আমাদের সমাজ সংসারে প্রায়
প্রতিটি ঘরেই, আমরা মেয়েদের মানসিকতার ধরণটিকেই প্রথম থেকে এই আত্মসমর্পণের অভিমুখে
পরিচালিত করে থাকি। একেবারে বাল্যকাল থেকেই ঘরে ঘরে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে।
এবং এই সংস্কৃতি বাঙালির আবহমান কালের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার। মনে রাখতে হবে, সেই একই
মানসিকতার বয়নে গড়ে উঠতে থাকে ছেলেদের মানসিকতার ধরণটিও। সেই বাল্য থেকেই ছেলেরা সংসারে
নারীর আত্মসমর্পণের ধারাটির সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাদের চেতনার বিকাশের সাথে সাথে
পুরুষের কাছে নারীর আত্মসমর্পণের শর্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। ফলে আমাদের নিজেদের
ঘর থেকেই দাম্পত্যের সুখের ধারণা ও প্রধানতম শর্তটি ছেলে মেয়েদের ভিতর দৃঢ় হয়ে গেঁথে
যায়। যেটি তাদের পরিণত জীবনে তারা বাস্তবায়িত হতে দেখতে চায়। সেই বাস্তবায়নের পরিসর
ও সাফল্যের উপরেই নির্ভর করে দাম্পত্য সুখের অস্তিত্ব। এখানে বলে রাখা ভালো, দাম্পত্য
সুখের প্রধানতম শর্তটুকুই এখানে আলোচিত হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে, শুধুমাত্র এই শর্তের
উপরেই দাম্পত্য সুখ নির্ভরশীল। বাকি শর্তগুলি এই আলোচনার বিষয় নয়।
এখন পিতৃতন্ত্রের কাছে,
পুরুষের কাছে নারীর এই আত্মসমর্পণের দিগন্ত যতটা অর্থনৈতিক, তার থেকে অনেক বেশি শারীরিক
ও অনেকটাই মানসিক। অর্থনৈতিক বিষয়টি নিয়ে সাধারণত কোন বিতর্ক থাকে না। বিষয়টি এতটাই
সুষ্পষ্ট যে সেটি খালি চোখেই দেখা যায়। সোজা বুদ্ধিতে বোঝা যায়। মানসিক দিগন্তও প্রধানত
সেই অর্থনৈতিক দিগন্তের উপরেই নির্ভরশীল। হ্যাঁ একথা অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর নারীর
ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু মুশকিল হয় শারীরিক দিগন্তের পরিসর নিয়ে আলোচনা
করতে গেলে। প্রথমতঃ বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর এবং একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ।
দ্বিতীয়তঃ আমাদের সমাজের নানাবিধ সংস্কারে আমাদের মানসিক পরিসরের সংকীর্ণতা হেতু, আমরা
এই বিষয়ে সম্যক সচেতন নই আজও।
দাম্পত্যসুখের মূল অর্থাৎ
প্রধান চাবিকাঠি, নারী পুরুষের পারস্পরিক যৌনতৃপ্তি ও পরিপূর্ণতার পরিসরেই। অর্থাৎ
বিষয়টি প্রধানতঃ শারীরিক। এবং এটাই হওয়ার কথা। এটাই স্বাভাবিক। এটাই প্রকৃতি নির্দিষ্ট।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা সেটিকেই গৌণ বিষয় বলে ভাবতে ও ভাবাতে প্রয়াসী। এটাকে
বাঙালিত্বও বলা চলে। আমরা ধরেই নিই বিবাহিত স্বামীস্ত্রী পরস্পরকে ভালোবাসবে। একসাথে
সংসার করবে। পারস্পরিক দায় দায়িত্ব পালনের ভিতর দিয়ে সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালন করবে।
এইগুলিই স্বাভাবিক। এবং সমাজের স্থিতির জন্য জরুরী। কিন্তু ভুলে যাই, বা যেতে চাই,
নারী পুরুষের পারস্পরিক ভালোবাসা বা সম্পর্কের ভিত দাঁড়িয়ে থাকে পারস্পরিক যৌনসম্পর্কের
পরিপূর্ণতার উপরেই। আর সেই সম্পর্কের সূত্রেই নির্ভর করে দাম্পত্য সুখ। আমাদের শিক্ষায়
দীক্ষায় বিষয়টি কোন গভীর চিন্তা ভাবনার সামগ্রী হয়ে ওঠে না আদৌ। কারণ আমাদের ধারণায়
বিবাহ মানেই যৌনমিলনের অধিকার ও সন্তান উৎপাদন ও প্রতিপালন। যৌনমিলন মানেই সন্তান উৎপাদনের
ধারণাটিই আমাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আবার সেইটিই এই পিতৃতন্ত্রের শর্তাবলী অনুসারী
হয়ে, যৌনমিলনের আনন্দের প্রধানতম শর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যায় নারীর শারীরিক আত্মসমর্পণের
শর্তেই।
অর্থাৎ দাম্পত্যসুখের চাবিকাঠিও
আমাদের সমাজ সংসারে স্বামীর কাছে স্ত্রীর শারীরিক আত্মসমর্পণের শর্তেই গড়ে ওঠে। বিষয়টি
ব্যাতিক্রম ছাড়া কখনোই বিপরীত হয় না। এই যে স্বামীর যৌন কামনার কাছে স্ত্রীর আত্মসমর্পণ,
সেইটি যে সংসারে যত সাবলীল হয়, সেই সংসার বা দাম্পত্য ততই সুখের হয়। এবং এই আত্মসমর্পণ
আবার অধিকাংশ সময়েই নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ হওয়া চাই। তবেই দাম্পত্যসুখের দিগন্ত ঝলমল করে
উঠবে। তেমনটিই আমাদের দাবি। আমাদের পুরুষদের। আমাদের সমাজের। আমাদের সংসারের।
এইভাবেই নারীর শরীর ও মনের
উপর পুরুষের অধিকার সাব্যস্ত হয়, আমাদের সমাজ সভ্যতায়। বিশেষত বাঙালির প্রতিদিনের জীবন
পরিসরে। বিবাহের সাতপাক ঘোরা হয়ে গেলেই, কিংবা সইসাবুদ হয়ে গেলেই পুরুষ হিসাবে আমরা
পুলকিত হয়ে উঠি একটি যোনীর উপর নিঃশর্ত অধিকার লাভের আনন্দে। সেখানেই আমাদের পুরুষার্থ।
এবং সেই বিবাহিত যোনী বিবাহিত শিশ্নের কথায় ঠিক যেমনভাবে ওঠবোস করবে, তেমন ভাবেই নিরূপিত
হবে দাম্পত্য সুখের বাতাবরণ।
বেশ খুব ভালো কথা। নারী
যখন বিবাহের বৈতরণী পার হয়ে স্ত্রী’র সম্মান প্রাপ্ত হয়ে পিতৃতন্ত্রের সকল শর্তাবলী
মেনেই স্বামীর যৌন কামনার কাছে আত্মসমর্পণ করতেই স্বীকৃত হয়ছে, তখন তো আর কথাই নাই।
কিন্তু একবার বিবাহমণ্ডপে বা সইসাবুদের পর্বে আত্মসমর্পণ করা মানেই যে, সেটি চিরকাল
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে অটল অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, তেমনটি সবসময় নাও হতে পারে। আর
হয়ও না। হয় না বলেই দাম্পত্যের সুখও হয়ে ওঠে ক্ষণস্থায়ী। ফলে ঘরে ঘরে অশান্তির আগুনও
ধুমায়িত হতে থাকে। ফাটল ধরতে থাকে দাম্পত্য সম্পর্কের ভিতেই। যদিও অর্থনৈতিক কারণেই
অধিকাংশ ফাটলধরা দাম্পত্য টিকেই থাকে শেষমেশ, তবুও তাতে দগ্ধ হতে থাকে স্বামীস্ত্রী
দুজনেই। বেশির ভাগ সংসারেই সন্তানের কথা ভেবে সেই দহন নিয়ে পরস্পর পাশাপাশি অবস্থান
চলতে থাকে।
পিতৃতন্ত্রের এই ঘেরাটোপে,
আমাদের কারুরই খেয়াল থাকে না, বা আমরা অধিকাংশই খেয়াল রাখতে চাই না, স্ত্রী হিসাবে
নারীরও যৌনচেতনা যৌনকামনা পুরুষের থেকে কোন অংশেই কম হওয়ার কথা নয়। এবং সেই অনুভব ও
তার সুতীব্র সংঘটনও আমাদের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। শিশ্নের শর্তে যোনীর আত্মসমর্পণ
ঘটলেই মিলন সম্পূর্ণ হয় না। হতে পারে না। একই সাথে যোনীর শর্তেও শিশ্নের আত্মসমর্পণ
সমান ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী। অর্থাৎ পারস্পরিক নিঃশর্ত আত্মসমর্পণেই যৌনমিলন সম্পূর্ণ
পরিপূর্ণতা পায়। আর সেখানেই দাম্পত্যের আসল সুখ। আমরা ভুলে যাই, বা জানতেও পারি না,
বিবাহিত স্ত্রী’র শরীরের উপর অধিকার লাভ করার তৃপ্তিই দাম্পত্য সুখ নয়। বিবাহিত স্ত্রী’র
যৌন কামনাকেও সমান স্বীকৃতি দিয়ে পারস্পরিক যৌন আবেগের সম্মিলিত উদ্বোধনের মধ্যেই পরস্পরের
শরীর ও মননকে পরিতৃপ্ত করার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়েই সাব্যস্ত হয় দাম্পত্য সুখের উন্মুক্ত
দিগন্ত।
সেই দিগন্তে প্রতিদিন পৌঁছাতে
পারাটাই দাম্পত্যের প্রধানতম শর্ত। দায়িত্ব ও কর্তব্য। পিতৃতন্ত্র আমাদের সেই শিক্ষা
দিতে পারে না। পারে নি। আর পারবেও না কোনদিন। সেই কারণেই ঘরে ঘরে অসুস্থ দাম্পত্যের
ছায়া পড়ে চলছে সমাজ সংসারের পরতে পরতে। বিশেষত আমাদের বাঙালি সমাজে এই ছায়া ক্রমেই
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে সমগ্র সমাজটিকেই আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
আমরা জানি যে কোন মানুষের
সাথেই যে কোন মানুষের মনের মিল ভাবের মিল চেতনার সামঞ্জস্য হয় না। তাই আমরা কথায় কথায়
মনের মানুষ খোঁজার কথা বলে থাকি। কিন্তু আমাদের চেতনায় আরও একটি বড়ো সত্য প্রায় কখনোই
ধরা দেয় না। সেটি হলো, মনের মিলের মতোই যেকোন পুরুষের সাথে যেকোন নারীর শরীরের মিল
অর্থাৎ যৌন আবেগের মিল হয় না। হতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রেই মনের মিল, ভাবের মিল, চেতনার
সামঞ্জস্য থাকলেও যৌন আবেগের মিল ঘটে না। সেই ক্ষেত্রে দুজন মানুষের মনের মিল হলেও
শরীরের মিল হয় না। সমস্যা হয়, সেই ক্ষেত্রেও জোর করে শরীরের মিল ঘটাতে গেলেই। সেই দাম্পত্যও
সুখের দেখা পায় না। তাই বিবাহই শরীর ও মনের মিলের কোন শর্ত হতে পারে না। যার সাথে যার
মন ধরে যেমন সত্য, ঠিক তেমনই সত্য, যার সাথে যার শরীর মেলে। যার সাথে মেলে, তার সাথেই
দাম্পত্যসুখ ধরা দেয় বা সত্য হয়ে ওঠে।
অনেকেই বলতে পারেন, দাম্পত্যসুখ
কি কেবলই শরীরের মিলনের উপর নির্ভরশীল। নিশ্চয় নয়। শরীর ও মনন, উভয়ের পরিপূর্ণ মিলনের
উপরেই দাম্পত্যসুখের অস্তিত্ব। কিন্তু চেষ্টা করে সাধনা করে মনের মিল ঘটানো গেলেও,
শরীরের মিলন ঘটানো সম্ভব নয়, যদি না দুটি ভিন্ন শরীরের যৌন আবেগ পরস্পরের ভিতর পরিপূর্ণতা
পায়। না পেলে, সেটি সাধনার দ্বারা, বুদ্ধি বিবেচনার দ্বারা জোর করে ঘটাতে গেলেই যত
সমস্যার উৎপত্তি। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই উৎপন্ন সমস্যা নারীর যৌন আত্মসমর্পণের পথেই
নিস্পত্তি হয়। বা চাপা দেওয়া হয়। আমরা বুঝতে শিখি নি, প্রতিটি শরীরের নিজস্ব একটি ছন্দ
থাকে। যেমন প্রতিটি মনের নিজস্ব একটি ধারা থাকে। মনের ধারা বেছে বেছে মনের মানুষ খুঁজে
পাওয়া বরং সহজ। কিন্তু শরীরের ছন্দে শরীর মেলানো আদৌ সহজ নয়। কারণ এইখানেই অন্যান্য
প্রাণীর থেকে মানুষের পার্থক্য। শুধুমাত্র শিশ্নযোনীর মিলনেই আমাদের শারীরিক মিলন সম্পূর্ণ
হয় না, অন্যান্য প্রাণীর মতো। সেখানে সন্তান উৎপাদনেই যৌনমিলনের সার্থকতার পরিসমাপ্তি।
মানুষের ক্ষেত্রে সেটি সম্ভব নয় কখনোই। সম্ভব হলে ঘরে ঘরে এতো দাম্পত্যের অসুখ থাকতো
না। মানুষের শিশ্নযোনী এক হলেই গল্প শেষ হয়ে যায় না। কারণ এক একটি শরীরের যৌন আবেগের
ধরণ এক এক রকমের। সমধর্মী বা কাছাকাছি আবেগের শরীর ছাড়া অন্য শরীরকে শরীর গ্রহণ করতে
পারে না স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। তাই ছেলে মেয়ের বিবাহ দিয়ে ফুলশয্যার খাটে উঠিয়ে দিলেই
দুটি সত্ত্বার মিলন ঘটানো যায় না। সন্তান উৎপাদন হেতু বংশগতি বজায় রাখা যায় মাত্র।
তাই শিশ্ন ও যোনীর মিলনই
শেষ কথা নয়। শরীরে শরীর মেলানো শরীরের নিজস্ব ছন্দের পারস্পরিক আকর্ষণ বিকর্ষণের উপরেই
নির্ভর করে। সেখানে মিল হওয়াটাই দাম্পত্যসুখের প্রধান চাবিকাঠি। সেই মিল সঠিক ভাবে
সংঘটিত হলে, দাম্পত্য সুখের অন্যান্য শর্তগুলির বাস্তবায়ন হোক বা নাই হোক দাম্পত্যের
ভিতে ফাটল ধরে না সহজে। না, এই সহজ কথাটি অনুধাবনের সক্ষমতা আমাদের অধিকাংশ মানুষেরই
নাই। গোটা জীবন চলে যায়। অসুখী দাম্পত্য নিয়ে জীবন তোলপাড় হয়ে গেলেও আমরা বুঝতে পারি
না, গণ্ডগোলের মূল শিকড় কোথায় ও তা কতদূর অব্দি বিস্তৃত। এখানেই আমাদের সীমাবদ্ধতা
ও দুর্ভাগ্য।
শ্রীশুভ্র
শ্রীশুভ্র ১৯শে সেপটেম্বর ২০১৯: কপিরাইট লেখক
কর্তৃক সংরক্ষিত