সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

পারমিতা ভট্টাচার্য:মুক্তগদ্য:প্রেমিক যখন গাছ হয়ে ওঠে

 

প্রেমিক যখন গাছ হয়ে ওঠে


  অন্ধকার বারান্দার এককোণে  বসে আছি। শুকনো খটখটে একটি চর জেগে উঠেছে আমার চোখে । অথচ আমার চারপাশে নোনা জলের বন‍্যা বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরকম হওয়ার কথা ছিল না। মাঞ্চুপিসিদের পুকুরধারে কৃষ্ণচূড়া গাছে সবুজ তেলতেলে ঝিরঝির পাতায় ছেয়ে গিয়েছে। দু'চারটে ডালে লাল লাল ফুলের আভা দেখা দিয়েছে। মোল্লাপাড়ার রাস্তায় শিমুলও ফুটেছে। ভোরবেলা কোকিল ডাকছিল। মানে বসন্তের আহ্বান, তোমার তো বুঝতে অসুবিধা হয়নি! ঠিক রাস্তা দিয়েই এসেছ। আর তোমার আসাটা তো নিশ্চিত ছিল। আমি জানতাম, ভালবাসার মরশুম, তোমাকে ফিরতেই হবে। 

 

লাহিড়ীবাড়ির পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি চলে গিয়েছে কবিরাজ বাড়ির দিকে- ওদিক দিয়ে  এখন মস্ত বড় বড় লরি যাতায়াত করে। সাইকেলের স্পোকে বাঁধা তোমার-আমার যে জীবন এখন আর চোখে পড়ে না। সকাল ছটায় সাইকেলের সামনে চাপিয়ে কেউ তো স্কুলে পৌঁছে দেয় না। বড়জোর ঘুমন্ত চোখ কচলাতে কচলাতে স্কুলের বাসে তুলে দেয়। 

 

ঘন অন্ধকার ঘিরে ধরেছে আমাকে। তোমাকে দেখব বলেই তো বসে আছি। তুমি আলো নিয়ে আসবে। আমি সেই আলোতে বসন্ত দেখব।  তুমি নাকি ভালবাসার পাঁজি লিখেছ? আমাকে তো বলোনি কখনও। জানলেই বা কি করতাম! আমি তো জানি তুমি কী কী লিখতে পারো। আমাকে তো বর্ণমালা শেখানোর মতো ধরে ধরে শিখিয়েছ বিরহ, বিচ্ছেদ, উপেক্ষা, প্রতীক্ষা কত কিছু। সেগুলোই তো লেখো তুমি! কবিতা লিখতে বলেছিলাম, লেখোনি। কে না কি শব্দ চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। যা দু'একটা ছিল সীমান্ত পেরিয়ে আসার সময় কাস্টম অফিসে জমা করে নিয়েছে। আর ফেরত পাবে না। লম্বা গোঁফওয়ালা অফিসারটা না কি তোমার শব্দ নিয়ে বিছানায় শুয়ে লোফালুফি খেলবে।

 

চার বছর আগে তোমার কাছে বায়না করে কুড়াতে গিয়েছিলাম পলাশ। পকেটে হাত দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলে আমার ছেলেমানুষি। প্রকৃতিতে সদ‍্য ফাগের নেশা লেগেছে। কচি রঙ ছিটিয়ে দিয়েছিলাম তোমার সাদা শার্টে। একটুও বকা দাওনি , চোখও রাঙাওনি। তবুও আমি থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেন তুমি জান? ভয় পেয়েছিলাম, যদি রঙ মুছে যায়! আসলে তখন তো জানতাম না, ক্ষণিক মুহূর্তও  চিরকালীন হয়ে ওঠে। চিরঋণী, নতজানু। হাত ধরে ঘুরিয়ে আনলে বাঁধের ওপার থেকে।

তোমার সঙ্গে বালুতটে বসে সমুদ্র দেখব বলেছিলাম। বসন্তের একফালি চাঁদের আলো ছুঁয়ে থাকবে পৃথিবীর সব তুচ্ছতাকে। কথা বলার সময় কমে আসবে, ঠোঁটে নেমে আসবে সুর। ঘন্টা, মিনিট, ফেরার তাড়া সবকিছুকে ছুটি দেব। বেহিসেবি পথচারী হব আমরা দু'জন। আকাশ থাকবে সাক্ষী- তুমিও তো রাজি ছিলে, তা হলে পূরণ হল না কেন এই গোপন স্বপ্ন? ওহ্, গোপন তো গোপনীয় থাকে, তা স্বপ্ন হোক আর সম্পর্ক। পূরণ মানেই তো প্রকাশ‍্য। আমি ভুলেই গিয়েছি বীজগণিতের সহজ ফর্মুলা। 

কার্শিয়াং থেকে তোমার আনা বোস্টন ফার্ণের গায়ে বিন্দু বিন্দু মেঘ জমেছে। পোর্সিলিনের টবে ছোটো ছোটো পোকা। এসব এখন আমার নিউজপেপার। দূরের শব্দগুলো হালকা হতে হতে মিলিয়ে যায়। মস্ত বড় শূন‍্যের মধ্যে ঘুরপাক খাই। জানলা-দরজার পর্দাগুলো নির্জন দ্বীপে দোল খায়। পাবলো নেরুদার কবিতার মতো বিষণ্ণ বিকেল ঝেপে আসে মেঝের কোনাকুনি দেওয়াল জুড়ে। ঠিক তখনই মগ্নচড়ার মতো জেগে ওঠে একটা ঘর। চাবি হারিয়ে ফেলেছি। তালা খুলতে পারিনি। তুমি সেই তালা ভেঙে ঘর সাজালে। আমার সঙ্গে তুমি থাকতে শুরু করলে, একই ঘরে। তুমি ভাল করেই জানতে বিচ্ছেদ হবে। বিচ্ছেদই শেষ কথা। তবু বসন্তের সঙ্গে পাতাঝরার মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে দিলে একটা প্রেমিক-জীবন। 

গানের লাইনগুলো ভুলিনি। মাঝে মাঝে সুর হয়ে ওঠে। আচ্ছা তোমার তো আসার কথাই ছিল, আলো আনার কথাও ছিল,  আর তুমি তো এসেছ, তা হলে আমি কেন এত অন্ধকারে বসে আছি?  আর আমার চারপাশে নোনাজলের স্রোত বয়েই বা যাচ্ছে কেন?

 


পারমিতা ভট্টাচাৰ্য



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ