পর্ব-৫
বিংশ অধ্যায়
ইন্দ্রপ্রস্থের রাজপুরীতে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সেই সংবাদ। অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র দ্যুতক্রীড়ায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন জ্যেষ্ঠ পান্ডব
যুধিষ্ঠিরকে। বিষণ্ন মুখে বিদুর বললেন। ধৃতরাষ্ট্র ও
পান্ডুর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা তিনি। দাসীপুত্র, তবু ধীমান ন্যায়বান এই
ব্যক্তি রাজগৃহে পরম সম্মানিত। তিনি ধীর স্বভাবের কিন্তু
স্পষ্টভাষী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সতত প্রতিবাদী। কুটিল ও ক্রুর
স্বভাবী দুর্যোধনের অন্যায্য উক্তির প্রতিকূলে দৃঢ় অমত প্রকাশ করে থাকেন বলে
দুর্যোধন তাঁর প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন।
বিদুরের মুখ থেকে জানা গেছে, এক পরম রমণীয় সভাকক্ষ নির্মিত হয়েছে নাকি এই
দ্যূত ক্রীড়া উপলক্ষ্যে। ধৃতরাষ্ট্রের বিশেষ অনুরোধ সকল পান্ডবভ্রাতারা যেন
পত্নীগণসহ আসেন হস্তিনাপুরে। কারণ এ তো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নয়
শুধুই, প্রকৃত প্রস্তাবে এ এক পারিবারিক মিলনোৎসব।
আজ ইন্দ্রপ্রস্থে রাত্রি যাপন করবেন বিদুর। একটি নিরালা
কক্ষে তিনি বসেছেন। সঙ্গে রয়েছেন যুধিষ্ঠির ও নকুল। স্তব্ধ চারিদিক। তাঁকে খুব উদ্বিগ্ন ও অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। “ঈর্ষা—ঈর্ষা—বুঝলে
যুধিষ্ঠির, প্রবল ঈর্ষায় মানুষের চেহারা পর্যন্ত বদলে যায়। তুমি না দেখলে
বিশ্বাস করবে না, দুর্যোধনের দেহের উজ্জ্বল গৌর বর্ণ এখন একেবারে ম্লান হয়ে গেছে। চোখের তলায় কালিমা।”
“ঈর্ষার মৌলিক সত্য এই যে, ভোগ্য যা কিছু, প্রত্যেকেই তার সর্ব বৃহৎ ভাগ
দাবি করে।” – ম্লান মুখ যুধিষ্ঠিরের।
“কিন্তু বাস্তবে এই দাবি অলীক যুধিষ্ঠির। যোগ্যতম
ব্যক্তিই লাভ করে শ্রেষ্ঠকে। ঈর্ষায় মনের সমতা নষ্ট হয়। নষ্ট হয় যুক্তিবোধও। দুর্যোধন ক্রুর ও খল একাধারে। প্রকৃত প্রস্তাবে সে এক তস্কর।”
“ভ্রাতৃগণ বাদে কাউকে বলিনি এতকাল, একটি বার্তা জানাই আজ হে তাত। রাজসূয় যজ্ঞের পরে পিতামহ ব্যাসদেব এসেছিলেন এ ভবনে।”
“তাই নাকি? কোনো বিশেষ কারণ ব্যতীত নগরে তো তিনি পদার্পণ করেন না।”- কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করেন বিদুর।
“সত্যদ্রষ্টা তিনি। এক নির্মম সত্য প্রকাশ পেয়েছে
তাঁর মুখে। দুর্যোধনের পাপে এবং ভীমার্জুনের মহাশক্তির প্রকোপে
শীঘ্রই ভারতভূমি ক্ষত্রিয়শূন্য হবে। সেই থেকে আমার মনে শান্তি নেই তাত। জানি মহাকালের বিধান অতিক্রম করা অসম্ভব। তাই এখন বিষণ্ণ
প্রতীক্ষা। চতুর্দিকে দেখি শুধু ধ্বংসের চিত্রমালা।”- অতুল ঐশ্বর্যের মধ্যে বসে নিঃস্ব ভিখারির মতো উচ্চারণ করেন মহারাজ
যুধিষ্ঠির। আনত নয়ন। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন নকুল। তাঁদের প্লাবিত করে বয়ে যায় বিষাদ স্রোত।
বিদুর কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। এই মহাভয়ের
ইঙ্গিতই তো পেয়েছেন তিনি। লক্ষ্য করেছেন দুর্যোধনের বাক্যে, আচরণে নিহিত রয়েছে এক
গূঢ় অভিসন্ধি। তিনি কাতর ভাবে দুর্যোধনের হাত দুটি ধরে বললেন,-“বৎস!
আমি সতত এই অসার অক্ষক্রীড়ার বিরুদ্ধে। আপন অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এর ফলে
ধনক্ষয়, কলহ, সর্বনাশের উৎপত্তি হয়। ভেঙে খান খান হয়ে যায় সংসার। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র আমার প্রভু। তাঁর নির্দেশ অমান্য করতে পারি না। তাঁর আদেশেই তোমাদের আমন্ত্রণ জানাতে এসেছি, কিন্তু আমন্ত্রণ বাক্য উচ্চারণ
করতে বড় কুণ্ঠা জাগছে। তাই বলি, ধীর বুদ্ধির অধিকারী তুমি। সুবিবেচনা
অনুযায়ী যা উচিত বোধ হয়, তাই কর।”
“দ্বিতীয় উপায় নাই তাত! চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে, তেমনি নিয়তি আকর্ষণ
করছে আমাদের প্রবল বেগে। তাত, আপনি ভ্রাতা দুর্যোধনকে বলবেন, যুধিষ্ঠির অতি দীন
ব্যক্তি, তার আপাত দৃষ্ট সকল ঐশ্বর্য প্রকৃত প্রস্তাবে অলীক। যুধিষ্ঠির, রাজা
দুর্যোধনের ঈর্ষা ও ক্রোধের যোগ্য নয়। পিতামহ ব্যাসদেবের কথা শুনে
পর্যন্ত যুধিষ্ঠির অঙ্গীকার করেছে সে কখনও কারোর প্রতি কঠিন বাক্য উচ্চারণ করবে না। জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে সমদর্শী হবে। কি পুত্র, কি
ভৃত্য, কি করদ রাজ্যের রাজাগণ সকলের প্রতিই সে পক্ষপাতশূন্য আচরণ করবে। হ্যাঁ তাত, যুধিষ্ঠির নির্দ্বিধায় স্বীকার করছে যে, সে যুদ্ধ ভয়ে ভীত। এ ভয়ে অগৌরব নাই হে মহামতি। যুদ্ধ রক্তলোলুপ হিংস্র পশুর সমান। তার চিত্ত নাই, বুদ্ধি নাই, ন্যায় অন্যায় বিবেচনা নাই। আছে শুধু অন্ধ
ক্ষুধা। নিরীহ বেতনভোগী সৈন্যদের রক্ত, মাংসে তার ক্ষুন্নিবৃত্তি। সৈনিকের পরিজনগণের অবিরল অশ্রুধারায় সে আচমন করে। সেই মহা
সর্বনাশকে আহ্বান করার মধ্যে যুধিষ্ঠির তিলমাত্র পৌরুষও দেখে না।”- তাঁর কণ্ঠস্বর আবেগে কম্পিত হয়। বিদুর মুগ্ধ
দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন এই প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রটির দিকে। নূতন রূপে যেন
দেখলেন তাকে আজ। প্রজ্ঞার নম্র আলো উজ্জ্বলতর করেছে তার মুখশ্রীকে। নকুলের চোখের দৃষ্টি সহসা বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। তিনি জানেন
অগ্রজের অদৃশ্য মানস-তরঙ্গ, সর্বদাই তাঁকে স্পর্শ করে থাকে। আরো একজন বোঝে
তাঁকে। সে করেণুমতী। তার মনের একটি উদার আকাশ পট আছে। অবন্ধনা সুবাতাস বয়ে যায় সর্বদা। অকপটে তাঁরা
পস্পরের মধ্যে বিনিময় করেন কত স্মৃতি, কত ক্ষোভ, কত ভাবনা। পতি-পত্নীর
সামাজিক সম্পর্ক অতিক্রম করে তাঁরা হয়ে
উঠেছেন বন্ধু। যার বিচ্ছেদ অসহ, তাকেই তো বলে বন্ধু।
একবিংশ অধ্যায়
“কাল প্রভাতেই আপনারা যাত্রা
করবেন হস্তিনাপুরের উদ্দেশে?” – বিমর্ষ স্বরে করেণুমতী বলে। দ্রৌপদীসহ
পান্ডুপুত্রদের অন্য পত্নীরা সঙ্গে গেলেও, করেণুমতী যাবে না। গর্ভিণী সে। তার শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে, জননী কুন্তী নিষেধ করেছেন তাকে যেতে।
“হ্যাঁ প্রথম প্রহরের মধ্যে।”- নকুল উত্তরে বলেন,-“ জ্যোতিষবিদ গণনা করে দেখেছেন শুভক্ষণ নাকি তখনই। তারপর—”
“আপনি বিশ্বাস করেন, শুভক্ষণ,
অশুভক্ষণ?” – মৃদু স্বরে প্রশ্ন করে করেণু।
“বিশ্বাস অবিশ্বাসের সঙ্গে সংশ্রব
নাই, এ শুধু এক বহুকাল ধরে প্রচলিত রীতি।” – স্নিগ্ধ হাসি
নকুলের মুখে।
“সকল রাজাই শুভ মুহূর্ত দেখে
যুদ্ধযাত্রায় বেরন, তবু কেউ বিজয়ী হন, কেউ বা পরাজিত। শঙ্খধ্বনি,
মন্ত্রোচ্চারণ, ললাটে চন্দন বিন্দু এঁকে দেওয়া, এগুলি কি সত্যই নিয়ন্ত্রিত করে
মানুষের সাফল্য আর পরাভবকে? বলুন আর্যপুত্র-আপনার মনে হয় না কি?”- করেণু ক্রমশ
উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
“না করেণু, ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রিত
করে অতীত। বর্তমান এ দুই কালের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র যোগাযোগ বিন্দু
মাত্র। নিয়ত জন্মায়। নিয়ত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অতীত প্রসব করে তাকে আর ভবিষ্যৎ অবিরত ভক্ষণ করে ।”
জানালার বাইরে বাতাস আজ উত্তাল হয়ে উঠেছে। হানা দিচ্ছে
স্তব্ধ নিশীথের শয়ন ঘরে। উড়ে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তাঁদের শয্যা আস্তরণী, বসন। প্রদীপ নিভে গেছে। নকুল দৃঢ় ভাবে বেষ্টন করে আছেন গর্ভিণী পত্নীকে। তাকে স্নেহের সঙ্গে শদ্ধাও করেন তিনি। এই মুহূর্তে
তিনি যদি দিব্য চক্ষুষ্মান হতে পারতেন। সময়কে বিদীর্ণ করে দেখে নিতে
পারতেন ভবিষ্যৎকে? কখনও কখনও তিনি যে ক্ষমতা প্রাপ্ত হন। ক্ষণিকের জন্য। আবার বিস্মৃতির আঁধার ঘিরে ধরে তাঁকে।
নকুল জানেন স্পষ্ট উচ্চারণে না বললেও ভ্রাতা ভীম নিজেকে মনে করেন ধরিত্রীর
শ্রেষ্ঠ বীর। তাঁর আচরণে ফুটে ওঠে সে অহংকার! নকুলের ঠোঁটের কোণে
বিদ্রূপের হাসি জাগে। কে আছে সেই মহাবীর যে স্তব্ধ করে দিতে পারে সময়ের
প্রবাহ! এখনকার এই মনোরম কালবিন্দুতে যদি স্থির হয়ে থেকে যেত জীবন? এই সুন্দর
রাত্রিটিতে? তবে কি হোত? গতানুগতিকতায়
কি বিস্বাদ হয়ে উঠত সকল অনুভব? কত প্রশ্ন
আলোড়িত করছে নকুলকে। একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে। অসীম এ সৌরলোক। কাল অনাদি অনন্ত। মানুষ কখনই চরম প্রশ্নের উত্তর পাবে না।
সহসা তিনি দৃঢ়বদ্ধ করেন হাতের মুষ্টি। যেন এই
রাত্রিটিকে ধরে রাখবেন আপন মুঠিতে। পর মুহূর্তেই হেসে ফেলেন নিজের বালসুলভ
ভাবনায়। শিথিল হয়ে যায় করেণুকে বেষ্টন করে রাখা তাঁর বাহুপাশ।
করেণু নিজের ক্ষুদ্র করতল রাখে নকুলের গ্রীবায়। অন্ধকারে নকুল
অনুভব করেন শীতল হয়ে রয়েছে। তিনি নিজের হাতের মৃদু ঘর্ষণে
প্রিয় পত্নীকে দিতে চান যেন প্রাণের উত্তাপ। হঠাৎ সংকোচে অতি
মৃদু স্বরে করেণু বলে,-“আর্যপুত্র এখন কি কিছু দেখছেন? আপনাদের হস্তিনাপুরে
যাত্রার শেষে কি অপেক্ষা করে রয়েছে? কোনো বিপদ কি?” তারপর ঈষৎ অস্থির ভাবে সে
বলে,-“প্রয়াস করুন সে দর্শনের। ঋষিরা যে কত প্রক্রিয়ার কথা বলেন,
মনঃসংযোগ, ধ্যান—কিংবা আপনার ষষ্ঠেন্দ্রিয় কি বার্তা দিচ্ছে--”। বড় অসহায় লাগে
তার নিজেকে। সে নির্ভর করতে চায় পতির অলৌকিক শক্তির উপর।
“আমি চালনা করতে পারি না সে ক্ষমতাকে। মাঝে মাঝে
নিমেষের জন্য সে ক্ষমতা শুধু স্ফুরিত হয় শুনেছি প্রদীপ শিখার মতো। আবার নিভে যায়।”-
মধুর মতো বিন্দু বিন্দু মমতা যেন ক্ষরিত হয় নকুলের হৃদয় থেকে। এই প্রিয় নারীর শরীরের নিভৃতে শ্বাস নিচ্ছে তাঁর সন্তান। জ্যেষ্ঠ তাত ধৃতরাষ্ট্রের আহ্বানে কাল যাত্রা করবেন তাঁরা দ্যূতসভায় যোগ
দিতে। অগ্রজ যুধিষ্ঠির ও মাতুল শকুনির মধ্যে হবে দ্যুতক্রীড়া। শকুনি অতি ধুরন্ধর। এ খেলায় দক্ষ। পান্ডব ভ্রাতারা জানেন এ হবে এক অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অগ্রজের এই একটি
মাত্র নেশা। কিন্তু তত নিপুণতা নেই। অবশ্য
দ্যুতক্রীড়ার আমন্ত্রণ অস্বীকার করা রাজধর্মের বিরোধী। ইচ্ছা না থাকলেও
যুধিষ্ঠিরকে যেতেই হোত নিজের সম্মান রক্ষার জন্য। বিকর্ণের গোপন
পত্রের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল নকুলের। তার পত্রের বক্তব্যের সঙ্গে মিলে
গেছে ক্ষত্তা বিদুরের ভাবনাও।
এই মহার্ঘ মানব জীবনকে কেন আমরা সতত বিনষ্ট করি নিজেদের চিন্তা ও কর্ম
দ্বারা? নকুল, করেণুর নাভিতলে হাত রেখে শিহরিত হন। অজাত শিশুটি,
চঞ্চল হয়ে উঠেছে। আন্দোলন জেগেছে মাতৃগর্ভে। অন্ধকারে মৃদু
শব্দ করে করেণু উদ্বেগ ভুলে সুখের হাসি হাসে।
আর নকুল সহসা নিজের বক্ষে হাত রাখেন। ভুলে গিয়েছিলেন। সঞ্চিত পাপের বোঝা যে তাঁকেও ভারাক্রান্ত করে রেখেছে। ইচ্ছায় হোক বা
অনিচ্ছায়, সকল যোদ্ধৃকেই বহন করতে হয় সেই পাপ-ভার। দুটি বিস্ফারিত
কিশোর চক্ষু নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে অন্ধকার ভেদ করে। এই তো সেদিন। রাজসূয় যজ্ঞের সূচনায় অগ্রজ যুধিষ্ঠিরের অনুমতিক্রমে, তাঁরা চার ভাই
চারদিকে বেরিয়েছিলেন দিগ্বিজয় যাত্রায়। অর্জুন উত্তরে, ভীম পূর্বে, সহদেব
দক্ষিণে আর নকুল পশ্চিমে। স্পষ্ট মনে পড়ে যাত্রা কালে, পাঞ্চালীর আনন্দে, গৌরবে
উজ্জ্বল অপরূপ সে মুখখানি। স্বামীদের মঙ্গল কামনায় আপন হাতে
বিজয় তিলক এঁকে দিয়েছিলেন প্রত্যেকের ললাটে। অজস্র সৈন্যের
সিংহনাদে, রথ চক্রের ঘূর্ণন শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছিল চতুর্দিক।
নকুল প্রথমে রোহিতক দেশে উপস্থিত হয়েছিলেন। মনোরম সে দেশ
ময়ূর জাতির বাসভূমি। ধনধান্যে পূর্ণ, গোসম্পদে সমৃদ্ধিশালী। নগরীতে অজস্র সুরম্য প্রাসাদ। এই শান্তিময় স্থানে মহা বিপর্যয়ের
মতো উপস্থিত হয়ে নকুল রাজকর গ্রহণের দাবি ঘোষণা করলেন। ময়ূরগণ মহাবীর ও
শস্ত্রনিপুণ। সম্মান রক্ষার জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করল তারা। রক্তস্রোত, আহত পশু ও মানুষের আর্তনাদে ভয়াল রণভূমি হয়ে উঠল সেই শান্ত দেশ। যুদ্ধব্যবসায়ী ছাড়াও স্বভূমি রক্ষার জন্য দলে দলে যোগ দিয়েছিল সে দেশের
বালক, কিশোররাও। অনভিজ্ঞ তারা। তাঁর সুশিক্ষিত
সৈন্যদলের মতো নৈপুণ্য কোথায় তাদের! তবু কি পরাক্রম!নিশ্চিত মৃত্যুকে কি অনায়াসে
অগ্রাহ্য করে দলে দলে এগিয়ে এসেছিল স্বদেশ রক্ষার্থে। বিস্মিত
হয়েছিলেন নকুল। যুদ্ধের শেষ দিনে, অজস্র ক্ষয়ক্ষতির পরে ময়ূরগণের শক্তি
যখন প্রায় নিঃশেষিত, তখনই শুধু পরাভব স্বীকারের বার্তা ঘোষণা করেছিল তারা। হৃষ্টমনে নকুল ময়ূর-প্রধানের শিবিরের পথে চলেছিলেন। সহসা একটি মাত্র
অশ্বারোহী রণহুঙ্কার দিয়ে, নকুলের পথরোধ করল। নকুল দেখলেন
সুকুমার মুখের এক বালক। ময়ূরগণ প্রকৃতির বিধানে বলশালী দেহের অধিকারী। এই বালকও দীর্ঘকায় ও সুদেহী। স্পর্ধিত তার মুখের ভাব। হাতে খোলা তরোয়াল। তার মুখে রণহুঙ্কার বড় কৌতুকজনক মনে হয়েছিল নকুলের। উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন তিনি। “পথ ছাড়ো ওহে বালক। আপন গৃহে ফিরে যাও। তোমার জননী এতক্ষণ তোমাকে না দেখে
নিশ্চয় ব্যাকুলা হয়ে উঠেছেন। দুগ্ধপান করে, কন্দুক নিয়ে খেলা
কর বরং। এ তরবারি বালকের খেলার বস্তু নয়।”- হেসে উঠল
নকুলের অনুচরের দলও। এমন উপহাসে রাগে লাল হয়ে গেল বালকের মুখ। “রে তস্কর, পরের সম্পদ অপহরণ করতে এসেছিস। আমি ঘৃণা করি
তোদের। আর এক পাও অগ্রসর হতে দেব না।”- তলোয়ার
উঁচিয়ে ধরল সে।
বিস্মিত হয়ে তাকালেন নকুল।
ওকি নিজের পরিণাম না বুঝে এমন কথা বলছে? একটু সমীহও এল যেন তার প্রতি। সময়ে সামান্য ইতস্তত করছিলেন তিনি। আর সেই
মুহূর্তেরও ভগ্নাংশ সময়ে বালক উন্মুক্ত তলোয়ার আস্ফালন করে নিজের অশ্বকে চকিতে
তাঁর দিকে চালনা করল। নকুলের সামান্য বিভ্রান্তিতে তলোয়ারের আগা এসে বিদ্ধ হোল
তাঁর চিবুকে। ক্ষত গভীর না হলেও তাঁর মুখ ও গলদেশ নিমেষে রক্তে লাল
হয়ে উঠল। আপন রক্ত দর্শনে ভীষণ ক্রোধে নকুল আত্মহারা তখন। গর্জন করে নিজের আক্রমনোদ্যত অনুচরদের উদ্দেশে বললেন,-“থামো, এ অর্বাচীনকে
আমি নিজ হাতে নিপাত করব।”- পরমুহূর্তেই এক দ্রুত অসম যুদ্ধে বালকের ছিন্ন মুন্ড
ভূপতিত হোল তার মৃত অশ্বের পাশে। রক্ত হ্রদে ভেসে রয়েছে যেন সে
মুন্ড। তবু বিস্ফারিত হয়ে তার উন্মুক্ত দু চোখ। নকুলের মনে হোল তখনও প্রবল ঘৃণা বিচ্ছুরিত হচ্ছে সেই স্থির দৃষ্টি থেকে। হঠাৎই তীব্র বমন বেগ এল নকুলের।
ভুলে গিয়েছিলেন। তারপর আরো কত তুমুল যুদ্ধ। শৈরীষক, মহেত্থ,
দশার্ণ, শিবি, ত্রিগর্ত, অম্বষ্ঠ। একের পর এক দেশ জয়। কত ছিন্ন অঙ্গের স্তূপ, আর্তনাদ, রক্তস্রোত, অস্ত্রের ঝনৎকার। সকল যুদ্ধের স্মৃতি- চিত্রমালা একই! মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সব। বহু বিজয় লাভের শেষে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে আসেন চতুর্থ পান্ডব। সহস্র হস্তি তাঁর জয়লব্ধ ঐশ্বর্য বহন করে অতিকষ্টে।
কিন্তু আজ হঠাৎ করেণুর জঠর স্পর্শ মাত্র সেই বালক হননের স্মৃতি কেন জেগে উঠল!
সুদূর জনপদের কোন অনাম্নী নারী বহন করেছিল একদা সেই উদ্ধত বালককে আপন গর্ভে। বালক বলেছিল – তস্কর—। ক্রমাগত
প্রতিধ্বনিত হতে হতে সে শব্দ ব্যাপ্ত হয় নিশীথ চরাচরে। তস্কর তস্কর—তস্কর--।
সহসা রাজপ্রাসাদের প্রাকারের বাইরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে এক রমণী কণ্ঠ। “কে? কার কান্না?” চমকিত হয়ে বলেন নকুল।
“ও উন্মাদিনী। আমি জানি তাকে। আপনাদের
দিগ্বিজয় যাত্রার সময়ে আপনারই সৈন্যদলে ছিল ওর একমাত্র পুত্র। দশার্ণ যুদ্ধে
নিহত হয়। সেই থেকে সন্তান শোকে উন্মাদিনী হয়ে উঠেছে ওই রমণী। পথে পথে ঘোরে একাকিনী।”
যুদ্ধ কত প্রাণ যে গ্রাস করে। অন্ত নাই তার। রাজাগৌরব প্রতিষ্ঠা পায় শত সহস্র প্রজার প্রাণের বিনিময়ে। কত রক্ত ও অশ্রুস্রোত বয়ে চলে। বড় বিলম্বে এই বোধ এল। পিতৃব্য বিদুর দুর্যোধনকে
তস্কর বলেছিলেন। কিন্তু হায় তাত,
আমরা প্রতিটি ক্ষত্রিয় নৃপই কি তস্কর নই? পরস্বাপহারী সকলেই। বহু প্রাণের
বিনিময়ে এ প্রাসাদে সঞ্চিত মহার্ঘ রত্নরাজি কি অনর্থক মনে হয় আজ! আনত মুখে ভাবেন
নকুল।
আরো একবার আর্ত স্বরে কেঁদে ওঠে উন্মাদিনী নারী। অন্ধকারে নিজের
ওষ্ঠ, অধর, নাসিকা, চক্ষু, গ্রীবাদেশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যান নকুল। ব্যাকুল প্রশ্ন
করেন নিঃশব্দে নিজেকেই। তিনিও কি তবে দুর্যোধনেরই প্রতিমূর্তি! ভ্রাতাদের মুখে,
তাঁর পরিচিত প্রতিটি ক্ষত্রিয় নরপালের মুখে, গভীর আতঙ্কে তিনি দুর্যোধনকেই
প্রত্যক্ষ করেন। লোভ, আগ্রাসী লোভ শুধু সেই সব মুখে। এক দুর্যোধন
বহুধা হয়েছে তবে? আজ কে কাকে তস্কর বলে?
দ্বাবিংশ অধ্যায়
পান্ডবদের দ্রুতগামী অশ্ববাহিত রথগুলি, হস্তিনাপুরের দিকে যাত্রা করল। ইন্দ্রপ্রস্থ প্রাসাদের অলিন্দ থেকে করেণুমতী দেখছিল অনুচরীদের সঙ্গে। অশ্বক্ষুরের আঘাত উড়ছিল ধূলার ঝড়। ক্রমশ অস্পষ্ট
হতে হতে মিলিয়ে গেল তার দৃষ্টিসীমার বাইরে। আর তখনই সে অনুভব
করল, তার শরীরে মৃদু অস্বস্তি। ভয় পেল সে। কেমন অন্য রকম
কিছু। “কি যেন হয়েছে আমার। ভাল লাগছে না।”- বলল সে। “কুন্তী মায়ের কাছে গিয়ে বল।এ কি হোল
আমার!”- তার সহচরীরা দৃষ্টি বিনিময় করে হাসল।
জননী কুন্তীর মুখেও মৃদু হাসি ফুটে উঠল। তিনি আশ্বস্ত
করলেন বধূকে। তাঁর নির্দেশে
ওরা তাকে নিয়ে গেল প্রসব কক্ষে। প্রশিক্ষিত ধাত্রীকে সংবাদ দেওয়া
হোল। অস্বস্তি বাড়ছিল ক্রমাগত।
এক সময়ে শুরু হোল তীব্র যন্ত্রণা। ধাত্রীর
নির্দেশানুসারে, সে নিঃশব্দে সহ্য করতে লাগল প্রবল সেই যন্ত্রণা। ধাত্রী বলেছিল আর্তনাদ করলে প্রসব হতে অধিক সময় লাগে। কি দীর্ঘ এই
প্রসব বেদনার কাল। অপরাহ্নবেলায় সব যন্ত্রণার অবসানে সে জন্ম দিল একটি
সুন্দর পুত্র সন্তানের। সে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে যেতে শুনতে পেল, কে যেন বলছে,-“দেখ
দেখ চক্ষু দুটি অবিকল যেন আমাদের চতুর্থ কুমারের মতো।“ কি অনাবিল আনন্দ আর স্বস্তি তার সর্বাঙ্গে। কোনো উদ্বেগ নাই এই মুহূর্তে। ক্রমশ সে ডুবে যেতে লাগল অতল
দীঘিতে শান্তির অবগাহনের মতো গাঢ় ঘুমে।
দিন ও রাত যায়, চন্দ্র সূর্যের নিয়মে। সূতিকা গৃহ থেকে
বেরনোর দিন কবে, সে হিসাব নাই তার। এ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিস্ময়ে সে এখন
আবিষ্ট। প্রাণ থেকে প্রাণের সৃষ্টি, এই আনন্দময় রহস্য অশ্রুত
সঙ্গীতের মতো ধ্বনিত হয় তার চেতনায়। নূতন এক প্রাণ কণিকা। নিজের গভীরে বহন করেছিল যখন, তার স্ফীত হয়ে ওঠা উদরের মধ্যে ঘন ঘন আন্দোলনে
যে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করত। কি অসহায় এ শিশু। বিশ্ব সংসারে অন্য কোথাও তার খাদ্য নাই। সঞ্চিত হয়ে রয়েছে
শুধু মাতৃস্তনে। ক্ষুধায় চিৎকার করে কাঁদে শিশু। ধাত্রী তখনই
করেণুর স্তনে শিশুর মুখটি সংলগ্ন করে দেয়। শিশুর কোমল ঠোঁট
উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য।
একটি প্রাণ ক্রমশ পুষ্ট হয়ে উঠছে তার স্তন্যদুগ্ধে। কি অপূর্ব
অনুভূতি এক। এখন সমগ্র জগৎ তার সূতিকা গৃহের দুয়ার প্রান্তে পড়ে থাকে। ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। ঘুমহীন রাত্রে বিভোর হয়ে সে
পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন সুন্দর শিশু সে আগে কখনও
দেখেনি। এ গৃহে এখন এক জননী, এক শিশু ব্যতীত আর কেউ নাই। ধাত্রীগণকে তার ছায়ার মতো মনে হয়। তারা এ শিশুর
পরিচর্যার সহায়িকা মাত্র। বিশেষ কথা বলে না তারাও। করেণুমতী যদি
লক্ষ্য করত তবে বুঝতে পারত, এ প্রাসাদে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তার প্রিয় ধাত্রীগণ, যারা গর্ভাধানকালে হাসি, কৌতুকে তাকে আনন্দিত রাখতে
চাইতে, তারা যেন এখন যন্ত্রচালিত
পুত্তলিবৎ। তাদের মুখে হাসি নাই। জননী কুন্তী
একদিন মাত্র সূতিকা গৃহে এসে নবজাতককে আশীর্বাদ করেছিলেন। তাঁর মুখের গাঢ়
কালিমা সে লক্ষ্য করেনি।
এখন এই সূতিকা গৃহ থেকে সে সঙ্গীত, বাদ্যরব, পুরাঙ্গনাদের হাস্যধ্বনি,
কিছুই শুনতে পায় না। তার অবশ্য মধ্যে মধ্যে পতির কথা মনে হয়। কিন্তু সে জানে রীতি অনুযায়ী, তিনি এই সূতিকা গৃহে প্রবেশ করবেন না। এক মধ্যাহ্নে স্তন্যপান করে শিশু যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, হঠাৎ তার মনে হোল, এত
দিনে পান্ডবেরা নিশ্চয় হস্তিনাপুর থেকে ফিরে এসেছেন। তার মনে পড়ল
যাত্রার আগের রাত্রিতে তার পতি বড় বিষণ্ন ও উদ্বিগ্ন ছিলেন। গাঢ় আশ্লেষে
আবদ্ধ করে রেখেছিলেন তাকে। কিন্তু খুব অল্প কথা বলেছিলেন। তখনই ভাসা ভাসা সে শুনেছিল কি সব যেন, বিদুর দ্যূতসভায় আমন্ত্রণ জানাতে এসে
দুর্যোধনের ষড়যন্ত্রের আভাস দিয়েছিলেন। কত কি গূঢ় অভিসন্ধি ছিল যেন। তবে পান্ডবভ্রাতারা এত শক্তিশালী, বুদ্ধিমান যে দুর্যোধন তাঁদের কোনো ক্ষতি
করতে পারবে না। নিশ্চিত হয় সে। তবে ইচ্ছা
থাকলেও নকুলের সম্বন্ধে কোনো সংবাদ জিজ্ঞাসা করতে লজ্জা বোধ করে সে।
এ সম্বন্ধে আর চিন্তা করে না। মৃদু হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। আজ মনে হয়, এতকাল নিজেকে সে চেনেনি সঠিক ভাবে। নকুল রাজকার্যে
যখন ইন্দ্রপ্রস্থের বাইরে গমন করতেন, তখন শূন্যশয্যাতে একাকিনী রাত্রিযাপন করত সে। বিষণ্ন হয়ে থাকত তার মন। নকুলকে ছাড়া এই বিপুল বৈভবময়
মনোরম প্রাসাদ তার অন্ধকার মনে হোত। আর যেদিন তিনি ফিরে আসতেন তখনই
আনন্দে হেসে উঠত চারিধার। গহন রাত্রির প্রতীক্ষা করত সে। অতি যত্নে
সজ্জিত করত নিজেকে। তারপর আকাঙ্খিত মুহূর্তটি আসত যখন, শরীর-মনের সে কি
নিবিড় মিলন। অজস্র চুম্বনে চুম্বনে, অর্থহীন কথা ও আনন্দের অশ্রুতে
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত রুদ্ধদ্বার কক্ষ। পতিকে ছেড়ে এমনকি সে পিতৃগৃহে
যাবারও ইচ্ছা প্রকাশ করেনি কখনও। সে শুনেছিল আগামী বছরে নকুলের
যাপনকাল দ্রৌপদীর সঙ্গে নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে। ভাবলেই তার
ক্ষোভ জাগত। অভিমানে জল আসত চোখে।
কিন্তু আজ সে কথা ভাবলে হাসি পাচ্ছে তার। তখনও পর্যন্ত সে
বালিকা ছিল। কত সামান্য কারণেই না অভিমান জাগত মনে! এই শিশু,
মুহূর্তের মধ্যে তাকে মাতৃত্বের কোন্ বৃহৎ জগতে অধিষ্ঠিত করে দিয়েছে।
“আর্যে”- এই ডাক শুনে নিবিড় চিন্তার জগৎ থেকে উঠে এল সে। সামনে দাঁড়িয়ে কুশা, তার এক পরিচারিকা। মধ্যবয়সিনী,
মুখে এখনও যৌবনের লাবণ্য। সে বুদ্ধিমতী ও কর্মপটু বলে, করেণুর খুব প্রিয়। “মাতা কুন্তী নির্দেশ দিয়েছেন, আজ আপনার হরিদ্রা স্নানের দিন।” সে দেখল কুশার মুখ বিষণ্ন। করেণু ঘুমন্ত শিশুর দিকে তাকাল। ম্লান হাসি হেসে কুশা বলল,-“উদ্বিগ্ন হবেন না। নবোজাত কুমারের
পরিচর্যার দায়িত্ব আমার। দুগ্ধ ধাত্রীও নিযুক্ত করা হয়েছে। স্নান ও পূজা
অন্তে মাতা কুন্তী তাঁর কক্ষে আহ্বান করেছেন আপনাকে। স্থির হয়েছে কাল
প্রভাতে সপুত্রক আপনি শুক্তিমতীর পথে যাত্রা করবেন।”
-কুশার ঠোঁট দুটি কাঁপছে। করেণু সব ভুলে গেল। চকিত আতঙ্ক তাকে স্পর্শ করে। হিম শীতল অনুভূতি জাগে বুকের
মধ্যে। সে এতকাল বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল। কিছু দুর্ঘটনা ঘটল নাকি তারই মধ্যে। কুশার অভিব্যক্তিতে
সে অমঙ্গলের আভাস পাচ্ছে। এক নিঃশব্দ চিৎকার ওঠে তার অন্তর মথিত করে। আর্ত রবে সে বলে,-“আর আর্য নকুল? কোথায় তিনি? কবে ফিরেছেন প্রাসাদে?”
“ফেরেননি, তবে শারীরিক ভাবে কুশলেই আছেন, সংবাদ এসেছে। আসুন আর্যা
দাসীরা আপনার জন্য নূতন বসন এনেছে।”- অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে উত্তর
দেয় কুশা।
সে দুরু দুরু বক্ষে পরিচারিকাদের সঙ্গে স্নানাগারের দিকে যায়। কত দিন পরে কক্ষের বাইরে এল সে। প্রভাতের আলোয় দেখে সে ভাবে
অলিন্দ এমন ধূলিম্লান কেন? কেনই বা পারিপাট্যের অভাব চতুর্দিকে। সমস্ত পরিবেষ অশুভ ইঙ্গিতবাহী যেন! স্নানের পরে নব বস্ত্র পরায় তাকে দাসীর
দল। নির্বাক তারা। তাদের কোনো
প্রশ্ন করতে সাহসী হয় না সে।
ত্রস্ত মুখে সে মাতা কুন্তীর কক্ষে আসে। কুন্তী স্বভাবে
ধীরা। অচপল একটি ব্যক্তিত্ব আছে তাঁর। কিন্তু তাকে
দেখা মাত্র আজ কেঁদে ওঠেন তিনি আর্তস্বরে। তাকে বুকে জড়িয়ে
ধরেন। করেণুর কাছ থেকে এত দিন যে তথ্য তার অগোচরে রাখা হয়েছিল,
এই মুহূর্তে বন্যার প্রবল স্রোতধারা হয়ে বেরিয়ে আসে। মহা সর্বনাশের
সেই সংবাদ পায় সে।
দুঃস্বপ্নেরও অগোচরে ছিল যা, তেমনই ঘটেছে হস্তিনাপুরের দ্যূতসভায়। যুধিষ্ঠির বারে বারে পরাজিত হয়েছেন ক্রীড়ায়। একের পর এক পণ
রেখে তাঁর সকল সম্পদ,রাজ্য,অলঙ্কার,এমনকি পঞ্চভ্রাতার স্বাধীনতা
পর্যন্ত হারিয়ে ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছিল তাঁদের। তখন নরাধম শকুনি, প্রস্তাব দেয় পান্ডবভার্যা দ্রৌপদীকে পণ রাখার। সেই মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরের নিশ্চয় মতি বিভ্রম হয়েছিল। নয়তো অমন কদর্য
প্রস্তাবে তিনি সম্মত হলেন কি করে? তখনই অক্ষের দান ফেলেছিল ধূর্ত বৃদ্ধ। আর কুটিল হাসি হেসে বলেছিল, - তাও জিতে নিলাম।
বলতে বলতে ক্রোধে, ক্ষোভে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন কুন্তী। তাঁর দুই চোখ অগ্নি বর্ষণ করছিল। আর তারপর
দুরাত্মা দুর্যোধন উন্মাদ কুক্কুরের মতো উৎকট চিৎকার করে বলেছিল,- দ্রৌপদী এখন
থেকে আমাদের দাসী, ওরে কে আছিস নিয়ে আয় তাকে, অন্য দাসীদের সঙ্গে মিলে সে আমাদের
গৃহ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করুক।
দ্রৌপদী তখন রজস্বলা ছিলেন। তাঁর কাতর অনুনয় গ্রাহ্য করেনি
দুর্বৃত্তেরা। দুঃশাসন অন্তঃপুরে গিয়ে সেই পান্ডব কুললক্ষীকে কেশাকর্ষণ
করে প্রকাশ্য সভায় নিয়ে আসে। “সুকুমারী, নীলপদ্মবর্ণা সেই
কন্যা, --তখন রক্ত লাঞ্ছিত একটি মাত্র বসন তার অঙ্গে—আহা কি অসহায়া সে তখন, বিপন্না
হরিণী যেন—এ কথা ভেবে হায় করেণু, আমার হৃদয় যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কত দুঃখ পেয়েছি আজীবন কিন্তু করেণু, আমার স্নুষার এই অপমান আমি সহ্য করতে
পারছি না। আজ নিশ্চিত বুঝলাম, এ পৃথিবীতে ধর্ম নাই, সত্য নাই,
ঈশ্বর বলে কেউ নাই! নয়তো পঞ্চপতির পত্নী সে, তবু তাকে অনাথার মতো ঐ কাপুরুষ
দুঃশাসন কেশাকর্ষণ করে সভায় নিয়ে গেল। তার আগে বজ্রাঘাতে সে দুর্বৃত্তের
মস্তক বিদীর্ণ হোল না—তারপরেও আবার সূর্যোদয় হোল? সূর্যাস্ত হোল? দিন কাটতে লাগল নিজের নিয়মে?”-
হাহাকার করে কেঁদে ওঠেন মনস্বিনী কুন্তী। যেন দূতের মুখে
বর্ণনা শোনা সে ভয়ঙ্কর দৃশ্য তিনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন।
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে করেণু শ্বশ্রূমাতার দিকে। এ কি শুনছে সে! সম্পূর্ণ বোধগম্য হচ্ছে না তার। জননী প্রলাপ
বকছেন না তো? অনুচারীরা তাঁকে ঘিরে বসে। চোখের জলে ভেসে
যাচ্ছে তাদের মুখ। সে ক্রমশ শোনে, এই
গ্লানিপূর্ণ ঘটনার পরে, নারীর এমন মর্মান্তিক অবমাননা দেখে, সভাস্থ সকলেই
ধৃতরাষ্ট্র তনয়দের প্রকাশ্যে ধিক্কার দিয়েছিল। তখন ধৃতরাষ্ট্র
লোকলজ্জায় ভীত হয়ে, পান্ডুপুত্রদের
দ্যূতক্রীড়ায় পরাজয়ের শর্ত থেকে মুক্তি এবং শকুনির জিতে নেওয়া সকল সম্পদ ফিরিয়ে
দিয়েছিলেন। কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার সে বুদ্ধিভ্রষ্ট বৃদ্ধ,
অনাচারী পুত্রদের প্ররোচনায় দ্বিতীয়বার দ্যূতক্রীড়ার আয়োজন করেন। যথারীতি পরাভব ঘটে যুধিষ্ঠিরের। এবারের শর্ত অনুযায়ী, সকল পান্ডব ভাই, বধূ দ্রৌপদী সহ কাম্যক বনে গমন
করেছেন। দ্বাদশ বর্ষ বনবাসের পরে আরো এক বৎসর তাঁদের অজ্ঞাতবাসে
থাকতে হবে।
আগামী পূর্ণিমা তিথিতে দুর্যোধন সপরিবারে অধিকার করবে রমণীয় এই পুরী। এ প্রাসাদের পরিচারক পরিচারিকাদের প্রভু নন তাঁরা আর। কিন্তু দুঃশীল
দুর্যোধনের প্রভুত্ব মানতে চাইছে না তারা। উন্মত্তের মতো
চিৎকার করে কাঁদছে।
পান্ডববধূগণ - দেবিকা, বিজয়া, করেণু, সুভদ্রা, বলন্ধরা সন্তানসহ তারা যে
যার পিতৃগৃহে গমন করবে। কুন্তী বাস করবেন ক্ষত্তা বিদুরের গৃহে। অর্থাৎ সমগ্র পরিবারটি অনিশ্চিত কালের জন্য বিপর্যস্ত হয়ে গেল।
সম্পুর্ন বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে অনেকক্ষণ সময় লাগল করেণুমতীর। সে কাঁদল না। একটিও আক্ষেপোক্তি উচ্চারণ করল না। মর্মর মূর্তির
মতো কুন্তীর পদতলে বসে রইল। তার মনে হচ্ছিল অগ্নিস্রাবী পর্বত
জীবন্ত হয়ে উঠেছে। উত্তাপে ঝলসে যাচ্ছে তার স্বামী, তার পুত্র, তার সকল
প্রিয়জন। কতক্ষণ পরে সে অস্ফুট গুঞ্জনে বলে উঠল,-“জননী”
কুন্তী শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন। করেণু ব্যগ্র স্বরে বলল,- “মা, এ
কি তবে খান্ডব দাহনে শত সহস্র জীবকে বাসভূমিচ্যূত করার প্রতিফল?” – যে প্রশ্নের
উত্তর মানব কোনোদিনই জানবে না, তেমন বহু প্রশ্ন মথিত করতে লাগল তার হৃদয়কে।
কুন্তীর ভিতরে তীব্র আলোড়ন চলছিল। পান্ডবদের
বিপর্যয়, দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা, আসন্ন ছিন্নমূল জীবন যাপনের অনিশ্চয়তার চেয়েও গভীরতর
ছিল তা। গ্লানি ও লজ্জায় গোপনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল তাঁর
অন্তর। তাঁর পুত্র কর্ণের শোচনীয় অধঃপতনের সাক্ষী হয়ে রইল
হস্তিনাপুরের রাজসভা। আপন ভ্রাতৃবধূ দ্রৌপদীকে সে ‘বেশ্যা’ বলে সম্বোধন করেছিল। অট্টহাসি হেসে তাকে নগ্না করতে উৎসুক! হায় দৈব! এ মহাপাপে সে সমূলে বিনষ্ট
হবে, বিন্দুমাত্র সংশয় নাই কুন্তীর। ভীমার্জুন মহা ক্রুদ্ধ এখন। অপমানের প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত হচ্ছে তারা। ভবিষ্যতের
পটভূমিতে কুন্তী দেখতে পাচ্ছেন, ত্রয়োদশ বৎসর পরে, এক মহাযুদ্ধের সূচনা। নির্বোধ জননীগণ যুগে যুগে এইভাবেই বুঝি নির্মাণ করে ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের
ইতিহাস! বৃথা আক্ষেপে হাহাকার করেন অসহায়া
বৃদ্ধা।
তখনই এক দাসী সংবাদ নিয়ে আসে করেণুর অগ্রজ ধৃষ্টকেতু রাজপুরীতে উপস্থিত
হয়েছেন।
ক্রমশ
0 মন্তব্যসমূহ