এখানে নদী আছে। অববাহিকা আছে। বাঁধ আছে। জলাধার আছে।
পাহাড়টিলা আছে। নিরালা আদিবাসী গ্রাম ও গ্রাম্যজীবন আছে। আর আছে সম্ভ্রম জাগানো
প্রকৃতি। আরও কত কী যে আছে। দামোদরের বাতাসে কিছুটা ভালোবাসা উড়িয়ে দিই। ওই জলরঙকে
কেমন নিবিড় মনে হয়। রূপকথার মতো। সদ্য আষাঢ়ে সে জলরঙে ঘাই মারছে। চারপাশে সবুজ
লাস্য। সবুজের সঙ্গে এই বর্ষায় বিস্তর কথা বলতে থাকে গাছেরা। এইসময় খানিক নুয়ে
থাকেন অর্কদেব। দিগন্তবিস্তৃত জলকথার গোপন পেলবতাকে সঙ্গে নিয়ে ডুব দিচ্ছে
চুপিসার।
অথচ, একটা সময়
দামোদর নদকে বলা হতো ‘Sorrow of Bengal’। বানভাসি দামোদরের কী প্রখর রূপ
তখন। বৃষ্টি ঝরলো কী
ঝরলো না, দামোদর ফুঁসে উঠতো। আর সেকালে দামোদর নদে বন্যা
হতো। আকছার। দামোদর নদের জলকে বাঁধার জন্য কয়েকটি প্রকল্পের প্রস্তুতি শুরু হয়।
দামোদর অববাহিকার পাঞ্চেত বাঁধটি বাকি প্রকল্প গুলির মধ্যে অন্যতম। ১৯৪৩ সালের এক ভয়াবহ বন্যার পর ১৯৪৮ সাল নাগাদ ডিভিসি বা
দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের পরিকল্পনায় দামোদর নদ অববাহিকায় তিলাইয়া, কোনার, মাইথন, পাঞ্চেত চারটি
বাঁধ ও জলাধার তৈরি হল। ডিভিসির অধীনে দামোদরের ওপর ১৯৫৯ সালের ৬ ডিসেম্বর পাঞ্চেত
বাঁধের শুভসূচনা হয় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর হাতে। যেখানে আজ
অবিরাম উৎপন্ন হচ্ছে জলবিদ্যুৎ। তথ্যগতভাবে পাঞ্চেত বাঁধটির দৈর্ঘ্য ২২.২৩৪ ফুট,
চওড়া ৩৫ ফুট, উচ্চতা ১৪৭.৬৪ ফুট। পশ্চিমবঙ্গের
পুরুলিয়া জেলাটি সেতুর দক্ষিণে, ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ জেলাটি
রয়েছে উত্তরে। পাঞ্চেত বাঁধের জলাধারটি বিশাল পরিব্যাপ্ত। এবং তাতে জল ধরে রাখার
ক্ষমতা ১২১৪০০০ একর ফুট। যা থেকে হাইডেল পাওয়ার প্রোজেক্টের মাধ্যমে উৎপন্ন হচ্ছে
জলবিদ্যুৎ। তবে তথ্যাদি যাই
থাকুক, পাঞ্চেত জলাধার এলাকিটি পর্যটকদের ভারি পছন্দের
জায়গা। বিশেষ করে সপ্তাহান্তিক ভ্রমণরসিকদের কাছে তো বটেই।
আমরা চলেছি আসানসোল থেকে ভাড়া-গাড়িতে জি টি রোড ধরে
দিশেরগড়ের দিকে। দিশেরগড় একটি জনবসতিপূর্ণ খনিশিল্পাঞ্চল। প্রসঙ্গত, এই এলাকাটি জি টি রোড প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট শের শাহ সুরির নাম
অনুসারে আগে ‘শেরগড়’ নামে পরিচিত ছিল।
ব্রিটিশ জমানায় ইংরেজদের মুখে ‘দি শেরগড়’ ক্রমশ ‘দিশেরগড়’ হয়ে যায়।
বাঁদিকে ঘুরে পুরুলিয়া-চিরকুন্ডা রোড। আরও খানিক পথ পেরোতেই চোখে পড়বে দিগন্তে
ভেসে ওঠা পাঞ্চেত পাহাড়ের হাতছানি ডাক। কখনও ঘন কালো মেঘ তো ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টির
অপরূপ শোভা। বৃষ্টিস্নাত সবুজ জঙ্গুলে পথ, টিলা, আর ২১০০ পাঞ্চেত পাহাড়। আর টলটলে দামোদর নদের এক অনন্য আকর্ষণ। পাঞ্চেত
সেতুর নীচে বর্ষার জলে টইটুম্বুর দামোদর নদের অপূর্ব বাহার। আহা কী তার রূপ! মন তো
বাহানা খুঁজবেই।
পাঞ্চেত বাঁধের মাঝ বরাবর আমাদের গাড়ি দাঁড়ালো সেতুর
ধার ঘেঁষে। ধনুকের মতো বাঁকা সেতুটি। মনোলোভা জলজ বাতাবরণ ও দুর্দান্ত পাহাড়ি
পশ্চাদপট। মনকে দু’দণ্ড জিরেন দিতে
আর কী চাই। বাঁদিকে পাঞ্চেত পাহাড়, জলাধার। রাস্তার রেলিং
শেষে ঢাল নেমে গেছে জলাধার পর্যন্ত। জলে সার দিয়ে প্রচুর ডিঙি নৌকা। একদিকে আছে
দামোদর পাড়ের ধীবর সংসার। দামোদরের জলই যাঁদের রুজিরুটি। সারারাত দামোদরের জলে
ডিঙি নৌকা বেঁধে জাল বিছিয়ে থাকে তারা মাছের অপেক্ষায়। সেই জালে ধরা পড়ে কালবোশ,
রুই, কাতলা। সেইসব মাছ চালান যায় দিশেরগড়,
চিরকুন্ডা, কুমারডুবি, আদ্রা,
বরাকর, আসানসোল পানে। নৌকাবিহারের ব্যাবস্থাও
আছে জলাধারের জলজ মজলিসে। ডাইনে সবুজ নিসর্গ, পার্ক, কোয়ার্টার। ঝাপসাচ্ছন্ন সবুজ পরিবেশ আর জলাধারের অতল জলরাশি। মন তো
খুশিয়াল হবেই। ভরা বর্ষায় স্লুইস গেট থেকে যখন জল ছাড়া হয়, সে
এক দেখার মতো চমৎকার দৃশ্য
বৈকি। কী উতরোল বেগে ফেনানীভ জল উদ্দাম ঝরে পড়ছে। কী তার উছলতা। কী তার প্রখর তেজ
ও গর্জন। শীতের মরসুমেও যখন আবহাওয়া থাকে মিষ্টি মধুর, পাঞ্চেত
তখনও পাগলপারা। সম্মোহিত করে রাখে পর্যটকদের। তবু যেন নিঃসঙ্গতা আছে কোথাও।
চার চারটে বাঁধ দিয়েও দামোদরের যৌবনে ভাঁটা ফেলা যায়
না। যদিও কোথাও এই বাঁধগুলিই তাকে হ্রদের চেহারা নিতে বাধ্য করেছে। পুরুলিয়া
খরাপ্রবণ এলাকা। খানিক বৃষ্টিতে লালমাটির এলাকাগুলি সতেজ ও সবুজ হয়ে ওঠে। নানা
গাছের অভ্যথনা। জলাধারগুলিও তখন ভরে ওঠে কানায় কানায়। সেই হেতু পাঞ্চেতের এই বিশাল
জলাধারটিরও গুরুত্ব অপরিসীম। পাঞ্চেত তখন রূপেবিভঙ্গে মাধুরীময়ী। ডানদিকে নিচে
সাজানো গোছানো নেহেরু পার্ক। এখানে এক জায়গায় একটা স্নেক পার্ক হয়েছে। মুবারক
আনসারি নামে স্থানীয় একজন এটির দেখভাল করেন। জঙ্গলের সাপদের উদ্ধার করে তাদের
চিকিৎসা করা ও নিশ্চিত আশ্রয় দেওয়াই এই পার্কের উদ্দেশ্য। এখানে বিষধর কেউটে, ময়াল, গোখরো ইত্যাদি ছাড়াও আছে কিছু
সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী।
প্রকৃতির সঙ্গে পাহাড়, তার সঙ্গে নদ ও সবুজ জঙ্গল, তারও সঙ্গে
কিছুটা অতীত ইতিহাস, বর্তমান প্রযুক্তি __ ভাগ্যিস এই মন ভালো করে দেওয়া বাতাবরণের মাঝে এসেছিলাম। ছবির
মতো গড়ানে পাঞ্চেত পাহাড় ঢাল। তার বুকে সবুজ বনেদিয়ানা। আলো-ছায়া বাঁক। উছলা উতলা
দামোদর স্তব্ধতার আয়োজনের মধ্যেও উস্কানি দিতে সদা প্রস্তুত। দামোদর নদের ওপর এই
মুহূর্তে ধুসর মেঘের আনাগোনা, তবে বৃষ্টি নেই। বনকুঠি থেকে
মধ্যান্যভোজের পরই পায়ে পায়ে আবার চলে আসি, জলাধারের
কাছটিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও ফেটাল গভরমেন্ট অফ জার্মানির যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছে
লক্ষণপুর ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট বা পাঞ্চেত জলাধারের জল শোধনাগার। চারপাশের
অসাধারন দৃশ্যাবলী। কোথাও ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়টিলা, কোথাও
সবুজাভার মোটিফ। বর্ষার মোক্ষম সময়টাতে সবুজে ছয়লাপ থাকে পাঞ্চেত ও তার
পার্শ্ববর্তী এলাকাসমুহ।
বিকেল ঘনিয়ে আসে ক্রমশ। পাঞ্চেত জলাধার তখন মত্ত থাকে মারকাটারি সূর্যাস্তের হোরি খেলা নিয়ে। সে অস্তরাগ শুধুই মুগ্ধতার কথা শোনায়। এদিকে সন্ধ্যে হতে না হতেই পাঞ্চেত সেতুর ওপর রাস্তার আলোগুলি এক এক করে জ্বলে উঠলো। ধনুকের মতো বাঁকা সেতুর ওপর,
কীভাবে যাবেন –
কলকাতা থেকে রেলপথে কুমারডুবি হল নিকটবর্তী স্টেশন।
সেখান থেকে টোটো বা গাড়ি নিয়ে ১০
কিলোমিটার দূরেই পাঞ্চেত ড্যাম। কলকাতা থেকে সড়কপথে পাঞ্চেত ২৪০ কিলোমিটার,
চিরকুন্ডা থেকে ৯ কিলোমিটার, আসানসোল থেকে ২০
কিলোমিটার।
কখন যাবেন –
বর্ষার ঠিক পরেই অগস্ট – সেপ্টেম্বর মাসে এবং
অক্টোবার – ফেব্রুয়ারী হলো পাঞ্চেত ভ্রমণের সেরা সময়। তবে বছরের যেকোনো সময়েই
পাঞ্চেত ঘুরে আসা যেতে পারে।
কোথায় থাকবেন –
গড়পঞ্চকোট নেচার রিসোর্ট, পলাশবীথি ইকো রিসোর্ট, পাঞ্চেত
রেসিডেন্সি ইত্যাদি। এছাড়াও সকালে গিয়ে সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরেও আসা যায়।
0 মন্তব্যসমূহ