সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সোমা রায়


                       
                

 জলঙ্গির ঘাট ও একটি জীবন 

                                               
 সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল স্বরূপা। দুদিকে দুটো ঘাট। ছোটবেলায় শুনত, ওদিকের বালির ঘাট মেয়েদের। সমান ঘাট, আস্তে আস্তে নেমে গেছে জলের গভীরে। স্নান করতে কোন বিপদ নেই। আর এদিকের পাথরের ঘাট ছেলেদের। বড় বড় পাথর চারদিকে। নামলেই কোমরজল। তবে সবাই বলত পাথরের ঘাটের জল বেশি ঠাণ্ডা। কত হাসাহাসিই না করেছে তখন! 
 ও পাথরের চুপ করে বসে রইল।জলঙ্গির ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। জলের গন্ধ ছোটবেলাটা বারবার চোখের সামনে এনে দিচ্ছে। 
 মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবনাগুলোকে উড়িয়ে দিল। তারপর মোবাইল অন করে আবার মেসেজটা পড়ল-
‘মা, রাগ কোর না। নিউজিল্যান্ডে সেটল হচ্ছি। আমি আর রিয়া ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে আছি বলে তোমাকে আনতে পারছি না। ভাল থেকো।’
 অফ করে দিল। মনে পড়ল প্রবালের শেষ কথাগুলো, ‘আমি আগে চলে গেলে তুমি বাবানের কাছে চলে যেও।’
 প্রবালের ভাগ্য, ওকে এই দিনটা দেখতে হল না।
 আর দেরি করল না। মোবাইলের সিম খুলে সবসুদ্ধ জলে ভাসিয়ে দিল। চটিজোড়াও ছুঁড়ে দিল। কোমরে জড়িয়ে নিল আঁচল। অর্থহীন জীবন বয়ে চলার ক্লান্তি থেকে এবার নিজেকে মুক্তি দেবে। আজ শেষবারের মত বাপের বাড়ি দেখতে এসেছিল স্বরূপা। এখানেই, এই শৈশবের মাঝে ও শান্তির ঘুম ঘুমবে।  
 চারদিকে অন্ধকার নেমে গেছে। শীতকাল বলে বিকেলে গা ধোওয়ার লোকজনও নেই। এই সময়। আস্তে আস্তে পাথরে বসে পা দুটো জলে ডোবাল। সত্যিই পাথরের মত ঠাণ্ডা। 
 “দিদি। অ দিদি।”
 কে! চমকে মাথা ঘোরাল। কে? কাঁচাপাকা একমাথা চুল। কপালে কাটা দাগ। 
 অহ! সুকুমারদা! আশ্চর্য! 
 “দিদি গ, উটে আস দিদি। চল, ঘর চল।”
 আবার ফিরে তাকাল জলঙ্গির দিকে। মাথাটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে কেন! ওই ডাকে কী যেন আছে। 
 হুড়মুড়িয়ে ছেলেবেলা ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই ঘর, সেই লাল সিমেন্টের বারান্দা, নারকেল আম কাঁঠালের বাগান আর দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত। 
 জোরে মাথা ঝাঁকাল। না না । কিছুতেই না। ও আর ফিরবে না। 
 “অ দিদি। মুনে আচে তুমার, ই ঘাটে আমি তলিয়ে যাচ্চিলাম। মাষ্টামশাই চুলের মুটি ধরি বাঁচালেন। মুনে নাই?” 
 থরথর করে কাঁপছে স্বরূপা। হ্যাঁ। তাই ত! বাবা সুকুমারদাকে বাঁচিয়েছিলেন। 
 “অ দিদি আমার! আসো। হাত ধরো। ওটো মা আমার। চল। মা ব্যাটায় আবার ঘর বাদি।”
 দুচোখে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলঙ্গি। ঝাপসা চোখে দুটো হাত বাড়িয়ে দিল স্বরূপা। 

  
  সোমা রায়