সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

তৃষ্ণা বসাক

 


মধ্যিখানে চর (ধারাবাহিক)

 ( প্রথম পর্ব)

তৃষ্ণা বসাক

 

পুজোর কলকাতা ছেড়ে যাওয়া কি যে কষ্টের। কিন্তু এ তো বাংলা ছেড়ে অধিক বাংলায় যাওয়া। আমার সোনার বাংলায়। সল্টলেক থেকে সৌহার্দ্য বাসে চেপে বসা নবমীর ভোরে। আবার নবমীর রাতেই পৌঁছে যাওয়া আর এক বাংলা মায়ের কোলে। মাঝে চ্যাংড়াবান্ধায় এক খিটকেল কাস্টমস অফিসার ব্যাগ খুলে হাটকে একাক্কার অবস্থা। যে শাড়িগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আত্মীয়াদের জন্যে, সেগুলো পুরো ভাঁজ খুলে কচলিয়ে কি করুণ দশা করে দিল তাদের। যেন কতবার পরা পুরনো শাড়ি। সৌহার্দ্য বাসের ফিরোজ ভাই এগিয়ে না এলে সেগুলো ফেরত পাওয়াই যেত না। শাড়ির মতোই তছনছ মন নিয়ে, ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন ঢাকার নবাবপুর রোডে এসে পৌঁছলাম, তখন রাত নটা বেজে গেছে। সরু গলির মধ্যে হঠাৎই আলদিনের দৈত্য যেন বিশাল প্রাসাদ বসিয়ে গেছে। এ বাড়ির বাসিন্দারা বহুবার পালিয়েছে প্রাণ হাতে করে, আবার ফিরে এসেছে। সেই পালানো আর ফিরে আসার ইতিহাস এর প্রতিটি বাঁকে। বাড়ির সদর দরজা থেকে মূল বাড়িতে পৌঁছতে তাই অগণিত গলির ভুল্ভুলাইয়া। পরে বুঝেছি, এর কারণ হানাদারকে বিভ্রান্ত করে কিছুক্ষণের জন্যে ঠেকিয়ে রাখা, সেই অবসরে বাড়ির সবাই যাতে পালিয়ে যেতে পারে। সে বড় সুখের সময় নয়। স্বাধীনতা আর দেশভাগ হাত ধরাধরি করে এসেছিল। এই উপমহাদেশ ভেঙে দুটো দেশ ভারত আর পাকিস্তান। সে পাকিস্তানের আবার দুটো অংশ, পশ্চিম আর পুব। পুব যে দুয়োরানি তা তো বোঝা যাচ্ছিল পদে পদে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল রাওয়ালপিণ্ডি আর লাহোরের কতিপয় পরিবারের হাতে। পুবের শিল্প অর্থনীতির মাজা ভেঙে দেওয়া হচ্ছিল সুপরিকল্পিত ভাবে। সবচেয়ে আঘাত আসছিল ভাষা সংস্কৃতির ওপর। এরই জেরে ১৯৫২ র ভাষা আন্দোলন, আর তারপর দু দশক ধরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। আবার এক নতুন দেশের জন্ম হল। বাংলাদেশ। যাদের জাতীয় সঙ্গীত যখন বাজে তখন গলার কাছে কী যেন দলা পাকায়, চোখে জল আসে, বুকে গর্ব হয়। সারা পৃথিবীতে যে ছড়িয়ে যাচ্ছেন রবি ঠাকুর, ছড়িয়ে পড়ছে বাংলা ভাষা। 

তাই পাসপোর্টে ছাপ পড়তে একটু অদ্ভুতই লাগছিল, বিদেশ নাকি? নবাবপুর রোডে আসতে আসতে চারপাশের দোকানপাট দেখেও চোখের কি আরাম। সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে বাংলাভাষা। কানের আরাম। খাস কলকাতায় একটা বিশুদ্ধ বাংলা বাক্য শোনা প্রায় যায়ই না।

আধো অন্ধকারে গলির ভুল্ভুলাইয়া পেরোতে গিয়ে দেখি ছোট ছোট ঘরে মানুষজনের ঘরকন্না। দেখেই বোঝা যায় তাঁরা সমাজের পিলসুজের একেবারে নিচের অংশ, যেখানটায় আলো পড়ে না। পরে শুনেছি, ওরা কেউ শাঁখারিটোলার সোনার দোকানে সোনার গুঁড়ো কুড়িয়ে বেড়ায়, কেউ ফেরিওলা, কেউ রিকশা টানে। এদের ডেকে এনে বাড়ির মধ্যে জায়গা দেওয়া অকারণে নয়। দাবায় যেমন রাজাকে বাঁচাতে সামনে বোড়েদের এগিয়ে দেওয়া হয়, এরা ঠিক তেমনি। হানাদারের আক্রমণের প্রথম চোটটা ওদের ওপর দিয়ে যাবে। তখন অনেক সময় পাওয়া যাবে মালিকদের নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার। পালিয়ে যাওয়ার সময় বরাবর এঁরা লক্ষ্মী জনার্দন নিয়ে গেছেন বুকে করে। ফিরেও এসেছেন তাদের বুকে নিয়ে। সেই লক্ষ্মী জনার্দনের মন্দির আছে বাড়ির চত্বরেই। কিন্তু গলির চক্করে চট করে খুঁজে পাওয়াই দায়। বলা বাহুল্য, এটা ছিল আত্মগোপনের জায়গা। বাড়ি থেকে না পালিয়ে বাড়ির মধ্যেই লুকিয়ে থাকা। এখানে প্রতি বছর অন্নকূট হয়। সেখানে নাকি শাড়িতে মুখ ঢেকে পুজো দেখতে আসে বাংলাদেশের  সত্তর দশকের এক প্রখ্যাত অভিনেত্রী, যে আদতে এ বাড়ির মেয়ে । সে নাকি এখন থাকে লাহোরে, পাক টেলিভিশন সিরিয়ালে এখনো খুব জনপ্রিয় মুখ। মানুষ যেন পাখির মতো। উড়তে উড়তে কতদূর চলে যায়। আবার যতদূরেই যাক পাখি তার বাসাটি ভোলে না। মেয়েটি তাই ফিরে ফিরে আসে নবাবপুর রোডে। সুউচ্চ শুভ্র অন্নের স্তূপ পেরিয়ে তার চোখ চলে যায় কৃষ্ণাঙ্গ যুবাটির দিকে। কৃষ্ণ বা জনার্দন যাই বলা যাক তার নাম। তার না হয় এখানে শেকড় আছে, আমি কেন আসতে চেয়েছি এখানে? ভাবতে ভাবতে  মন চলে যায় ঋত্বিক ঘটকের কোমলগান্ধার ছবির সেই দৃশ্যে, যেখানে রেললাইনটা শেষ হয়ে গেছিল। ওপারে একটা অন্য দেশ। সেই কাটা রেললাইনটা, নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে, কেয়াপাতার নৌকো এইসব পড়তে পড়তে আমার মনে একটা শেকড় তৈরি হয়েছে কখন অজান্তে। শুধু বাংলা নয়, কোথাও দেশভাগ মেনে নিতে চায় না আমার মন। পরে তো পূর্ব পাঞ্জাব, পশ্চিম পাঞ্জাবের যন্ত্রণার কথাও জানলাম। কিসান চন্দরের পেশোয়ার এক্সপ্রেস, মান্টোর অসাধারণ গল্পগুলো, পরবর্তীকালে পাঞ্জাবি লেখকদের রচনা- অজিত কৌর, মোহন ভাণ্ডারী – আমাকে অস্থির করে তোলে ভীষণ। দেশভাগ, গৃহযুদ্ধ, আর তার ফলে এক বিপুল সংখ্যক মানুষের মাইগ্রেশন – এ যে কি ভয়ানক!  দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে ছোট ছোট ঘুপচি ঘরে নগণ্য মানুষের ঘরকন্না দেখছিলাম। দৃষ্টি অন্ধকারেও দূরে চলে যাচ্ছিল। আন্দাজে বুঝলাম খুব কাছেই জিন্দাবাহার লেন। পরিতোষ সেনের অসামান্য স্মৃতিকথা পড়ে পড়ে যাকে আমি চিনি। ওই তো ওই বাড়ির ছাদ থেকেই  হয়তো রংবেরঙ্গের ঘুড়ি উড়ত, লক্কা পায়রারা আকাশে উড়ত চক্রাকারে। এখন কোথায় তারা? কোথায় বুদ্ধদেব বসুর পুরানা পল্টন?  কোন বাড়িতে রাণু সোমকে গান শেখাতে আসতেন নজরুল?যাবত প্রিয় বইয়ের পাতা খুলে যাচ্ছিল ফরফর করে। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম সেই সময়ে, কখনো আবার ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাইয়ের ঢাকায়। হঠাৎ  শিউলি ফুলের গন্ধ এল নাকে। শিউলির গন্ধ আর এবাড়ির পুরনো  গল্প শুনতে শুনতে   কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম কে জানে।  ( ... ক্রমশ...)

 

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ