রেম
দিয়েছে আমি কুব্জি বলে কি আমার প্রেম জাগাতে নাই হ্যা? বল বুড়ি। তুই তো অনেকবছর মস্তি
করেছিস।
বৃন্দার ওর কথা আর একদম
ভালো লাগছে না। ভিতরটা যেন ছিঁড়ে দুভাগ
হতে চাইছে।একভাগ তাড়াতাড়ি কাজ শেষ
করে ছেলে বউয়ের গঞ্জনা আর অলিখিত কর্তব্য শেষ করতে চায়।আর একভাগ কেঁদে আকুল হয়ে এখনই এই রাস্তার
মাঝে লুটোপুটি গড়াগড়ি খেতে চায়। সমস্ত অপ্রেম হৃদয় থেকে ত্যাগ করার পর একটি
ক্ষীণ অদৃশ্য আলোর মত প্রেম হৃদয়ে সংগোপনে রেখেছে সে। তাকে কি বেটার বউএর কথায়
উপরোধে ইহজগত থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবে বৃন্দা?
কুবলি তাড়া মারে,-কি হল্য? কিছু বলচিস নাই যে? মিনমিন করে বৃন্দা বলে,-কুবি,এমন কে আছে তোকে বিয়া করবেক লো? কন্ঠি বদল তোকে কে করব্যাক
লো?
–আছে আছে। স্যা হল রাজার বেটা। রাজার বেটা পাথর কাটা। তাকে পাঠাবেক আমার শ্রীহরি
কালাচাঁদ। দেখবি ঘোড়ায় চেপে আসবেক, আমাকে মালা পরাবেক। মালা বদল হবেক আর আমাকে
তুলে লিয়ে যাবেক। কুবলির চলন শ্লথ হয়ে যায়। গলা স্বপ্নিল।
বৃন্দারও চলন থেমে যায়। চোখের সামনে নিজের বিয়ের
রাত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংসারের টানাপোড়েনে স্মৃতি ম্লান তো হয়েইছিল ছোটোবউএর ওই
নিষ্ঠুর আদেশে একেবারেই মন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। এখন কিজানি কেন ছবি বড়
বেশি স্পষ্ট হয় ভাসছে। স্মৃতিছবি ও হাহাকার। তারসাথে যোগ দিল প্রভাত ফেরির খোল করতাল। ডুবে গেল বৃন্দা স্মৃতি
চারণে। মানুষটা বহুদিন প্রভাত
ফেরি করেছে। কীর্তনিয়া দলে খুব নামডাক। রাধে রাধে করত আর
প্রেমভক্তিরসে ডুবে থাকতো। চাষবাস ছাড়াও নানা ধরনের শস্যবীজ কেনাবেচাতে
যা রোজগার হতো সেই টাকা দুই ছেলের পড়াশুনোতে খরচ করত। এতো পরিশ্রমের পরও তার এমন
নেশা, রোজ সন্ধেবেলায় বৃন্দাকে
পাশে বসিয়ে শুরু করত পালা সঙ্কীর্তন। মজে যেত দুজনায়। বাধা পড়ল ছেলেদের বিয়ের পর। প্রথমে মিনমিন করে তারপর
তুলকালাম। শেষের দিকে বুড়ো জবুথবু
বাকহারা হয়ে আর পারলনা বাঁচতে।
কুবলির চিত্কারে চমকে ওঠে
বৃন্দা। -কি লো? কুকুরটার গায়ে পড়বি নাকি? দেখে শুনে চল। রাধে রাধে।
চমকে উঠে সামনে তাকাতেই
বৃন্দা আঁক করে উঠে থমকে গেল। চোখ খোলা নিষ্পলক। মুখ হাঁ। কুবলি ওকে টানতে গিয়েও
পারলো না।শক্ত হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে
রইল।বৃন্দা কাঁপা গলায় ডাক
ছেড়ে কাঁদতে বসে গেল কুকুরটার সামনে। কুকুরটা উঠে গা ঝাড়া দিয়ে চলে গেল। -কুবলি রে। কুকুর লয় তোর মেসো ছিল রে। যাবার আগে আমাকে দেখা দিয়ে
গেল রে।-আ মর। চুপ কর বলছি। মাঝ রাস্তায় কেঁদে মরছিস? কুকুরটাকে নিজের ভাতার
বলতে তোর ঘিন লাগছে না?
-না না কুকুর লয় তোর মেসো
গো। অবিকল তেমনি করে শুয়ে গো।সেই ওর মরার দুদিন আগে আমার বেটার ঘরদুয়ারের
সামনে যেমনটি ঘুমায়ে ছিল ঠিক তেমনি। ই কি করলে গো। যাবার আগে ই কি তুমার লীলা।
বৃন্দা হঠাৎ চুপ।প্রভাতফেরির গান দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।স্পষ্ট মনেপড়ল,সেদিন বুড়ো সকাল থেকেই আকুলিবিকুলি করছিল। বিড়বিড় করে কত কথাই না
বলছিল।সে এমন জিদ পালা গান সে
গাইবেই। বৃন্দা হাতে ধরে পায়ে ধরে
অনেক বিনতি করেছিল কোনো কথাই শুনল না। আগে আগে ভোর রাতে খঞ্জনি নিয়ে বুড়ো প্রভাতী
গান ধরতো। উসখুস করতে করতে একদিন
তুলকালাম কান্ড। এই বাড়িতে সেবা খেতে চাও
তো আজ থেকে এসব চলবেনা। ছেলে বৌ চায় না গলা তুলে কীর্তন গান হোক এই বাড়িতে। তাই ভয়ে সেই থেকে বুড়ো সেই
যে চুপ তারপর বহুদিন চুপচাপ রা সা নেই। কিন্তু সেদিন তার এমন জিদ, রাসপূর্ণিমায় রাতে তিন
মাইল দূরে রাসমঞ্চে পালা গান গাইতে যাবেই। শেষে বৃন্দা দোতালায় বড় ছেলের ঘরে গিয়ে অনেক
অনুনয় বিনয় করে এল। রাতে ওরা ফিরে এলে যেন সদর
দরজা খুলে দেয়। ওরা কিছু বলল না। কিন্তু বুড়ো আনন্দে নাচতে
লাগলো। পূর্ণিমার রাত। ফুটফুট
করছিল জ্যোত্স্না। মাঝরাত
অব্দি রাসলীলার উল্লাস। শ্রীখোল করতাল ও মানভঞ্জনের আবেগাশ্রু। বৃন্দা যুবতী হয়ে
গেছিল। সে যে হদ্দ কুঁজো সেকথা সে ভুলেই গেছিল। দেখছিল তার বৃদ্ধ স্বামী আসরের
মাঝে কেমন হেলেদুলে মানভঞ্জন গাইছে। নাক থেকে কপাল অব্দি চন্দনের তিলক। গর্বে
বৃন্দার চোখ বেয়ে জল।
ঘর ফেরার পথে বুড়ো আবার
চুপ। নিজের মেহনতে তৈরি পুরোনো ভিটে ভেঙে দুই ছেলের জন্যে দোতলা ঘর করে দিতে হল।
একেবারে ভিতর দিকে একটা জলা জায়গায় একটা খাটাপায়খানা ভেঙে সেখানে একটা ঝোপড়ি করে
বুড়ো বুড়িকে থাকতে দেওয়া হল। অনেক বলেকয়েও রাস্তার ধারে একটা রুম নিতে পারলো না
বুড়ো। সেই দুঃখে চিরটা সময় দুঃখী থাকতো। বৃন্দার মনে পড়ে, সেদিন মাঝরাতে নির্জন রাস্তার ধারে বাড়িতে
পৌঁছে বহুবার হাঁকাডাকা করল, কতবার বন্ধ সদর গেটে করাঘাত করল কিন্তু কেউই
দরজা খুলে দিল না। সুনসান গলি। একটা কুকুরও নেই। বৃন্দা অনেকখন ডাক ছেড়ে কাঁদল।
শেষে নিরাশ হয়ে বুড়ো মাঝপথে শুয়ে পড়ল। পরদিন সকালে দেরি করে ওদের ঝি এসে যখন
ডাকাডাকি করল তখন ওরা গেট খুলল। সেদিন থেকেই বুড়ো মৌন। একটা কথাও মুখ থেকে বেরত না।তার দুদিন পর বৃন্দা পুকুর থেকে স্নান সেরে
এসে দেখে বুড়ো গলায় দড়ি নিয়ে ঘরের মাঝে ঝুলছে।
তার লোলচর্ম হাতে কুবলির
টান পড়তেই বৃন্দার কান্না শুরু,-কুবলি রে তর মেসো শেষ দেখা দিতে ঐখানে শুয়ে ছিল রে। কুকুর
লয়।
ঝাঁঝিয়ে উঠল কুবলি,-হঃ। কিকরে বুঝলি শেষ দেখা? তোরা গোটা পরিবারটা উয়াকে
সুখ শান্তি দিলি নাই এখন ছাই সিঁদুর আর ভাঙা কুলো তেমাথাতে ফেলবিস আর উয়ার আত্মা
সংসার ছেড়ে চলে যাবেক ভাবছিস?
-আমি কি মনের মানুষটাকে
খেদতে চাইছি গো কুবলি? ওই ছুটু ঘরটায় যবে গলায়
দড়ি নিল তবে থেকে আমি আর উয়ার হাওয়া বাতাস একসঙ্গেই তো আছি? তুইই বল? আমি কি উয়াকে ছাড়তে পারি?
-তোর ছোটো বেটার বউ তোকে বলে দিল তোর সোয়ামি
পিচাশ হয়েছে। ঘরে কোনো উন্নতি নাই। উত্পাত করছে, উয়াকে গাঁঘরের মুড়া থেকে
খেদ, আর তুই গড়গড় করে রাতভোরে
চললি উয়াকে গাঁ থেকে তাড়াতে? সোয়ামির উপরে মায়া টান ছিল কী নাই লো? এইকথাই না বলবেক লোকে? আমি হলে অমন নাই করতাম গো। আমরা গরীব মানুষ। আমাদের ভক্তি মায়া আছে গো। তোর বেটারা চাকুরে বড়লোক। কি? চুপ করে আছিস যে বড়? আমার কথাটা খুবই খারাপ
লাগছে লয় মাসি? তোর এত বুদ্ধি তাও বুজছিস
নাই যে? ইবারে তোকেও ভিটা ছাড়া
দুনিয়া ছাড়া করবেক।
বৃন্দা কোনো কথা বলেনা। একজনের সাদা কাপড় আর
অন্যজনের খয়েরি। ভোরের আবছা আলোয় দুই ঝুঁকে
যাওয়া কুঁজো মেয়েছেলে গুড়গুড় করে মাঝরাস্তা দিয়ে হাঁটছে। দূর থেকে মনে হয় দুটি ছাড়া
দিশি গরু সারারাত মাঝরাস্তায় কাটিয়ে এখন ঘাসের সন্ধানে যাচ্ছে কোথাও। বৃন্দা আবার গভীর চিন্তায়
ডুবে গেল।তিনরাত পরপর বুড়ো
ছোটোছেলের স্বপ্নে এসেছিল। স্বপ্নে দেখেছে তার অসহ্য কষ্ট। আজ তিনদিন ধরে রোজ সকালেই
সেই স্বপ্ন চেচিয়ে মেচিয়ে হাত নেড়ে ছেলের বউ বর্ণনা করছে বৃন্দার মুখের ওপর। শ্বশুর যে ঘরে ফাঁসি
লাগিয়ে মরেছে সেই ঘর কোনোমতেই তার আত্মাকে শান্তি দিচ্ছে না। বাবা নিজমুখেই বলেছে ঘরটা
ভাঙ। নাহলে আমার মুক্তি নাই। অকালে মরা মানুষ তার তো
বিহিত করতেই হবে। ওরা যে ডাহা ঝুট বলছে সেটা
বৃন্দা বোঝে। কিন্তু কিছু করার নেই। গতকাল সকালে বড় নাতির ছোটো
মুখে বড় কথা জোরকরে শুনতে হল। দাদুর ভূত ভাগাতে হবেক। বামুন ঠাকুর বলেছে তোদের
এই জবরদখল ঘরটাতে আর বাস করার লয়। বাবা বলেছে ইটাকে ভেঙে দুটা বাথরুম পায়খানা
বানানো হোক। বাবা বলেছে তোকে ইষ্টিশনের
পাশে একটা ঝুপড়িতে থাকতে দিবেক।
কুবলির কথায় চমক ভাঙল।–দেখ মাসি তোরা বুড়োবুড়ি যে ঘরটাতে বাস করতিস
সেটা যে সেফটি ট্যাংকের উপরে সেটা আমি ভালই জানি। ওই জায়গাতে একটা খাটা
পায়খানা ছিল।তোর বেটারা রোডের ধারে
আলিসান বিল্ডিং ঠুকে নিল আর তোদের জন্যে একটা ঘুপসি খাপরার ঘর। ওই ঘরের চালাকাঠে ফাঁসিতে
ঝুলল বুড়া। উটা কি আর মানুষের বাস
করার ঘর গো?ভাঙা দুয়ার দিয়ে ইঁদুর সাপ
ঢুকে। বর্ষার জল ঢুকে।
-তবে কি উয়ারা ঠিকই করছে? হ্যাঁ রে কুবলি?
-হ আমি সবই জানি। তব্যা উয়ারা ঘরটা ভাঙ্গুক
তোকে ঘরছাড়া করুক তাতে কোন অ নাই। ই গ্রামে কোন মরদটা আছে বল ন যে সে বিধবা
বুড়ি মায়ের সেবা করে আর মাকে ভিনু না করে সাথে রাখে? বলতে পারবিস? যা করেছে করেছে। তাবলে উয়ারা নিজের বাপকে
খেদবার জন্যে মন্তর পড়া ছাই সিঁদুর আর ভাঙা কুলো তোকে দিয়ে ফেলাচ্ছে কেনে? নিজেরা কেনে যাচ্ছে না।তোকে দিয়ে কেনে করাচ্ছে ইটা বুঝ? তোকে কি একবেলাও খেতে দেয়
কোনো বেটা?
বৃন্দা চুপ। কুবলি একনাগাড়ে বকেই চলল।-এতদিন তোর ক্ষেমতা ছিল, নিজের দুটি ভাতে ভাত
রান্না করেও উয়াদের ঝিগিরি রাঁধুনিগিরি করতিস। এখন লড়বড় করছিস দেখে উয়ারা
ঝি রাখল। ব্যাস তর কাজ তো ফুরাল। এখন যত অপয়া কাজ তুই কর? তাই না মাসি? যেখানে মন্তর ফুঁকা ছাই
সিঁদুর কুলো ফেলতে যাচ্ছিস সেখানে মেসোর ভূত তোকে ভর করুক মারুক তাতে তো উয়াদেরই
ভাল। আর না করুক তাতেও ভাল। তোকে তো উয়ারা সঙ্গে
রাখবেক নাই? বল আমি হক কথা বলছি কি না? তুই তো মাসি তোর ছোটো
বেটার বিহা ই গ্রামেই করেছিস। উ পাড়াতে। তোর বিয়াই বিয়ান তোর সাথে কোনো সম্পর্কই
রাখেনা। উল্টে অপমান। ছোটো বউটার
বাপ মরতে উয়ার মায়ের সিঁথির সিঁদুর পোছা আর শাঁখা ভাঙাও সেই তোকে দিয়েই করালো। ইসব
নাপতানির কাজ। ইসব তোর গায়ে লাগে না? রাধে রাধে। দেখ মাসি। গোবিন্দ যা করেন
তা তোর ভালোর জন্যেই। যেখানে প্রেম নাই সেখানে নরক। ওই নরক থাক্যে উদ্ধার করবেন
শ্রীমধুসূদন। তোর কতবড় পুণ্য যে তুই উদ্ধার হতে যাচ্ছিস লো।
বৃন্দা মুখ খোলে। অসহায়
করুণ চোখে জল।–কি করে উদ্ধার হব গো? আমার এখন কি গতি আছে। দুনিয়ায় আর কে আছে আমার? তার চেয়ে এই ভাল। ই ইদিকে
ঠেললে ইদিকে যাব,উ
উদিকে ঠেললে উদিকে যাতে হব্যাক। আমার কি আর মুক্তি আছে?
-দেখ মাসি। উয়ারা যা করেছে
ভগবান তোর সহায় বলেই হয়েছে। তুই ভাবিস না। মধুসূদন আমার মতন কুঁজিকে রাজরানী করতে
চায় আর তোকে উদ্ধার করবেক নাই? তুই রাজ ভোগবি মাসি। রাধে রাধে। শুধু এখন
কবুল কর তোর সংসারের দিকে ফিরে তাকাবি না?
-তব্যা আমি কুথায় থাকব গো
কুবলি। শ্মশানে? ইসটিশনে?
-সে তুই যেথায় থাক সুখে
শান্তিতে ভক্তি রসে থাকবি। আর আমি রাজরানী হব গো? ইটা আমি তিন সত্যি করে বলতে পারি।
-কুবলি,তুই কি রাত কথা বলচিস?
-রাধে রাধে। নাগো সত্য
কথা। দ্যাখ দ্যাখ কেমন ভোরের লাল আলো সিঁদুরের মতন রঙ ঢেলেছে। আমার থুবড়ি আইবড়
মাথা আর তোর বিধবা পাকা মাথা রাঙাই দিয়েছে? জয় রাধে। ওই শুন ট্রেনের শব্দ। আমরা ইসটিশনের
কাছে এসে গেছি। ওইখানেই তো তেমাথা।
কুবলি এবার বৃন্দার হাত
শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে চলল। বৃন্দা হাঁসফাঁস করতে লাগলো। কুঁজো শরীরে হাঁটাও
যায়না। কুবলি যেন সোজা হয়ে গেছে? ওর মুখ ভরাট বুক সরু কোমর একদম বিবাহিতা
যুবতীর মত। বৃন্দা ঘাড় ফিরিয়ে ওর দিকে তাকিয়েই রইল।
- মাসি তোর হুঁশ নাই লো? এই তো আমরা তেমাথায়
দাঁড়ায়ে। ফেল ফেল ইবার হাতের ভাঙা কুলো ছাই সিঁদুর। হাতটা কাপড়ে মুছে নমো কর। বল
শ্রীহরি শ্রীহরি।
বৃন্দা তাই করল। হঠাৎ খুব মুক্ত হালকা লাগলো
নিজেকে। এতো সহজে এক জটিল ভয়াবহ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাবে ভাবতেই পারেনি সে।
কুবলি কিন্তু থামে না। বৃন্দাকে টেনে হিড়হিড় করে নিয়ে চলল স্টেশনের দিকে।
-ছাড় ছাড় হাতটা আমার। আর
কুথাকে লিয়ে যাবিস?
কুবলি কিছু বলে না।
বৃন্দা ওরদিকে তাকিয়েই রইল।বড়বড় চোখ পুরুষ্টু রসালো ঠোঁট, ভোরের আলোয় সিঁদুরে মুখ,নাকের পাটা ফুলছে উত্তেজনায়। বুক ওঠানামা
করছে। দাঁড়িয়ে পড়ে কুবলি। হঠাৎ সারা গা দুলিয়ে হো হো করে হাঁসতে থাকে।
বৃন্দা চমকে ওঠে। এ হাসি সে চেনে। এ হাসি সোহাগ মিলনের আগে লাজ শরম খোয়ানোর হাসি।
কুবলি জড়িয়ে ধরে বৃন্দা বুড়িকে। কানের কাছে মুখ রেখে সামনে তাকিয়ে বলে,-হুই দেখ মাসি। ওই হোথা।
আমার রাজপুত্তুর বসে।
প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে
নিরালায় এক মধ্যবয়েসী পুরুষ বসে। কুবলি দৌড়ে গিয়ে ধপাস করে ওর হাঁটু জড়িয়ে কোলে
মুখ রেখে বসে পড়ল। বৃন্দা খুটখুট করে এগিয়ে কাছথেকে তাকে দেখে বুকটা ছ্যাত্ করে
উঠল। বছর বিশেক আগের তার সোয়ামির চেহারা। অবিকল সেই ঠোঁট সেই নাক সেই কপাল নাক
জুড়ে রস তিলক। সেই ঢুলু ঢুলু চোখ। মানুষটি উঠে দাঁড়াল। বৃন্দা হাউ হাউ করে কেঁদে
উঠল।
সুবল দত্ত