রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩২ খ্রস্ট্যব্দের ১১ এপ্রিল পারস্য সফরের উদ্দেশে যাত্রা করেন। কবির বয়স তখন একাত্তর বছর। আমৃত্যু তিনি ছিলেন চিরযুবা। জীবনের পড়ন্ত বেলায় যখন পারস্যরাজের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ এসে পৌঁছল, তখন কবি ভালোবাসার এ আহবান উপেক্ষা করতে পারলেন না। পথের ক্লান্তির কথা বিবেচনায় এনেও তিনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। বয়সের জড়ত্ব তাঁর মনের লাগাম টেনে ধরার একেবারে চেষ্টা করেনি তা নয়। কিন্তু যৌবনে কবি আরব বেদুঈন হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন; বার্ধক্যে সেই বেদুঈনদের আবাসভূমির কাছে যেতে পারার সুযোগ তিনি সৌভাগ্য হিসেবে গ্রহণ করলেন। কবি ভুবনে ভুবনে চেতনা ও বন্ধুত্বের যে জাল বুনেছিলেন তার সুতোয় পারস্যও গাঁথা হয়েছিল।
কবি ভারতবর্ষের প্রাচীন শহর কোলকাতার এক বুনিয়াদি ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মগ্রহণ
করলেও শৈশবে তাঁর মানসলোকে পারস্যের ছবি অক্ষয়ভাবে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। কবিপিতা মহর্ষি
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ফারসি ভাষার সুপণ্ডিত। সদ্যনিষিদ্ধ রাজভাষা হলেও জোড়াসাঁকোর
বুনিয়াদি পরিবারটির মধ্যে ক্ষয়িষ্ণুতার চিহ্ন নিয়ে ভাষাটি তখনো টিকে ছিল। তদুপরি কবিপিতার
প্রিয় কবি পারস্যের জগদ্বিখ্যাত শামসউদ্দিন হাফিজ। মহর্ষি তাঁর চতুর্দশতম সন্তানের
নাম রাখার ক্ষেত্রে তাঁর প্রিয় কবি শামসউদ্দিন হাফিজের নামটি বাছাই করেছিলেন। মহর্ষির
জীবনীগ্রন্থে ও এর ইঙ্গিত আছে। শামসউদ্দিন বঙ্গতর্জমায় রবীন্দ্রনাথ। পারস্যে যাবার
ব্যাপারে আরো কিছু কারণ থাকা অস্বাভাবিক নয়। তৎকালীন ঔপনিবেশিক ভারতের স্বাধীনতার প্রাক্কালে
হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে অবিশ্বাস ঘনিভূত হয়েছিল, তার অভিঘাত থেকে রবীন্দ্রনাথও বাদ
ছিলেন না। তাঁর পারস্য ভ্রমণসূত্রে সে অপপ্রচার কিছুটা খণ্ডন হতে পারে, এ ধারণাও অমূলক
নয়। তবে বড় কারণ রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক উদ্বোধন। জীবনের শেষবেলায় এসে এই বিশ্বমানবের
মনে এশিয়ার পুনর্জাগরণের চেতনা উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। যে এশিয়া ছিল একদিন সমস্ত শুভ
এবং ভাববাদী চেতনার পিতৃভূমি; প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সকল মহামানবের জন্মদাত্রী
এই এশিয়া। মুসা ইসা মুহম্মদ কৃষ্ণ বুদ্ধ কনফুসিয়াস জেরোস্তরো-সবাই এশিয়ার সন্তান। বাবেল
থেকে যেভাবে মানুষের ধারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল, তেমনি এশিয়া থেকেই সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান
দর্শন সারা দুনিয়াকে পথ দেখিয়েছিল। অথচ সেই এশিয়া আজ চিন্তাশূন্য দর্শনশূন্য, যা এই
হৃদয়বাদী ভাববাদী তদুপরি জাতীয়তাবাদী কবিকে বড় কষ্ট দিয়েছিল। পারস্যে যাবার সুযোগে
তিনি এশিয়ার উদ্বোধনের কথাটি জোরেশোরে বলতে পারবেন বলে ধারণা করেছিলেন। নোবেল পাওয়ার
পরে কবি যখনই বিদেশ সফরে গিয়েছেন, এমনকি ইউরোপ সফরেও তিনি এ কথাটি সরবকণ্ঠে বলেছেন,
এশিয়ার কাছে তোমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথ এই মতের পক্ষে সরাসরি
অবস্থান নিলেও সেই শৈশবে ইউরোপ প্রবাসেই ভারতীয় জাতীয়তাবোধের উদ্ভব ঘটেছিল। পারস্যের
ব্যাপারে আরো একটি কথা বলা যায়, তাহলো প্রাচীনকালে পারস্যের সঙ্গে ভারতবর্ষের এক অন্তর্নিহিত
যোগাযোগ ঘটেছিল। উভয় দেশের চিৎপ্রকর্ষে বয়ে গিয়েছিল একই রক্তের তরঙ্গমালা। ভারতবর্ষের
ইতিহাসকে একটু আলাদা করে সৃষ্টি করেছিলেন আর্যরা; যাদের জ্ঞাতিগোষ্ঠী পারস্যে থেকে
এসেছিল এক সময়ে। আর্যরাই উপনিষদের স্রষ্টা-রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের পটভূমিও সেখানে।
সে দিক দিয়েও রবীন্দ্রনাথ পারস্যের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করেছিলেন। পারস্য ভ্রমণ রবীন্দ্রনাথের
জন্য অন্য আর পাঁচটা দেশ ভ্রমণের চেয়ে কিছুটা আলাদা।
রাজা রামমোহন রায় একদিন হিন্দুধর্মের সনাতন অচলায়তন ভেঙে উপনিষদের বাণীকে
বুদ্ধি ও যুক্তির উপর দাঁড় করিয়ে ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন। উনিশ শতকের এই যুগ
প্রবর্তকও ফারসি ভাষা সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন। কবিপিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছিলেন রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত পথের প্রধান পুরোহিত। সনাতন হিন্দুধর্মকে পরিহার
করে তিনি রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এই ধর্ম গ্রহণসূত্রে
ঠাকুর পরিবার, বিশেষ করে দেবেন্দ্রনাথের আত্মজরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত হন। চিরদিনের
ছোঁয়াছুঁয়ির বেড়া ডিঙিয়ে ভারতীয় প্রাচীন এই ধর্ম নিজেকে রক্ষার জন্য চারপাশে যে সিস্ট
গঠন করেছিল অন্য কোনো অর্বাচীন মতের প্রবেশ সেখানে সীমিত। সেই ধর্ম দেবেন্দ্রনাথের
পরিবারকেও বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। হিন্দুর আচার-আচরণ এবং প্রার্থনাসভায় যোগ দেয়ার
অধিকার তাদের জন্য অবারিত ছিল না। অবশ্য এ ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল কয়েক ‘শ বছর আগে তাদের
পূর্বপুরুষের পিরালীত্ব বরণের মাধ্যমে। এ বেদনা শৈশব থেকেই দেবেন্দ্রনাথের চতুর্দশতম
পুত্রের মনে দানা বাঁধতে থাকে। ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষের ধর্মীয় সংঘাত ও সংখ্যালঘুর
মনোবেদনা বালক কবিকে দহন করতে থাকে। পারস্য-ভ্রমণসূত্রে রবীন্দ্রনাথ সে বেদনার কথাও
স্মরণ করেছেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের দর্শনের পশ্চাৎভূমিটি গঠিত হয়েছিল দেবেন্দ্রনাথের
ভক্তি ও চিরন্তন সুফিবাদী চেতনা থেকে। কবিপিতা পারস্যের সুফিবাদী চেতনায় মুগ্ধ ছিলেন।
দেবেন্দ্রনাথের হাফিজমুগ্ধতা কেবল কবিতার জন্য নয়, ইরানি কবির দর্শনও তাঁকে মুগ্ধ ও
অনুপ্রাণিত করেছিল। বৈষ্ণব ভাববাদের সঙ্গে সুফিবাদের মানসিক ঐক্য রয়েছে। নশ্বর মানবকে
অবিনশ্বরের অংশ করে তোলা এই মতবাদের প্রধান লক্ষ্য। দেবেন্দ্রনাথের ধর্মের এবং দর্শনের
পক্ষে হাফিজ এক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলেন। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের পারস্য ভ্রমণ প্রসঙ্গে
পিতা দেবেন্দ্রনাথ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। তাছাড়া কবির ভ্রমণপর্ব
ও শুরু হয়েছিল মূলত ঋষিপিতার হাত ধরে। এগার বছর ছ মাস বয়সে ১২৭৯ বঙ্গাদ্ধের মাঘ মাসে
সবে কবির উপনয়ন উপলক্ষে মহর্ষি হিমালয় থেকে কলকাতা এ সেছিলেন। ফেরার পথে তিনি রবীন্দ্রনাথকে
সঙ্গে নিয়ে যান। এ ভ্রমণ কিশোর কবির পর্যটন আকাঙ্ক্ষা প্রসারিত করেছিল। কোলকাতা থেকে
বোলপুর, সাহেবগঞ্জ, দানাপুর, এলাহাবাদ, কানপুর প্রভৃতি স্থানে দু-একদিন করে বিশ্রাম
নিয়ে কবি পিতার সঙ্গে অমৃতসরে এসে সেখানে মাসখানেক অবস্থান করেন। তারপর সেখান থেকে
ডালহৌসি পাহাড়। হিমালয়ের শৈলবাসে মহর্ষির আসন ছিল। সেখানে কয়েক মাস অপেক্ষা করে ১২৮০
সালের আষাঢ় মাসে কবি জোড়াসাঁকো ফিরে আসেন। পিতৃদেবের সঙ্গে এই ভ্রমণ কবির মনে ভ্রমণের
মধ্যেও উপাসনা ও অধ্যাত্মচেতনার জায়গা নিয়েছিল। কবির ওপর দেবেন্দ্রনাথের প্রভাবের কথা
‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমার জন্ম যে পরিবারে সে পরিবারের ধর্মসাধন
একটি বিশেষ ভাবের। উপনিষদ এবং পিতৃদেবের অভিজ্ঞতা, রামমোহন এবং আর আর সাধকদের সাধনাই
আমাদের পারিবারিক সাধনা।’ পারস্য ভ্রমণের সঙ্গে রামমোহন এবং কবিপিতার পরোক্ষ চিৎপ্রকর্ষই
রবীন্দ্রমনে পারস্যের ব্যাপারে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছিল।
কবির ধারণা ছিল একাত্তর বছর বয়সে দেশভ্রমণের ঝুঁকি নেয়া ঠিক নয়। তবু সত্তর
বছরে প্রাচীন কবি শেষের কবিতা রচনা করতে পারেন তাঁর মনে বয়সের জড়ত্বের ছাপ পড়া প্রায়
অসম্ভব।
পারস্য ভ্রমণের সময় ছিল গ্রীষ্মকাল। তখনো আকাশপথ এত মসৃণ ও সহজলভ্য হয়ে
ওঠেনি। কিন্তু আয়োজকদের অশেষ আন্তরিকতা কবিকে না বলতে বাধা দিল। গ্রীষ্মকালে রেল এবং
পানিপথে বৃদ্ধ কবির যাত্রা সুখকর হবে না বিবেচনা করে পারস্যরাজের আয়োজক কর্তৃপক্ষ ওলন্দাজ
বিমানে তার ভ্রমণের আয়োজন করেন। কবির জন্য এটা ছিল দ্বিতীয় আকাশ ভ্রমণ। তবু বিমানযাত্রার
রোমাঞ্চকর অনুভূতি কবির মধ্যে পুরোমাত্রাতেই ছিল। মাটি থেকে ওপরে ওঠার মধ্যে যে মধ্যাকর্ষজনিত
আকর্ষণ, মাটির মায়ের মায়া কবি তা এবার পুরো মাত্রায় অনুভব করেছেন। যেটা লন্ডন থেকে
প্যারিস যেতে অনুভব করেননি। কবির মনে সাহস দেবার জন্য তার পারসিবন্ধু দিনসা ইরানি সঙ্গী
হয়েছিলেন পারস্যের বুশেয়ার বন্দর থেকে। আর বোম্বাইয়ের পারসিক কনসাল কেহান সাহেব পারস্য
সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্ব পেয়েছিলেন কবির যাত্রার সকল আয়োজন করার এবং সাহচর্য দেবার।
বৃদ্ধকবির অসুস্থ শরীরের দেখাশোনা এবং পারিবারিক পরিবেশ কিছুটা নিশ্চিত করতে সঙ্গে
ছিলেন বউমা অর্থাৎ রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী। আর কর্মসহায়করূপে সঙ্গে ছিলেন কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়
এবং বিশ্বকবির তরুণ সচিব কবি অমিয় চক্রবর্তী। কেদারনাথ এক সপ্তাহ আগেই রওনা দিয়েছিলেন।
কবি পারস্য ভ্রমণের বায়ুযানের গল্প রসিয়ে বলেছেন। বোধকরি কবি আকাশপথের
এই পর্যটনে কৌতূহলী বালকের মতো খুব মজা পেয়েছিলেন। তিনি যখন বিমানে চড়ে পারস্য ভ্রমণে
বেড়িয়েছেন তখনো কম ভারতীয়ই এই আকাশযানে সোয়ার হয়েছেন। মাটির মানুষের আকাশে ওড়ার স্বপ্ন
আজন্ম। মানুষও চায় পাখির মতো ডানা মেলে বাতাসে ভেসে থাকতে, দূর-দূরান্তে গমন করতে।
প্রকৃতি মানুষকে সেই ওড়বার ক্ষমতা দেয়নি, তবে প্রকৃতিকে জয় করবার ক্ষমতা দিয়েছে। সব
প্রাণিকেই প্রকৃতি তার প্রয়োজনের সকল কিছু দিয়েছে, কেবল মানুষকেই কষ্ট করে সবকিছু অর্জন
করে নিতে হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বায়ুযানের এই উড্ডয়নে খুব একটা আনন্দিত হতে পারেননি।
কেননা প্রকৃতির অধিকারে পাখির যে উড়া তার মধ্যে একটি সুষম ব্যাপার আছে, যা বায়ুযানে
নেই। কবিকে বহনকারী এই উড়ন্ত দানবযানটির প্রতি তিনি খুব একটা দয়ার্দ্র হতে পারেননি।
বিশেষ করে আকাশ পথে এর দাপাদাপি এবং চিৎকারে কবি স্বস্তি পাননি। তবে কবি সেই আকাশযানে
উঠে একটি সত্য আবিষ্কার করেছিলেন। সেটি হলো, যন্ত্রযুদ্ধে মানুষ কেন এত নির্মম এবং
ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। কারণ, মাটির মানুষ যখন আকাশে ওঠে তখন মাটির মাকে তার বড় অচেনা মনে
হয়। মানুষের অস্তিত্বই তার চোখে পড়ে না। কবি এখানে একটি চমৎকার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন
মহাভারতের কৃষ্ণচরিতের সঙ্গে। শ্রীভগবতগীতাতে যেমন শ্রীকৃষ্ণ মায়াকাতর অর্জুনকে তত্ত্বের
উপদেশ দিয়ে তার মায়ার বন্ধনকে দূরে সরিয়ে দিয়ে আত্মীয়বধের জন্য প্রস্তুত করে তুলছেন,
তেমন যন্ত্রের দ্বারা মানুষকে দূরে সরিয়ে নিয়ে মানুষকে বাধ্য করে তোলা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের
এ ভ্রমণ ছিল দুটি মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে। যুদ্ধের ভয়াবহতা মানুষের ও নির্মমতা কবি
প্রত্যক্ষ করেছেন। কবির মন কেঁদে উঠেছে। কবি সতর্ক করে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের
মহত্ত্ব এখানেই- ধর্ম কিংবা সংস্কারে নয়; মানুষ গুরুতেই তার নিষ্ঠা। গীতার যে ধর্ম
মানুষ মারার বিধান দেয় রবীন্দ্রনাথ ধর্মের সেই বাণীকে উপহাস করতে ছাড়েন না। খ্রিস্টান
অনুসারী যারা মানুষ মারে রবীন্দ্রনাথ তাদেরকেও বিশ্বাস করেন না। ব্রিটিশ ফৌজ পারস্যে
শেখদের গ্রামে নিয়মিত বোমাবর্ষণ করে চলছিল সে সময়ে। খ্রিস্টান ধর্মযাজকের মুখে এই সংবাদ
রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগেনি। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘গীতায় প্রচারিত তত্ত্বোপদেশও এই রকমের
উড়োজাহাজ- অর্জুনের কৃপাকাতর মনকে সে দূরলোকে নিয়ে গেল, সেখান থেকে দেখলে মারেই বা
কে মরেই বা কে।’
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যনীতি ব্যক্তি বিশেষের সত্তাকে অস্পষ্ট
করে দেয় বলেই তাদের মার এত সহজ। খ্রিস্ট এই সব মানুষকেও পিতার সন্তান বলে স্বীকার করেছেন।
কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মযাজকের কাছে সেই পিতা এবং পিতার সন্তান হয়েছে অবাস্তব। সেজন্য
সাম্রাজ্যজুড়ে আজ মার পড়ছে সেই খ্রিস্টেরই বুকে। যে কারণে ব্রিটিশ বিমান বাহিনির ধর্মযাজকের
অনুরোধেও রবীন্দ্রনাথ এই আকাশযমকে আশীষ করতে পারেননি। যে বাণী দিয়েছিলেন, সে বাণীর
মর্মার্থ আলাদা। রবীন্দ্রনাথের ঠিক বোধগম্য নয়, মানুষকে মারার জন্য কেন আকাশে উঠে বোমাবর্ষণ
করতে হবে ! রবীন্দ্রনাথ একে cannibalistic greed বলে উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের
পারস্য সফরকালেও ভারত ছিল ইংরেজ শাসনের অধীন। তাদের নীতি ছিল দ্বিমুখী- নিজের দেশ এবং
উপনিবেশের জন্য আলাদা আলাদা আইন। উপনিবেশ থেকে অর্থ শোষণ করে নিয়ে নিজের দেশকে রসালো
করে তোলা ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
যাত্রার তৃতীয় দিনে রবীন্দ্রনাথ পারস্যের বুশরায় পৌঁছান।
ওই দিন বিকেলে পারস্যের পার্লামেন্টের একজন সদস্য কবির সঙ্গে সাক্ষাৎ
করে জানতে চেয়েছিলেন, পারস্যকে জানার জন্য কবির কী ধরনের আগ্রহ রয়েছে? কবি জানান, পারস্যের
শাশ্বত রূপটিই তিনি জানতে চান। যে পারস্য ইতিহাসের অন্ধকার ভেদ করে আলোর মধ্যে উদ্ভাসিত
হয়েছে। ১৯১২ সালে কবি যখন য়ুরোপ ভ্রমণে গিয়েছিলেন তখনো একজন ইংরেজ কবি রবীন্দ্রনাথের
কাছে জানতে চেয়েছিলেন কবির য়ুরোপে আসার উদ্দেশ্য কি? কবি বলেছিলেন, য়ুরোপের মানুষকে
দেখতে, যে য়ুরোপের চারিদিকে জ্ঞানের আলো জ্বলছে, প্রাণের আলো জ্বলছে, সেই আলোকিত মানুষ
দেখার জন্যই কবি য়ুরোপে এসেছেন। কবির আলোকিত মন সবখানেই আলোর সন্ধানে ব্যাপৃত ছিল।
প্রাচীন সভ্যতার লীলাভ‚ মি পারস্য। পারস্যের একটি শাশ্বত স্বরূপ আছে,
যা আপন মহিমায় স্বপ্রতিষ্ঠ, সেই পারস্যকে জানার বড় আগ্রহ কবির। কিন্তু কবির সে আগ্রহ
বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কারণ আধুনিক পারস্যের একদিকে ক্ষুধা দারিদ্র্য অশিক্ষা, যাদের কাছে
সুষম পরিবর্তনটি এসে পৌঁছেনি। অপরদিকে যে পারস্য আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তারাও প্রাচীন
সভ্যতার প্রতি সচেতন নয়।
পারস্যে কবি যে সম্মান ও আপ্যায়নে ভূষিত হয়েছিলেন তা সম্ভব হয়েছিল
পারস্যের নিজস্ব ঐতিহ্যের কারণে। কেননা তাদের রক্তের মধ্যে মিশে আছে কবির মন। পারস্যের
কবিমনও রবীন্দ্রনাথকে কবি হিসেবে তাদের স্বগোত্রীয় কবির ভালোবাসায় সিক্ত করেছিল। তারা
মনে করেছিলেন পারস্যের মরমিয়া কবিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মনের মিল রয়েছে প্রচুর। তাছাড়া
কবি বিবেচনার ক্ষেত্রে পারস্য ও য়ুরোপের মধ্যে একটি বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। য়ুরোপে কবিকে
যারা জানে কিংবা যারা কেবল কবিতা পাঠক তারাই শুধু কবিকে বিবেচনা করে থাকে। কিন্তু পারস্যে
কবির বিবেচনা সবার কাছে। কবি আধ্যাত্মিকগুরুর মতো পারস্যজীবনে প্রভাব বিস্তার করে আছে।
এখানকার মানুষের বোধের জগতের সঙ্গে কবি একটি আলাদা মেজাজ নিয়ে অবস্থান করছে। সুতরাং
কবিকে সম্মান করতে তাদের বাধে না। আর রবীন্দ্রনাথ কেবল ভারতের কবি নন, এশিয়ার এই কবি
পুরোহিত পারস্যের মেজাজের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। রবীন্দ্রনাথ পারস্যে যেয়ে বুঝতে পেরেছিলেন।
প্রাচ্যদেশীয় কবি হিসেবে তার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। প্রাচ্যদেশীয় সম্মানের রীতিটিই এমন।
কবি যখন এই যাত্রায় মিশরে যান তখন তাঁর সম্মানে সেখানকার আইনসভার কার্যক্রম কিছু সময়ের
জন্য মুলতুবি রাখা হয়েছিল। এ ধরণের সম্মান কেবল প্রাচ্যেই সম্ভব, পাশ্চাত্যে নয়। পারস্যবাসী
যে কবিকে তাদের মরমীয়া কবিদের সমগোত্রীয় মনে করেছিলেন, এতে কবি বেশ পরিতৃপ্তিবোধ করেছিলেন।
আর তাদের মনে করার কারণে কাব্যের পরীক্ষা দিয়ে কবিকে তাদের কাছে পৌঁছাতে হয়নি। রবীন্দ্রনাথের
একটি অবস্থান পারস্যের কাছে আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাছাড়া কবির ভাষার সঙ্গে যেহেতু
পারস্যবাসীর পরিচয় ছিল না, সেহেতু যাচাই করার বন্ধুর পথে কবিকে যেতে হয়নি বলে কবি যেন
একটু স্বস্তি বোধ করেছেন। কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন পারস্যেরও গ্রহণ করবার ক্ষমতা দেখে। ধর্মীয়
সঙ্কীর্ণতা ও স্বার্থের ভেদবুদ্ধি থেকে পারস্য অনেকখানি মুক্ত বলে সে সময়ে কবির কাছে
মনে হয়েছিল। কবি বলেছেন, ‘য়ুরোপীয় সভ্যতায় সামাজিক বাধা নিয়মের বেড়া আরো কঠিন। বাংলার
নিজের কোণ থেকে বেরিয়ে পশ্চিমেই যাই, দক্ষিণেই যাই কারও ঘরের মধ্যে আপন স্থান করে নেয়া
দুঃসাধ্য, পায়ে পায়ে সংস্কার বাঁচিয়ে চলতে হয়- এমনকি বাংলার মধ্যেও। এখানে অশনে বসনে
ব্যবহারে মানুষে মানুষে সহজেই মিশে যেতে পারে। এরা আতিথেয় বলে বিখ্যাত, যে আতিথ্যে
পংক্তিভেদ নেই’।
পারস্যের অন্তরের রূপে কবি যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন, তেমনি ভূপ্রকৃতির রূপও
কবিকে ভাবতে অবসর দিয়েছিল। কারণ ভারতবর্ষের জলহাওয়ায় কবি বেড়ে উঠেছেন, পারস্যের সঙ্গে
যার রয়েছে বিস্তর ফারাক। পারস্য সমতলভূমি নয়। সমতলভূমির কবি যখন মালভূতে এসেছিলেন
তখন তার মনের অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। মাঠের পরে মাঠ এবং খুব
কমসংখ্যক ঘরবাড়ি বা বৃক্ষরাজি সেখানে কবির চোখে পড়েছিল। ভারতবর্ষের প্রায় সবখানেই ঘন
গাছপালা এমনকি অরণ্য প্রকৃতি। সুতরাং অরণ্যপ্রকৃতির মানুষ এবং মরুভূমির মানুষের বিশ্বাস
ও এবং মনোজাগতিক গঠন আলাদা হওয়া স্বাভাবিক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ ছ হাজার ফুট ওপরে
অবস্থিত পারস্য। রবীন্দ্রনাথের চোখে ধরা পড়েছিল, এশিয়ার এদিক থেকে ওদিক যেন দুটি বিপরীত
মেরু। আফগানিস্তান থেকে আরম্ভ করে মেসোপোটেমিয়া হয়ে আরব পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ভাষায়
‘নির্দয়ভাবে নিরস কঠিন,। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সৌভাগ্যক্রমে এরা বাহন হিসেবে পেয়েছে
উট ও ঘোড়া, আর জীবিকার জন্য পালন করেছে ভেড়ার পাল। এই জীবিকার অনুসরণ করে এখানকার মানুষকে
নিরন্তর সচল হয়ে থাকতে হয়। আর এ কারণেই পশ্চিম এশিয়ার মানুষ বারে বারে বড় বড় সম্রাজ্য
স্থাপন করতে পেরেছে। এর প্রধান কারণ এখানকার ভূমির কঠোরতা। এই ভূমি তাদের সহজে খাদ্য
আশ্রয় দেয়নি। ঠেলে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। তাই পরের দেশে পরের অন্ন সংগ্রহ করে তাদের
অস্তিত্ব¡ রক্ষা করতে হয়েছে। তারা পরিণত হয়েছে যোদ্ধার জাতিতে।
পারস্য হলো প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি।
পারস্যের রাজনৈতিক ইতিহাসও তেমন মসৃণ নয়। বহুবার হয়েছে ইতিহাসের পট পরিবর্তন।
পারস্যের বাইরে থেকে অনেকেই এই দেশটি দখল করে শাসন- শোষণ করেছে। বর্বরতায় নিষ্ঠুরতায়
রক্তের গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বেশিক্ষণ দেশটিকে পদানত রাখা সম্ভব হয়নি। অনেক
জাতিই সেই দেশের সঙ্গে লীন হয়েছেন। আর্যরা তাদের অভিবাসনপর্বের এক পর্যায়ে পারস্যে
স্থায়ীভাবে থেকে গিয়েছিল। নতুন নতুন অভিবাসীরা এই দেশটিকে তাদের মতো করে পছন্দ করে
ফেলেছিল। বহুবার আক্রান্ত হয়েও এই ভূখণ্ড পরাজয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেদের ঐক্যকে
মজবুত করেছে। বিশ শতকেও ইংরেজ ও রাশিয়া মিলে দেশটিকে পদানত রাখার চেষ্টা করেছিল। এ
দেশের নিজস্ব উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু খুব বেশিদিন তা সম্ভব হয়নি। পারস্যের
প্রাণশক্তি দেখে রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হয়েছেন। আরবের হাতে, তুর্কির হাতে, আফগানের হাতে
পারস্য বারবার দলিত হয়েছে, তবু তার প্রাণশক্তি প্রকাশের পথ থেকে পারস্য কখনও দূরে সরে
যায়নি। রবীন্দ্রনাথের ধারণা- আকেমেনীয়, সাসানীয়, সাফাবি রাজাদের হাতে পারস্যের সর্বাঙ্গীন
ঐক্য দৃঢ় হওয়ার ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে। পারস্যের সভ্যতার মধ্যে তার ভেদবুদ্ধির ছিদ্র
নেই। সমস্ত জাতিকে আশ্রয় করে পারস্যে যে ভাষা ও সাহিত্য বহমান তারই ধারাবাহিকতা পারস্যকে
বাঁচিয়ে রেখেছে। পারস্য নতুনকে গ্রহণ করেছে অকুণ্ঠচিত্তে কিন্তু এর জন্য নিজেকে তার
কিছু বর্জন করতে হয়নি। রবীন্দ্রনাথ যখন পারস্য ভ্রমণে যান তখন পারস্যর রাজা ছিলেন রেজা
শাহ। তাঁর শাসনব্যবস্থার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে রেজা
শাহর সময় থেকে আধুনিক পারস্যের সূচনা।
১৭ এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ শেখ সাদির সমাধি দর্শনে গিয়েছিলেন ।
কবির সমাধি প্রাঙ্গণে শিরাজের গভর্নর রবীন্দ্রনাথের অভ্যর্থনার আয়োজন
করেছিলেন। সাদির সমাধি দর্শনের আগে তাঁকে সেখানকার চেম্বার অফ কমার্সেও যেতে হয়েছিল।
কেননা সেখানকার ব্যবসায়- ব্যাণিজ্য বিষয়ে কবির কৌতূহল ছিল প্রচুর। সাদির সমাধির স্থাপত্যকলা
কবিকে মুগ্ধ করতে পারেনি। এই সাধক কবির আমলের গুণপনা কিছুই নেই, যা কিছু আছে আধুনিককালের
মতো। ফুল দিয়ে প্রদীপ দিয়ে কবির কবরস্থান সাজানো, প্রাচীর ও প্রাঙ্গণজুড়ে কার্পেট দিয়ে
সাজানো।
বোধকরি কবির পারস্য ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিল হাফিজ। জোড়াসাঁকোর
ঠাকুর পরিবারটির সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটেছিল পারসিয়ানা ছাদে, আর মনের বিকাশ ঘটেছিল পারস্যের
মরমী কবিদের কব্যপাঠের মাধ্যমে। বিশেষ করে কবিপিতার হাফিজমুগ্ধতা ছিল তার উপনিষদ সাধনার
মতো সত্য। কবি পারস্য থেকে ফিরে এসে বিচিত্রা‘য়’ (আশ্বিন ১৩৩৯) যে ভ্রমণ বৃত্তান্ত
লেখেন তাতে তাঁর প্রমাণ আছে। কবি হাফিজের সমাধিতে এসে সত্যি আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। কবির
কথায়, ‘তখন আমি বালক। যে পারস্য ভাবরসের পারস্য, কবির পারস্য। তার ভাষা যদিও পারসিক,
তার বাণী সকল মানুষের। আমার পিতা ছিলেন হাফজের অনুরাগী ভক্ত। তাঁর মুখ থেকে হাফিজের
কবিতার আবৃত্তি ও তার অনুবাদ অনেক শুনেছি। সেই কবিতার মাধুর্য দিয়ে পারস্যের হৃদয় আমাদের
হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল। আজ পারস্যের রাজা আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন, সেই সঙ্গে সেই কবিদের
আমন্ত্রণও মিলিত। আমি তাঁদের উদ্দেশে আমার সকৃতজ্ঞ অভিবাদন অর্পণ করতে চাই যাদের কাব্যসুধা
জীবন্তকাল পর্যন্ত আমার পিতাকে এত সান্ত্বনা এত আনন্দ দিয়েছে।’ মৈত্রেয়ী দেবী কলেছেন,
মহর্ষি দেবন্দ্রনাথ কবি হাফিজের ভক্ত ছিলেন-সুফী কবিদের গান ভালবাসতেন-হাফিজের কাব্যরস
তার জীবনের মূল রস সিঞ্চন করতেন।
হাফিজের সমাধিতে এসে কবির মনের যে দশা হয়েছিল তার বর্ণনা দেয়া যাক, অবশেষে
হাফেজের সমাধি দেখতে বেরুলুম। নতুন রাজার আমলে এই সমাধির সংস্কার চলছে। পুরানো কবরের
উপরে আধুনিক কারখানায় ঢালাই করা জালির কাজের একটা মণ্ডপ তুলে দেওয়া হয়েছে। হাফেজের
কাব্যের সঙ্গে এটা একেবারেই খাপ খায় না। লোহার বেড়ায় ঘেরা কবি আমাকে মনে হলো যেন আমদের
পুলিশ অর্ডিনান্সের কয়েদী। ভিতরে গিয়ে বসলুম। সমাধিরক্ষক একখানি বড়ো চৌকো আকারের বই
এনে উপস্থিত করলো। সেখানি হফেজের কাব্যগ্রন্থ। সাধারণের বিশ্বাস এই যে, কোন একটা বিশেষ
ইচ্ছা মনে নিয়ে চোখ বুজে এই গ্রন্থ খুল্লে যে কবিতাটি বের করবে তার থেকে ইচ্ছার সাফল্য
নির্ণয় হবে। তাই মনে মনে ইচ্ছা করলুম ধর্ম নামধারী অজ্ঞতার প্রাণান্তিক ফাঁস থেকে ভারতবর্ষ
যেন মুক্তি পায়।
যে পাতা বেরুল তার কবিতাকে দুই ভাগ করা যায়। ইরানী ও কয়জনে মিলে যে তর্জমা
করেছেন তাই গ্রহণ করা গেল। প্রথম অংশের প্রথম শ্লোকটি মাত্র দিই। কবিতাটিকে রূপকভাবে
ধরা হয়, কিন্তু সরল অর্থ ধরলে সুন্দরী প্রেয়সীই কাব্যের উদ্দিষ্ট।
প্রথম অংশ। মুকুটধরী রাজারা তোমার মনোমহন চক্ষুর দাস, তোমার কণ্ঠ থেকে
যে সুধা নিঃসৃত হয় জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানেরা তার দ্বারা অভিভূত। দ্বিতীয় অংশ। স্বর্গদ্বার
যাবে খুলে, আর সেই সঙ্গে খুলবে আমাদের সমস্ত জটিল ব্যাপারের গ্রন্থি, এ ও কি হবে সম্ভব।
অহংকৃত ধার্মিক নামধারীদের জন্য যদি তা বন্ধই থাকে তবে ভরসা রেখো মনে ঈশ্বরের নিমিত্তে
তাই খুলে যাবে।
‘বন্ধুরা প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরের সংগতি দেখে বিস্মিত হলেন।’
কবিপিতার মানসপুরুষ হাফিজ কবিকেও ভক্তি ও ভাবে অবিভূত করেছিল। এই মহান
কবির সঙ্গে নিজের মানসিক সাযুজ্য অনুভব করেছিলেন। অধ্যাত্ম ও মানবিক বোধের সঙ্গে কবি
ঐক্যবোধ করেছিলেন। কবি সেই মুগ্ধতার বর্ণনা দিয়েছেন-এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে
একটা চমক এসে পৌঁছাল, এখানকার এই শান্ত প্রভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের বসন্তদিন থেকে
কবির হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত। মনে হল আমারা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা
রসের অনেক পেয়ালা ভর্তি করেছি। আমিও তা কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধর্মিকদের কুটিল ভ্রুকুটি।
তাদের বচন জালে আমাদের বাধতে পারিনি, আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধ প্রবাহের আনন্দের
হাওয়া। নিশিতে মনে হল আজ শত শত বৎসর পরে জীবন মৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে
এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।’
হাফিজের সমাধিতে এসে কবির মন ভালোলাগার তৃপ্তিতে ভরপুর হয়ে উঠেছিল। নিজের
শৈশব, পিতৃলোব আর দর্শনের ভুবনের নির্মাতার উদ্ভব মৃত্তিকার সঙ্গে এখানে ক্রমে তার
সাক্ষাৎ ঘটেছিল।
রবীন্দ্রনাথের এই যাত্রার বড় পাওনা স্বাজাত্যবোধের উদ্বোধন। সেই স্বজাত্যবোধের
সূতিকাগার কোনো সঙ্কীর্ণজাতি-স্বার্থের নিগড়ে বন্দি নয়। এই স্বাজাত্যবোধের অর্থ কোনো
জাতিসত্তার ওপরে নিজেদের অতীত অজ্ঞতাকে তুলে ধরা নয়। বরং এর মাধ্যমে তৎকালীন পৃথিবীর
জাতি-গোষ্ঠীর বর্বরতা থেকে মানুষকে রাহুমুক্ত করা। জীবনারম্ভের সূচনা-পর্ব থেকেই রবীন্দ্রনাথ
ছিলেন আলোকিত মানুষ। পারিবারিক পরিবেশ এবং বিশ্ব প্রাকৃতিক পরিবেশের পাঠশালা তাঁকে
একজন ইতিবাচক বোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছিল। যেমনটি ঘটেছিল এশিয়ার আর সব মহা
মানবদের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, একদিন এশিয়া ছিল জ্ঞান বিজ্ঞান এবং
মহামানবদের লীলাভূমি অথচ সেই এশিয়া আজ জ্ঞানশূন্য মহামানবশূন্য। কিন্তু এই জ্ঞান আজ
এশিয়াকে ত্যাগ করে ইউরোপে ভর করেছে। তবে এশিয়া যে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছিল দুনিয়াব্যাপী,
পৃথিবীকে তার স্থানে টিকিয়ে রাখার জন্য সেই জ্ঞানের চর্চা পুনরায় শুরু করা জরুরি হয়ে
পড়ছে বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন। মানুষের পৃথিবী কেবল বস্তুর সাধনা দিয়ে টিকে থাকতে
পারে না। ভাবের সাধনাও মানুষের জন্য জরুরি। এশিয়ার ভাববাদী দর্শনের প্রতি কবির ভালোবাসা
থাকলেও য়ুরোপের বস্তুবাদী সাধনার প্রতি কবির কোনো অশ্রদ্ধা ছিল না। কিন্তু কবির কাছে
তা মনে হয়েছে অসম্পূর্ণ। একটিকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে অন্যটি দ্বারা মানব জীবনের সিদ্ধিলাভ
করা সম্ভব নয়। কবি বলছেন, ‘এ যুগে য়ুরোপ সত্যের একটি বিশেষ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছে।
সেই সাধার ফল সকল কালের সকল মানুষের জন্যই, তাঁকে যে না গ্রহণ করবে সে নিজেকে বঞ্চিত
করবে।’ কিন্তু য়ুরোপ তার বাইরের দিকটি রক্ষা করতে যেয়ে ভিতরের দিকটি বেমালুম ভুলে বসে
আছে। ফলে মানুষে মানুষে জাতিতে জাতিতে তার যে আন্তঃসম্পর্ক সে দিকে তার কোনো ভ্রক্ষেপ
নেই। জোরেশোরে আবিষ্কার করে চলেছে মানুষ মারার কৌশল। এ থেকে বাঁচতে এশিয়ার দিকে ফিরে
আসা ছাড়া কবি আর কোনো গত্যন্তর দেখেননি। একদিন এশিয়াই জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল
পৃথিবীতে। কিন্তু কবি শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন এই ভেবে যে যুরোপের সংঘাতটি এশিয়ার শীতল
রক্তের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল দুষ্টক্ষতের মতো। কবি আসলে সতর্ক করে দিতে চান যে, এশিয়া যেন
য়ুরোপের পশু শক্তিকে নতুন যুগের দাবি বলে ভুল করে না থাকে। কবির কথা, ‘এশিয়া যদি নতুন
যুগে এসেই থাকে তবে এশিয়া তাকে নতুন করে আপন ভাষা দিক। তা না করে য়ুরোপের পশু গর্জনের
অনুকরণই যদি সে করে সেটা সিংহনাদ হলেও তার হার।’ এশিয়া কেবল এশিয়ার জন্য জেগে উঠবে
এটি কবির কাম্য নয়। কবির বিশ্বাস এশিয়া যদি সম্পূর্ণ জাগতে না পারে তা হলে য়ুরোপের
পরিত্রাণ নেই। এশিয়ার দুর্বলতার মধ্যেই এশিয়ার মৃত্যুবান।
৮ মে কবি এখানে এক জনসভায় বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতার মধ্যে ধরা পরেছে
বৃদ্ধ কবির এশিয়া উত্থানের স্বপ্নময় বাণী। পারস্য গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় এই অংশটুকু
মুদ্রণ থেকে বাদ দেয়া হয়। আমাদের ঠিক জানা নেই রবীন্দ্রনাথ কেন এই অংশটুকু গ্রন্থকারে
সংরক্ষণ করেননি। তাহলে কি এশিয়াকরণের যে স্বপ্নটি কবির মনের উপ্ত হয়ে ছিল সেটিকে সেদিন
তার কেবল স্বপ্নই মনে হয়েছিল? সেই উচ্চাভিলাষী স্বপ্নকে তিনি হয়তো গ্রন্থের প্রামাণিকতা
থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলে। তবু কবির সেদিনের বক্তৃতার এই অংশটি উদ্ধৃত করা প্রয়োজন
মনে করছি: ‘এশিয়াকে আজ ভার নিতে হবে মানুষের মধ্যে এই দেবত্বকে সম্পূর্ণ করে তুলতে,
কর্মশক্তি এবং ধর্মশক্তিকে এক করে দিয়ে। অতীতকালে একদা এশিয়ায় সৃষ্টির যুগপ্রবণ শক্তিতে
দেখা দিয়েছিল। তখন পারস্য ভারত চীন নিজ নিজ জ্যোতিতে দীপ্যমান হয়ে একটি সম্মিলিত মহাদেশীয়
সভ্যতার বিস্তার করেছিল। তখন এশিয়ায় মহতী বাণীর উদ্ভব হয়েছিল এবং মহতী কীর্তির। তখন
মাঝে মাঝে এশিয়ার চিত্তে যেন কোটালের বান ডেকে এসেছে, তখন তার বিদ্যার ঐশ্বর্য বহু
বাধা অতিক্রম করে বহুকাল ধরে বহুদেশে পরিব্যাপ্ত হয়েছে।
তার পর এসেছে দুর্দিন, ঐশ্বর্য বিনিময়ের বাণিজ্য পথ ক্রমে লুপ্ত হয়ে এল।
যুদ্ধে দুর্ভিক্ষে বিশ্বনাশা বর্বরতার নিষ্ঠুর অক্রমণে এশিয়ার মহাদেশীয় বন্ধন ছিন্নভিন্ন
হয়ে গেল। তার পর আর এশিয়াকে মানবিক মহাদেশ বলতে পারি নে- আজ এ কেবল ভৌগোলিক মহাদেশ।’
রবীন্দ্রনাথ যে ভারতবর্ষে জন্মেছিলেন পারস্যের মতো সে ভারতেরও গ্রহণ করবার
ক্ষমতা ছিল ইতিহাসের কাল থেকে স্বীকৃত। আর্যরা নিজেদের ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে এসে কিছু
অংশ পারস্যে থেকে গিয়েছিল। আর কিছু অংশ চলে এসেছিল ভারতবর্ষে। ভক্তির ভারতবর্ষ ও পারস্য
জ্ঞানের এবং যুক্তির যোগ ঘটাতে তাদের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। আর্যদের পথ অনুসরণ করে
পারস্য এবং ভারতবর্ষে বাইরে থেকে কত মানুষ রাজন্য রাজবংশ এবং ধর্ম এসে এ দেশে তার জায়গা
করে নিয়েছে। যেমন ইসলামের প্রায় প্রথম যুগেই পারস্যে ইসলাম তার বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী
নিয়ে এসেছিল। খুব অল্প দিনের মধ্যেই পারস্য ইসলামের বাণী তার মর্মে গ্রহণ করল। কিন্তু
পারস্য ইসলামের আরবী রূপকে দিল পাল্টে। সে ইসলামকে গড়ে তুলল পারসিয়ানা ছাঁদে। তাকে
নতুন করে ভাষা দিল। এমনকি ইসলামের মর্মমূলে পৌঁছে দিল সর্ব মানববাদ সুফিজমের প্রভাব।
ইসলাম এখানে এসে হারিয়ে ফেলল কিছুটা তার যুদ্ধংদেহী মনোভাব। ‘আরব পারস্যকে ধর্ম দিয়েছে,
কিন্তু পারস্য আরবকে দিয়েছে নানা বিদ্যা এবং শিল্পসম্মত সভ্যতা। ইসলামকে পারস্য ঐশ্বর্যশালী
করে তুলেছে’। মূলত পারস্য থেকে ইসলাম ভারতবর্ষে জায়গা করে নেয়। এ ধর্মকে মেনে নিতে
ভারতবর্ষের তৎকালে খুব একটা কষ্ট হয়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন পারস্য ভ্রমণে যান তখন
আর ভারতের সেই সর্বংসহা গৌরবময় রূপের অবশিষ্ট ছিল না। ইংরেজ কূটচাল তা নষ্ট করে দিয়ে
গেছে। এই সব অভিঘাত পারস্যের জীবনের মধ্যেও এসেছে কিন্তু পারস্য তার গৌরবজনক রূপকে
কখনও অপমানিত হতে দেয়নি। রবীন্দ্রনাথ পারস্যে এসে এই সত্যটি আবার দেখে অভিভূত হয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, পারস্য ধর্মকে কেবল তার বাইরের ব্যাপার করে তোলেনি। পারস্যের ধর্ম
তার অন্তরের বিকাশ। কেবল ধর্মের অক্ষর অনুসরণ পারস্যের ধাতে নেই। পারস্য ইসলামকেও বানিয়ে
নিয়েছিল ব্যক্তির বিকাশ এবং সমর্পণের আশ্রয় হিসেবে। তাই সুফিবাদের বিকাশ আমিত্বের উদ্বোধন
এবং সর্বেশ্বরে বিশ্বাস পারস্যের হৃদয়ে গ্রথিত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি পরমত সহিষ্ণুতা পরাকাষ্ঠা
না থাকলে ইসলামের সেই প্রবল পরাক্রান্ত যুগে বাহাই ধর্মের বিকাশ ঘটতে পারতো না পারস্যে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দুঃখের অন্ত ছিল না ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের পীড়নে।
হিন্দু- মুসলমান এখানে কেউ কম যায় না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে এ কথা
লিখেছিলেন।
এক সময়ে পারস্যের প্রধান উপাস্যের নাম ছিল আহুরমাজদা। যিনি তার উপাসকদের
কাছে থেকে চেয়েছিলেন সাধু চিন্তা সাধু বাক্য ও সাধু কর্ম। তখনকার কালের সেমেটিক জাতির
যুদ্ধে দয়াধর্ম ছিল না। দেশজোড়া হত্যা লুণ্ঠন বিধ্বংসন বন্ধন নির্বাসন এই ছিল রীতি।
কিন্তু খোরাস ও তার পরবর্তী সম্রাটদের রাষ্ট্রনীতি ছিল তার বিপরীত। তাঁরা বিজিত দেশে
ন্যায়বিচার, সুব্যবস্থা ও শান্তি স্থাপন করে তাকে সুসংহত করেছেন।
কবি ১১ এপ্রিল তারিখে পারস্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন, ১৩ এপ্রিলে বুশরায়
পৌঁছেছিলেন আর পারস্যরাজের সঙ্গে কবির প্রথম সাক্ষাৎ হয় ২৯ এপ্রিল রাতে। রাজা রেজা
শাহ পাহলভির প্রতি কবির মুগ্ধতা ছিল আগে থেকেই। কবির মনে হয়েছিল এই রেজা শাহ নতুন যুগের
নতুন রাজা। কবি রেজা শাহ পাহলভিকে ভারতবর্ষে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রাজা
আসার ইচছাও ব্যক্ত করেছিলেন। এশিয়াকে জানার ইচ্ছা তাঁরও রয়েছে বলে উল্লেখ করেছিলেন।
রেজা শাহ কবিকে বলেছিলেন, ভারতবর্ষের সমস্যাটি অনেক জটিল, সে তুলনায় পারস্যের সমস্যা
অনেক সরল। ভারতের বিশালতা এবং প্রচুর লোকসংখ্যাই এর জন্য দায়ী, যারা বিভিন্নভাবে বিভক্ত।
দেশের প্রকাণ্ড আয়তনই যে দেশের প্রকাণ্ড শত্রু সে কথা বুঝতে কবির কষ্ট হয়নি।
0 মন্তব্যসমূহ