জীবনের নানা পর্বে রাত নগ্নিকা সিটিং দিয়ে আসছে বরাবর। রাতকে কাছে পেয়েছি
ট্রেকিং এ গিয়ে বেশি। তবে বর্তমানে ঘুমকাতুরে হওয়ার চেষ্টা করি। এ যেন সেই
প্রেমের ন্যাগিং পর্ব।
চোদ্দ পনের বছর হবে শর্করা- শঙ্করার সঙ্গে ঘর করছি। নিজে শুতে পাই ছাই না পাই শঙ্করাকে ডাকি ছাই না ডাকি শর্করার সঙ্গে থাকতেই হবে। তাই রাত মানেই নিজেকে জোর করে ঘুম পাড়াবার পালা। মফস্বলী বহুফসলী রাত চোরের ভয়ে হ্যালোজেন জ্বেলে কাটায়। এই তো যাদবপুরে আমার এক ননদের বাড়িতে নেটলন কেটে এসির তার কেটে দিয়ে চোর কিছু হাতাতে চাইছিল। পারে নি। কিছুক্ষণ পরে সেই তারজাল বিদ্যুৎ পেয়ে দাউদাউ করে জ্বলছে। ঘুমন্ত ননদের মাথায় গায়ে আগুন ছিটকে লাগায় উঠে পড়ে সে এক হৈচৈ কান্ড। চারদিকে হ্যালোজেন। অমাবস্যা বলে পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আর পূর্ণিমা রাতে যেই লাইট নিভাই ঘরের অমনি জোছনাভূতের পান্ত ছানারা পশ্চিমের হাঁ বুক জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। প্রায়ই আমার স্বতঃসিদ্ধ স্বপ্নের শিশুরা স্বপ্নে খেলা করবে বলে আড়ি পেতে রাখে এইভাবে। স্বপ্নে কতো কতো রাত আমি অলৌকিক বালক বালিকাদের সঙ্গে খেলা করি। হাত ঘোরাই জোছনায়। চাদরে পড়ে ছায়া আদর। মোবাইল জ্বেলে যথাসাধ্য ভৌতিক ছবি তুলি। একজন হাউস ওয়াইফের ইন্সটাগ্রামে গিয়ে তারা ভৌতিক ছবি হয়। মোবাইলে নিঃশ্বব্দে ভেসে ওঠে মেসেজ মরা মাছের মতো। একটা সময়ের পর মোবাইল - তপস্বী মানুষেরা চুপ মেরে যায়। মেট্রো ট্রেন বন্ধ হয়ে গেছে কোন কালে। স্টেশন সংলগ্ন গাছগুলো ঘুমাবে এখন। ট্রেনলাইনের বাতিস্তম্ভ সুপারনোভা হয়ে দাঁড়িয়ে। এমনি এমনি কাউকে যদি বলতে যাই রেজিস্টার্ড পাগল বানিয়ে দেবে আমাকে। প্রায় রাতে প্রচুর হুড়ুম দুড়ুম শব্দ শুনি। কেউ যেন ভারি জলের ড্রাম গড়িয়ে নিয়ে চলেছে ছাতে। অথবা টেবিল চেয়ার কেউ দড়াম করে ফেলে দিল। অনেক বার মশারিতে মশা ঢুকবার ভয় জয় করে বাইরে বেরিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি কোত্থেকে শব্দ হয় এমন হাড় হিম করা? ভূত কিংবা ভগবান কোনোটাই বিশ্বাস করি না। পা টিপে টিপে ছাদে গিয়ে দেখেছি চরাচর শান্ত। তাহলে নিচের ফ্ল্যাটে কোথাও... উত্তর মেলে নি। আছে ঘ্যামা কুকুরদের একটানা চিৎকার। প্রথমে পাশের বাড়ির গোল্ডেন রিট্রিভারটি মৃদঙ্গের মন্দ্র আভাসে বেজে উঠবেন। তাকে অনুসরণ করে আশেপাশের আরো অনেকে গলা ছড়াবে। ক্রমশ দূরতর বেপাড়ার কুকুরেরা উপস্থিতি জানান দিতে থাকে। থামতেই চায় না। ভাবি কুকুররা থামলেই ঘুমিয়ে পড়ব। তার হয় না। ঘুম চটে যায়। একটা এরোপ্লেন উত্তর দিক থেকে পুবে চলে যায়। মনে পড়ে পুব আর ফুরায় না। তারপর শর্করা শংকরাকে তুষ্ট করতে জল খেতে উঠি। ছোট বাইরে করতে যাই। বাথরুমে পুরানো পত্রিকা পড়ে থাকে একটা দুটো। তাই কুড়িয়ে চোখ বোলাই। আরেঃ এই আচারমাখা খবরটা তো পড়া হয় নি! ঝিমুতে থাকা মুরগির ঢঙে নিজের সিকি পয়সার জীবনে আঙুল বুলিয়ে কতোটা খোটা হলাম বুঝে নেবার চেষ্টা করি। জীবনের গর্তগুলো ছাই দিয়ে বোজাব বলে খাতা কলম খুলে বসি। যে জীবন যাপন করা হল না তার জন্য শোক জাগে। শেষ বয়সে রূপকথার ফল ফলে গিয়েছে। শেষ বয়সে এই ব্যাঙ রাজকন্যা হয়ে থাকা আমার। ব্যাঙ রাজকন্যা পাতাল বাসিনী নয় গো। ভূকেন্দ্রের গলিত লাভাবিলাসিনী। জাঁতাকলে ইঁদুরের লেজ আটকানো দিন রাত। ফটাং করে টান দিয়ে লেজ ছিঁড়ে ফেললেই পৃথিবীর মায়া কেটে বেরিয়ে যাব। ব্যাঙ রাজকন্যা সারা পৃথিবী টপকাতে চায় পারে না। খুব হাঁচোর পাঁচোর করে। পারে না। তার বধ্যভূমিতে শুধু মেঘ হননের পালা। তাকে সবাই নন্দিনী জোয়ার্দার নামে চেনে। দেবযানী বসু বলে জানে না। পাশের ঘর থেকে পুত্র উঠে পড়ে। এখন ও আর্যপুত্র ডাক শোনার বয়সে পৌঁছে গেছে। : একি রে ঘুমুস নি? : আরে: মা তুমিও ও টিভি চালালো। : আস্তে আস্তে পাপা জাগ যায়েগা স্টুডিও জোনের তীব্র হ্যালোজেন ঘরের দেওয়ালে। ভাবলে দেখা যাবে রাজস্থানী কোনো শিশমহলে ঢুকে পড়েছি। গাছের ছায়ারা দোলে। ব্যালকোনিতে এসে দাঁড়িয়েছি। নূরজাহান আর সেলিমকে যেন ছুটে যেতে দেখি নিচে রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ সিকিউরিটির বাঁশির শব্দ শুরু হয়। এত রাতে ওরা কোকিলের ডাক বাজায় বাঁশিতে। খুব বেখাপ্পা লাগে। এর চাইতে মেহের আলীর তফাৎ যাও শোনা অনেক ভালো। প্যাঁচারা এ গাছে ও গাছে উড়ে বেড়ায়। খ্যাঁচখ্যাঁচ আওয়াজ তোলে। ওদের অস্পষ্ট অবয়ব চোখে পড়ে। আজ ফাটছে না। কিন্তু রাত একটাতেও কখনো শুনেছি বাজি ফাটতে। একটানা ফাটে। পাবলিক এখানকার বড়ো আমুদে। অভিধান গালাগালির শব্দগুলো লুকিয়ে ফেলে ঐ সময়ে। হয়তো কোনো নাবালিকা কিশোরীর যোনি ফাটার আওয়াজের মধ্যে সমাধান খোঁজে। আর সেলুকাস তো এখন এলে শুনতেন : সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই সমাজ। দুটো বাড়ির পরে একটা ঝাউগাছ ঘেরা বাড়ির ছাতে একটি জ্বলন্ত মোবাইল পায়চারি করছে। এই দৃশ্য দেখে মনে পড়ে যায় মীরার ভজন মেরে তো গিরধারি গোপাল দুসরো না কোওওওওওঈ। যাকে শির মোওর মুকুট মেরে পতি সোওওওওওঈ। ঐ বাড়িতে একটি প্রতিবন্ধী ছেলে আছে। দিনের বেলায় চেঁচামেচি করে। ওকে হয়তো ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হনুমানের ডাক শোনা যায়। ভয়াল হুব হুড ডাক। এতো রাতে ওরা কি খাদ্য পাবে? এর ওর চালের ওপর লাফায়। পাড়া শান্ত হয়। যদিও জলবায়ু শান্ত হয় না। মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙে পিস্তলের শব্দে। নিশাচর হয়ে যাওয়া ঘরের ছেলেরা রুট অপারেশন করে রুটি রুজির জন্য। আমাদের ফ্ল্যাটও তৈরি হয়েছে এই ভাবে ঐতিহাসিক তাড়নায়। ডারুইন সাহেবের জৈব তত্ত্ব মেনে। ভাবি ঘুমের ওষুধ খাবো কি খাবো না। গুন গুন করি রবীন্দ্রসঙ্গীত --- না না গো না কোরো না ভাবনা।ঐ যাবো কি যাবো না র সঙ্গে মিলে যায় খাবো কি খাবো না। এবার রান্নাঘরে আওয়াজ শুনে সেখানে গিয়ে দেখি পুত্র ফ্রিজ থেকে মেরিনেট করা মাংস বার করে রান্নার উদ্যোগ করছে। : মা মশলাটা মিক্সারে পিষে দাও। মাসলিনের টুকরো দাও মশলা বাঁধব মনে মনে ভাবলাম মাসলিন তো এক্সটিংক্ট হয়ে গেছে। রান্নাঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে মিক্সার চালালাম। কি রাঁধবি রে? আপাদমস্তক নেটিজেন পুত্রটি ট্রাংকুলাইজার গলায় বলে: বিরিয়ানি। জাফরান কাবাব চিনি সহ গোটা দশেক মশলা খুঁজে পেতে দিলাম। ও দমে বসালো কাচ্চি বিরিয়ানি। ঘুম পাচ্ছে এবার সত্যিকারের। হঠাৎ কাঁই কাঁই চিৎকার পরিত্রাহী। কি ব্যাপার ! পাঁচিলের নিচে ঝোঁপে বেড়াল শিকার করেছে এক বিশাল মুসকো ভাম। ওঃ পুরো অ্যানিমেল প্লানেট চলছে যেন। ভামের খুব উৎপাৎ।সকালে উঠে দেখি মলচিহ্ন পড়ে থাকে বারান্দার রেলিং এ। শুতে যাবো কি মধ্যবিত্ত মশারি হাওয়ায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে। অবাধ্য মশারিকে বাগে আনতে এক খন্ড ' অন্যান্য ও ঋত্বিক তন্ত্র ' খাট ও তোশকের মধ্যে গুঁজে দিই গোঁজামিল জীবন শান্ত রাখতে।
দেবযানী বসু
|