নৈঃসঙ্গ্যেরও গতি আছে
জীবনানন্দ দাশের সাথে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করতাম একাকীত্ব আপনার কি কারণে ভালো লাগতো। কবি মানুষজন তেমন পছন্দ করতেন না। হাঁটা পথে পরিচিতজনকে দেখলে তিনি উল্টো পথ ধরতেন। বিষয়টি জানা বলেই পরিচিতরা তো বটেই নতুনরা তাঁর কাছে যেতে বিব্রতবোধ করতেন। একাকী থাকতে পছন্দ করতেন বলেই কি তিনি অল্প আয়ুর ভেতরে কয়েক ট্রাংক কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ লিখতে পেরেছিলেন? এসবও জিজ্ঞাসা করা যেত। আটান্ন বছরের অনুজের পক্ষে এই জিজ্ঞাসা কোনও মতেই সম্ভব না হলেও জীবনানন্দের সৃষ্টিশীলতার গভীর তল পেতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। ভারতের বাইরে তিনি কখনো যাননি কিন্তু তাঁর লেখার মধ্যে তিনি বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। নিঃসঙ্গ জীবনানন্দ এখানেই সার্থক।
তার মানে এই নয় একাকী জীবন খুব সুখের। আবার কোলাহলের মধ্যে থেকে আমরা
যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও একাকী থাকতে ভালোই লাগে। সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় দীর্ঘ ট্টেন যাত্রায় বঙ্কিম রচনাবলী সাথে নিতেন। এক সাক্ষাতকারে তিনি
বলেছিলেন, তাকে যদি কোনও দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয় তবে তিনি রবীন্দ্র রচনাবলী সাথে
নিয়ে যাবেন। মেঘদূত কাব্যে নিঃসঙ্গ যক্ষ মেঘকে অবলম্বন করে বার্তা পাঠাতেন তাঁর প্রিয়তমা
স্ত্রীকে। এই যে রবীন্দ্রনাথ-জমিদারপুত্র; জমিদারী দেখাশোনা করেছেন
পূর্ববঙ্গে,তাঁর ভরা সংসার। একে একে প্রিয়জনের অকাল মৃত্যু তাঁকেও নিঃসঙ্গ করেছে।
রচনাবলীর মধ্যে জায়গা নিয়ে আছে সেই দুঃখজাগানিয়া প্রসঙ্গ। স্ত্রীর মৃত্যুতে কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা রবীন্দ্রনাথকে আরও নিঃসঙ্গ করেছে। পৃথিবীর
সকল কবির জীবনে নৈঃসঙ্গ কম বেশি তাড়া করেছে। বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’
উপন্যাসের রাজেনবাবুর পাঁচ-পাঁচটি কন্যা তার কিন্তু তিনিও নিঃসঙ্গ। স্ত্রী শিশিরকণার মৃত্যু রাজেনবাবুকে
একাকিত্বের দিকে নিয়ে গেলেও তার নৈঃসঙ্গ তার কাছে বিরক্তিকর হয়ে ওঠেনি বরং মেয়েদের
নিয়ে তার যে উচ্ছ্বাস তাও নৈঃশব্দ্যের প্রলেপে ঢাকা। অর্থ্যাৎ মানুষ মূলতঃ যে একা
তা রাজেনবাবুর ভরা সংসারের দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়। একাকিত্ব নৈঃসঙ্গ
চেতনাকে সীমারেখায় বেঁধে ফেলে।
জুটি ভেঙ্গে গেলেও একাকিত্বে ভোগেন স্বামী অথবা স্ত্রী। আমাদের
পরিচিত কবি সৈয়দ রফিকুল হায়দার ছিলেন আমলা। বেশ কিছু ভালো কবিতা লিখেছেন তিনি।
স্ত্রীর সাথে তার চমৎকার সম্পর্কের বিষয়টি ছিল সকলের জন্য উপভোগ্যের। উপভোগ্য এ
কারণেই তিনি নিজেই তাদের দাম্পত্য বিষয়ের নানা কথা বন্ধু ও পরিচিত মহলে অবলীলায়
বলতেন। প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর অল্প দিনেই তিনি তাঁর অনুগামী হন। কখনো
কখনো ক্রিকেটে জুটি ভেঙে গেলে সাথীটিও বেশিক্ষণ ক্রিজে থাকতে পারেন
না।
এবার নিজের কথা। মানুষ মূলত একা হলেও এই যে আমি - সব সময়ই কোলাহলের
মধ্যে থাকি; কখনো কি নিঃসঙ্গতা আমাকে গ্রাস করতে চেয়েছে? বিষয়টির সংক্ষিপ্ত ব্যাখা
দেয়ার আগে আমার সারা জীবনের কাব্যচর্চাার তালিকা নজর করে দেখি নৈঃসঙ্গ নিয়ে আমার একটি বাক্যও নেই। তাহলে জীবনটা কি স্রোতের স্বপক্ষেই ছিল? এই সাধারণ
জীবনে অনেক কিছুকেই অসাধারণ মনে হয়েছে। জীবনকে দেখছি বিস্ময়ের সাথেই। হিশেব নিকেশ যে
করি না তা নয়। ব্যর্থতা আমাকে অনেকক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ করেছে। আবার পরক্ষণেই আশাবাদী
হয়ে উঠেছি বলেই দুঃখবোধ একা একাই বিলীন হয়েছে। কিন্তু এ গুলো নিজের কবিতায় এসেছে
ঠিকই তবে সামগ্রীকভাবে তা ইতিবাচক অর্থ প্রকাশ করেছে। সেই অর্থে আমার গতানুগতিক
সাধারণ জীবন এবং কবিতা কখনো আলাদা হয়ে ওঠেনি। বই যেমন নিত্য সঙ্গী হাস্যকর হলেও
বউও তবে প্রয়াত সৈয়দ রফিকুল হায়দারের মতো নয়। সংসার জীবন স্থূল হলেও তাকে
পাশকাটানোর উপায় নেই।
ধারণা করি, নিঃসঙ্গ জীবনের গতি কখনো কখনো সঙ্গ থেকেও আনন্দের যা আমি
এখনো পাইনি। পেয়েছিলেন সর্বগ্রাসী জীবনানন্দ দাশ।
0 মন্তব্যসমূহ