জাতীয় সড়ক জ্বলছে
জাতীয় সড়ক। দুপাশে অন্ধকারের ঢেউ,
ধানক্ষেত দুলছে, ধানক্ষেত রক্তে ভেসে যাচ্ছে,
টলমল হাঁটছে কেউ, পালাতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে,
মরে যাচ্ছে, মরে যাওয়া যথেষ্ট ছিল না বলে চিতা,
বিনা আয়াসেই দাউদাউ চিতা। এই কি চন্দনকাঠ? কোন গন্ধ নেই তো!
আমি কেবল মাংসের গন্ধ পাচ্ছি, আমার নিজের মাংস, আমার
বোনের মাংস,
আমার ক্লাসের সব বন্ধুদের, জঙ্গলজিলাবি গাছের গায়ে হেলান দেওয়া
আমাদের সাইকেলের মাংস...
লেডিবার্ড, লেডিবার্ড, এগুলো আবার কোন কিসিমের পাখি?
কাল দেশ জুড়ে ফিমেল ব্ল্যাক আউট, কোন পাখি উড়বে না,
পাখি উড়লেই যেহেতু গুলি করে নামানো হবে,
তাই জাতীয় সড়ক একটি নিখুঁত ভুগোল বইয়ের
মতো, পাতাছেঁড়া,
আমরা মাঝে মাঝে দেখেছি ওরকম বই,
যখন আমরা ইস্কুল যেতাম, যেদিন আমরা ইস্কুল যেতাম,
জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে সারি সারি সাইকেল, লেডিবার্ড,
লেডিবার্ড হড়কে ধানক্ষেতে নামে, ঘষটাতে ঘষটাতে ধানক্ষেতে,
রক্ত খুব ভালো সার, হাড়ের টুকরোয় ভরপুর ক্যালসিয়াম,
আমরা জীবনবিজ্ঞান পড়েছিলাম একদিন,
আমার খুব ওইরকম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নারী শিশু,
দাবাখানা, চশমা পরা ডাক্তারনি, করিনা কাপুরের
মতো,
ইচ্ছে ছিল, লেডিবার্ড চড়ে, জাতীয় সড়ক ধরে আরও
আরও ভেতরের গ্রামে...
কিন্তু হবে না, যেহেতু আমি মরে গেছি, আর ভালো করেও মরি নি,
আর আমাদের মাংস জল-অচল হতে হতে আগুন-অচল
ও,
তাই ওখানে কী পুড়ছে? আজীব বাত! সত্যি তো কিচ্ছু পোড়েনি,
জাতীয় সড়ক, তার দুধারে অন্ধকারের ঢেউ, ধানক্ষেত
দুলছে,
কোজাগরী দুদিন পর, ধানের দুধ খেতে নামছে লক্ষ্মীপেঁচা,
কিন্তু আমরা কিচ্ছু খাইনি, আমি, আমার বন্ধুরা,
আমার বোন,
জিভটা থাকলেও আমরা কাউকে কিচ্ছু বলতাম না,
কিন্তু এত ফালতু আগুন, আমরা ভালো করে পুড়তে পারলাম না,
শুধু পোড়া মাংসের গন্ধ নিয়ে হাঁচড়পাঁচড়
উঠে এলাম জাতীয় সড়কে,
প্রতিটি ধানক্ষেত থেকে উঠে এলাম,
আর আমাদের দোমড়ানো লেডিবার্ডের পাশ দিয়ে
যে সব গাড়ি ছুটছিল-
তারা দেখল জাতীয় সড়ক জ্বলছে, খামোখা!
মাথা নেই, জিভ নেই, শুধু
যোনিপীঠ, সিঁদুরচর্চিত
দেবীপক্ষ। তাই মুখোশের বিক্রি কমে গেছে
একদম।
সিঁদুর, প্রচুর সিঁদুর । থকথকে সিঁদুর পাথরের ওপর।
বাঁশ,
উদাসীন বাঁশ চলেছে গাড়ি ভর্তি,
কিছুতেই পুড়ছিল না যে মাথা,
তাকে ভেঙ্গে দেওয়া হল বাঁশ দিয়ে,
এরপরও টানা পাঁচদিন দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিমা
শরীর,
মাথা নেই, জিভ নেই, শুধু যোনিপীঠ, সিঁদুরচর্চিত,
দেবীপক্ষ। তাই মুখোশের বিক্রি কমে গেছে
একদম।
সিঁদুর,প্রচুর সিঁদুর । থকথকে সিঁদুর পাথরের ওপর।
শাকম্ভরী
কাশফুলের ঝোপে তিনটে মুনিয়া,
আর অজস্র প্রজাপতি,
আমি একটা বাবলা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে
দেখছি গাছটা একা নয়, একটা ডুমুর গাছ
বাবলার গায়ে বেহায়ার মতো হেলে আছে,
আবার একটা ধুঁধুলের লতা উঠেছে বাবলাকে
জড়িয়ে
তার হলুদ ফুলে উঁকি মারছে একটা ভ্রমর,
এর ওপর সাদা সাদা মেঘ,
গাছ,
পাখি, মেঘ কেউ একলা নয়
হঠাৎ মাঠ ভেঙে এল সোমবারী মণ্ডল,
তার হাতে কলমী শাকের বোঝা,
সে ভ্যান চালাতে চালাতে আমার দিকে চেয়ে
হাসল,
তার ছেলে বৌ নাতি নাতনির সংসার,
ছেলের কাজ নেই অনেকমাস।
শাক তুলে নিয়ে বিক্রি করবে বাজারে,
পাঁচটা পেট।
সোমবারী মণ্ডলের কলমী শাক দু আঁটি নিয়ে
ভাবি দুর্গার আর এক নাম তো শাকম্ভরী!
শিউলি আর রক্তের গন্ধ
কিছুই হতে চায়নি,
শুধু শিউলির গন্ধ নিতে চেয়েছিল প্রত্যেক
শরতে।
শরত কোন দীর্ঘ ঋতু নয়,
এক মুঠো শিউলির মতোই বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে
যায়,
শুধু একটা সুগন্ধ, মনখারাপের মতো সারাবছর,
মেয়েটা এসব জানে না,
তার শরীরটা যেখানে পড়েছিল,
শিউলি গাছ সেখান থেকে খুব দূরে নয়,
কয়েকটা কাক আর কুকুর ছুটে গেছিল রক্তের
গন্ধ পেয়ে,
কিন্তু সে শিউলির গন্ধ ছাড়া কিচ্ছু
পায়নি...
ওকে ডাকো
কলমী শাকের মতো হেলাফেলায় গজিয়ে উঠেছে যে
জীবন,
তাকে তুমি ডাকো,
শাঁখের আওয়াজে ঘরে এসে এক কাপ চা খাক,
একটু জিরিয়ে ও আবার বেরিয়ে পড়বে কাজের
খোঁজে,
খালের ওপরের নড়বড়ে সাঁকোয় গিয়ে বসে থাকবে
উবু হয়ে,
দেখবে ম্যাটাডোরে করে মা আসছেন,
আর তাঁর গা থেকে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে
শোলা,
গরজন তেল, জরি,
দেবী তাঁর সব বরাভয় রাস্তায় লুটিয়ে চলে
যাচ্ছেন,
ওই সাঁকোর ওপর বসে থাকা,
কাজ না পাওয়া একা মেয়েটা কি তার কিছুই
পাবে না?
ধূলিবসনা
‘সব্জি, সব্জি’
হাঁকতে হাঁকতে দুর্গা চলেছে ভ্যান ঠেলে ঠেলে,
খালি পা,
সাতসাগরের জল একজায়গায় করলেও
অত ধুলো ধোয়ানো যাবে না!
শক্তিরূপেণ
কী করে এত রোদ আনো, এত ছায়া আবার
দেওয়ালে,
কদম গাছ একটানা দাঁড়িয়ে থাকে
এসব পাবে বলে,
বাঁশপাতি কাউকে ছাড়ে না, কাঠঠোকরাও ভয়ে পালিয়ে যায়,
কী করে এত শক্তি পায় পাখি এই শরতে!
লকডাউনের দুর্গা
এখানে আর কেউ আসবে না,
শুধু কলমীশাকগুলো ইচ্ছেমত বাড়তে থাকবে,
উচ্ছে গাছ মরে যাবে একা একা,
ভারতী মণ্ডল স্টেশনে এসে রোজ ফিরে যাবে,
ট্রেন চলবে না,
আমরা একা একা অল্প সব্জি দিয়ে ভাত ফুটিয়ে
খাব।
বরাভয়
আমার শরীর থেকে উঠে আসছে তোমার বরাভয়,
আমি বুঝি আমিও দেবী
এই রোদ যতক্ষণ আমিও ততটা দেবী
নিজেকেই বধ করে চলি অবিরাম
ধাক্কা মেরে ফেলছ আর আমি উঠে দাঁড়াচ্ছি,
ধাক্কা মেরে ফেলছ আর আমি উঠে দাঁড়াচ্ছি,
ধাক্কা মেরে ফেলছ আর আমি উঠে দাঁড়াচ্ছি,
অসুর নয়, নিজেকেই বধ করে চলি অবিরাম।
চোখের নিচে কালি
ঘামের গন্ধে কর্পুর আর ধুনো,
নতুন কড়কড়ে শাড়ি আর পারফিউম,
তবু চোখের তলায় কালির দাগ...
দেবীচিহ্ন
গলায় ত্রিশূলের মতো এই আঁচড় কামড়ের দাগ
দেখেই তো
দেবী বলে চেনা যায়,
ঘাড়ের কাছে খানিকটা মাংস খুবলিয়ে তুলে
নেওয়া,
সারা গায়ে কালসিটে আর ছ্যাঁকা,
পিঠ খুললে-
থাক,
দেবীর কিছু আঘাত নিজস্ব থাক,
তবে গুছিয়ে নিতে এত সময় নিচ্ছে
যে অসুর বধের লগ্ন প্রায় বয়ে যায়!
এসো মার দাও পালটা মার
‘কৌমারী শক্তি অস্ত্র দ্বারা,
বারাহী অসির দ্বারা এবং মাহেশ্বরী ত্রিশূল দ্বারা মহাসুর রক্তবীজকে
আঘাত করিলেন।’
আঘাত করো, যার কাছে যা অস্ত্র আছে,
চুলের কাঁটা, লংকার গুঁড়ো, আঁশবটি,
মেধা আর মেরুদণ্ড-
আঘাত করো-
রক্তবীজ কখনো মরে না, এক এক বিন্দু থেকে জন্মায় লক্ষ রক্তবীজ,
তাই জিভ দিয়ে চেটে নাও রক্ত।
পালটা মার দেবার সময় এখন।
শারদ বিষাদ
কী দিয়ে এই কান্না লিখব বুঝতে পারছি না।
এমন কোন হরফ আছে কি, যাতে এই অশ্রুগুলো ফুটে ওঠে
এই পুজো আমাকে বারবার ব্যর্থ করে চলে যায়,
এই শারদ স্যুভেনিরের প্রথম থেকে শেষ
পর্যন্ত আমি নেই,
আমি একটা হেমন্তের পাতার মতো ঝরে পড়ছি,
আমার কিছু নেই যা দিয়ে আমি এই পতন ঠেকিয়ে
রাখতে পারি।
অস্ত্র দিতে ভুলে গেলে মাগো?
জন্ম দিলে, কেন অস্ত্র দিতে ভুলে গেলে?
কেন শিখিয়ে গেলে না মারের বদলে পালটা মার
দিতে হয়,
কেন বারবার আমরাই মেনে নেব, সুখাদ্য সাজাব,
এক কোণে গন্ধরাজ লেবু, লঙ্কা,
তেতো দিয়ে শুরু হয়, তারপর একে একে শাক পাঁচ ভাজা,
মাথা দিয়ে ডাল, কমপক্ষে দুটি নিরামিষ, তারপর মাছ... কেন, কেন?
থালা সাজানোয় আমি লেগে থাকি,
ওই থালা ছুঁড়তে পারি না,
জন্ম দিলে, কেন অস্ত্র দিতে ভুলে গেলে মাগো?
1 মন্তব্যসমূহ
খুব ভাল লাগল প্রতিটা কবিতা।
উত্তরমুছুন