সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

তামিমৌ ত্রমি


এই চিত তোর 



আমি আর সানগ্লাস। উদয়পুর থেকে যতবার যেদিকে চার চোখ ছুঁড়ে দিই,  সেই একই সবুজের দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ। সেই
সবুজ পাহাড়, আর দূরের ধূসর পেনসিল  পাহাড়। তার চেয়ে একটু দূরে আর উপরে বর্ষার আয়নাজল আকাশ। তার
 দিকে চোখ রাখলেই বুকের লুকোন পাপগুলো ছাঁত করে ওঠে। তার চেয়ে সামনের দিকে চোখ রাখা ভাল। তিন ঘন্টা চলার পর  একটি রোডসাইড হোটেল থেকে চা খেয়ে সোজা চিতোর গড়ের দোরগোড়ায়। ড্রাইভার বলেছিল, গাইড লাগবে। নইলে কুলোবে না।  সুতরাং গাইড নেওয়া হল। অবশ্য ততক্ষণে আমরা চিতোরের প্রবেশপথ পার হয়ে কয়েক পাক ঢাল বেয়ে উঠে গেছি। এবার গাইডকে গাড়িতে তুলে ড্রাইভার ইঞ্জিনে স্টার্ট দিল। সোনালী গেরুয়া বা আগেকার দিনে বাবার মুখে শুনেছিলাম, গ্যাবা কালার। সেই হলদেটে প্রাচীরবেষ্টিত তুলোট ইতিহাস চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে।চীনের প্রাচীর। কুম্ভল্ গড় ; যেখানে রাণা প্রতাপ জন্মেছিলেন। অতঃপর চিতোর। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম প্রাচীর অজগরের মতো আমাদের পাশে পাশে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে। প্রথমে কুম্ভপ্যালেসে  আমরা নামলাম না। সে সন্ধ্যায় লাইট এন্ড সাউন্ডে সাজুগুজু করে মুখ দেখায়। তাই আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আমরা  পা রাখলাম মীরার মন্দির আর কুম্ভ শ্যাম মন্দির - চত্বরে। ষোড়শ শতাব্দীতে রাণা কুম্ভ নির্মিত মীরা মন্দির। গিরিধারী নাগরের পদতলে বসে আছেন শ্বেতবসনা আত্মমগ্না চিতোর – কন্যা মীরা। চিরতরে বিলীন হয়ে আছেন কৃষ্ণপ্রেমে। তাঁকে কেউ বিষ দিতে গিয়েছিল বুঝি, সে বিষ অমৃত হয়ে গেছিল। ভক্তি নিষ্ঠা লৌকিকতার ও অনন্য স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে এ মন্দির প্রাংগন যেন অবনীতে অমর্ত্য।  বিদ্যাধর বিদ্যাধরীদের কেউ গাইছেন, কেউ পাখোয়াজ বাজাতে বাজাতে নৃত্য করছেন।


 কেউ মালা হাতে দাঁড়িয়ে। তাদের পাথুরে শরীরে এঅনশ্বর প্রাণ যারা ঢেলে দিয়েছেন, সেই মহাপ্রাণদের শতকোটি প্রণাম।কিন্তু অমর্ত্যলোক কতখানি অমর্ত্য? সেখানেও দেবাসুরের নিত্য যুদ্ধ আর ক্ষমতা ও নারীদখলের হিংস্রতা। ১৩০৩, দিল্লীর সুলতান  আলাউদ্দিন খলজী   চিতোরের শেষ গুহিলা শাসক ( এরপরেই শুরু হয় সিসোদিয়াদের রাজত্ব, মহারাণা উদয় সিং ও তাঁর পুত্র মহারাণা প্রতাপ যে বংশোদ্ভূত)  রাওয়াল রতন সিং এর অপরূপা মহিষী রাণী পদ্মাবতীকে পাবার জন্যে আকুল হয়ে চিতোর আক্রমণ করেন।রাওয়াল রতন সিং যুদ্ধক্ষেত্রেই শহীদ হলেন। বীরাংনা রাণী পদ্মাবতী প্রায় আঠেরো হাজার রাজপুত রমণীদের নিয়ে সতীত্ব রক্ষায় অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। এই যে অচিনপাখিকে খাঁচার ভিতর পেয়েও না পাওয়া, এই যে হাতকে ফাঁকি দিয়ে বালির গলে যাওয়া - এই না পাওয়ারই হিংস্র ও নির্লজ্জ নিদর্শন চিতোরের প্রতিটি ধূলিকণায়; প্রতিটি মূর্তির গায়ে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নির্বিচারে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে অস্ত্র। বেশিরভাগ মূর্তিরই মুখ বিকৃত।নারীদের অধিকাংশেরই বুক শ্রোণী বীভতসভাবে খন্ডিত। মন্দিরের একেবারে চূড়ায় এককোণে কোনমতে লুকিয়ে থাকা দু একটি ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতী' রপ্রায় অক্ষত অস্তিত্ব দেখে আমরা তাদের নন্দন - আত্মার উঁকি ঝুঁকি দেখতে পাই।


 তাও তো ভাগ্য যে, এই মন্দিরগুলোর চূড়া অব্দি অক্ষত আছে। ইন্দো - আর্য ধারায় গঠিত এই মন্দিরগুলো সামনে সোমনাথ আর পিছনে জগন্নাথ মন্দিরের সং যুক্ত আদলে গঠিত। গাইডের দাবি, এই চিতোরের মন্দিরগুলোই নাকি সোমনাথ আর জগন্নাথ মন্দিরের স্থাপত্য রীতির অনুপ্রেরণা। কিন্তু এই মন্দির প্রাংগনের বাইরে গোটা চিতোর গড় জুড়ে যে অসংখ্য মন্দির ছড়ানো ছিটোন রয়েছে, তাদের মুন্ডু যেন তরবারির এক কোপে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে ক্ষত বিক্ষত ধড় থেকে। চারদিকে নারকীয় হত্যালীলা।তবু সুন্দর জেগে থাকে।যেমন এই মুহুর্তে আমাদের সামনে জেগে উঠেছে সর্বেশ্বর মন্দির। এরও মাথাভাংগা - তবু এর শরীরে যে  নশোবছরের চিন্ময়ী মায়া,  তা থেকে চোখ ফেরানো যায় না। কিন্তু বাকি ছিল বিস্ময়! বিন্দুমাত্র ভক্তিবর্জিতা সাক্ষাৎ অধার্মিক আমি গর্ভগৃহে চোখ রেখে ওখানেই গেঁথে গেলাম। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের তিন বিশালাকৃতি মুখ পাশাপাশি, ফণীগণ তিনজনেরই অংগস্পর্শ করে আছে ভেবে বড় ধন্দে পড়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছে চেনা তিন মূর্তি তবু যেন চেনা দেয় না। পুজারী জিসমাধান বাতলে দিলেন। আসলে সর্বেশ্বর হলেন শিব,  তিনিই ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর হিসেবে লীলা করে চলেছেন। তাই সবারই এমন যোগী যোগী ভাব। জানার পর আবার দাঁড়ালুম তাদের সামনে। এখন চোখে পড়ল ব্রহ্মার মুখের নীচে একটি কমল। তার গোটা মুখে চোখে সৃজনের আনন্দ - বিভা ছড়ানো। বিষ্ণুর চিরধাতা প্রসন্নভাব আর রুদ্ররুপী মহেশ্বরের ঈষৎ বেরিয়ে থাকা জিভ ( কালীর মতো অতটা নয় যদিও) যেন তার ঐটুকু অংশ দিয়েই লেহন- লীলায় নিশ্চিহ্ন করে দেবে এই জগত।সর্বেশ্বরের মন্দির থেকে বেরিয়ে তার অনন্য কারুকাজের পরিক্রমা সেরে এবার গেলামরাজপুত রমণীদের স্নান কুন্ড দেখতে।  গেলাম মানেই তো যাওয়া নয়।  পথে পড়ল অজস্র মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ,  উদ্যান,   একদিকে রাজা ও রাজবংশের লোকদের গড়ে  ঢোকার খাস দরজা,  তার উলটো দিকে জনসাধারণদের যাতায়াত করার আম দরজা। মোরিয় রাজা চিত্রাংদ মৌর্য বা মোরি' র ( ভারত শাসনকারী মৌর্যবংশীয় নয়, স্থানীয় মৌর্য) নির্মিত চিত্রকূট বা চিতোর দুর্গের যেন কোন শেষ নেই।  আর আগেও বলেছি, স্থাপত্য শৈলীগুলো বাদ দিলে বাকি যে জমি ইতস্ততঃ ছড়ানো ছিটোন ছিল, তাতে মন কাড়া উদ্যান।  সেই উদ্যানের শোভা দেখতে দেখতেই  গাইডের মুখে শুনলাম, এই উদ্যানগুলো ছিল সব খাড্ডা। এই সব জায়গায় গর্ত  খুঁড়ে রাখা হোত জওহর ব্রত পালনের জন্য। যখন শেষের সেদিন আসত, সেই গর্তগুলো অগ্নিকুন্ডে পরিণত হোত। রাণী ও রাজপুত রমণী স্নান কুন্ডে স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে সেখান থেকে আগুনে ঝাঁপ দিতেন। শুধু তো ১৩০৩, নয়, ৭৩৪ সালে প্রথম গুহিলা রাজা বাপ্পা রাওয়াল যখন চিতোর জয় করেছিলেন,  তখনও,   আবার ১৫০০ সালে যখন গুজরাটের শাসক বাহাদুর শাহ যখন চিতোর নিজের আয়ত্বে এনেছিলেন,  তখনো - তিন ঐতিহাসিক সময়ের তিন রাণী  তাদের হাজার হাজার মরণসংগিনীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আগ কা দরিয়ায়।এই খাড্ডাগুলো সরকার থেকে পরে উদ্যান করে দেওয়া হয়েছে, কারণ মেট্রোরেলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ার  মতো এই গর্তগুলোতেও আত্মহত্যাকামী মানুষরা রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে আগুন জ্বেলে জওহর পালন করত।এমনকী যে পথে এই মুহুর্তে  দাঁড়িয়ে আছি, সেসবও 'ওহি' ছিল।  ওইই।গল্প (?)শুনতে শুনতে উদ্যান - মগ্ন চোখদুটো জতুগৃহ হয়ে গেল। কত মানুষের ছাই মেখে কত যুগের ছাইয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছি ভস্মমাখা সর্বেশ্বর হয়ে। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা চেটে নিলাম।এই  তিনরাণীর ও রাজপুত রমণীর জওহরব্রত উদ্ যাপনের সম্মানে চিতোরে প্রতি বছর  মহোতসব পালিত হয়। মহোতসব।  হাসলাম। সবকিছুই মহোতসব সংসারে। পুড়ে মরার মহোতসব,  যেমন দেশভাগের মহোতসব।, যেমন ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার মহোতসব, যেমন কারবালায় তৃষ্ণায়  বুক ফেটে মরার মহোতসব,  অসুর মারার মহোতসব, এবারের ডিসেম্বরে কোথায় বেড়াতে যাব - ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যাই স্নান কুন্ডের দিকে।আড়াইশো সিঁড়ি বেয়ে তবে নামতে হয় ট্যাংকে।  পঞ্চাশ ফিট গভীর। টিয়ারং জল। এর উতসমুখ কেউ জানে না। শুধু জল পড়ে, ইতিহাসের পাতা নড়ে। সে জল আবার গরমে ঠান্ডা,  ঠান্ডায় গরম। সর্বশেষ শ্যাওলা পিছল সিঁড়িতে পা রাখতেই কলজেটা অব্দি ঠান্ডা হয়ে গেল। বর্ষাস্নাত রাজস্থান যাত্রায় এই প্রথম চিত্তোরে রোদ উঠল।  তারপর ঘোরাবেড়ানো। একস্রোতে সব গ্লানি মুছে গেল। সেই জলসিঁড়ি 'র প্রস্থটুকু পেরলেই দেখা যাবে একটি ছাউনি। তার তলায়  দুটি  পাথুরে গোমুখ  জলবমি  করছে। তাতেই ভরছে এই বিরাট বড় ট্যাংকের পেট। কিন্তু গোমুখে জল কি করে আসছে, তা কেউ জানে না ।  গোমুখ দুটোর উল্টোদিকে একটি বড়সড় বিষ্ণুর মূর্তি শোভা পাচ্ছে। একজন স্থানীয়া মহিলা অবলীলায় ওই জলে প্রায় ভাসতে ভাসতে পুন্যার্থীদের মাথায় টি দিয়ে যাচ্ছেন। উঠে  এলাম পায়ে পায়ে। জুতো পরলাম। ছবি তুললাম। নিজেদের।  নেপথ্যে সোনানীল আকাশ  সবুজাভ আরাবল্লী,  টিয়ারং ট্যাংক, আরো দূরে ব্যস্ত নগর জীবন। সামনে আমরা। অনন্তের অহমিকায় উদ্ভ্রান্ত দুটি বিন্দু।মহারাণা সংগা যুদ্ধ জয়ের পর তৈরি করিয়েছিলেন এই বিজয়স্তম্ভ। কুতুব মিনারের মতো কষ্ট জয়স্তম্ভ এখনো দিতে শুরু করে নি। বিজয়ের চূড়ায় পৌঁছানো যায় একটু ক্লেশ স্বীকার করে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠলেই।  এই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নাকি ক্রনিক পায়ের ব্যথাও সেরে যায়; এমনটিই জানালেন গাইড। কিন্তু সেই  পরীক্ষাটিও করতে রাজি না হওয়ার জন্য ঠাম্মা আর নাতি দুজনকেই গাড়িতে রেখে আসা হল। জুতো খুলে ভেতরে পা রাখতেই প্রত্নরত্নের খনি উজাড় হয়ে গেল সামনে। মূলত শংখ চক্র গদা পদ্মধারী বিষ্ণুর অবয়বেই স্তম্ভের আগা থেকে গোড়া খোদাই করা। তবে কর্তার ইচ্ছায়ইচ্ছামতী লক্ষ্মীও স্বমহিমায়  আছেন, বিশেষত রাজস্থানে দেখলাম গজলক্ষ্মীর প্রভাব খুব বেশি। উদয়পুরের সিটি প্যালেসে ঢুকতেও তাঁর দেখা পেয়েছিলাম।  এখানেও পেলাম। আর দেখা পেলাম শ্মশ্রুধারী হংস অলংকৃত ব্রহ্মার ।  বেশ অনেক বারই উঠতে নামতে দেখা হল তাঁর সাথে। শুনেছিলাম, পুষ্করেই একমাত্র ব্রহ্মার মন্দির আছে। আর এই চিতোরেও দেখলাম তাঁর প্রভাব।
নিজের মেয়ে স্বরস্বতীকে কামনা করেছিলেন, সেই অজাচারের অপরাধে তাঁর বন্দনীয় আসনটি হারালেন তিনি। কামদেবকে অভিশাপ দিলেন  ভস্ম হওয়ার। শিবের ক্রোধানলে সেই শাপ সত্যি করে মদন ভস্মীভূত হয়ে হলেন অতনু। অবশ্য তিনি ও স্ত্রী রতি যখন ভোলেবাবার পা ধরে কান্নাকাটি করলেন, তখন অবশ্য মদন অতনু থেকে আবার সুতনু হলেন, কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা নিজে থেকে গেলেন ব্রাত্য। আদমের হাড় থেকে জন্মেছিলেন ঈভ।  সেই ঈভের গর্ভেই আদম অংকুরিত করেছিলেন মানব সভ্যতার বীজ। সেদিনের সেই অজাচারগুলো না ঘটলে বোধহয়, কোনটা অজাচার আর কোনটা নয়, সে বিচার করার কালান্তরে মানুষ পৌঁছতো না।যাই হোক, হংসবাহনা বীণাবাদিনীর দেখাও পেলাম, যত উপরে ওঠা গেল। একেক সময় মোবাইলের টর্চলাইট জ্বালাতে হল, দু চারটে সিঁড়িএমন দুর্ভেদ্য অন্ধকারে।  তার মধ্যে আবার ওঠার সময়ে নামার আর নামার সময়ে ওঠার দলের প্রাদুর্ভাব আছে। রাস্তা কারোর একার নয়, সিঁড়িও নয়। একবার  বেহাত হলে বেশ কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তাছাড়া প্রতিটি তলাতেই একটা করে জানলা। সেই একের উপর এক জানলাতে চোখ রাখলেই বোঝা যায়, দ্যাখো আমি বাড়ছি মামি। অবশেষে এল জয়স্তভের এভারেস্ট।বড় বড় দরজা মাপের জানলা দিয়ে দেখা গেল সারি সারি খেলনা গাড়ি। পিঁপড়ে পিঁপড়ে মানুষ। কেমন যেন অতিমানব মনে হল নিজেদের। নেমে এলাম তড়িঘড়ি। বড্ড মানুষ হতে ইচ্ছে করছিল। তাই।

তামিমৌ ত্রমি  



তামিমৌ ত্রমি