‘ভাষালিপি’ থেকে প্রকাশিত
চার ফর্মার পেপারব্যাক বইটিতে কবিতাগুলোর আলাদা করে কোনো নাম নেই, সংখ্যার মাধ্যমে
সূচিত করা হয়েছে তাদের। কিন্তু আমার মনে হয়, গোটা বই জুড়ে একটিই কবিতা লিখে গেছেন
অরূপরতন। না আমি তথাকথিত কোনো বুক রিভিউ লিখতে বসিনি, চেষ্টা করছি কবিতাগুলো আমার
বোধের জগতে যে অভিঘাত তৈরি করছে, সেই তরঙ্গের দু-এক ঝলক তুলে ধরতে।
বইটিতে আদিগন্ত ছড়িয়ে আছে
প্রেম ও বেদনা। অরূপরতন হালদারের কবিতা এই প্রথম আমি একসঙ্গে এতগুলো পড়ছি, আর যে
কথা মুখবইয়ের পাতায় ওঁর লেখা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে বারবার, সে ধারণা আরও দৃঢ়বদ্ধ
হচ্ছে। প্রথমেই আসি বইটির নামের প্রসঙ্গে, শূন্য রক্ত গাথা, এমন তিনটি আপাতসম্বন্ধযুক্ত
শব্দ নিয়েও কেন বইটির নাম ‘শূন্য রক্তগাথা’ হল না, সে কথা আমাকে ভাবিয়েছে। শব্দগুলিকে কেন সিঁড়িভাঙা
অংকের ধরনে প্রচ্ছদের ওপর বসিয়ে দেওয়া হল, একথা সত্যিই ভাবায়। পড়তে পড়তে আমার মনে
হয়েছে, জীবনের সঙ্গে নিউক্লিওলাস অবধি জড়িয়ে থাকা এই তিনটি শব্দ কিভাবে জারিত হয়ে
উঠেছে কবির বোধের জগতে, অথবা জারিত করেছে কবিকে, তারই ধারাভাষ্য এই বই। এক আশ্চর্য
ঘোরের মধ্যে লেখা সম্পূর্ণ বইটি,
যে ঘোর পাঠককেও সংক্রমিত করে, ফেলে দেয় তুমুল দ্বিধায়, অস্বস্তিতে, দাঁড় করিয়ে দেয়
নিজের মুখোমুখি।
পেশায় চিকিৎসক এই কবি জীবন
জন্ম মৃত্যু ও মানুষের বিপন্নতাকে চুল্লির ভেতর হাত ডুবিয়ে আগুন স্পর্শ করার মতো
করে ছুঁয়ে দেখেছেন তাঁর পেশার কারণেই। পাঠাভ্যাস তো আলাদা বিষয়, সে তো থাকবেই।
কিন্তু এ এমন এক পেশা যাতে জীবনের আলো ও অন্ধকারের মাঝে যে সরু একখানি রেখা, তাকে
অনুভব করার এক বিশেষ সুযোগই বলি বা বাধ্যবাধকতাই বলি, তা আপনাআপনিই ঘটে যায়, তার
ওপর নিজের আর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাই তাঁর কবিতার নোঙর গাঁথা হয়ে যায় সৃষ্টির আদিম
শূন্যতা থেকে শুরু করে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শিকড়ে, আবার বিস্তারিত বৃক্ষের মতো তার
লৌকিক অলৌকিক ও অতিলৌকিক বিভা ছড়িয়ে পড়ে সমকালে, বিজ্ঞানবোধে, যাপনের দৈনন্দিনতায়,
মৃত্যুচেতনায়। তাই রাস্তা থেকে নিঃশব্দ থাবায় বেড়াল উঠে আসে তাঁর বিছানায়।
চায়ের কাপ থেকে মর্মর জেগে ওঠে রাত্রির শিরায়,
সে মেঘের মতো ওড়ে, তার রক্তাম্বরখানি আমাদের
স্বপ্নে এসেছে। টেবিলে, চেয়ারে, চিরুনির দাঁতে তুমি
বিম্বিত, সে আলোয় গোপন ছুরিরা কথা বলে, হাসে,
(২১)
অরূপরতন কবিতায় ছবি আঁকেন।
তা বলে কখনই তাঁর কবিতাকে বিবরণধর্মী বলা যাবে না, বরং একটি ছবিকে বিমূর্ত রূপ
দেওয়ার মতো দুরূহ কাজ তিনি করে ফেলেন অনায়াসে। এক গূঢ় সান্ধ্যভাষায় তাঁর চলাচল।
আশ্চর্য তাঁর শব্দপ্রয়োগ। এখানে শব্দচয়ন কথাটি কিন্তু বলছি না, বরং ওঁর কবিতায়
যেমন ধ্রুপদী শব্দের ব্যবহার বহুলাংশে রয়েছে, আবার খুব সাধারণ, প্রাত্যহিকতা থেকে
উঠে আসা শব্দও প্রয়োগের গুণে বাক্যগুলি হয়ে ওঠে ধ্রুপদী। আর শেষ অব্দি পাঠক পেয়ে
যান এক একটি বিরাট ক্যানভাসজোড়া ছবির ইঙ্গিত। আবার কোনো কোনো কবিতায় আমি শুনতে পাই
ইমন কল্যানের থেকে মধ্যরাতের দরবারি পার হয়ে সুর চলে গেছে আহির ভৈরবের দিকে। আমার
ভেতর জেগে ওঠে ভোর। সেই সুর, সে ছবির ভেতরে ঢুকতে গেলে পাঠককেও হতে হবে তার
অংশীদার, নইলে সে ছবি বা গান হয়ে উঠবে দুষ্প্রবেশ্য।
এই চকখড়ি, ভেতরে সারেঙ্গী বাজে, তোমাকে ছাড়া
কিভাবে আলোর ভেতরে যাব? কথা হয় জ্যোৎস্নায়,
ওইখানে কুয়াশার মাতন, বালকাশ্রম ফিরে আসে।
(২৩)
কবি তাঁর নারীকে এভাবে আকুল হয়ে ডাক দেন, আর এই
সাতান্নটি প্রেমের কবিতা, সাতান্নটি টুকরো একটিই চিঠি হয়ে ভেসে যাচ্ছে সেই নারীর
দিকে,
… তোমার প্রেমের ভার নিয়ে কাগজের
নৌকোরা গেছে গলিপথে, কোনো নিরন্ন বাঁকে তারা
দেখে মহামায়া ভেসে যায়, গায়ে তার অজস্র
দোমড়ানো ঘড়ির কাঁটা…
আসলে কবি এক স্বপ্নাচ্ছন্ন পাখি, কবেকার রাত্রি এসে
তাকে অসাড় জলের দাহ দিয়ে গেছে। কখনও প্রবল রভসে, কখনও তীব্র বেদনায়, কখনও
বিষণ্ণতার মাঝে তিনি ডাকছেন তাঁর নারীকে।
কুয়াশা এসেছে আমার ধমনিতে, সূর্যমুখীদের হিংসা
থেমে যায়; তুমিও বঁধুয়া যেমন, শ্বাস টানো। মরমি
বাহুতে উল্কির রোমন্থন ফিরে আসে, চাঁদোয়ার নিচে
মৃগদাব জ্বলে, পরিপক্ক দিন নজরানা চেয়েছে। তোমার
দাঁতের কোরকে মাংসর স্তব, চাপ অনুভূত হয় গোপন
হত্যার শরীরে। ঘুরন্ত নাগরদোলা প্রকৃত বিভ্রম, তুমি
দেখ রোমাঞ্চিত দৃশ্যপট, শ্রাবণ শ্রাবণের ভেতরে
বাকশূন্য জল নিয়ে বয়েছে। অববাহিকার মদির গর্ভ
থেকে চুলের গন্ধ আসে, একটি উল্লসিত পাত্র তার
জননী অবধি পোড়ে।
(৩৭)
কী মারাত্মক লাইন— একটি উল্লসিত পাত্র তার জননী অবধি
পোড়ে। যে সঘন জ্বালা কবি অনুভব করছেন পলে অনুপলে, সেখানে পাত্র তার তৈরির উপাদান
অবধি পোড়ে, কুর্নিশ জানাই কবিকে এমন ভাবনার জন্য। এরকম আরও কিছু লাইন পড়ে আমি চমকে
উঠেছি, তার কয়েকটি না উল্লেখ করে পারছি না,
হাওয়ায় ভাসমান দেহ ছিঁড়ে
যায়, ভাতের শরীর (৩)
হঠাৎ স্তিমিত রূপের কাছে চলে
আসি (১)
গমনোদ্যত কুকুরের দেহরেখা
থেকে আলো আসে শরীরে(৬)
তোমার স্তবের ভেতর পা ফেলি,
পা পুড়ে যায় (২৫)
চায়ের কাপের মধ্যে অবিনাশী
ভ্রূণের আক্ষেপ (১৯)
বৃষ্টির কাঁথা ফোটে একটি
মুহূর্ত জুড়ে (৪৮)
তমসার নাড়ি ধরে রাস্তা
সূর্যের দিকে যায় (৫১)
এমন আরও বহু লাইন আছে মনে
থেকে যাওয়ার মতো, আছে আশ্চর্য কিছু শব্দবন্ধ, যেমন—পাখিরঙ ছাদ, স্বয়ংপ্রভ পাঁজর,
ইত্যাদি। আসলে বইটি এভাবে এত অল্প সময়ের মধ্যে পড়া ও তার পরবর্তী সংবেদন ভাষায়
বর্ণনা করা অন্তত আমার পক্ষে বেশ কঠিন। কেননা, এ-বই রয়ে-সয়ে পড়ার, ধীরে কোনো
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভেতরে প্রবেশ করার মতোই হওয়া উচিত এ-বইয়ের পাঠ। তবু প্রথম পাঠে
আপাতভাবে যে কথাগুলি মনে আসে,
অরূপরতনের কবিতায় বারবার
গানের অনুষঙ্গ এসেছে। এসেছে কমলা ঝরিয়া থেকে আখতারীর কথা, বিবিধ বাদ্যযন্ত্রের
কথা, রাগ-রাগিনীবিষয়ক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কথা। আর কবিতাগুলোও যেন সেভাবেই বেজে
উঠেছে। বিজ্ঞানের অনুষঙ্গ এসেছে, সে তো আসবেই, কিন্তু, তা এসেছে এমনই সংগোপনে, যেন
প্রায় বুঝতে না দিয়ে। যেমন একটি ছবি আঁকতে গেলে আলো বা ছায়া কোনদিক থেকে পড়বে
ভৌতবিজ্ঞানের এই বোধটুকু একজন শিল্পীর যেমন থাকা প্রয়োজন, অথচ তা কখনই প্রকট হয়ে
ওঠে না ছবিতে, একজন জাত রাঁধুনীর রান্নায় যেমন কোনো একটি মশলার গন্ধ উগ্র হয়ে উঠবে
না, একজন প্রাজ্ঞ রসায়নিক যেমন জানেন কিভাবে নীল থেকে লাল হয়ে ওঠে লিটমাস কাগজ,
ঠিক তেমনই এক নিপুণ শব্দশিল্পীর মতো অরূপরতন তাঁর ক্যানভাস ভরে তুলেছেন অন্তর্গত
ক্ষরণের লিপিতে।
একটি কবিতার কথা না বলে
পারছি না, যদিও এই ধরনের আনপ্রডিক্টেবিলিটি ওঁর লেখায় বারবার এসেছে। যেমন,
‘হাইড্র্যান্ট’ শব্দটি শুনলেই জীবনানন্দ মনে পড়ে, মনে পড়ে কুষ্ঠরোগীর কথা, অথচ
সেখানে, অরূপরতন লিখছেন, হাইড্র্যান্ট ভরে যায় তূরীয় চুমোয় (৯)। মোহ ও নির্মোকের
মধ্যে যে দোলাচল, হয়তো বা প্রবল বিদ্রূপ, হয়তো যন্ত্রণা… এভাবে একের পর এক ‘হয়তো’
বসিয়ে যাব, কিন্তু লক্ষ্যভেদ হবে না। আর এটাই ওঁর কবিতা। যে কবিতার কথা দিয়ে শুরু
করেছিলাম,
কদম গাছটার নিচে সারা দুপুর ট্যাক্সিটা ভেজে,
তার শরীর থেকে হলুদ দেবদূত প্রাচীন ডালে
এসে বসে, তোমার প্রেমের থেকে দূরে, কদমের
গাছ সব জানে।
(১৮)
‘কদম গাছ’ শুনলে প্রথমেই মনে
আসে কৃষ্ণের কথা, বা বৃষ্টিদিনের প্রথম ফুলের সুবাসের কথা। কিন্তু, সেখানে অরূপরতন
নিয়ে এলেন একটি হলুদ ট্যাক্সিকে। সেই এ কবিতার নায়ক। কদম গাছ চুপচাপ সব দেখছে, যেন
সে এক নিয়ন্তা। শেষ অব্দি আমরা দেখি, শ্রাবণের টুকরোরা প্রতিটা কাগজের নৌকো থেকে
অন্ধকার তুলে নেয়। পড়ে থাকে শুনশান রাস্তা, আর মাঝরাতে একটা নিভে যাওয়া তারা একা
একা চলে যায় গঙ্গার দিকে। এখানে এসে মনে হয়, তাহলে… তাহলে সেই হলুদ ট্যাক্সিই কি এ
কবিতার নায়ক! হয়তো না, হয়তো হ্যাঁ, আবারও সেই ‘হয়তো’-র দোলাচল। হয়তো সেই নিভে
যাওয়া তারাটিই এ কবিতার নায়ক।
এ বই যেন এক দহনের গাথা, যার
চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসছে রক্ত। তাই যে মূর্ছার অতল থেকে নিঃশব্দ ঘোড়াটির কেশরে যে
শ্রাবণ নেমে আসে, তা তাঁর রক্তের অধিগত, তবুও তিনি ব্যর্থ প্রেমিক। কিন্তু এখানেও
কথা আছে, যে কারণে লেখাগুলি একরৈখিক অর্থাৎ শুধুমাত্র দু-জন নরনারীর প্রেমের কবিতা
না হয়ে, হয়ে উঠেছে যে কোনো সংবেদনশীল মানুষের খুব কাছের কবিতা, তার একটা বড়ো কারণ আমার মনে হয়,
কেন্দ্রাভিগ ও কেন্দ্রাতিগ চলাচল। কখনও কবিতার পাড়ে বসে কবি দেখছেন জীবনকে, আবার
কখনও তীব্র প্যাশনেট হয়ে আঁকড়ে ধরছেন কবিতাকে। যেমন ধরা যাক ৫৭ সংখ্যক কবিতাটি,
বৃষ্টির পিপাসা নিয়ত, শস্যের অবলোকন একটি
ভূমার মতো হার্দ্য অথচ করুণ। তার পৃষ্ঠাগুলো
কবোষ্ণ, জানে বহুকৌণিক নক্ষত্রদের জীবন,
ছাইয়ের মাত্রাবোধ ও উড়ন্ত গালিচা, জানে তার
জাদুর ভেতর একটি অশ্রুর বিন্দু কিভাবে অনন্তের
দিকে যায়। ছায়ার আগুন মারীচের নিঃশ্বাস থেকে
দূরে আজ দেখে জলের রজঃ সন্তপ্ত, তবু গ্রহদের
শিথিল জীবন তাকে আমোদিত করে।
বইটি পড়তে পড়তে শেষ অব্দি মনে হয়, এ নিছক রোম্যান্টিক
প্রেমের কবিতার বই নয়। আসলে মাকড়সার অনিবার্য লালায় বিহ্বল এক মানুষ টের পায় একটা
নির্জন দ্বীপ একসময় পৃথিবী হয়ে ওঠে, সে টের পায় মাকড়সার অলৌকিক শ্রমের মধ্যে একটা
ব্রহ্মাণ্ড বিদ্ধ হয়ে আছে সেই আদিকাল থেকে, সে দেখে ছুরিটি রমণীয়, তার ফলার শীর্ষে
এক মাধব কি গভীর নীল! সে বুঝতে পারে কবিতার এই অনন্ত যাত্রাপথে পিচ্ছিল শ্যাওলার
গ্রহ, সে গ্রহ জটিল, আরও জটিল, তার সম্বিত নিভে যায় যে বিমূঢ় স্রোতে, সেখানে
বস্তুর মায়া নেই, কেবল এক অবিদ্যা ধীরে ফুটে ওঠে… একটা পাতার জীবন ক্রমে আরও গোপন,
স্তব্ধ
শূন্য রক্ত গাথা
অরূপরতন হালদার
ভাষালিপি
0 মন্তব্যসমূহ