গুচ্ছ কবিতা
দেশ দ্বেষ কিংবা মনু সংহিতা
১
ছোটবেলায়, দেশ বলতে বুঝতাম আমাদের গ্রামের বাড়িটিকে। বাবার চাকুরী সূত্রে শহরের
ভাড়াবাড়ি যেন দেশ নয় কেবলই এক ঠিকানা মাত্র। নিছক এক পিনকোড। তাই ইস্কুলে পুজো বা গরমের ছুটি পড়লেই যখন আমরা ঊর্ধ্ব শ্বাসে ছুটতাম দেশের
বাড়িতে তখনও নীরেন্দ্র নাথের ‘দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকারের
মধ্যে তুমি' চোখে বা চেখেও
দেখিনি। তখন ঐ গ্রামের বাড়ি আর তার রাস্তার ম্যাপ ছিল দিনের আলোয় টানটান খোলা এক
পাতা।
২
ইকির মিকির চামচিকির
চামেকাটা মজুমদার
ধেয়ে এলো দামোদর…
বলতে না বলতেই ধাঁ করে পৃষ্ঠদেশে ধেয়ে এলো প্রচণ্ড কিল । মুখ ফেরাতেই দেখি নাকের পাটা
ফুলিয়ে ফুঁসছে তুফানি । খুব রাগ ছিল তার খুব রাগ । অন্তত ছোটবেলায় তেমনই মনে হোতো।
আর এখন, যখন জেনে গেছি জীবন আসলে এক ধূসর রাগ বাহার মানে ঐ ‘ফিফটি শেডস অফ গ্রে' এখন বুঝি রাগ নয় আসলে সেসবই ছিল তুফানির গায়ে লেপে দেওয়া অনন্ত শূন্যতার ঝাঁঝ।
৩
বেঁচে থাকলে সে এখন নব্বই ছুঁই ছুঁই হোতো।নব্বই বছর
আগে গ্রাম বাংলার নেহাতই এক ছাপোষা ঘরের মেয়ের নাম তুফানি ! ভাবা যায় ! ঠাকুমা বলেছিল যেদিন সে জন্মায় সেদিন নাকি ঝড় উঠেছিল প্রবল যেন তুফান। আর আমি দেখি পিসিমার তুফানি রূপ। পাকা গমের মতো রং , তিলফুল
নাসা, হরিণ চোখ, দেখলেই বুকের মধ্যে অবশ্যম্ভাবী গুড়গুড় তুফান শুরু।
৪
এলাটিং বেলাটিং সই লো / রাজামশাই একটি বালিকা চাইলো …
রাজা স্বয়ং চেয়েছে যখন ,তখন আর অগ্র
পশ্চাৎ দেখা শোনা ! বরং ঢাক ঢোল মৃদঙ্গ বাজে অষ্টম বর্ষীয়া তুফানি বাপের বাড়ির উঠোন পেরিয়ে চলে যায় । চলে যায় অন্য উঠোনে । চলে যায় লাল চেলি বিবাহের সাজে ।
৫
ওঘরে যে বাঘ কে তা জানত !
রাজা কিনা, তাই তার রোগেও ছিল রাজ- রোশনাই। তখন যক্ষ্মাকে রাজরোগ বলা হোতো এবং বলা
হোতো নিরাময় অযোগ্যও। এদিকে সেই রাজামশাই ছিলেন তার বংশের শিবরাত্রির সলতে সুতরাং সলতেটি নিভবার আগেই বংশধর চায় যে! নইলে যে
বৃথা যায় ধন আহরণ। তড়িঘড়ি রোগ লুকিয়ে বিবাহ। এদিকে মেয়ের (তুফানি) তখন পিরিয়ডই
হয়নি সরি পিরিয়ড বলতে নেই বলতে হয় মাসিক। কিন্তু যমের তো তর সয় না। বলো হরি হরি
বোল ছিটিয়ে সে দেয় সলতে
নিভিয়ে।
৬
স্বামীখেকো বিধবা কুমারী ফিরে আসে পূর্বাশ্রমে। দাদা ভাইয়ের ভরাট সংসার। সেখানে এমন
অলক্ষুণে বিধবার পা ! তাও কিনা আগুন রূপসী ! দাও চুল মুড়িয়ে মুড়িয়ে একদম কদম ছাঁট
করে। না ইঞ্চি পাড় নয় ,পরনের কাপড় হোক ধূধূ সাদা যেন অনন্ত
বালুচর । বাতাসের গায়ে ভাসে
আলোচাল ঘ্রাণ
৭
এদিকে তুফানির ছিল আমিষান্ত প্রাণ। শুধু মাছ নয়, আঁশ কানকো তেল পটকা সব সবেতেই তার ...।। ওদিকে সংসার
বিজ্ঞপ্তি ঝোলায় মাছ দুরস্থান এমনকি কলাইডালও নিষিদ্ধ ! আহা কেমন সুগন্ধ ছড়ায় বোঝো না!
আর সাদা শাড়ির তুফানি, রাতভর ভেজানো কলাইডাল টুকরিতে নিয়ে নামে পুকুরের ঘাটে। পৌষের
সকাল। নিরামিষ বেড়ি পরা তুফানির হাত কলাইয়ের ডাল নাড়ে পুকুরের জলে ।খোসার মোড়ক
ফ্যাটিয়ে সাদা হয় টুকরির ম্যাপ, ধুয়ে যায় যাবতীয় ডালের কালোরা ।এক কম্বল শীতের মধ্যে ঢুকে যায় নতুন বড়ির
ঘ্রাণ। তুফানিরই হাতের ফোড়নে টগবগ টগবগ ফুটে ওঠে বেগুন বড়ির ঝোল আগুন হাঁড়িতে । রসনায় তৃপ্ত সুখী সংসার তোলে প্রশান্ত উদ্গার।
তুফানি, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আলো চালে মাখে সৈন্ধব লবণ বিষাদ ...।
৮
আচ্ছা তুফানির দেশ কোথায়! দেগে দেওয়া দ্বেষ ছাড়া আদৌ
কি আছে তুফানির কোনও দেশ!! তুফানিদের দেশ!?
আমি দেখি পৃথিবীর সমস্ত তুফানিরা কলার মান্দাসে বসে
দুখানি বিধবা হাত দিয়ে জলের আঁচড়ে আঁকে মনু সংহিতা।
0 মন্তব্যসমূহ