কৈশোরে যখন সিনেমা দেখতে শিখলাম, মানে আকর্ষণ বোধ করতাম, সেই আকর্ষণের পেছনে থাকতো
সিনেমার নায়ক ও নায়িকাদের অভিনয় দেখা আর তাদের গান শোনা । আর ছিল কিছুটা নিষিদ্ধ
বিষয়কে আবিষ্কারের উত্তেজনা । কেননা সেই নিতান্ত কৈশোরে জলখাবারের পয়সা বাঁচিয়ে
কিংবা বাজার দোকানের খরচ থেকে দু এক পয়সা সাফাই করে পাঁচ আনা পয়সা জোগাড় হয়ে গেলেই
সিনেমার টিকিটঘরে লাইন লাগানো সেই বয়সে নিষিদ্ধ তো ছিলই । কৈশোরে যখন
লুকিয়ে-চুরিয়ে সিনেমা দেখতে শুরু করলাম তখন এদেশে কথাবলা সিনেমার বয়স পঁচিশ
পেরোয়নি । ১৯১৯এর ৮ই নভেম্বরে মুক্তিপ্রাপ্ত ম্যাডান কোম্পানীর ‘বিল্বমঙ্গল’ হল প্রথম বাংলা পূর্ণ দৈর্ঘের কাহিনীচিত্র, সেটা নির্বাক সিনেমার যুগ । সেই হিসাবে এ’বছর বাংলা চলচ্চিত্র
শতবর্ষ পূর্ণ করলো । বাংলা চলচ্চিত্র কথা বলতে শুরু করলো ১৯৩১এ । প্রথম সবাক
চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩১ এর ২৭শে জুন । যাইহোক বাংলা চলচ্চিত্রর ইতিহাসের
বৃত্তান্ত লেখা এখানে অপ্রাসঙ্গিক । আমার বিষয় সিনেমার
মেয়েরা ।
চলচ্চিত্রে মেয়েদের আসার পথটা ফুল বিছানো ছিল না ।
১৯২৫-৩০এর বাংলায় রক্ষণশীলতার বেড়া অনেক ভেঙ্গেছে,
এগিয়েছে সমাজ, তবুও মেয়েদের থিয়েটার, সিনেমা করা বা রেকর্ডে
গানগাওয়া তখনকার সমাজ অনুমোদন করতো না । বাংলা চলচ্চিত্রের পথচলা শুরুর আদিপর্বে অর্থাৎ
নির্বাক যুগে অভিনয়ের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন এংলো ইন্ডিয়ান মেয়েরা আর থিয়েটারের
অভিনেত্রীরা । নির্বাক সিনেমা, তাই কোন ভাষায় সংলাপ
উচ্চারিত হচ্ছে তা জানার বালাই নেই । সেই সময় এংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রী শ্রীমতী
পেসেন্স কুপার, মিস ভায়োলেট কুপার, মিস আলবার্টিন্ মিস হিপো লাইট প্রমুখ লোকপ্রিয় হয়েছিলেন । মেমসাহেবদের অভিনীত
‘নল দময়ন্তী’, ‘বিষ্ণু অবতার’, ‘কপালকুন্ডলা’ দেখতে নাকি ‘হাউসফুল’ হয়ে যেত । কিন্তু বাঙালি দর্শক বেশিদিন সিনেমায় মেমসাহেবদের বাঙালি ললনা
ভাবতে রাজি হবেন কেন? অতয়েব থিয়েটারে নীচের মহলের মেয়েরা ছাড়া আর গতি ছিল না । বাংলা
সিনেমার সেই শৈশবে সিনেমায় এলেন মঞ্চের অভিনেত্রীরা – কুসুমকুমারী, শিশুবালা, নীহারবালা,নীরজাসুন্দরী,প্রভাদেবী প্রমুখ অনেকে ।
বাঙালির চলচ্চিত্র উদ্যোগের পিতৃপুরুষের মর্যাদা দেওয়া হয় ধীরেন্দ্রনাথ
গঙ্গোপাধ্যায় বা ডি জি কে । বাংলা চলচ্চিত্রের সেই আদিপর্বে ধীরেন্দ্রনাথ
চেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের অভিনয়ে মেয়েরা আসুক, বুঝেছিলেন বিদেশিনী
মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে বাংলা সিনেমা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে পারবে না । সেকালে এটা খুব সহজ ছিল না সামাজিক নিষেধকে
অগ্রাহ্য করা, যার জন্য অপবাদও কম সইতে হয়নি তাঁকে । রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে শান্তিনিকেতনে কাটানো
আধুনিক মননের মানুষ ধীরেন্দ্রনাথ
চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সোনাগাছির গণিকাপল্লীতে ছুটে বেড়িয়েছেন
। অবশেষে নিজের স্ত্রী রমলা ও কন্যা মনিকাকে সিনেমায় নামিয়েছিলেন সামাজিক নিষেধের
বেড়া অগ্রাহ্য করে । প্রথম ছবি ‘বিলা্ত ফেরত’এ প্রখ্যাত এডভোকেট বিধুভূষণ মুখার্জীর মেয়েকে নায়িকার ভুমিকায় নামিয়ে অসাধ্য
সাধন করেন । মেয়েদের উদ্দেশ্যে ধীরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘তোমরা এসো, তোমরা পবিত্র করে তোল এই মিথ্যার আবরণে চাপা
পড়ে থাকা চিত্রজগৎকে । তোমরা এই জগৎটাকে গঙ্গাজলে রূপান্তরিত কর’ ।
১৯৩১এ বাংলা সিনেমা কথা বলতে শুরু করলো । বাংলা চলচ্চিত্রের
নির্বাক ও সবাক যুগের সন্ধিলগ্নে বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছিল নীচের মহল থেকে আসা এক
নিঃসম্বল, অসহায়া বালিকাকে, নাম তার কাননবালা, পরবর্তীতে যিনি কানন দেবী । নির্বাক সিনেমার যুগে পাঁচ টাকা পারিশ্রমিক পাওয়া
কানন বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে দীর্ঘ ষাট বছরেরও বেশি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকে
এর অভিভাবিকা হয়ে উঠেছিলেন । নীষ্ঠা, সততা আর তন্ময় সাধনায়
নিজেকে অবহেলার অন্ধকার থেকে দীপ্তিময়ী ব্যক্তিত্বে উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন কানন দেবী ।
অভিনয়, নাচ, গান এবং শরীরি সৌন্দর্য
কাননকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে গিয়েছিল । তিনিই বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম ‘মহা নায়িকা’ । চলচ্চিত্রে ‘নায়িকা’ কথাটির ধারণার শুরুও তখন থেকেই । চল্লিশ দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের আদিপর্বে
সিনেমায় আসা মলিনা দেবী, ছায়া দেবী, চন্দ্রাবতী দেবী, সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায়,
দীপ্তি রায়, শোভা সেনরা পঞ্চাশ ষাট সত্তর দশকে সাহিত্যনির্ভর বাংলা সিনেমায় বহু
স্মরণীয় চরিত্র সৃষ্টি করেছেন । কে ভুলতে পারে কানন দেবীর ‘অন্নদা দিদি’, মলিনা
দেবীর ‘রাণী রাসমণি’, ছায়া দেবীর ‘হারমোনিয়াম’, ‘আপনজন’ ?
পঞ্চাশ,ষাট ও সত্তর এই তিনটি
দশককে বলা যেতে পারে মূল ধারার বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্নযুগ । এই সময়ে উঠে আসেন
অনেক সৃজনশীল চিত্রনির্মাতা ও শক্তিশালী অভিনেত্রী । আবার এই দশকেই পাই সমান্তরাল
সিনেমার তিন চিরশ্রেষ্ঠ পরিচালক সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনকে
। মূল স্রোতের বাংলা সিনেমার কাহিনী বিন্যাসে আসে লক্ষণীয় বদল । পঞ্চাশের দশকে
আমরা পেলাম সুচিত্রা সেন,সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়,সন্ধ্যারাণী,অরুন্ধতী দেবী,সুপ্রিয়া চৌধুরী,মাধবী মুখোপাধ্যায়,মঞ্জু দে, মালা সিনহা, সবিতা বসু, রুমা গুহঠাকুরতা, অনুভা গুপ্তর মত অনেক শক্তিশালী অভিনেত্রী । রূপালী পরদায়
এলো সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসার ছবি ।
ষাটের দশকে পেলাম সন্ধ্যা রায়, অপর্ণা সেন, শর্মিলা ঠাকুর, মহুয়া রায়চৌধুরী, লিলি চক্রবর্তী,মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়,সুমিত্রা মুখার্জী,অঞ্জনা ভৌমিক, আরতী ভট্টাচার্য,মমতাশঙ্কর প্রমুখকে, যাদের অভিনয়ে বাংলা
সিনেমায় পেয়েছি অসামান্য কিছু নারী চরিত্র ।
বাংলা চলচ্চিত্র তার জন্মলগ্ন থেকেই সাহিত্যনির্ভর ।
বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র থেকে শুরু করে তারাশঙ্কর
বন্দ্যোপাধ্যায়,বিভূতিভূষণ,মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়,প্রেমেন্দ্র মিত্র,শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ বসু, বনফুল, সমরেশ বসু,নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সুবোধ ঘোষ প্রমুখের অনেক
কালজয়ী উপন্যাস-গল্পের সফল চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে যেগুলি আজও বাংলা চলচ্চিত্রের
সম্পদ । এঁদের পরেও শীর্ষেন্দু
মুখোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত,
প্রফুল্ল রায়, আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী প্রমুখের
লেখা কাহিনীর সার্থক চলচ্চিত্রায়ন আমরা দেখেছি ।
বাংলা সাহিত্যে বরাবরই নারী চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে অসামান্য দক্ষতায় সমাজ
বাস্তবতাকে মনে রেখে । বাঙালি চলচ্চিত্রে নিটোল গল্প চায়, চায় সেই গল্পের মধ্যে নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে । এই সময়ের শক্তিময়ী
অভিনেত্রীরা সৃষ্টি করেছেন বাস্তবের রক্ত-মাংসের নারী চরিত্র যারা আপন বোধ ও মননে,হাসি-কান্নায়,আবেগে,সরলতা-শঠতায়,হিংসা-বিদ্বেষে,প্রেম-বিষাদে,বুদ্ধিমত্তায়
বাস্তব জীবনের বিশ্বাসযোগ্য বাঙালি নারী । তাই এইসব অভিনেত্রীদের কাছ থেকে পেয়েছি ‘সর্বজয়া’(পথের পাচালি/ উমা দাশগুপ্ত) ‘আরতী’(মহানগর/ মাধবী) (মাধবী), ‘নীতা’ (সুপ্রিয়া / মেঘেঢাকা তারা),
‘পান্নাবাঈ’ (সুচিত্রা / উত্তর ফাল্গুনী), ‘আরতী’(মাধবী / মহানগর), ‘দয়াময়ী’(শর্মিলা / দেবী), ‘ফুলি’ (সন্ধ্যা রায় / ফুলেশ্বরী), রুমা গুহ ঠাকুরতা (পলাতক), অরুন্ধতি দেবী (‘ক্ষুধিত
পাষাণ’) ‘চিনু’ (মমতাশঙ্কর / একদিন প্রতিদিন) ইত্যাদি ।
গত শতকের আশির দশকে পৌঁছে বাঙালির বিনোদন জগতে অনেক কিছুর
বদল ঘটে গেল, বাংলা সিনেমারও । পণ্যায়ন সৃষ্টি করলো আমাদের
রুচির সংকট । সাহিত্যনির্ভর কাহিনীকে বিদায় দিলেন প্রযোজকরা । তারাই ঠিক করে দিতে
লাগলেন সিনেমার ‘স্টোরিলাইন’ । মৌলিক নারী
চরিত্র হারিয়ে গিয়ে সিনেমায় এলো মারপিট জানা নায়ক আর চটুল নাচ-গান করা নায়িকা ।
তাদের পোষাক, আচার আচরণও কেমন বদলে গেল। তারা যেন আর
মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীর প্রতিনিধিই নয় । নায়িকাপ্রধান সিনেমার নির্মাণই বন্ধ হয়ে
গেল । কেউ কষ্ট করেও মনে করতে পারবেন না, বাংলা চলচ্চিত্রে গত
ত্রিশ বছরে কটা স্মরণীয় নারী চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে ! আশির পর দেবশ্রী রায়, শতাব্দি রায়, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, রূপা গাঙ্গুলী, মুনমুন সেন, ইন্দ্রাণী হালদাররা যখন সিনেমায় এলেন ততদিনে পণ্যায়নজাত রুচির সংকট আর
সৃজনশীলতার দেউলিয়াপনা বাংলা সিনেমার শরীরে থাবা বসিয়েছে । এই শতকের পাওলি দাম বা
রাইমা সেনদের সাধ্য কি দেউলিয়াপনার সেই থাবা থেকে বাংলা সিনেমাকে উদ্ধার করেন !
এদের অভিনয় প্রতিভা অব্যবহৃতই থেকে গেল ।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ভালো এবং ব্যবসায়িকভাবে সফল
সিনেমা আমরা পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু তা বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের সাম্প্রতিক অবস্থার
একটা অতি খন্ড চিত্র মাত্র । এদের ছবিগুলো প্রায় সবই শহুরে এলিট দর্শকদের মাথায়
রেখেই নির্মিত,তাদের সমাজের কথা, তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বই এইসব ছবির কাহিনীসার,
সাধারণ মানুষের যাপনচিত্র
তাদের পারিবারিক হাসি-কান্না, বিষাদ-বিপন্নতার গল্প
তেমনভাবে পাই না এই সব ছবিতে । এখনো সাধারণ বাঙালি সিনেমাপ্রেমিক সিনেমাকে ‘বই’ বলে, যার অর্থ বইয়ের মতই নিটোল
গল্প চায় সিনেমার মধ্যে, চায় সেইসব সিনেমার
চরিত্ররা হবে তাদের মত । এখন রাজ চক্রবর্তী, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, কমলেশ্বর, সৃজিৎ, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা ভালো
ছবির নির্মাণ করছেন, ব্যবসায়িক সাফল্যও
পাচ্ছেন । তারাও সাহিত্যনির্ভর সিনেমার নির্মাণ করছেন না কেন, মধ্যবিত্ত সমাজের
প্রতিনিধিত্বমূলক নারী চরিত্র সৃষ্টি করছেন না কেন এ বড় বিস্ময় ।
সিনেমাশিল্পের সঙ্গে যুক্ত সকলেই বাংলা চলচ্চিত্রের সংকটের
কথা বলেন । মাল্টিপ্লেক্স আর টেলিভিশনের দাপটে একপর্দার প্রেক্ষাগৃহগুলো বন্ধ হয়ে
যাচ্ছে । তো এই সংকট থেকে পরিত্রাণের রাস্তা খোঁজার প্রয়াসও তেমন হচ্ছে না ।
সিনেমায় সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের দৈনন্দিন যাপনের গল্প না থাকলে, সাহিত্যনির্ভর না হলে, সিনেমার গল্পে আটপৌরে
বাঙালি নারীর মৌলিক চরিত্র প্রাধান্য না পেলে বাংলা সিনেমাশিল্প তার সার্বিক সংকট
থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে না । এই কথা বাংলা বানিজ্যিক সিনেমার কারবারিরা অনুমোদন
করবেন এমন ভরসা অবশ্য আমার নেই ।
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়