পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী
বরাবরই উপেক্ষিতা। পুংলিঙ্গের তীক্ষ্ণতায় সে সৃষ্টিলগ্ন থেকেই অসহায়। নারী তার
শরীরের জন্য সন্তান ধারণে বাধ্য হয়েছে, ক্রমে পুরুষ তাকে গৃহবন্দী করে নিজের সাম্রাজ্যের জাল বিছিয়েছে, নারীকে উপভোগের বস্তু করেছে। সব ধর্মের স্রষ্টাই
পুরুষ, নিয়মাবলী তাই নিজেদের
সুবিধে মতোই করেছে। পুরুষ কখনওই নারীকে তার থেকে উচ্চস্থানে দেখতে অভ্যস্ত নয়।যখনই
কোন নারী জ্ঞান,বিদ্যা,বুদ্ধিতে তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে তখনই তার পেশীশক্তি,কল্পিত ধর্ম আর অদৃশ্য ঈশ্বরের সাহায্যে নারীকে দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিদুষী
খনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আদি প্রস্তর যুগে সমস্ত পুরুষজাতির কাছে নারীই ছিল অলৌকিক
দেবীস্বরূপা,এমনকি সন্তান জন্মের রহস্যকেও
দৈবজাদু বলা হতো,নারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো। কৃষিযুগ
শুরু হওয়ার পরই ফসল উৎপাদনের সঙ্গে নারীর সন্তান প্রজননের এক যোগসাজশ পুরুষের কাছে
উন্মোচিত হলো। একসময় যেখানে নারীকে শস্যদাত্রী হিসেবে দেবীরূপে বন্দনা করা হতো,পুরোহিতদের পরামর্শে নারীকে ভোগের পণ্য হিসেবে
ব্যবহার করা শুরু হলো। সমাজে নারীর অবনমনের সেই সূত্রপাত। উৎপাদন ভূমিকায় নারীর
গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছিল,তাকে "ভার্যা"সম্বোধন করা হয়।ভার্যা অর্থাৎ ভৃত্য অর্থাৎ অন্যেরদ্বারা ভরণীয়া। প্রাক
বৈদিক ওবৈদিক যুগে বিদ্যার্জন,যাগযজ্ঞ,শাস্ত্ররচনায় নারীর অবদান থাকলেও পরে সেইসব অধিকার
কেড়ে নেওয়া হয়।গার্গী,লোপা,মৈত্রেয়ী সহ আরো অনেক নারীই ঋক বেদের সূত্রকার ছিলেন,কিন্তু সেখানেও ছিল পুরুষের কর্তৃত্ব। গার্গী
যাজ্ঞবল্ক্যকে তর্কযুদ্ধে নানান প্রশ্নে বিদ্ধ করতে থাকলে যাজ্ঞবল্ক্যের পৌরুষে
আঘাত লাগলে তিনি বলে ওঠেন,"গার্গী,মাতিপ্রাক্ষীর্মা তে মুর্ধ্বা ব্যাপপ্তৎ।"(বৃহদারকোপনিষদ)। অর্থাৎ "গার্গী যদি আর প্রশ্ন করো,তোমার মাথা খসে পড়বে।"বৈদিক ক্রিয়াকর্মে,মন্ত্রোচ্চারণে নারীর অধিকার খর্ব করা আরম্ভ হয়েছে
স্মৃতিশাস্ত্রগুলি রচনার পর থেকে,বিশেষত
মনুমহারাজের তাড়নায়।
সব ধর্মেই দেবতা থেকেই দেবীর সৃষ্টি,সব ধর্মেই নারী ব্যক্তি নয়,উপভোগ্য
বস্তু।সব ধর্মই নারীর সতীত্ব খুব ভালো বোঝে, কিন্তু সতীর কোন পুংলিঙ্গ আজও নেই। অর্থাৎ পুরুষের বহুগামিতায় সে ছাড়পত্র
দিলেও নারীর বেলায় নৈব নৈব চ। একটা সময় নারীও বহুগামী ছিল,স্বয়ংবরা হতো। নারীর মেধা মননের মূল্য দিতে পুরুষের বরাবরই অনীহা। মুসলিম
ধর্মে তো আল্লাই শেষ কথা। নারীকে পুরুষের দৃষ্টি থেকে বাঁচাতেই বোরখা,পর্দাপ্রথা সৃষ্টি। মহম্মদের বহু আগে ইহুদী
সমাজেখ্রিস্টের মা মেরি অসূর্যস্পশ্যা ছিল। এখনো সিস্টাররা সেই আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে
নিজেদের ঢেকে রাখে। দেবীকে মাতৃজ্ঞানে পূজো করে মন্ত্রোচ্চারণ করা হয়,"যশো দেহি,ধনং দেহি,পুত্রং দেহি!!"পুত্রী নয়,আজও বিবাহ-শ্রাদ্ধ সামাজিক অনুষ্ঠানে পুত্রেরই
একচ্ছত্র অধিকার। ঐতরে ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে,"পত্নী সহগামিনী,কন্যা দু:খ,পুত্র ঊর্ধ্বতম স্বর্গের আলো। পুত্রহীন ব্যক্তি কখনো স্বর্গলাভ করেনা।"(৬/৩/৭/১৩)
মনুসংহিতার বিধানের পেরেক নারীকে আঘাতের পর আঘাত
দিয়ে শেষ করে দিয়েছে।
"বন্ধ্যাষ্ঠেমেহধিবেদ্যাবে দশমে তুমৃতপ্রজা। একাদশে
স্ত্রীজননী সদ্য স্বত্বপ্রিয়বাদিনী।"অর্থাৎ সন্তানহীন নারীকে বিয়ের আটবছর পরে,মৃতসন্তানের জননীকে দশবছর পরে,কন্যাসন্তানের জন্মদাত্রীকে এগারো বছর পরে আর কলহপরায়ণ স্ত্রীকে যে কোন
সময়ে ত্যাগকরা যায়।ঐতরেয় ব্রাহ্মণে বিলা আছে,"সেই নারীই উত্তম যে পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় এবং স্বামীর
কথার ওপর কথা বলেনা।"বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য
বলছেন,"যা হি এব পুত্রৈষণা সা
বিত্তেষণা।"পুত্রকামনাই বিত্ত কামনা।হিন্দুধর্মের
সব গ্রন্থেই কাম আর মৈথুনের ছড়াছড়ি।ইন্দ্র থেকে কৃষ্ণ সবাই ব্যাভিচারি।ইসলামের
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মহানবী থেকে শুরু করে হজরত আলি,হজরত ওসমান সবাই যুদ্ধবন্দী নারীদের উপভোগ করেছে।কোরানে
বলা আছে,"তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যাদের
অধিকারী-- আল্লাহ তোমাদের জন্য তাদেরকে
বৈধ করেছেন!!"(সুরা ৪:২৪)
হিন্দু মহাকাব্য বলতে রামায়ণ আর মহাভারতকেই বোঝানো
হয়। রাজা জনকের পালিতা কন্যা,সীতাকে
ভূমিকর্ষণের সময় পাওয়া যায়। কন্যাসন্তান হওয়ার অপরাধে তাকে মাটির হাড়িতে ভূমিতে
রেখে দেওয়া হয়েছিল। যে রামকে ভালোবেসে সীতাও বনবাসী হন, রাবণ তাকে অপহরণ করে বন্দী করে, যুদ্ধশেষে দীর্ঘ বিরহের পর সীতার সাথে দেখা হলে রাম বললেন,"তোমার জন্য যুদ্ধ করিনি, নিজের সম্মানের জন্যই করেছি। যাও তুমি, তুমি সচ্চরিত্রই হও আর অসচ্চরিত্রই হও, তোমাকে"ভোগ"করতে পারিনে, তুমি কুকুরে চাটা ঘি।"অপমানিত সীতার পাতালপ্রবেশ ছাড়া উপায় ছিল? লক্ষ্ণণের স্ত্রী ঊর্মিলা সেই বা কি দোষ করেছিল? সদ্যবিবাহিত লক্ষ্ণন তাকে ফেলে রাম-সীতার সাথে বনে চলে গেলো, লক্ষ্মণের ঊর্মিলার প্রতি কর্তব্য ছিল না? তখনো সতীদাহ চালু হয়নি, দশরথ
মারা যেতে তার রাণীরা কেউ সহমরণে যায়নি। অথর্ব বেদে রয়েছে,"আমরা,মৃতের
বধূ হবার জন্য জীবিত নারীকে নীত হতে দেখেছি।"(১৮/৩/১,৩)। পরাশর সংহিতায় পাই,"মানুষের শরীরে সাড়ে তিন কোটি লোম থাকে,যে নারী মৃত্যুতেও তার স্বামীকে অনুগমন করে, সে স্বামীর সঙ্গে তেত্রিশ কোটি বৎসরই স্বর্গবাস
করে।"(৪:২৮)। দক্ষ সংহিতার ৪:১৮--১৯নং
শ্লোকে বলা হয়েছে,"যে সতী নারী স্বামীর মৃত্যুর পর
অগ্নিতে প্রবেশ করে সে স্বর্গে পূজা পায়।"ধর্ম এভাবেই নারীর জ্বলন্ত চিৎকার ঢাক ঢোলের শব্দে ঢেকে
দিয়েছে। ভাগ্যিস বিদ্যাসাগর হৃদয় দিয়ে নারীর কষ্ট বুঝেছিলেন। সূর্পণখা লক্ষ্মণকে
প্রেম নিবেদন করতে এলে তার নাসিকা কর্তন করে তার নারীসত্ত্বাকে আহত করার অধিকারই
বা কে দিয়েছিল? বৃদ্ধমুনি গৌতমের স্ত্রী অহল্যা
ইন্দ্রের কামনায় সাড়া দিলে গৌতমমুনির রোষানলে পরে বিতাড়িত হয়। অহল্যা নারী,তার এই নষ্টকামের মানে হয়!! অথচ মুনিঋষিদের সুন্দরী দেখলেই রেতঃপাত হয়ে যেতো।গনিকারা
নৃত্যগীত শেখার অধিকার পেতো।মর্তের গনিকা স্বর্গের অপ্সরারূপে চিত্রিত,দেবতারা কোন মুনির সাধনায় বিচলিত বোধ করলে তার
চরিত্রস্খলনের জন্য এই রূপসী যুবতীদের পাঠাতো। এই যে চিত্তবৃত্তি বর্জিত দেহসর্বস্ব
তরুণীর কল্পনা,এই ছিল পুরুষের নারীর কাছে
প্রত্যাশা।
মহাভারতে পুরোহিত,ব্রাহ্মণদেরকে শ্রাদ্ধের দক্ষিণাতে অন্যান্য বস্তুরসাথে নারীদেরকেও দান করা
হতো।(আশ্রমবাসিক পর্ব ১৪/৪,মহাপ্রস্থানপর্ব
১/৪,স্বর্গারোহণ পর্ব৬/১২, ১৩)
ধর্ম পুত্র চায়, সমাজ পুত্র চায়,পরিবার পুত্র চায়। মানুষের
পুত্রপিপাসা বাড়ার সাথে সাথে নারী নির্যাতন বেড়েছে। কন্যাভ্রুণ হত্যা চালু হয়,আজও চলছে। ধর্ম নারীকে শেষ করে দিয়েছে।
পুত্রাকাঙ্ক্ষাই সমাজে নিয়োগপ্রথার মতো জঘন্য
ঘৃণ্য প্রথার সৃষ্টি করেছে। আজও অনেক জায়গায় এর প্রচলন আছে। নারী সঠিক সময়ে রজঃস্বলা
হবে এটা তো স্বাভাবিক ঘটনা,কিন্তু
আগেও এখনো রজঃস্বলা নারীকে কোন শুভ কাজে,পবিত্র স্থানে যেতে দেওয়া হয়না। রজঃস্বলা নারীকে উপভোগ করতে না পারলে
অন্যনারীতে গমন করা স্বাভাবিক ছিল।ধৃতরাষ্ট্রর দাসীগর্ভে জাতপুত্রের নাম যুযুৎসু।কৌরবসভায়
প্রচুর বীরের সামনে দ্রৌপদীকে কেশাকর্ষণ করে বিবস্ত্র করে নারীর প্রকৃত অবস্থান
আমাদের জানিয়ে দেয়। প্রতিবাদহীন রাজসভায় একমাত্র প্রতিবাদী বিকর্ণ।পঞ্চস্বামী
সত্ত্বেও যুধিষ্ঠির কি করে দ্রৌপদীকে পণ্য করতে পারে?
সবধর্মেই নারী প্রান্তিক,একারণে নারীর কোন অর্জনের ইতিহাস নেই। পোপ্ততন্ত্র আবিষ্কারের আগেই শহীদ
হওয়া নারী গণিতবিদ আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাইপোশিয়ার নাম
ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অনুচ্চারিত ছিল।বাইবেলে ঈশ্বরের নামে খুন,ধর্ষণ রাহাজানিকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।সব ধর্মেই
নারী শস্যক্ষেত্র,তাকে তার স্বামী ইচ্ছেমতো কর্ষণ
করতে পারে।সম্পত্তিতে নিজের শরীরেও নারীর অধিকার নেই।একই গ্রন্থে দুরকম বিধান,"বিধবা নারীরা পুনরায় বিয়ে করতে
পারবে না,তাদেরকে নিরামিষভোজী ও অত্যন্ত দীনহীনভাবে বাকি জীবন কাটাতে হবে।"(মনুসংহিতা, ৫/১৫৭,১৬০)।"স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দাহ ও
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ করে স্বামী আবার বিয়ে করবে।"(মনুসংহিতা,৫/১৬৮)।
জ্ঞানার্জন থেকে বঞ্চিত নারী কাব্যকাহিনী রচনা
করবে কি করে? সেখানেও পুরুষ তাকে যোনি আর
স্তনের আধার বলেই উপস্থাপিত করেছে। খুব বেশি হলে জননী,পতিব্রতা হিসেবেই এঁকেছে।কল্পনায় সে নারীরূপে বিভোর, বাস্তবে সে সেই নারীকে দাসী ছাড়া অন্যকিছু ভাবে কি? পরপুরুষে আসক্ত নারীকে অতিসহজেই কুলটা, দানবী, ডাইনি নানা কু-সম্বোধনে ঘৃণিত করে তুলেছে।
যে টলস্টয়ের"ওয়ার এন্ড পিস" পড়ি, সেই টলস্টয় ব্যক্তিগত জীবনে
দুশ্চরিত্র ছিল,অবৈধ সন্তানদের কাজে লাগাতো, নিজের স্ত্রী, সোফিয়াকে তেরোবার গর্ভবতী করে শেষ জীবনে সমকামিতায় জড়িয়ে পরে। সোফিয়াই তার
ঐ বইয়ের পান্ডুলিপি বিবর্ধক কাঁচ দিয়ে অনুলিপি তৈরি করে। বর্তমান কিছু কাব্য ছাড়া
অধিকাংশ বিখ্যাত লেখকের লেখনী নারীকে অনুশাসনে রাখতেই পছন্দ করেছে।মাইকেল
মধুসূদনের এগারোটি পত্রকাব্য নিয়ে লেখা"বীরঙ্গনা কাব্য"।পুরাণের
নারী চরিত্র শকুন্তলা, তারা, রুক্মিণী, কৈকেয়ী,সূর্পণখা, ভানুমতী, দ্রৌপদী,দু:শলা,জাহ্নবী,জনা,উর্বশী এদের স্বামীদের উদ্দেশ্যে লেখা পত্রগুলো পড়লে তাদের প্রতিবাদী মনোভাব সম্মান আদায় করে নেয়।নারী নরকের দ্বার যারা রটায় তারাও জানে নারীই তাদের
স্রষ্টা। ধর্মজাল থেকে নারী বেড়িয়ে না আসলে সে সারাজীবন সর্বত্র উপেক্ষিতা হয়েই
থাকবে।
মনিভা সাধু