অনুতাপ
একটা কথা অধুনা বিজ্ঞান
বলছে, মনের
ভিতরে থাকে শরীর,শরীরের
অভ্যন্তরে কোথাও থাকেনা মন। অতীত বর্তমান জীবন কাহিনি,ভবিষ্যত্ ভাবনা,পরিবেশ, সংসার চিন্তা, প্রেম, ক্রোধ এইসব যাবতীয় মেনুগুলি ওই সফ্টওয়ার মহা বেগবান
মনের ভিতর বাহির। শরীরের বাইরে ভিতরে কাছে দূরে কোথায় যে থাকে কেউ বলতে
পারেনি আজও। কিন্তু মন বলে কিছু যে আছে তা সবাই বিশ্বাসকরে। কোনো
পরিচয় দিতে গিয়ে কেউ বলে,‘আমাকে মনে আছে
তো?’ বা রেগেমেগে ‘মনে পড়ছে না?’ কিংবা ‘মনে রাখবে তো?’ এতেই
বোঝা যায় আমাদের প্রত্যেককে ঘিরে একটা অদৃশ্য শক্তি আধার আছে তাতে স্মৃতিগুলি ভবিষ্যতের
জন্যে স্টোর করে রাখা থাকে বা রাখি। যেগুলো সঞ্চিত রাখতে চাই সেগুলো নিরাকার। যাতে
রাখতে চাই সেটিও নিরাধার। অদ্ভুত বিস্ময়কর ব্যাপার,আমাদের অস্তিত্বের অর্ধেক অংশই শূন্যতা। আমাদের
শরীরের মানে মস্তিষ্ক হৃদয় হাড় মজ্জা রক্ত অনু পরমাণু ধরে চিরে চিরে আতিপাতি করে
খুজলেও এই মন আধারটিকে পাওয়া যাবে না,এই কঠোর সত্য মানুষ মেনে নিয়েছে। তেমনি করে মানুষ মেনে নিয়েছে
আমাদের শরীরের উপরে আকাশ যেমন সুবিশাল। অনন্ত পরিব্যাপ্ত। তেমনিই বিশাল পরিব্যাপ্ত আমাদের
মন। মনো আকাশ।
প্রতি মানুষের জানার
ইচ্ছা কম বেশি থাকেই। প্রতিটি মানুষই কম বেশি জটিল স্বভাবের। আরো
আরো চাহিদা ও চাহিদা চেপে রেখে একটু আধটু হলেও ডিপ্রেশন পুষে রাখা। এসব আম
জনতার না থাকলে কি বুদ্ধ সক্রেটিস ও সময়ে সময়ে প্রতিটি ধর্মীয় স্তরে ফিলসফারের
আবির্ভাব কেন হয়? উন্মত্ততা রাগ অসহনশীলতা ধৈর্যহীনতা এইসব চারিত্রিক
দোষের মধ্যে পড়ে,একথা আশাকরি
আধুনিক সমাজ জেনেছে। এইগুলির প্রদর্শনের পরই প্রায় সব মানুষই অনুতাপের
কবলে পড়ে। ‘ইস কেন ওই কাজটা করলাম? না
করলেই ভালো হতো’। এবং এই ড্রামা মাথার ভেতরে
অনেকদিন ঘুরপাক খায়। মন বা চিন্তা কিন্তু এই ব্যাপারটা যে ক্ষতিকর তা বুঝে
এর নিরাময় চায়।‘যাকগে, যা
হবার তা হয়েছে, লিভ এন্ড ফরগেট’। এই
ভেবে শান্ত হবার চেষ্টা করে। কিন্তু অনুশোচনা ছ্যাঁচড়ের মত মনের কোণে লুকিয়ে থাকার
চেষ্টা করে। ভুল জানা বা ভুল সিদ্ধান্তই অনুশোচনার কারণ। ভুল
চিন্তা মানুষের দুঃখভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং পরে অনুশোচনার দিকে ঠেলে দেয়, এই কথা গীতাতেও বলা হয়েছে।
আমাদের মন বর্তমানের
সম্পুর্ন রসাস্বাদন থেকে বঞ্চিত রাখতে চায়। চিন্তা ঘটমান বর্তমানে ওতপ্রোতে
জড়িয়ে থাকে। চিন্তা হলো স্মৃতির খোরাক আর স্মৃতি সর্বদাই অতীতের। তাই
অতীত আমাদের বর্তমান থেকে টেনে পিছনে নিয়ে যেতে চায়। এই ঘটনাটি প্রতিটি মানুষের
মধ্যেই ঘটে। অতীত বিষয়ের টানের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি হলো অনুশোচনা।অনুশোচনা
এতো জোরালো মানুষের ঘুম কেড়ে নেয়। কোনো এমন কাজ যা অন্যের ক্ষতি করে, অন্যকে খুব জোর আঘাত করে,নিহত বা আহত করে,কিংবা তার মানসিক ক্ষতি
করে এবং সেই কাজের পর তার ভুল কর্মের উপলব্ধি হওয়াটাই আমরা অনুশোচনা বলে জানি।আমাদের
কেউ কেউ অতীতে ডুবে থাকতে ভালোবাসে আর এটাই জীবনের মস্ত বড় ভুল। অতীতে
অব্যক্ত চিন্তাগুলো মাথায় যেখানে স্টোর করা থাকে,সেগুলোর অতিরিক্ত ব্যাবহারের জন্য সেগুলো মাথার ভিতরে
স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে গোলমাল শুরু করে দেয়,যা ডিপ্রেশনের কারণ
হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি সেই চিন্তা ভবিষতের কোনো পরিকল্পনার ভুল
সিদ্ধান্ত এনে দেয়।
আসলে আমরা ঠিক দেহগত বাস করিনা,মনোগত বাস করি। তাই সবসময়ই মাঝে মাঝে সচেতন হয়ে
ভাবা চাই আমি কী করছি? কী ভাবছি এখন? অবশ্য কিছু আশা ব্যঞ্জক ভাবনা ভবিষ্যতের কাল্পনিক সুখ
এনেদেয়। যাতে চড়ে আমরা তার বিপরীত কিছু ভাবতেই পারিনা। এরজন্যে
আগে পিছনে কিছুই না ভেবে গোঁয়ারের মত কাজ করে বসি। একটুও ভাবিনা যে ওই একগুয়ে চিন্তা
আমাকে বোকা বানাচ্ছে। যখন ভবিষ্যত্ আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, তখন সেই ভুলের জন্যে অনুশোচনা
ছাড়া আর কিছুই থাকেনা।এবং এই অনুশোচনা চেনের মত অতীতের অনুশোচনাগুলি টেনে আনে।
আমাদের মনোকাশ ক্ষণে
ক্ষণে নানা অন্ধকার ও অস্থিরতা আবর্জনার মেঘে ঢেকে যায়। তার জন্যে শরীরে নানারকম প্রদাহ। একটি
একটি করে নয়, একের সাথে আরেক বা তার সাথে চেনের মত অন্য কষ্টগুলোও
বাঁধা। আমরা যারা কর্মময় জীবনে ব্যস্ত থাকি বা জীবনে কোন
লক্ষ্য নিয়ে চলি,পাত্তা দিইনা। মনকে
শান্ত ও সংযত করতে পারলেই অন্ধকার কেটে যায়। যুক্তি মানবিকতা পরিবেশ মৌলিকতা
ও সময়সাপেক্ষ এইসবের চিন্তায় মনের নির্মলতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে চেষ্টাকরি। কিন্তু
কখনো কখনো দুর্বলমনে অন্ধকার আরো ঘন হয়ে আসে। গুপ্তকাম উঁকিমারে সুযোগ খোঁজে
ছোবলমারে। সফলতা হোক কিংবা অসফল ঠিক তারপরই চোরাপথ দিয়ে আসে চরম
আফসোসের দহন। সমাজ ও নিজঅস্তিত্বের ভয় অপরাধ চিহ্ন মুছে দেবার উগ্র
অন্ধ ইচ্ছা এবং শেষে যা হয়। নিজেকে টার্মিনেট করে দেবার অন্ধ ইচ্ছা। এতো
শুধু চোরা কামরূপ অন্ধকারের কথাই উল্লেখ করা হলো। ক্রোধ লালসা অন্ধ যুক্তিহীন
মায়ামোহে ধোঁকা খাওয়া এমনকি অন্যের বিলাসিতায় ভয়ানক মর্ষকামী হয়ে দিনের পর দিন নিজ
দরিদ্রতা একটি অভিশাপ জেনে নিজেরই অস্তিত্ব বিপন্ন করা। এই ইন্দ্রিয়জনিত কষ্টগুলি
একসাথে সবগুলিই যন্ত্রনা দেয় আর আশ্চর্যের ব্যাপার কিছু মানুষ ওগুলি সুখ চুলকুনি
বা খোস বা দাদের মতই প্রদাহ শরীর ও মনে সযত্নে লালন পালন করে। শুভচেতনা দিতে কোনো
শুভানুধ্যায়ী এলে তাকে সে পছন্দ করেনা,বিরক্ত হয়।এবং এই পথের শেষে হাহাকার তাকে পরিসমাপ্তির পথে টেনে
নিয়ে আসে। তখন সে এতটাই একা হয়ে যায়,সে পৃথিবীর কোনো মানুষকে বা মানবতার মতবাদকে বিশ্বাস করতে
পারেনা।
অধ্যাত্মিক অতিন্দ্রিয়
ক্ষমতা spiritual instinct। পৃথিবীকে
জানতে চাওয়ার ইচ্ছাই আধ্যাত্মিকতার রাস্তায় পা বাড়ানো। ঘৃণাকে বিদায় দিলেই ক্ষমা আসে। ক্ষতি
স্বীকার করলেই লাভ আসে। চাওয়া পাওয়ার চিন্তা ভাবনা থেকে বিরত থাকলে মন শান্ত
হয়।
ক্ষমা
মনের ভিতর ক্ষমা করার
প্রবৃত্তি তখনই আসে যখন, যে মানুষকে তার দোষের জন্য ক্ষমা করে দেওয়া হবে,তার প্রতি ঘৃণা ও ক্রোধ মনের ভিতর থেকে আগেই নিঃশেষ হওয়া উচিত। তার
প্রতি কোনো রকমের বিরূপ মনোভাব মনের ভিতর থেকে যেন না ওঠে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি
ক্ষমশীলতার উপর একটা শিক্ষামূলক প্রজেক্ট চালাচ্ছে। ওদের ওয়ার্কশপে রীতিমতো ট্রেনিং
দেওয়া হয়, কেমনকরে
ক্ষমাশীল হওয়া যায়। শুধু ওরা কেন, ওয়েস্টার্ন দেশগুলি খুব উত্সাহের সাথে এই প্রোগ্রাম
চালায়। কেননা ওরা ভালোভাবেই জানে,এই প্রোগ্রামে সামান্য টাকা খরচ করলেই নিজেদের ও দেশের
স্বাস্থ্য শান্তি ও সামুহিক উন্নতির সুফল পাওয়া যায়। আসলে যিনি ক্ষমা করেন তিনিই বেশি
লাভবান হন, তাঁর
মন শান্তি লাভ করে আর অহংকার ও ক্রোধ থেকে তিনি মুক্ত হন। গবেষনায় দেখা গেছে gratitude ক্ষমা mindfulness ও সেলফ compassion সুনিদ্রার সহকারী হয়। কিন্তু
মানব প্রকৃতির কাঠামোই এরকম, মানুষের মনের ক্রমবিকাশই এরকম যে, প্রতিশোধপরায়ণতা এবং ক্ষমাশীলতা
দুটিই পাশাপাশি দ্বন্দ্বমূলক ভাবে অবস্থান করে। রাগ উষ্মা ক্রোধে মানুষ চেতনা
হারায় কিন্তু ক্ষমা ঠান্ডা মাথায় সচেতন হয়ে যুক্তি দিয়ে মনকে বুঝিয়ে করা হয়। তবে
বিগত কয়েক দশকের পর মানুষের চরিত্র পরিমার্জিত ও সভ্য হয়ে ওঠার কারণ বিজ্ঞানের
দ্রুত প্রগতি। সোশ্যাল মিডিয়া এবং আন্তর্জাল দূরের হোক বা কাছের
পরস্পরের সম্পর্ক সহজ করে দিয়েছে। মানুষ নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছে ও দিতে চাইছে। তার
ফলে মানুষ কোনো ভুল বা খারাপ কাজ করে ফেলে অনুতাপে নিঃসঙ্গ একাকী হয়ে নিজেকে দগ্ধ
করার চেয়ে নিকট জনের কাছে ব্যক্ত করার প্রবণতা হয়েছে। বা ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার প্রবৃত্তি
হয়েছে এটা আমার মনে হয়। শ্রী শ্রী রবিশংকর বলেন, ‘আমি মনে করি, বর্বর যুগের শেষে আমরা এখন পারস্পরিক বিশ্বাস,প্রেম,করুণা,অধিক
সেবা পরায়ণতা ও পারস্পরিক মমতা নিয়ে একটি যুগে বাস করছি। আগের
কয়েক দশক আগে নিজের ও পরিবেশ নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা ছিল না’।
প্রতিটি মানুষের মধ্যেই
সম্পর্ক পাতানোর একটা প্রবৃত্তি রয়েছে। এই সম্পর্ক দৃঢ ও প্রেমের হতে গেলে ক্ষমাশীলতার
ভূমিকা অত্যন্ত জরুরী। এবং তা হয়ই। কারণ প্রতিটি মানুষের মধ্যে দোষ
বদআচরণ অন্ধক্রোধ স্বার্থপরতা এইসব ঋণাত্মক অবগুণ থাকেই। সেগুলি মন থেকে মেনে নিয়েই
মানুষ পরস্পরের কাছাকাছি আসে এবং খারাপের থেকে ভালোটি বেছে নেয়। একেই
বলে ক্ষমা।
কাউকে ক্ষমা করে দেওয়ার
উত্তম নিদর্শন হলো, তাকে বুকে জড়িয়ে ধরা। এর মধ্যে তিনরকম সহানুভূতির কথা
আসে। compassion, sympathy এবং অন্যটি empathy। এই
তিনরকমের সহানুভূতির সাথে জড়িয়ে আছে করুণা দয়া এবং ক্ষমা। এইসব ক্ষেত্রেই ক্ষমা দয়া বা
করুণাপ্রার্থীর অঙ্গস্পর্শ বা আলিঙ্গন করলে তার মন প্রানের দহন শান্ত হয়। sympathy হলো অন্যের দুঃখে সমবেদনা জানানো। empathy হল সহমর্মী হওয়া, কারো অনুশোচনা শুনে ব্যথিত হওয়া। কিন্তু compassion হলো সেইরকম সহানুভূতি যখন কারো
মনো দুঃখে কাতর হয়ে তার কষ্টের ভাগীদার হওয়া। মজার কথা আমরা যখনই ক্ষমাপ্রবন
ও করুণাময় হয়ে উঠি আমাদের হৃদয় স্পন্দন ধীরে ও ছন্দময় হয়ে ওঠে। তার
কারণ একটি উপকারী হরমোন আমাদের শরীরে নিঃসরণ হয়,তার নাম অক্সিটসিন। আবার দয়া মনের মধ্যে উদয় হলে
ডোপামিন ও সেরোটোনিন নামের অত্যন্ত দুর্লভ হরমোন শরীরে নিঃসরণ হয়। ওইসব
হরমোন আমাদের অন্তঃস্থল থেকে মমতাময় দুগ্ধ নিঃসরণের মতো। নিজের মানবিক গুণগুলির পুষ্টি
এবং সমাজ প্রকৃতি পরিবেশের জন্যেও হিতকারী।
বৌদ্ধধর্মে মনকে সংযত
করতে বন্ধুত্ব করুণা ক্ষমা শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। বৌদ্ধধর্ম সাধনার মূল ধারা হল
করুণা ও ক্ষমা। ইসলাম ধর্মে বলা হয়, মহান আল্লাহ তাআলা অতি দয়ালু ও
ক্ষমাশীল। তিনি ক্ষমাশীলতাকে ‘বীরের কাজ’বলে উল্লেখ করে কোরানে বলেছেন, যে সবর করে ও ক্ষমা করে,নিশ্চয়ই সে বীরের কাজ করে (সূরা-৪৩)।
কেউ যখন ক্ষমাহীন নিষ্ঠুর
অপরাধ করে,সেটা অন্ধ ক্রোধে হোক বা কারো
প্ররোচনায় কিংবা বিকৃত কাম তাড়নায়, তার
ভিতরে ভিতরে একটা আত্মগ্লানির আগুন ধুঁয়ো চাপা হয়ে থাকে। সেটা সে নিজেও জানেনা। যাকে
বা যার অতি প্রিয়জন তার এই কৃতকর্মের শাস্তি না চেয়ে ক্ষমা করে দেয় তখন সেই
আত্মগ্লানির আগুন জ্বলে ওঠে। এবং সেটাই হয় তার চরম শাস্তি। এই অনুশোচনার দহনে সে জ্বলে
পুড়ে খাঁটি মানুষ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ধর্মীয় বা হিংসাত্মক গোষ্ঠী দ্বারা ব্রেন ওয়াশ
করা মানুষ অনায়াসে কিছু না ভেবেই যন্ত্র মানুষের মত হত্যা বা হিংসামূলক কাজ করে
তার কাছে অনুশোচনা আশা করা যায় না, তাই তার শাস্তি একান্তই কাম্য। অথবা শাস্তি ও ক্ষমা দুইই।
|
1 মন্তব্যসমূহ
অসাধারণ
উত্তরমুছুন