সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

গৌতম দে



স্বর




একটা গলার স্বর ঘুরে বেড়াচ্ছে সারাক্ষণ। ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রাম-গঞ্জ-শহরে। অনেকেই হয়তো বুঝতে পারছে। আবার কেউ বুঝতে পারছে না। আমি কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি, সেই স্বরের উজ্জ্বল উপস্থিতি।। 
সেই গলার স্বরটা বাইরে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে কোন ফাঁকে, আমার ঘরে বেমালুম ঢুকে পড়েছে বুঝতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে, পারমানেন্ট জায়গা করে নেবে আমার ঘরে। যেন আমার ছায়া হয়ে আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরঘুর করবে। মাঝেমধ্যে কথা বলবে। শুনতে হবে আমাকে। যেন আমার কোনও প্রশ্ন নেই। কোনও উত্তর নেই। কোনও অস্তিত্বই নেই। 
আমাকে নজরে রাখছে সব সময়। সর্বক্ষণ। শুধু কি আমাকে? না, অন্য আরও কেউ কেউ আছে আমার মতো...। 
আমি বাইরে গেলেও সেই গলার স্বরের উপস্থিতিটা টের পাচ্ছি। ভীষণভাবে টের পাচ্ছি। কিছু বলতে পারছি না। শুধু রেগে যাচ্ছি ক্ষণে ক্ষণে। 
কিন্তু যার ওপর রাগছি, তার অবয়বটা টের পাচ্ছি না। টের পাচ্ছি শুধু তার গলার স্বর। আমার যেন কিছু করার নেই। যদি তাকে চাক্ষুষ করতে পারতাম তাহলে তার মুখোমুখি হওয়া যেত...!

এই যেমন আমি এখন ঘরে বসে আছি। বসে আছি বিছানায়। দক্ষিণের জানলাটা খোলা আছে। ওই জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির কালু ভড়ের বাগান বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। বাগানের ডান দিক ঘেঁষে একটা বড় পুকুর আছে। সুন্দর বাঁধানো ঘাট। লাল রঙের। এটা কালু ভড়ের নিজস্ব পুকুর। যত্নআত্তি করে। টলটলে জল। পাড়ার লোকেরা চান করে। তবে কাউকে কাপড় কিংবা বাসন মাজতে দেয় না। বেলা বাড়লে পাড়ার মানুষজন চান করতে আসে। সেই পুকুর, পুকুরের ঘাটটা আমার ঘরের এই জানলা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে আছি সেদিকে। সকালের আলোটা অন্য দিনের মতো উজ্জ্বল নয়। কেমন যেন গরিব গরিব। বরং বলা যায়, বহু ব্যবহারে বিধবার শাড়ির মতো। ফ্যাকাশে। জ্যালজেলে।
এইরকম সকাল দেখলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। 'থুম্বা' দিয়ে বসে থাকি। কিছু কাজ করতে ইচ্ছা করে না। অলসতা পেয়ে বসে আমাকে। এদিক সেদিক তাকাই। ঘন ঘন। বারে বারে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। শরীরের ভিতরের উত্তাপের টের পাই।
একটু পরে আসা সেই প্রজাপতিটাকে খুঁজি। ব্যাকুলভাবে খুঁজি। প্রজাপতিটা উড়তে উড়তে কালু ভড়ের বাগান টপকে ঘরের জানলা দিয়ে আমার চারপাশে ঘুরঘুর করবে। এখানে সেখানে বসবে। আমার খুশি খুশি মুখটা দেখতে দেখতে সে ঘরময় উড়ে বেড়াবে। তারপর আলমারির হাতলে গিয়ে বসবে। আর অমনি আশ্চর্যজনকভাবে আলমারির হাতলটা ঘট করে শব্দ করবে। লকটা খুলে ফেলবে। আলমারিটা দু'হাত মেলে প্রজাপতিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে।
আমি দেখব। শুধু দেখব। নিজের মনেই হাসব। কিছু বলতে পারব না। তখুনি মনটা একটু একটু করে ভালো হয়ে উঠবে। মা প্রায় দৌড়তে দৌড়তে রান্নাঘরে যাবে। 
প্রজাপতি খুশি। 
আজ তিনজনে একসঙ্গে চা খাবো।

যা কিছু বলবে সেই গলার স্বর। সেই গলার স্বরের কথা আমাকে শুনতে হবে। আমার বেঁচে থাকাটা যেন তার ওপর নিয়ন্ত্রণ করছে। তা কেন? আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। চারদিকে কিসব ভয়ংকর চিৎকার হচ্ছে। রক্তাক্ত চিৎকারগুলো গোলাগুলি লাগা ভাঙা বাড়ির দরজা জানলায় ঝুলছে। কখনওবা রাশি রাশি ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। খবর হচ্ছে। টিভিতে দেখাচ্ছে সেসব...।
-আপনার কোটা শেষ হয়ে আসছে।
-কিসের?
-জীবনের।
-সে কি! আমি যে এখনও বাঁচতে চাই।
-তা তো বললে হবে না ভাই। বলতে বলতে সেই অদৃশ্য গলার স্বর সারা ঘরময় হেঁটে বেড়ায়। বিড়ি ধরালো বুঝি! বিড়ির ধোঁয়া, টুকরো আগুন কিছু দেখতে পাই না। শুধু পোড়া বিড়ির গন্ধটা টের পাই। যেন আমার ঘর, ওই স্বরের বাগান বাড়ি। 
আমি রেগে যাই। চিৎকার করে প্রশ্ন করি-আপনি কে?
-আমি! বলার সঙ্গে সঙ্গে সেই গলার স্বর হো হো করে হেসে ওঠে। ঘরের চারটে দেয়ালে ধাক্কা খায়। প্রতিধ্বনিত হয়। আমি তাঁকে দেখতে পাই না। ব্যাকুল হয়ে উঠি। তারপর আবারও বলি-আপনার কায়া প্রকাশ হোক আমার সামনে। আমি দেখতে চাই, আপনি কে? 
-আমাকে দেখতে পাবে না। আমাকে কেউ দেখতে পায় না। অথচ আমি সর্বত্র বিরাজমান।
প্রজাপতিটা এখনও আসছে না। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাই। সকাল ন’টা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। আবার পুকুরঘাটের দিকে তাকাই। চারটে হাঁস খেলা করছে। খেলা করতে করতে পুকুরের জলে ঘন ঘন ডুব দিচ্ছে। সাঁতার কাটছে। চান করছে। পালকে হলুদ ঠোট ডুবিয়ে গা পরিষ্কার করছে।
-কি ভাবছো তখন থেকে? আবার সেই গলার স্বরের প্রশ্ন।
-ভাবছি অনেক কিছু।
-এখন আর ভেবে কাজ নেই তোমার।
-কেন?
-যাকে নিয়ে ভাবছো। আকুল হয়ে উঠছো। সে আর আসবে না। আসবে না কোনও দিন...।
-তাকে যে আসতে হবে। আমি যে তার অপেক্ষায়...। আমি গড়গড় করে বলে উঠি।
আমার কথা শুনে অমনি গলার স্বরটা হেসে ওঠে। এই চারটে দেয়ালে প্রতিধ্বনি হতে হতে আছড়ে পরে বিছানায়। বিকট হাসি আর চিৎকারে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। আমার নিজস্ব স্বর ডুবে যায়। 
সেই অচেনা স্বর আমার শরীর ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে-চলো এবার তোমাকে নিয়ে যাই...।
-কোথায়?
-অতল মৃত্যুর খাদে।
-কেন?
-তোমার শরীরের সমস্ত কলকব্জা অন্য কথা বলছে। অন্য ভাবনা ভাবছে। আর কয়েক মিনিট হয়তো হাতে পাবে। তোমার শেষ ইচ্ছা কি?
-ওই প্রজাপতিটাকে দেখব। প্রাণ ভরে দেখব।
-বেশ।                                    
 ৪

মা আসে। হাতে চায়ের কাপ। আমাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। জিগ্যেস করে-কি রে, কাল রাতে তুই ঘুমোসনি?
-না।
-কেন রে?
মায়ের এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারি না। চোখে জল এসে যায়। শেষবারের মতো মা’কে দেখতে থাকি। আমাকে ওইভাবে তাকাতে দেখে মা আবার জিগ্যেস করে-তোর কি হয়েছে  রে খোকা?
'কয়েক মিনিট’ যে বেঁচে আছি এই কথাটা বলতে পারি না। শুধু বলি-যাও এখান থেকে...।
চারটে থেকে এখন ছটা হাঁস। আরও বাড়বে। বেড়ে চলবে। তারা এখনও পুকুরে আছে। বার বার জলে ডুবছে। সাঁতার কাটছে। তারপর ঠোঁট দিয়ে মেয়েদের মতো কাঁধের শাড়ির আঁচলটা পাট পাট করে ভাঁজ করছে। তারা কি পুকুর থেকে উঠবে না!
আমি অজান্তেই ফিসফিস করে হেসে উঠি। প্রজাপতি তো এইভাবে শাড়ির বাহারি রঙ বাতাসে ভাসিয়ে উড়তে উড়তে আমার ঘরের জানলা টপকে আসত। আলনা, আলমারি, ড্রেসিংটেবিল, রান্নাঘর, বাসনকোসন সব জানা। চেনা তার। প্রজাপ[তি আসলে মা খুব খুশি হয়। রান্না  করতে করতে কখনও নুন বেশি হয়ে যায়।
আমি খেতে খেতে কিছু বলি না। মা বুঝতে পারে। জিগ্যেস করে-কি রে খোকা, নুন বেশি হয়ে গেছে ডালে?
-তা একটু।
-আর একটু ভাত মেখে নে...।
আমি তাই করি। মায়ের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা একটা দীর্ঘশবাস বাতাসে ভাসতে ভাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরে। যেন বলতে চায়, এবার প্রজাপতিকে ঘরে এনে আমাকে ‘মুক্তি’ দে।
আমার সঙ্গে সঙ্গে মায়েরও বয়স মাটিতে গড়াচ্ছে। মা গড়াতে গড়াতে অনেক দূর চলে গেছে। আমি কি অত দূর যেতে পারবো? হয়তো পারবো না। বাবা অত দূর যেতে পারেনি। তার আগেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল। খুন হয়ে গেছিল হোগলা বনের মধ্যে।। সে তো কত বছর আগেকার ঘটনা। মায়ের মুখে শুনেছিলাম, বাবাকে নিয়ে অনেক কথা। আসলে মা সেদিন বোঝেনি, অদৃশ্য স্বর বাবাকেও গ্রাস করেছিল ক্রমে ক্রমে। এখন বুঝতে পারি। আমাকেও সেই স্বর একটু একটু করে গ্রাস করেছে। এখন আমার শরীরের ভিতর ঢুকতে চায়!
আমি মায়ের সঙ্গে মাঝপথেই আছি। সর্বক্ষণ মাকে ছুঁয়ে থাকতে চাই। কিন্তু কতক্ষণ? প্রশ্নটা সেখানে।
আমাকে সেই অচেনা গলার স্বর আর 'কয়েক মিনিট' ছাড় দিয়েছে। বন্ধুদের কাছে শুনেছি তারাও এমন গলার স্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। নিয়মিত পুজো পাচ্ছে। যারা করতে পারেনি তাদের আমার মতই হাল হয়েছে। এখন আমি সেই অচেনা গলার স্বরের কাছে বন্দি। 
প্রজাপতিকে অ্যাত দিন বলিনি। জানি, ও ভয় পাবে। মাকেও বলিনি সে কথা।
প্রজাপতিটাকে উড়ে আসতে দেখে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসা সেই অচেনা স্বরটা ভয় পেয়ে যায়। আমার বমি পায়। বাথরুমে গিয়ে হড়হড় করে বমি করি। মৃত অনেক মানুষের মুখ ভেসে ওঠে। আমার বাবাকেও দেখে চমকে উঠি। দু'চোখ দিয়ে গরম জল বেরিয়ে আসে। অনেক দিনের জমে থাকা কান্নার স্রোত গাল বেয়ে নামতে থাকে। একটু হালকা হয় শরীর। শুধু 'কয়েক মিনিটে'র বেঁচে থাকার নোটিশটা পায়ের কাছে পড়ে থাকে।


গৌতম দে