মহাযুদ্ধ
সে এক
ভীষণ যুদ্ধ হয়েছিল। ভয়ানক যুদ্ধ ভাইয়ে ভাইয়ে । এমন যুদ্ধ আগে কেউ কখনো দেখেনি।
আশেপাশের জমি বহু বছরের জন্যে বন্ধ্যা হয়ে গেছিল, এত ভয়ানক অস্ত্রের তেজ। উত্তরার গর্ভের মতো কত রমণীর গর্ভের সন্তান গর্ভেই মরে
গিয়েছিল। আর ফিরে আসেনি।তাদের মাথায় তো কৃষ্ণের হাত ছিল না।আর নতুন করে যে সন্তান
উৎপাদন হবে, তার জন্যে তো
পুরুষ লাগবে, পুরুষ। গৃহে, জনপদে, গোচারণ ভূমিতে কোথায় ছিল পুরুষ? সবাই তো যুদ্ধে গেছিল, ফেরেনি। যারা ফিরেছিল, তাদের ক্ষমতা ছিল না রমণীর উষ্ণ কোমল জরায়ুতে নতুন সৃষ্টির বীজ রোপণ করার।যৌন
ক্ষমতা দূরে থাক, রমণীদের
দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করারও যে শক্তি ছিল না এদের, তার
প্রমাণ তো কৃষ্ণের মৃত্যুর পর অর্জুন যখন দ্বারকার কুলনারীদের নিয়ে হস্তিনাপুর
ফিরছিলেন, তখন আভীর দস্যুদের হাত থেকে তিনিও রমণীদের রক্ষা
করতে পারেননি।
পঞ্চনদ
(বর্তমান পাঞ্জাব মনে হয়) প্রদেশের এক স্থানে আভীর দস্যুরা তাঁদের আক্রমণ করলে
‘অর্জুন ঈষৎ হাস্য করে তাদের বললেন ‘যদি বাঁচতে চাও তো দূর হও, নতুবা আমার শরে ছিন্ন হয়ে সকলে মরবে’। দস্যুগণ নিবৃত্ত হল না
দেখে অর্জুন তাঁর গাণ্ডীব নিলেন এবং অতি কষ্টে জ্যা রোপণ করলেন, কিন্তু কোন দিব্যাস্ত্র স্মরণ করতে পারলেন না’
অর্জুন, তুমি অর্জুন। সেই কিংবদন্তীপ্রতিম অর্জুন দিব্যাস্ত্র ভুলে
গেছেন! তাঁর সামনেই দস্যুরা যথেচ্ছ রমণীদের হরণ করে নিয়ে যাচ্ছে, এমনকি অনেকে স্বেচ্ছায় দস্যুদের সঙ্গে চলে যাচ্ছে। আর এইভাবেই, যা ভয় পেয়েছিলেন আর্য কুলপতিরা, সেই বর্ণসংকর
সন্তানে ভরে যাচ্ছে ভারতভূমি, আর্য রক্তে মিশে যাচ্ছে অনার্য
রক্ত।
এ এমন এক যুদ্ধ যা শুধু আঠেরো দিন ধরে লড়া হয়নি, লড়া হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এবং যেখানে মুছে গেছে আর্য অনার্য, বিজয়ী বিজিতের সীমারেখা।
এ এমন এক যুদ্ধ, যেখানে সমগ্র জম্বুদেশ পক্ষে বিপক্ষে ভাগ হয়ে গেছিল। একমাত্র বলরাম,
যিনি নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছিলেন, তিনিও এই
যুদ্ধসঞ্জাত মানসিক বিকলন থেকে বাঁচতে পারেননি। কেই বা পেরেছিলেন? এ এমন এক যুদ্ধ, যেখানে বিজিত মরে
বাঁচেন এবং বিজয়ীর জন্যে থাকে আত্মগ্লানির রক্তাক্ত সিংহাসন। তাই তো
যুধিষঠির বলেছিলেন ‘আমাদের জয় হয়নি, দুর্যোধনেরও জয় হয়নি। তাঁকে বধ করে আমাদের ক্রোধ দূর হয়েছে, কিন্তু আমি শোকে বিদীর্ণ হচ্ছি। ধনঞ্জয়, আমার রাজ্যে
প্রয়োজন নেই, তুমিই রাজ্যশাসন করো’
জন্মের
কুয়াশা
ভাইয়ে
ভাইয়ে যুদ্ধ, এক ভাইয়ের নাম আর্য, আরেক ভাইয়ের নাম অনার্য। এক রহস্যময় সকালে বধূমাতা
কুন্তী হস্তিনাপুরে হাজির হলেন পাঁচটি অজ্ঞাতকুলশীল বালককে নিয়ে। বললেন তারা নাকি পাণ্ডুর সন্তান। পরে জানা গেল
সন্তান ঠিকই, কিন্তু ক্ষেত্রজ। যেকোন ক্ষেত্র নয়, স্বয়ং দেবতার ঔরসে জন্ম । হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বাস করানো হল সেই কথা।
দেবতার পুত্র। অরণ্যে দেবতা কোথায়? বলিষ্ঠ আরণ্যক, নিষাদ, ব্যাধ, কিরাত- এঁরাই তো ছিলেন সেই সম্ভাব্য পাঁচ
পুরুষ।ইতিহাস মুছে দিয়েছে তাদের নাম। আর্য রমণীর সঙ্গে অনার্য রক্তের মিশেলের পাপ
শুদ্ধ করে নেওয়া হয়েছে দেবতাদের নাম ব্যবহার করে।এইভাবে বিখ্যাত কুরু বংশে অনুপ্রবেশ ঘটল অনার্য রক্তের। আর এই অনার্য পরিচয় মুছতেই কি বারবার পঞ্চপাণ্ডব অনার্যদের
হত্যা করে চলেন না? জতুগৃহের সেই
নিষাদী আর তাঁর পাঁচ পুত্রকে হত্যা দিয়ে শুরু, তারপর নিষাদ পুত্র একলব্যের
আঙুল কেটে নেওয়া- এসবই পাওয়ার পলিটিক্স, যে ভূমি থেকে উত্থান, সেই
ভূমিকেই পদাঘাত করা, অস্বীকার করা
নিজেদের অনার্য উৎসকে। তাই বারবার পাণ্ডুপুত্রেরা জড়িয়ে যান অনার্য নিধনে।
কিন্তু এমনই নিয়তি যে অনার্যরাই হয়ে ওঠে তাদের নিয়ামক। বেদব্যাস, কৃষ্ণ এবং দ্রৌপদী এই তিন কালো চামড়ার মানুষ হয়ে ওঠেন
ভারতভাগ্য বিধাতা। না, ইতিহাস এঁদের অনার্য বলেনি। কারণ এ কাহিনী তো লিখেছিলেন স্বয়ং
বেদব্যাস।মজার কথা হচ্ছে বাল্মিকি এবং ব্যাসদেব দুজনকেই অনার্য বলাই যায়। এঁদের কথা ভাবলে আমার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
‘মড়িঘাটের মেলা’ গল্পের সেই গ্রামের দূরদর্শী এবং সংবেদনশীল সাধুটির কথা মনে পড়ে
যায়, যিনি রটিয়ে দিয়েছিলেন যে বছরের একটি
বিশেষ দিনে মড়িঘাটে মা গঙ্গা আসেন, যাতে দরিদ্র মানুষ,
যারা অনেক দূরে গিয়ে পয়সা খরচ করে গঙ্গাস্নানের সুযোগ পায় না,
তাদের জীবনেও একটি দিন উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।
ব্যাসদেব
ক্রান্তদর্শী ছিলেন, কিন্তু
দেশকালকে অস্বীকার করতে পারেন নি। তিনি যেখানেই অনার্য সংযোগ
দেখেচ্ছেন, সেখানেই তাদের জন্মকাহিনীতে নিয়ে
এসেছেন দেবতার মায়া। তাই কৃষ্ণকে নিয়ে জন্মের পরেই বিক্ষুব্ধ যমুনা পাড়ি দেন
বসুদেব, দ্রৌপদী উঠে আসেন যজ্ঞের আগুন থেকে আর ব্যাসদেবের
বাবা মা অর্থাৎ মুনি পরাশর আর ধীবর কন্যা সত্যবতী মিলিত হন একটি নির্জন দ্বীপে, ঘন কুয়াশার আড়ালে।
শুধু
এই তিনজনই নন, আরেক অনার্যের
কাছেও পরাজিত হয়েছিলেন অর্জুন। তিনি একজন কিরাত। সেই কিরাতকে ভজনা করেই তিনি
পৌঁছতে পেরেছিলেন তাঁর অভীপ্সিত দিব্যাস্ত্রের কাছে।
গারো
পাহাড়ের কিরাত?
গারোরা মঙ্গোলীয় জাতগোষ্ঠীর বৃহৎ বডো সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।প্রাচীন প্রাগ জ্যোতিষপুর ও কামরূপ রাজ্যের, বলতে গেলে সাম্রাজ্যের বর্তমান খাসিয়া পাহাড়ের খাসিয়ারা বাদে(যারা অষ্ট্রিক মনখেমর সম্প্রদায়, অবশ্য তারাও মঙ্গোলীয়) সব জাতিই বডো সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।এই সম্প্রদায়ের লোকদের আর্যরা দৈত্য, দানব, অসুর ইত্যাদি আখ্যা দিত।এরা দক্ষিণে সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত বসতি স্থাপন করেছিল। র্তমান আসাম, অবিভক্ত বাংলা ও উড়িষ্যায়, প্রাচীন প্রাগজোতিষপুর সাম্রাজ্যের প্রভাব ছিল। ইতিহাস প্রমাণ দেয় যে, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে আর্যবর্তে যে ষোড়শ মহাজনপদ (রাজা) ছিল তাতে এইসব অঞ্চলে কোনো আর্য রাজ্যের উল্লেখ নাই। এইসব অঞ্চল ছিল আর্য বিবর্জিত দেশ।প্রাগৈতিহাসিক যুগে এই অঞ্চলের অর্থাৎ প্রাগ জ্যোতিষপুরের প্রথম যে রাজার নাম পাওয়া যায়, তার নাম মৈরাং। এটি একটি মঙ্গোলীয় নাম। পরবর্তীকালে আর্যরা তার নাম দেন মহীরঙ্গ দানব।এই বংশের শেষ রাজা ঘটককে হত্যা করে নরকাপুর প্রাগজ্যোতিষপুুরের সিংহাসনে বসেন।এই বংশের অনেক রাজা, দীর্ঘদিন প্রাগজ্যোতিষপুরে রাজত্ব করেন।অসুর বংশ রাজত্ব করলেও অধিবাসীগণ অধিকাংশই ছিল দানব বংশীয়।এই দানব বংশীয় লোকেরাই পরবর্তীকালে ‘কিরাত’ জাতি বলে প্রসিদ্ধি লাভ করে।প্রাচীন পুন্দ্রবর্দ্ধনের রাজা বাসুদেব ও প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা ভগদত্ত বিরাট কিরাত বাহিনী নিয়ে কৌবর পক্ষে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগ দেন।
গারোরাও ঐ সময়ে ‘কিরাত’ নামেই পরিচিত ছিল।গারোদের গল্পকাহিনি হইতে জানা যায় যে, মহাদেব (শিব) গারো মেয়ে ‘নাবারীতিরা দিপারীকে’ বিয়ে করেছিলেন। কোচদের কাহিনিতেও জানা যায় যে, মহাদেব কোচ মেয়ে ‘হীরা ও জিরাকে’ বিয়ে করেছিলেন।এই জন্য কোচ ও গারোরা অনেকে নিজের মহাদেবের বংশ বলে থাকে।শিবের
বিয়ে কিন্তু আমাদের বরাবর কৌতূহল আকর্ষণ করেছে। আমাদের মনে পড়তে পারে উমা হিমালয়ের
কন্যা, সুতরাং তাঁর পার্বত্য উপজাতি গারো
হওয়ায় অবাক হবার কিছু নেই। মহাদেব নাকি ‘কিরাত’ জাতির লোক ছিলেন। তিনি আর্য ছিলেন না। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী স্বীকার করেছিলেন যে, মহাদেব অনার্যদের দেবতা ছিলেন। কালে আর্যরা তাকে নিজেদের দেবতা করে নিয়েছে। বৈদিক যুগে আর্যদের দেবদেবীর নামের তালিকায় মহাদেবের নাম না থাকাই এর প্রমাণ।
রামায়নেও গারোদের কিরাত জাতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে।রামায়নে কিঙ্কান্ধ্যা কাণ্ডে সীতার অন্বেষণে পূর্বদিকে যে সৈন্যদলটি পাঠানো হয়েছিল
(সেনাপতি বিনত-র অধীনে) তাতে ঐ সৈন্য দলকে বলা হয়েছে :-
দ্বীপবাসী
হেমবর্ণ সুদর্শন কিরাত যারা কাঁচা মাছ
খায়, যারা অর্ধনর অর্ধব্যঘ্র তাদের কাছে
যাবে। (বাল্মিকী রামায়ণ)
আর
কৃত্তিবাস লিখেছেন-
ব্রহ্মপুত্র তরি রঙ্গে করিহ প্রবেশ।
মন্দর পর্বতে যাইও কিরাতের দেশ।।
যাইবে দশটি দেশ আর সাকদ্বীপে।
কিরাত জানিবা আছে অত্যদ্ভুত রূপে
কনকচাঁপার মত শরীর বর্ণ।
উঠাখানার মত ধরে দুই কর্ণ।
থালাহেন মুখখান তাম্র্রবর্ণ কেশ।
একপায়ে চলে পথ বিক্রমেতে বিশেষ।।
জলের ভিতর বৈসে মৎস্যবৎ মুথ।
মানুষ ধরিয়া খায় আইসে সম্মুখ।।
বলিয়া মানুষ ব্যাঘ্র তাহাদের খ্যাতি।
আতপ সহিতে নারে কিরাতের জাতি।।
সীতা লৈয়া থাকে যদি কিরাতের ঘরে।
যত্ন করি চাহিও তথায় লঙ্কেশ্বরে।।
এখানে ব্রহ্মপুত্র নদ পার হওয়ার পর যে পর্বত বা পাহাড় সম্মুখে পড়ে তাই গারো পাহাড়। এই গারো পাহাড়ের একটি চূড়া কোয়াশিমিন্দ্রি। এই মিন্দ্রিকেই মন্দর বলা হইয়াছে। এ ছাড়া আরও দুটো মন্দর পর্বতের নাম পাওয়া যায়। একটি হিমালয়ে ও অপরটি গঙ্গার দক্ষিণে বিহারের ভাগলপুর জেলায়।
এই বর্ণনায় কানকে উঠোনের (উঠাখানা) মত বড় বলা হয়েছে। কারণ গারোরা আগে কানের ওপরে ও নিচে অনেক গয়না পরত বলে কান বড় দেখাত।আর
এই অর্ধেক বাঘ আর অর্ধেক মানুষের একটা
দারুণ গল্প আছে। গারোদের বিশ্বাস ছিল যে, গারোরা দিনে মানুষ হয়ে রাত্রে বাঘ হতে পারত বা একই সময়ে মানুষ ও বাঘ দুই জীবনের অধিকারী হত। গারো ভাষায় একে বলা হত “মাচ্ছাদু মাচ্ছাবেত”
এই বাঘ হয়ে যাবার
ব্যাপারটা দারুণ। অনিতা অগ্নিহোত্রীর উপন্যাস ‘মহাকান্তার’-এ এমন একটা লোকবিশ্বাস
আমরা পাই ছত্তিশগড়-ওড়িশা সীমান্তে কালাহান্ডি সন্নিহিত নওয়াপাড়া অঞ্চলে ভূমিহীন
গোন্ডদের মধ্যে। ‘লোকে বলে দসরু নাকি ছিল পালটা
বাঘ। এমন হয় সুনাবেড়া অঞ্চলের এই অলীকে আসলে মেশা পৃথিবীতে। পাল্টা বাঘকে লোকে
‘পরধিয়া’ বাঘও বলে। দিনের বেলা সে সুপুরুষ যুবক, নিয়ামাটির বর। রাতে বাঘ হয়ে ঘুরে বেড়ায়’
বহু দেশি ও বিদেশি লেখকরা কাশ্মীরের কলতিস্থান, লাজক, সমগ্র হিমালয়ের পাদদেশ, সমগ্র আসাম,
অবিভক্ত বাংলার উত্তর ও পূর্বাংশকে বডো ভাষা গোষ্ঠীর কিরাত জাতির বাসস্থান ছিল বলে মনে করেন।বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যায় কিরাত জাতির যে সমস্ত লোকেরা এখন মূল জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে এবং নিজেদের প্রাচীন ভাষা ছেড়ে মিশ্র ভাষা ব্যবহার করছে তাদের ‘কিরাস্তি’ বলা হয়।
প্লিনি গারো পাহাড়কে মালেয়াস পাহাড় এবং এই পাহাড়ের বাসিন্দাদের মান্দাই (মান্দি, মান্দাই=মানুষ) বলেছেন।টলেমি কিরাত জাতির সঙ্গে গারিওনি জাতির উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায় গারো পাহাড়
নাকি মৈরন্তম পর্ব্বত । তিনি হয়তো রামায়ণে উল্লিখিত মন্দর বা মিন্দ্রিকে মৈরন্তম পর্ব্বত বলেছেন।
কবি
চন্দ্রাবতীর লেখা দস্যু কেনারামের পালায় উল্লেখ আছে:
গারুয়া পাহাড় হইতে দক্ষিণ সাগর।
ঘরবাড়ি নাহি কেবল নল খাগড়ার ঘর।।
এইসব ছাড়াও ‘রাজা রঘুর পালা’ “বাংলার পুরনারী” গ্রন্থে ‘রাণী কমলাতে’ ‘গারো’ জাতির উল্লেখ রয়েছে। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন “মৈমনসিংহ গীতিকায়” পূর্ব ময়মনসিংহের রাষ্ট্রীয় অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন “প্রাগজ্যোতিষপুরের অবনতির পরে, পূর্ব ময়মনসিংহ কতগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য পরিণত হয়। রাজবংশীয়, কোচ এবং হাজং প্রভৃতি শ্রেণীয় লোকেরা এই সমস্ত ক্ষুদ্র রাজ্য শাসন করিতেন। ১২৮০ খৃ: সোমেশ^র সিংহ নামক এক ব্রাহ্মণ যোদ্ধা কোচ রাজবংশীয় বৈশ্য গারো নামক রাজার অধিকৃত সুসংঙ্গ দুর্গাপুর রাজ্য কাড়িয়া লইয়াছিল। উক্ত বর্ণনা অনুসারে বুঝা যায় যে, গারোদের রাজবংশী, কোচ ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হত।’
ইতিহাস
আর পুরাণ মিলিয়ে যা নিশ্চিত করে বলা যায়, তা হল কিরাতরা বীর যোদ্ধা জাতি, পর্বতেই এদের মূল
বাসভূমি ছিল আর পশুশিকার ছিল এদের প্রধান জীবিকা। এখানেও শিবের কিরাত জাতির প্রধান
এবং অনার্য হবার ইঙ্গিত স্পষ্ট। কারণ কে না জানে শিবের আর এক নাম পশুপতি এবং অর্জুন
কে তিনি যে অস্ত্রটি উপহার দেন, তার নাম পাশুপত।
কিরাত
–অর্জুন সংবাদ
মহাভারতে
সবচেয়ে দীর্ঘ এবং সবচেয়ে ঘটনাবহুল পর্বটির নাম বনপর্ব। যদিও উদ্যোগ পর্ব বলে আলাদা
একটি পর্ব আছে, তবু আমরা দেখছি
বনপর্বেই সেই উদ্যোগের বীজ রোপণ করা হয়েছিল। তাই একে আমরা প্রস্তুতিপর্বও বলতে
পারি। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যুধিষ্ঠির আর অর্জুনকে দুই বিপ্রতীপ ভূমিকায় ।যেকোন যুদ্ধের জন্য একটা
মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি থাকে আর থাকে ব্যবহারিক প্রস্তুতি, অর্থাৎ অস্ত্রশস্ত্রের জোগাড়, মিত্রশক্তি
সংগ্রহ ইত্যাদি। প্রথমটা যুধিষ্ঠির করলে, দ্বিতীয়টা অবশ্যই
অর্জুন। ভীম এখানে শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে পরিবারের সার্বিক প্রতিরক্ষার দায়িত্বে,
এর মধ্যে অবশ্য তিনি সহস্রদল পদ্ম এনে দ্রৌপদীর অনুরাগভাজন হয়েছেন।
নকুল সহদেবের বিশেষ কিছু ভূমিকা বনপর্বে দেখা যায় না।(বস্তুত সারা মহাভারতেই এত
প্যাম্পার্ড চরিত্র আর তৃতীয় নেই) আর দ্রৌপদী ইন্ধনের কাজ করেছেন, অশ্রুপাতে বা ভর্তসনায় তিনি যুদ্ধ এবং প্রতিশোধের আগুন ধিকিধিকি জ্বালিয়ে
রেখেছেন পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে। যুধিষ্ঠির যেহেতু ভেতর থেকে শান্তিকামী তাই তাঁর
মনটিকে প্রস্তুত করতে অনেক মুনি ঋষির উপদেশের প্রয়োজন হয়েছিল।
‘সত্যি
বলতে, আর কিছুই করছেন না, শুধুই শুনছেন। কখনও কিছু বলছেন না তা নয়, কিন্তু
শোনার অংশটা বহুগুণ বেশি। শোনা, এই তাঁর কাজ, তাঁর বৃত্তি, তিনি যে শুনছেন, এটাই
বন পর্বের ‘ঘটনা’। তাঁকে শুনতে হচ্ছে রোষতপ্ত বিলাপ-তেজস্বিনী পাঞ্চালীর মুখ-আর
রণোৎসাহী ভীমের মুখে অনেক ভর্তসনা আর কুতর্ক। কিন্তু যা তিনি স্ব-প্রণোদনায় শুনছেন,
সাগ্রহে, সতৃষ্ণভাবে অবিরল- তা হল মুনিদের
মুখে পুরাণ কথা-ভরতবংশের ধূসর ইতিহাস নয়, নয় পূর্বপুরুষের
গতানুগতিক গুণকীর্তন, কিন্তু সেই সব অজর ও অম্লেয় কাহিনী,
যার দ্বারপথ দিয়ে আমরা যেন বিশ্বজীবনের অন্তপুরে চলে যাই, দেখতে পাই অনির্ণেয় এ জ্যোতি-আমাদের সুপ্রিয় ও সুপরিচিত সব নীলিমা ও
শ্যামলিমা থেকে বহুদূরবর্তী এক বিন্দুর মতো’
(মহাভারতের
কথা – বুদ্ধদেব বসু)
আর এর
বিপ্রতীপে অর্জুন বেরিয়ে পড়ছেন দুঃসাহসিক এক অভিযানে, দিব্যাস্ত্র সংগ্রহের অভিলাষে।আর তার প্রথম ধাপেই তাঁর সঙ্গে
সাক্ষাৎ হল কিরাত বেশী মহাদেবের ।তাঁকে না পেরিয়ে তিনি যেতে পারবেন না অভীষ্ট
গন্তব্যে, অর্থাৎ ইন্দ্রলোকে।
এই
সাক্ষাৎ নিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করেছেন ভারবি। সে মহাকাব্য অনেকটা সঞ্জয় লীলা
বনশালীর দেবদাসের মতো, গ্র্যাঞ্জার
ছাড়া আর কিছুই নেই, কালিদাসের অপরিমেয় সৌন্দর্য এখানে আশাই
করা যায় না। কিন্তু এত ঘটনা থাকতে কেন এইটিকেই বাছলেন ভারবি? কেন ইন্দ্রলোকের যাত্রার শুরুতেই কিরাত আটকে দাঁড়ালেন অর্জুনের পথ? তার উত্তর পাই জার্মান পণ্ডিত জোহান জেকব মেয়ারের একটি
উক্তিতে। তিনি বলেছেন
‘মহাভারত
এক ভারতবর্ষীয় অরণ্যের মতো বিস্তীর্ণ, তাতে বৃক্ষসমূহ পরস্পরে জড়িত ও স্থূলাঙ্গ লতাগুল্মে জটিল। বহুবিচিত্র
পুষ্পমঞ্জরীতে তা বর্ণিল ও সুগন্ধি, সর্বপ্রকার জীবের তা
বাসস্থান’ (মহাভারতের কথা – বুদ্ধদেব বসু)
এই বনে
একসঙ্গেই চরম অজ্ঞান আর চরম জ্ঞানের সহাবস্থান। আর তাই অর্জুন যখন এই অরণ্যে
প্রবেশ করছেন, তখন তাঁকে তো
বনচর কিরাতের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে।অর্থাৎ আর্য ভারতের যুদ্ধ জয়ের চাবিটি বেদ
ব্যাস সুকৌশলে রেখে দিলেন অনার্য ভারতের হাতে।
অর্জুন
হিমালয় ও গন্ধমাদন পার হয়ে, ইন্দ্রকীল
পর্বত পার হয়ে এক ঘোর বনে উপস্থিত হতেই মহাদেব কাঞ্চনতরুর মতো উজ্জ্বল কিরাতের বেশ
ধারণ করে পিনাক হস্তে হাজির হলেন। তাঁর সঙ্গে উমা এবং তাঁর সহচরীদের দেখে অর্জুন
বললেন ‘কে তুমি কনককান্তি? এই বনে স্ত্রীদের নিয়ে বিচরণ করছ
কেন?’ এই নারীদের অবাধ বিচরণও কিন্তু গারোদের দিকেও ইঙ্গিত
দ্যায়। আমরা জানি মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজে মেয়েরা কত স্বাধীন।
অর্জুন
এবং কিরাতের যুদ্ধে অর্জুন পরাজিত। পৃথিবীজয়ী অর্জুনের এই পরাজয় মধুর, কারণ এই একটি পরাজয় তাঁকে ভবিষ্যতের মহাযুদ্ধের জয় এনে দেবে ।
আর এই একটি পরাজয়ে লেখা হয়ে গেল আর্য ভারতের পরাভব এবং অনার্য ভারতের উত্থান।
শোক
থেকে শ্লোক আর শ্লোক থেকে শোক
কিরাতের
বৃত্তি যদি পশুশিকার হয়, তবে প্রথম
শ্লোক রচনার পেছনে তার ভূমিকা কে অস্বীকার করবে? মনে পড়ে সেই
মিলনরত ক্রৌঞ্চযুগলকে তীর ছুঁড়ে বধ করল এক ব্যাধ, আর সেই
দৃশ্য দেখে দ্রব হল দস্যু রত্নাকর থেকে জন্ম নেওয়া সাধু বাল্মিকীর মন? তাঁর কণ্ঠে শোনা গেল এক অশ্রুতপূর্ব ছন্দোবদ্ধ পদ, পৃথিবীর
প্রথম কবিতা।
‘মা
নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমোগম শাশ্বতীসমা
যৎ
ক্রৌঞ্চ মিথুনাদেক বধি কামমোহিতাম’
ওরে
নিষাদ, তুই কোনদিন জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবি না,
কারণ তুই কামমোহিত এই ক্রৌঞ্চদের মেরেছিস।
এই
শ্লোক তাঁকে আত্মবিশ্বাস দিল, যার বলে বলীয়ান
বাল্মীকি লিখলেন রামায়ণ নামে মহাকাব্য।
একটি
মহাকাব্যের সূচনায় যেমন, তেমনি আরও জটিল অন্য মহাকাব্যটির অন্তিমেও কিন্তু নিয়ামকের ভূমিকায়
সেই ব্যাধ বা কিরাতরা।
কুরুক্ষেত্র
যুদ্ধের একেবারে অন্তিমে আহত অবসন্ন দুর্যোধন যখন দ্বৈপায়ন হ্রদের মধ্যে লুকিয়ে
ছিলেন, পাণ্ডবরা অনেক খুঁজেও তাঁর সন্ধান
পান নি, তখন একদল ব্যাধ, যারা মাংসবহনে
ক্লান্ত হয়ে হ্রদের জলপান করতে গিয়েছিল, তারা দুর্যোধন,
কৃতবর্মা প্রমুখের চাপা স্বরে কথা শুনে বুঝতে পারল দুর্যোধন কোথায় লুকিয়ে আছে। এই ব্যাধেরা ভীমসেনকে মাংস এনে
দিত। তারা অর্থের প্রত্যাশায় পাণ্ডবশিবিরে খবর দিল আর তারই ফল গদাযুদ্ধ, দুর্যোধনের উরুভঙ্গ এবং শেষপর্যন্ত রাতের অন্ধকারে পাণ্ডবদের
পাঁচ পুত্র হত্যা।অর্থাৎ মহাশোক, মহাযুদ্ধের এই পরিণতি।
অন্ধকার
আরও ঘনিয়ে এল। শুধু মহাকাব্যে নয়, এই
দেশেও। তবে আলোর রেখা কি একেবারেই ছিল না? ছিল তো। মহাভারত
মানুষকে এক অমোঘ পরিণতির কথা মনে করিয়ে দ্যায়-
‘সকল
সঞ্চয়ই পরিশেষে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, উন্নতির
অন্তে পতন হয়, মিলনের অন্তে বিচ্ছেদ হয়, জীবনের অন্তে মরণ হয়’
এই বোধ
যে কবচ কুণ্ডলের মতো সহজাত করে তুলতে পারে, জয় পরাজয়, সুখ দুঃখ তাকে বিচলিত করতে পারে না।
আর এই
জীবনবোধ সঞ্চারের পাশাপাশি মহাভারত অনার্য উত্থানের ইতিহাস, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ কুশীলব কাঞ্চন তরুর মতো বর্ণের কিরাতরা
তো বটেই, একই বৃত্তিভোগী কৃষ্ণবর্ণ ব্যাধেরাও।এটাই
হয়তো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মধুর প্রতিশোধ তাদের।
তথ্যসূত্র-
গারো
নামের ইতিবৃত্ত ১ –মণীন্দ্রনাথ মারাক
বাল্মিকী
রামায়ণ ও মহাভারত- রাজশেখ্র বসুর সারানুবাদে
মহাভারতের
কথা – বুদ্ধদেব বসু
মহাকান্তার-
অনিতা অগ্নিহোত্রী
কৃতজ্ঞতা-
ডঃ ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
0 মন্তব্যসমূহ