‘ঘাসে ঘাসে নক্ষত্রপ্রলাপ’: রৌদ্রগণিকার পথ-এর পাঁচালী
সৌমনা
দাশগুপ্তর কবিতার মধ্যে সুপ্ত থাকে এক নিহিত পাতালছায়া। তাঁর পূর্ব প্রকাশিত
কাব্যগ্রন্থ বেদ পয়স্বিনী(২০০৬), খেলাহাট(২০০৮),দ্রাক্ষাফলের গান(২০০৮), ঢেউ এবং সংকেত(২০১৮), জিপার
টানা থাকবে(২০১৯), অন্ধ আমার আলোপোকা(২০১৯), সাপ ও সিঁড়ির সংলাপ (২০১৯) এর মধ্যে
আমরা দেখেছি প্রকৃতির চিরকালীন রহস্যের রূপ রস গন্ধ বর্ণ স্পর্শ একাকার হয়ে গিয়ে
সৃষ্টি করেছিল ইন্দ্রিয় বিপর্যাসের মায়াবী মেঘের তন্দ্রা। এবছর ২০২২ সালে কলকাতা বইমেলায়
আদম থেকে প্রকাশিত তাঁর সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ রৌদ্রগণিকার
পথ-এর ক্ষেত্রেও সেই তন্দ্রা পুরোমাত্রায় বিদ্যমান।
হিরণ মিত্রের যথাযোগ্য প্রচ্ছদে সেজে চার ফর্মার হার্ড বাঁধাই এই কাব্যগ্রন্থে
স্থান পেয়েছে মোট একচল্লিশটি কবিতা। প্রতিটি কবিতাই পৃথক উল্লেখের দাবি রাখে। তবু
এর মধ্যে বিশেষভাবে মৌতালি ওই নদীর পাড়ে', 'হড়পা বান', 'মধুপত্রী', 'চণ্ডস্বর',
'শোয়ানো রয়েছে ক্রাচ', 'জিন-পরিদের দেশ', 'গালগল্প', প্রভৃতি।
কবিতার
ভাষা ব্যবহারে কবি অকুতোভয় এবং ব্যতিক্রমী। সংস্কৃতিসম্পৃক্ত শব্দের বহুল
ব্যবহারের পাশাপাশি তিনি কবিতার মধ্যে সুন্দরভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন শরীরী আঘ্রাণ ও
প্রকৃতির অপার রহস্যকুসুম। তাঁর কাছে "ঘুম এক আশ্চর্য বাগান"। সেখানে দৃশ্যকে ঢেকে দিয়েছে
দৃশ্য। "শেকল ও কুকুরের মধ্যে" কবি বেছে নিয়েছেন "বাঁধ-দেওয়া নদী
আর উত্তুঙ্গ মরুবাতাস"।
সমাসোক্তি
অলংকারের বহুল ব্যবহার তাঁর কবিতার সম্পদ। শব্দ কখনও লাফিয়ে ওঠে বারান্দায়, কখনও শীতের মধ্যে থাকে জমে থাকা কথা আবার কখনও সানাই আর বাঁশি মেতে ওঠে গজল্লায়।
আদি
বাংলার প্রাচীনতম নিদর্শন সহজিয়া বৌদ্ধসংগীত চর্যার গানগুলির তত্ত্ব কিংবা বৈষ্ণব
রসতত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত শব্দসমূহ অনায়াসে আশ্রয় পায় তাঁর কবিতায়। তাই কমলা
সূর্য হয়ে ওঠে হ্লাদিনী, সুষুম্না বৃক্ষের গায়ে টাঙিয়ে
দেওয়া হয় লটকনা ফল। লৌকিক প্রকৃতির মধ্যে শরীরী আভাসের ইঙ্গিত সচেতনভাবে ফুটিয়ে
তুলতে কবি সিদ্ধহস্ত।
রৌদ্রগণিকার
পথ-এ তাই পড়ে থাকে অজস্র বক্রোক্তি। সস্তা
জনপ্রিয়তা অর্জনের পথ বর্জন করে এ কাব্যগ্রন্থের কবি বেছে নিয়েছেন এক রহস্যভরা নিরুদ্দেশ যাত্রা। এই বইয়ের কবিতাগুলো পড়ে জাগে শিহরণ, পুড়ে যায় ব্যথা, মন চলে যায় "ফটক-আঁটা চা-বাগানের
ভেতর। সেইখানে "শোয়ানো রয়েছে ক্রাচ"। কবির সঙ্গে সঙ্গে পাঠকেরও
মনে হয়-
"চাঁদ
এক অমীমাংসিত ভ্রূণ"।
চাঁদকে
নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থের কবির কল্পনার অন্ত নেই। কখনও তিনি খুলে দেখেন চাঁদকে-
"
আমি তবে চাঁদকে খুলে দেখি
ঘরের
ভেতর অন্য কোনো ঘর"
আবার
কখনও যান চাঁদের সঙ্গে জল সইতে-
"পূর্ণিমা-চোর
অক্ষরেরা জানে
আমি
ও চাঁদ জল সইতে যাই"
এই
কাব্যগ্রন্থের একাধিক কবিতায় বিভিন্ন রূপে ধরা পড়েছে চাঁদ। দু-একটির উদাহরণ
দেওয়া যাক-
"বিনবাতাসের
রাতে জ'রে যাচ্ছে মধুপত্রী চাঁদ"
"তামাগন্ধ
চাঁদ, ঘেয়ো কুকুরের কাতরানি"
"তামার
পাত্রের গায়ে যেটুকু গরল সেটুকুই চাঁদ "
"চন্দ্রগজাল।
রক্তে রক্ত ঢালা"
"মুখে
তুলে নিয়ে যাব ভাটালাগা চাঁদ"
এইরকম
অসংখ্য পঙ্ ক্তি রৌদ্রগণিকার সঙ্গী হয়েছে চাঁদ। এ যেন বিরোধাভাস অলংকারের সার্থক
প্রয়োগ। কেননা রৌদ্রগণিকার সঙ্গী প্রকৃত প্রস্তাবে চাঁদ নয়, সূর্যের হবার কথা। দিবালোকের প্রখর সূর্যকরতাপ রৌদ্র উপমিতের উপমান যেখানে গণিকা
আর রূপক অলংকারের সার্থক প্রয়োগে যেখানে এই উপমান উপমিতের অভিন্নতা কল্পনার
প্রস্তাব নামকরণের মাধ্যমে কবি দিয়েছেন, সেখানে
কাব্যগ্রন্থের একাধিক কবিতাতে দিন নয় বরং নৈশ পরিবেশে চাঁদের উপস্থিতি বিরোধাভাস অলংকারের
অস্তিত্বকেই স্বীকার করে নেয়। সেদিক
থেকে দেখলে সৌমনা এই কাব্যগ্রন্থে একজন প্রকৃত অলংকারশিল্পী।
রৌদ্রগণিকার
পথ কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু
কবিতার নির্মাণকৌশল অনবদ্য। এ প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে 'মৌতালি ওই নদীর পাড়ে', 'নার্ভ-গ্লোবিউলিন স্যুপ', কিংবা 'আদিখর্পর' শীর্ষক কবিতাগুলি।
সামগ্রিকভাবে
বলা যায় এই সময়ের একাধিক কাব্যগ্রন্থের ভিড়ে সৌমনা দাশগুপ্তর রৌদ্রগণিকার পথ
কাব্যগ্রন্থটি একেবারেই স্বতন্ত্র এবং তা প্রত্যাশিতভাবেই সহৃদয়-সামাজিক পাঠকের
হৃদয়ে আলাদা স্থান দখল করবে।
কাব্যগ্রন্থ
: রৌদ্রগণিকার পথ
সৌমনা
দাশগুপ্ত
আদম প্রকাশনা
প্রচ্ছদ- হিরণ মিত্র
১৫০/-
0 মন্তব্যসমূহ