করোনাকাল ও সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং
পৃথিবীটা বড্ড চট করে সাদা- কালোয়, আলো-আঁধারে, আমরা-ওরায় ভাগ হয়ে যেতে
চায়। হয়ে গেলে সুবিধা, একপক্ষ অন্যপক্ষকে শত্রুক্ষেত্রে দাঁড় করাতে পারে... গোলা গুলি
ছুঁড়তে পারে, তৈরি হয় স্যোশাল ডিসট্যান্সিং। এই করোনার করুণাঘন দিনে যেটা মূল মন্ত্র
হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ পর্যন্ত পড়ে প্রলাপ ভেবে পরের অংশ পড়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলা অমূলক নয়।
কারণ, করোনায় তিন মিটারের দূরত্ব রাখলেই যথাযথ, কে কার থেকে রাখল, সেটা গৌণ। অর্থাৎ
ব্যক্তি নিরপেক্ষ, সুতরাং আমরা-ওরা কাহিনি এনে ফেলা নেহাৎই মস্তিষ্কের খইভাজা হেতু।
কিন্তু কথাটা যদি সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং হয়, তবে ব্যাখ্যার মাত্রায় ভিন্নতা
থাকতে পারে, কিন্তু বিষয়টি আবহমানের। কেমন?
ধরুণ,
১) স্থান, প্রাচীন অবন্তী,
কাল, আনুমানিক পাঁচশ' খ্রীস্টাব্দ
এক মণিকার শিরোভূষণ বানিয়ে এনেছে, ভগবান নারায়নের মাথায় পরাবে বলে। পুরোহিত
তাকে নির্দেশ দেন, সে গহনা মন্দির চত্বরে রেখে স্থানত্যাগ করুক। শূদ্রের স্পর্শদোষ
কাটিয়ে পুরোহিত দেবতার মাথায় পরিয়ে দেবেন। সেই মণিকারের অধিকার নেই মন্দিরে প্রবেশের
বা দেবতাকে স্পর্শ করার। পুরোহিত আর মণিকারের অবস্থানের দূরত্ব কতটা?
২) স্থান, কলকাতা
কালঃ একুশ শতক।
রাজপথে নেতার গাড়ি যাচ্ছে, দড়ি দিয়ে আম জনতাকে আটকে দূরত্ব রাখা হয়েছে
নেতার নিরাপত্তার স্বার্থে। নেতার সাথে আম জনতার দূরত্ব কতটা?
৩) স্থানঃ দিল্লী, ভারত
কালঃ করোনাকাল
দিল্লীর বাস টার্মিনাসে অসংখ্য মানুষের ভিড়। তারা "পরিযায়ী শ্রমিক।"
লকডাউন ঘোষণায় বিপর্যস্ত, বাড়ি ফেরার আবেগে আকুল। পরিবহন নেই। খর রোদে সামান্য সম্বল
পোঁটলায় বেঁধে ঘুমন্ত সন্তানকে পিঠে নিয়ে হাঁটে.... ক্ষুধার মিছিলে হাঁটে। খবর হয়।
প্রশাসন বাসের ব্যবস্থা করে, প্রয়োজনের তুলনায় নামমাত্র। হাঁটা থামায় না তারা। আসলে
এই ক্ষুধার পথ এক সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং তৈরি করে দেয় যারা গৃহবন্দীত্বের বিলাসিতা মেনে
নিতে পারছে তাদের সঙ্গে। ক্ষুধার পথ চিরকালই এই সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং তৈরি করেছে, হালফিলে
যার নাম, জামলো মাকদম।
৩) স্থানঃ কোটা, ভারত
কালঃ করোনাকাল
সর্বভারতীয় ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষায় সাফল্যের জন্য বিশেষ শিক্ষা
নিতে যাওয়া ছাত্রছাত্রীরা লকডাউনের মাঝপথে বাড়ি ফিরতে চাইলে বিশেষ বাসের ব্যবস্থা হয়।
ছাত্রছাত্রীরা আমার সন্তানতুল্য। তাদের জন্য বাসের ব্যবস্থা করা ন্যায্য ও জরুরি। ততটাই
ন্যায্য ও জরুরি ছিল না কি, লঙ্কা শ্রমিক জামলো মাকদমের বাড়ি ফেরা নিশ্চিত করা? তাহলে
হয়ত মৃত্যুর আরেক নাম জামলো মাকদম হত না। জামলোর বয়স বারো বছর। বারোর জামলো, আর আঠারোর
বিবেক, সুরেশ, অনীতাদের সামাজিক দূরত্ব ক' যোজন?
৪) স্থানঃ উত্তরপ্রদেশ, ভারত
কালঃ করোনাকাল
পরিযায়ী শ্রমিকেরা রাজ্যে ঢুকলে ক্লোরিনজল দিয়ে জীবানুমুক্ত করার কর্মসূচি
চলে। হা ক্লান্ত শ্রমিকেরা সন্তানের চোখ হাত দিয়ে চেপে ধারাশুদ্ধ হয়। পরিযায়ী শ্রমিকদের
আসবাবের মত শুদ্ধিকরণ করা যায়, এটা ভাবেন যারা, তাদের সঙ্গে শ্রমিকদের ভাবনার দূরত্বের
মাপকে কি সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বলা যায়?
৫) আটকে পড়া শ্রমিকদের খাবার সরবরাহ করার জন্য সরকারী app তৈরি হয়েছে।
সেখানে নিজের নাম ঠিকানা নিজে নিজে ভরতে পারবেন ক'জন শ্রমিক? যদি না পারেন, তাহলে যারা
পারেন তাদের থেকে সেই শ্রমিকের ক্ষুন্নিবৃত্তির দূরত্ব কত আলোকবর্ষ? কেন?
ঘটনাক্রম আর দীর্ঘায়িত করলে ধৈর্যচ্যুতি অনিবার্য। মোটের উপর যে কথাটা
উপরের ঘটনাক্রমে ফুটে বেরোচ্ছে, সেটা একটা "সাদা-কালো" "আমরা-ওরা"
অবস্থান। এই সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং আবহমানের। কালের চক্রে কখনও কখনও সাময়িক মুছে গেছে
বা মুছে যাবার স্বপ্ন দেখেছে। এখন সেই স্বপ্নের তলানি কতটা আছে আর?
তাই, আমার বক্তব্য করোনাকালের আপ্তবাক্য "সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং"
নতুন প্রয়োগ মাত্র শারীরিক দূরত্ব নির্ণায়ক মাপকাঠি হিসাবে। কিন্তু মানুষের নিজস্ব
অবস্থানের প্রেক্ষিতে অপর অবস্থানকে দেখবার দৃষ্টিভঙ্গীতে এ দূরত্ব আবহমানের।
এই করোনাকালে দীর্ঘ লকডাউন এই সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং রাখারই কারণে। রোগ
যাতে তার তীক্ষ্ণ দাঁত নখে ফালা ফালা না করে দিতে পারে জনতাকে। রোগ থাবা না বসালেও
দীর্ঘ ডানার চিল আস্তে আস্তে নেমে আসছে তার ডানায় ক্ষুধার ধূসরতা নিয়ে। কর্মহীন মানুষের
কেউ কেউ সরকারি সাহায্যে কোনওমতে বেঁচে আছেন, কেউ কেউ শূন্য হাতে মুখ ঢেকে চুপি চুপি
রাস্তায় নেমেছেন। ভিক্ষায়। যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, তারা বেঁচে যাবেন হয়ত, রোগের
থেকে, ক্ষুধার থেকে। যাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই, তারা রোগ, ক্ষুধা এড়িয়ে বাঁচবেন তো?
এই বাঁচামরার হিসাবেও আশ্চর্য সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং।
আজ মে দিবসে মনে পড়ল।
০১/০৫/২০২০