সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

অভিষেক রায়


শতবর্ষে  চিত্রিতা দেবীঃ একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিতর্পণ


খুব কাছ থেকে দেখা কোনো মানুষের জন্মশতবর্ষ এলে মনে হয় মানুষটা অনেক ভিন মার্গের হয়ে গেছেন। মনে হয় খুব কাছের মানুষটা ধরাছোঁয়ার মত সময়ের অনেক ওপারে চলে গেছেন তিনি। যার কথা এখন লিখছি তাঁর সঙ্গে আলাপ হওয়াটাও বেশ অভূতপূর্ব ও কাকতালীয়। পুনে শহরে তখন পড়ছি, দ্বিতীয় বর্ষে ফার্গুসন কলেজে। এক পরিচিতা বাঙালী অধ্যাপিকা একদিন জানালেন এক বাঙালী বর্ষীয়সী লেখিকার কথা। বললেন খুব অসুস্থ হয়ে কলকাতা থেকে তিনি পুনেতে তার কন্যার কাছে এসে রয়েছেন। তিনি শুধুই রবীন্দ্র স্নেহধন্যাই নন, নিজেও কবি, লেখিকা, বিশিষ্ট অনুবাদিকা। অবাক ও আপ্লুত আমি। পড়ে আছি প্রবাসে, তখনও ইন্টারনেট সে আকারে প্রবেশ করেনি জনজীবনে যে একটা আঙুলের ছোঁয়ায় যা চাইব সব হাতের মুঠোয় এসে হাজির হবে। ফেলে আসা কলকাতার প্রতি সব সময়েই মন কেমন করে ওঠে। সেখানে একেবারে একজন বাঙালী লেখিকা, তাও রবীন্দ্রনাথের কাছের মানুষের সন্ধান পাওয়া, এত না চাইতেই অনেক পাওয়া। অনেক কৌতূহল নিয়ে হাজির হলাম বোটক্লাব রোডের ক্লিম্যাটিজ গার্ডেনসের  অ্যাপার্টমেন্টে। আগেই ফোন করেছিলাম। যে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলাম তার দেওয়ালে ঝুলছে রবীন্দ্রনাথের আঁকা দুটি ছবি। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোলাপি পাড়ের সাদা শাড়ি পরে ভারী চশমা চোখে এসে বসলেন এক অসাধারণ স্নিগ্ধ, সুন্দর মহিলা। নাম চিত্রিতা দেবী। তার নামের সঙ্গে আমরা অনেকেই খুব সম্যক ভাবে পরিচিত নই। প্রায় ছয় দশকের ওপর সাহিত্যচর্চা করে গেলেও তিনি সাহিত্য পাঠকদের কাছে রয়ে ছিলেন অপরিচিত এবং আশ্চর্যই অনেক সমৃদ্ধ লেখালেখি করেও তাঁর পরিচয়টা হত খ্যাতনামা লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর অনুজা হিসেবে। চিত্রিতার সঙ্গে আমার হয়েছিল ‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’ তিনি আমার কাছে ছিলেন একটা বিগত সময়ের প্রতিনিধি। বেশ অনেকগুলো দশক যার মধ্যমণি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তিনি সেই সময়ে কাটিয়েছিলেন তার কৈশোর ও যৌবন এবং কাটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহচ্ছায়ায়। আমি যখন তাঁর কাছে এসেছিলাম তখন তিনি তাঁর জীবনের শেষ কয়েক বছর কাটাচ্ছেন পুনেতে তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যার কাছে। একটা চোখ হারিয়েছেন, আরেকটি চোখেও দৃষ্টি সামান্য কিন্তু স্মৃতিশক্তি উজ্জ্বল আর নিজের মনের আলোয় জ্বলজ্বল করতেনসেদিন ওই প্রথম দেখা করতে যাওয়ার দিন জানতাম না যে এক অটুট স্নেহের বন্ধনে জড়িয়ে ফেলবেন তিনি আমায়। এর পরের তিন বছর প্রায় নিত্য যাতায়াত করেছি তার অ্যাপার্টমেন্টে। এত কাছ থেকে দেখা মানুষটি শতবর্ষ পূর্ণ করলেন, বিশ্বাসই হচ্ছেনা।

আমি তো চলে যাবো। আমার কথা কেউ জানল না। পারলে আমার কথা লিখো।‘  একথা বলতেন আমাকে বহুবার। প্রায় ছয় দশকের ওপর সাহিত্য চর্চা করেও যে বাংলা সাহিত্য জগতে পাঠক মহলে অপরিচিত থেকে গেছেন সেই নিয়ে এক গভীর আক্ষেপ ছিল তাঁর। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যখন শারীরিক অসুস্থতার কারণে আজীবনের শহর কলকাতা ছেড়ে তাঁকে কন্যার কাছে পুনেতে চলে যেতে হয়, তখন ওই শেষ বছর সাতেক আক্ষেপ তাঁকে ভীষণ ভাবে পেয়ে বসেছিল।কি লাভ হল, কেউ তো জানলনা, পড়লনা।‘ বার্ধক্যের নানা রোগভোগ তাঁর স্মৃতি শক্তি ম্লান করতে পারেনি। ছেলেবেলায় তাঁর বাড়িতে আসতেন যারা তার বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক পিতার কাছে, সেই তালিকাটা চমকে দেবার মতই। রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেন তাঁদের ঘরের মানুষ, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, জগদীশ চন্দ্র বসু, ব্রজেন শীল, সরলা রায়, কালীদাস নাগ, মেঘনাদ সাহা, আসতেন তরুন অধ্যাপক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন যিনি ছিলেন তাঁর পিতার ছাত্র পরে তার নিজের শিক্ষক
১৯১৯ এর ১২ জানুয়ারী চিত্রিতা দেবীর জন্ম কলকাতায়। পিতা আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন দার্শনিক ডঃ সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, মা হিমানী দেবী ছিলেনবম্বে টকিজেএর প্রতিষ্ঠাতা হিমাংশু রায়ের বোন। চার বছরের বড় দিদি মৈত্রেয়ীর সঙ্গে এক বৈদগ্ধ্যপূর্ণ পরিবেশে তাঁর ছেলেবেলা কেটেছিল। পিতৃ শুভানুধায়ী রবীন্দ্রনাথকে সেই চার-পাচ বছর বয়েসেই দুই বোনে করেছিলেনজীবনের ধ্রুবতারা আমায় বলেছিলেনশান্তিনিকেতনে যখন যেতাম, উত্তরায়ণের বারান্দায় বসে বাবা, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনায় মগ্ন। আমি বাইরে খেলছি রথীন্দ্রনাথ- প্রতিমা দেবীর পালিতা কন্যা পুপের সঙ্গে তার প্রথম কবিতার ডায়রি যখন রবীন্দ্রনাথকে দেখিয়েছেন উনি বলেছেনতুই লেখ।কিন্তু নিজগৃহে সেই উৎসাহ তিনি সেরকম পাননি যে খেদ আজীবন বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন। বড়মেয়ে মৈত্রেয়ীকে নিয়ে তখন দাশগুপ্ত দম্পতি ব্যস্ত। মৈত্রেয়ীর কবিতার বই প্রকাশ পেল। বাংলার সব বিখ্যাত সাহিত্যিককূল এলেন, বইটা উদ্বোধন করলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, ভূমিকাও তাঁর বইটার মলাটের ছবি কিন্তু এঁকেছিলেন চিত্রিতা। সেই নিয়ে কেউ কিছু বললনা। ষোড়শী মৈত্রেয়ীকে নিয়ে উন্মাদনায় দ্বাদশী চিত্রিতাকে দেখেও কেউ দেখলনা। জীবনের সবচেয়ে প্রথম যে লেখাটা, একটা উপন্যাসের খসড়া তা ছাদের চিলেকোঠায় বসে লিখেছিলেন। কিন্তু সে লেখা কোনোদিন ছাপা হয়নি। একদম পড়ন্ত কালে সেই লেখাটার কথা খুব মনে পড়ত তাঁর।

রোমাঞ্চ জাগত যখন তাঁর মুখে শুনতাম মৈত্রেয়ী-মির্চার অগ্রন্থিত প্রেম কাহিনী। আমরা অনেকেই ভুলে যাই ‘ন হন্যতে’ উপন্যাস , আত্মজীবনী নয়। আমায় একদিন বললেন ‘আমায় তো সবাই ভিলেন ভেবে রইল।‘ বলতেন মংপুতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাটানো সেসব দিন, দিদির চাইতে স্বল্পভাষী হলেও চিত্রিতার বাকচাতুরীতে রবীন্দ্রনাথও ভারী আমোদ পেতেন।  চিত্রিতা দেবী আমার কাছে ছিলেন একটা সময়ের দর্পণ। তার সামনে দাঁড়ালেই যেন সেলুলয়েডের ওপর চলে যেত একটার পর একটা সময়ের রীল তার কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো দিয়েই একটা বই হয়ে যেতে পারে।

তাঁর স্কুল জীবন শুরু হয়েছিল ডায়সেশন স্কুলের কিন্ডারগার্টেনে, পরে গোখলে মেমোরিয়ালে স্কুলের প্রতিষ্ঠাত্রী সরলা রায় আসতেন সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কাছে।  চিত্রিতা দেবী আমায় গল্প করেছিলেন 'জানো সরলা রায়, তখন তাকে সবাই মিসেস পি কে রায় বলত, মাঝে মাঝে আসতেন আমাদের বাড়ি। তখন চেনা পরিচিতের বাড়ি ঘুরছেন ছাত্রী জোগাড় করতে। সঙ্গে থাকত তার সেক্রেটারি। ঐ বিখ্যাত স্কুলের ঊষালগ্নে চিত্রিতা ছিলেন তার কয়েকজন ছাত্রীর একজন।   একদিন দেরীতে স্কুল পৌঁছনোর জন্যে স্কুল কতৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর অভিভাবকদের বিবাদ বাঁধাতে ক্লাস সিক্সেই স্কুলজীবনের ইতি। আমাকে বলেছিলেনপরে নিজে অবাক হয়েছি কারো খেয়াল হলনা, যে মেয়েটা এর পর কোথায় পড়াশুনা করবে?’ তবে বাড়িতে বাবার কয়েক হাজার বই, গৃহশিক্ষক এবং নিজের উদ্যোগেই চিত্রিতা প্রাইভেটে মেট্রিকুলেশন দিয়ে আশুতোষ কলেজে ভর্তি হলেন। কলেজে সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে স্নাতকোত্তরের ক্লাসে ডঃ রাধাকৃষ্ণানকে শিক্ষক রুপে পেয়েছিলেন। বিয়ে হয়ে যাওয়ায় অবশ্য স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করতে পারেননি। ১৭ বছর বয়েসে ইতালীর ফ্লরেন্স শহর থেকে ছবি আঁকার জন্যে স্কলারশিপ পান চিত্রিতা। কিন্তু মৈত্রেয়ী- মির্চা' ওই ঘটনার পরে মা রাজী হননি এই মেয়েটিকে একা একা বিদেশে  পাঠাতে। মজা করে আমাকে বলেছিলেন 'জয়দেব গুপ্তকে বলতাম আমার প্রথম বিদেশ যাবার সুযোগ নিজের যোগ্যতাতেই পেয়েছিলাম।'

সংস্কৃত, দর্শন ইংরেজি ছিল তাঁর বিষয়। উপনিষদ নিয়ে একনিষ্ঠ গবেষণা করে সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে সমগ্র উপনিষদ অনুবাদ করেছিলেন তিনি। এই কৃতিত্বের জন্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেলেনলীলা পুরস্কার পরবর্তীকালেও তাঁর খ্যাতি তাঁর এই উপনিষদের অনুবাদ ঘিরেই। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গেও যখন প্রথম দেখা হয় তখন তিনিও কৌতূহল প্রকাশ করেছিলেন তার প্রথম উপন্যাস ‘একটি সবুজ তারার সন্ধানে’, মাতৃহীন এক বালক ‘মধু’কে নিয়ে গল্প। আশ্চর্য এই উপন্যাসের sequel ওঁর শেষ উপন্যাস ‘অন্বেষণ’ এর পরে এল ‘দুই নদীর তীরে’, বাংলার গঙ্গা আর ইংল্যান্ডের টেমস নদীকে ঘিরে দুই পাড়ের মানুষদের জীবনকথা। ১৯৪৭ সালে তাঁর প্রথমবার বিলেত যাওয়া নিয়ে তাঁর ভ্রমণকাহিনী ‘অনেক সাগর পেরিয়ে’শুধু ইংল্যান্ড নয়, তাতে রয়েছে মোটর গাড়ি করে প্যারিস ভ্রমণ, মিশরের পিরামিড দর্শনশিশুদের নিয়ে লিখলেন ‘দুই হরিণ’ নামে মিষ্টি একটি গল্প। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, শিশু সাহিত্য নিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় ২৫ কবিতা লিখেছেন আমৃত্যু। তার কবিতায় স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রচ্ছায়া স্পষ্ট কিন্তু তার নিরাভরণ শুদ্ধতা স্পর্শ করে মনকে। ওই ভাষায় লেখাও অনেককাল বন্ধ। ‘রামায়ণ নিয়ে কিছুক্ষণ’ লিখলেন একটি সমালোচনা গ্রন্থ। তার আরেকটি নাটিকা ‘সন্ধ্যে সাড়ে ছটা’রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে একত্রিত করে পরস্পরের মজার কথোপকথন। তাঁরএকশো কবিতাসাহিত্যিক মহলে সমাদৃত হয়েছিল। ছোটগল্পের সংকলন ‘নির্বাচিত গল্প’এছাড়াও অসংখ্য পত্র পত্রিকায় লিখেছেন।

সিণ্ডেরেলার অবলম্বনে শিশুদের জন্যে লেখা বাংলা নাটিকাহারানো নূপুরখুব জনপ্রিয় হয়। তাঁর সাহিত্যচর্চা ছাড়াও নাটক, রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গীতিনাট্য তিনি পরিচালনা করতেন নিয়মিত নব্বই দশক পর্যন্ত। স্বামীর কর্মসূত্রে চল্লিশের দশকে যখন তিনি লন্ডনে আছেন, তখন রবীন্দ্রনাথেররাজা রানীমঞ্চস্থ করেন যার রিভিউ বেরোয় গার্ডিয়ান পত্রিকায়। P.E.N নামক সংস্থার নাম এখন প্রায় বিস্মৃতির অতলে, একসময়ে সারা বিশ্বের সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র ছিল। তার এশীয় বিশেষ করে ভারত শাখাটি খুব প্রভাবশালী ছিল। চিত্রিতা তার কলকাতা শাখার সেক্রেটারি  হয়েছিলেন। P. E.N ভিয়েনা সম্মেলনে ১৯৫২ সালে যোগ দিয়েছিলেন

অর্চনা’  পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তার শ্বশুরমশাই কেশবচন্দ্র গুপ্ত পরে চিত্রিতার ওপর পড়ে তার দায়িত্ব। বেশ অনেককাল সম্পাদনা করেছিলেন সে পত্রিকা। আমাকে বলেছিলেনএকবার জানোতো, বিপদে পড়েছিলাম। সজনীকান্ত দাস বুদ্ধদেব বসু দুজনকেই বলেছি সম্পাদকীয় বৈঠকে। এদিকে বুদ্ধদেব ফোনে জানালেন যে সজনী দাস এলে তিনি আসবেননা। কি কাণ্ড ভাবো?’ শনিবারের চিঠি গোষ্ঠীর সঙ্গেকল্লোলএর আদায়- কাঁচকলায় সম্পর্ক এখন সাহিত্যের ইতিহাস। লেকচার দেবার আমন্ত্রণ পেয়েছেন এশিয়াটিক সোসাইটি বিশ্বভারতীতে একাধিকবার, কবিতা পড়ার নিমন্ত্রণ এসেছিল নরওয়ে সরকারের তরফ থেকে। অসুস্থ অবস্থাতেই গেছিলেন সুদূর ওসলোয়। কবিতা পাঠের পরে একজন ইংরেজি না জানা নরওয়েজিয় শ্রোতা তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বলেছিলেন এগুলোই হল কবি হবার শ্রেষ্ঠ সম্মান। তাঁর শেষ পাব্লিক লেকচার ১৯৯৭ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথলেকচার বিশ্বভারতীতে

কলকাতার শিল্প- সাহিত্য মহলের সঙ্গে প্রায় দশকের সম্পর্ক তাঁর। জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন জয়দেব গুপ্তকে যিনি পেশায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, ব্রিটিশ ইলেকট্রিক কর্পোরেশনের (বর্তমান সি এস সি) উচ্চপদে ছিলেন এবং স্ত্রীর সাহিত্য- সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহ দিয়ে গেছেন। দুজনে একসঙ্গে বসে রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদ করতেন, সেসব পাশে বসে শুনতেন পরবর্তীকালের প্রখ্যাত অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে। রাদিচের প্রথম বঙ্গবাস অধ্যায়ে তিনি প্রায়ই আসতেন চিত্রিতার কাছে। দুই কৃতি কন্যা শমিতা গুপ্ত- ইতিহাসবিদ ডঃ লালী চট্টোপাধ্যায়- আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিদ। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে গুরুতর অসুস্থ হয়ে বড়কন্যার কাছে গুপ্ত দম্পতি পুনায় চলে যান। ছাড়তে চাননি সাধের কলকাতা। পুনায় যাবার পরে কয়েকমাসের মধ্যেই হারালেন প্রায় ষাট বছরের জীবনসঙ্গী, যে কন্যার কাছে চলে যান সেই শমিতাও দুরারোগ্য ক্যান্সারে তাঁর আগেই মারা গেলেন। আমি ততদিনে পুনা ছেড়েছি। ফোনে বলেছিলেনজানো তো, ঈশ্বর দত্তাপহারক’ ‘অনেক পেয়েছি, এখন অনেক দিতে হবে।কথাটা বারবার এখনো বাজে আমার কানে।

চোখের দৃষ্টি হারাবার পরেও ডিকটেশন দিয়ে শেষ করেছিলেন শেষ  উপন্যাসঅন্বেষণ অনেক উপরোধ, অনুরোধে লিখছিলেন স্মৃতিকথা ‘যা শুনেছি, যা দেখেছি’, সম্ভবত শেষ করতে পারেননি। খ্যাতি না থাকলে বা কলকাতার সাহিত্যিক গোষ্ঠীর মাথাদের তোয়াজ, তরিজুত না করলে যে সাহিত্যে বিশেষ স্থান পাওয়া যায়না সে কথা আমাকে অনেকবার বলেছেন তার স্পষ্টবাদিতার জন্যে বারবার অপ্রিয় হয়েছেন নানা গুনীজন মহলে। 'রবিবাসরীয়' সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৯ বিশ্বভারতী থেকে পেলেন 'দেশিকোত্তমা' তিনি তখন খুব অসুস্থ। কয়েকমাস পরে বিশ্বভারতী এল তাঁর কাছে। ফারগুসন কলেজের অ্যাম্ফি থিয়েটারের সম্মান প্রদান অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্যে মুগ্ধ করেছিলেন জনতাকে। ২০০৬ এর ১৮ মে ঘুমের মধ্যেই চলে গেছিলেন। আজ  তাঁর শতবর্ষ  উপলক্ষে তাঁর সাহিত্যকর্মকে আবার নূতন করে ফিরে দেখলেই হবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ। 
  

                                                                     অভিষেক রায়