[ মৃত্যুর সময় হৃদয় শ্বাস মস্তিষ্ক ইত্যাদি দেহের বিপাকীয় অঙ্গগুলি বন্ধ হাওয়ার
সাত সেকেন্ড পর মন ও প্রাণের অমূর্ত ক্রিয়া নিয়ে কাউন্ট ডাউন কাল্পনিক দর্শনমূলক
গদ্য ‘নির্বান পথ’। মন ও প্রাণশক্তি মৃত্যুর পর কিছুক্ষন শরীরে থাকে, এই বিজ্ঞান প্রসূত থিয়োরীর প্রেক্ষিতে এই কল্পনা। প্রথম অধ্যায়টি ‘বিচ্যুতি’। সাতটি স্তরে প্রাণ ও মনোশক্তির দেহের উপস্থ(নিম্নাংশ) থেকে উর্দ্ধমুখ দিয়ে
মহাশূন্যে লীন। এবার দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রথম অংশ ‘সুষুপ্তি’ বা নিদ্রা। এই অধ্যায়ে পার্থিব প্রাণশক্তির মহাপ্রাণের অথৈ সাগরে বিলীন এবং আবার
অভিযোজনের জন্যে পার্থিব জৈব আধারের খোঁজ(natural selection)।
দ্বিতীয় অধ্যায়
(আগের পর্ব Dormant/অকর্ম ও Silent/নিষ্কর্ম এর পর)
Activation/কর্ম
এক অনন্ত সম্ভাবনাময় মুখর শূন্যতা তার গোচরে এলো। শূন্য, কিন্তু দিকহীন অদৃশ্য ক্রমবিকাশের ধারায় মানব জীবনের অগণিত বুদবুদ। বুদবুদে অতীত বর্তমান ভবিষ্যত্ মিলেমিশে একাকার। সেই ভাসমান ও বহমান প্রতিটি বুদবুদের গায়ে নানা রঙের নক্সার মুহূর্মুহু পরিবর্তনের
মত, অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের মিশ্রণ। বর্তমানে অতীত স্মৃতি, ভবিষ্যত চিন্তায় বর্তমান, অতীতে কোনও এক সময়ে
ভাবী পরিকল্পনা এই সব বুদবুদ পৃষ্ঠে খেলা করছে। এক একটি বুদবুদ এক একটি মানব জীবনী। জন্ম থেকে মৃত্যু বা ভাবী মৃত্যু অব্দি। অসংখ্য বুদবুদ অনন্ত শূন্য পথে। এই স্রোত যার গতি নেই দিশা নেই, কিন্তু সজীবতার শব্দের মত তার শব্দ শক্তি বোধে অনুভব হল। মুখর ব্রহ্মান্ডীয় সময় পথে ভাসমান অব্রহ্মান্ডীয় অসংখ্য অগণিত জীবন পাঠাগার। ব্রহ্মান্ড ও তার ভিতরে অগণিত সৌরজগত। তাদের মধ্যে সজল পার্থিব আবহের মত অসংখ্য আবহগুলির যতকাল আয়ু, ততকাল অবধি মানবজীবনের অগণিত অতীত ও ভাবী মানুষের জীবনী বুদবুদ। এক একটি নিরাকার অলিখিত জীবনী সংকলন এই স্রোতে বহমান। এই জীবনীগুলি যা ঘটেছে ও যা ঘটতে চলেছে, সেগুলির সাথে প্রচ্ছন্ন ভাবে মানুষের স্বপ্ন ও কল্পনাগুলিও রয়েছে। মানুষ যা কল্পনাতে অন্যরকম জীবন যাপন চাইত কিন্তু পরিবেশ ও সম্ভাবনা তাকে অন্য
জীবন শৈলীতে বইয়ে দিয়েছে, সেইগুলিও জীবনী বুদবুদের গায়ে ক্ষণিক বর্ণালী বীক্ষণের মত ধরা পড়ছে। এই জীবনী বুদবুদগুলির প্রবাহ অসম্ভব দ্রুত, কিন্তু তার বোধের প্রেক্ষাপট সমস্ত তথ্য নিমেষে গ্রহণ করে যাচ্ছে। জীবনী বুদবুদের মধ্যে শুধু জীবনযাত্রাই নয়, ভিন্ন যত মানুষের ভিন্ন যত রকমের অনুভব ইচ্ছা রূপ রস গন্ধ বর্ণ স্পর্শ কামনা
উগ্র বা শীতল কাম হিংসা করুণা সমস্ত মন ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভুতি আবেশগুলি
বিশদভাবে তার কাছে প্রকাশিত হচ্ছে। সব বুদবুদগুলির ভিতর থেকেই স্নিগ্ধ সবুজ জ্যোতি নির্গত হচ্ছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে
দেখে পার্থিব প্রকৃতির রূপরেখা তার কাছে প্রকাশ পেল। এবং কোন মানুষের প্রতি নিরাকার প্রকৃতির কতটা মমত্ব আকর্ষণ, তার বোধে ফুটে উঠলো। বিশেষ করে,কোনো কোনো বুদবুদের ভিতর থেকে এক ভিন্ন নীল
মমত্ব জ্যোতি আলাদা ভাবে নির্গত হতে দেখে বোঝা গেল ওইগুলি নারী জীবনী। যাদের স্বত্তা মাতৃরূপ। সেইগুলির উপর তার বিশেষ বোধ জাগতেই সে ভাব নিদ্রা থেকে চেতনের দিকে অগ্রসর
হওয়ার এক অব্রহ্মান্ডীয় শক্তি সৃষ্টি করল। তার বোধ ব্রহ্মান্ড আতিপাতি করে খুঁজেও কিন্তু পৃথিবী বাদে এমন সরস মায়াময় স্নিগ্ধ
সবুজ ও নীল মাতৃপ্রকৃতির মমত্ব আলো পায়নি। তার বোধ চেতন সেই বিশেষ নীল আলো নিঃসরক জীবনী বুদবুদের উপর স্থির হল। এই জীবনী বুদবুদের মধ্যে সম্ভাবিত কোনো একটি, তাকে প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাবার বাহক হলে একটি অলিখিত অব্রহ্মান্ডীয় চুক্তি
পালন হয়। যে সব বুদবুদ থেকে নীল আলো নিঃসরিত হচ্ছে সেগুলির দিকে ধেয়ে যাবার এক প্রবল
টান অনুভব করল সে।
তার অনুভবে সে দেখল, এক একটি নীল আভা উত্সর্জনকারী বুদবুদ অসংখ্য অন্ধ আবর্ত প্রসব করছে। সেগুলো যে অন্ধ তাদের স্ফুরণ প্রকৃতিই বলে দেয়। এইগুলি প্রাণধারণ করলেই তারা পার্থিব হয়ে বাঁধা পড়ে যাবে। এরা অন্ধ,প্রাণ সংগ্রহের খোঁজ নিজেরা করতে পারেনা, তাই আগ্রাসী আকর্ষণ ক্ষমতা। অদম্য প্রবল মায়া টান, কিন্তু সেই মহা আকর্ষণ থাকতেও সে অনড় থাকতে পারল। এক এমন অসম্ভব শক্তিশালী শূন্য অন্ধ আবর্তের টান,যেটা কি, তার বোধে এলো না, কিন্তু সেটার ভিতরে ঢুকলে পরিণাম কি তা যেন তার অজানা নয়। কিন্তু যে ভাবে সংখ্যাহীন বুদবুদ থেকে অবিচ্ছিন্ন অসংখ্য অন্ধ শক্তি প্রসবিত
হচ্ছে, সেই তুলনায় তারা অতি নগণ্য মাত্রায় প্রাণ আকর্ষণ করতে পারছে। একটি পার্থিব মমত্ব বীজ সৃষ্টিতে কত যে অব্রহ্মান্ডীয় অসীম শক্তি নষ্ট হয়,এই অনুভবে তার আর একটু তন্দ্রার মাত্রা কম হল,আর একটু চেতনার দিকে অগ্রসর হল। এবার তার চারদিকে কুয়াশার মত যা ঘনিয়ে আসছে, তা হোল সময়, সেটা প্রত্যক্ষ করল। এই সময় কুয়াশা গ্রাস করবার সন্ধিক্ষণেই তাকে একটি অন্ধ আবর্তে প্রবেশ করে যেতে
হবে। এই এক বিধান। তাই মাতৃ বুদবুদগুলি থেকে তার এবং শুধু তারই উপযুক্ত একটি, যা থেকে যে নীল আভার স্ফুরণ হচ্ছে,তার ভিতর থেকে
বেরিয়ে আসা অসংখ্য অন্ধ আবর্তগুলির মধ্যে থেকে তারই উপযুক্ত একটিকে বেছে নিয়ে সেই
মূহুর্তে প্রবেশ হতে হবে। তবেই শেষ অব্রহ্মান্ডীয় শর্তটি পালন করা হবে। এবং সেটি হতেই হবে এই নিয়মে তার পূর্ণ জাগরণ হোলো।
যখন মহা সুষুপ্তির ঘোরে ছিল, তখন অসীমের পথে অনন্ত
বিস্তৃত হয়ে ছিল। এখন সে মায়া মমত্ব বুদবুদের স্রোতে স্থির এককেন্দ্রিক শূন্যদশায় মানব জীবনী
নিরীক্ষণ করছে। মহানিদ্রায় কত যে অর্বুদ ব্রহ্মান্ড তার শয্যা ছিল তার সমীকরণ হয় না। পরিমাপ হয় না। সেটা তার এখনো বিস্তার বোধের বাইরে। আগেই সে সমস্ত মমত্ব বুদবুদ থেকে নীল উত্সরণের অনুভব আলাদা করে নিয়েছে। এবার নীল প্রবাহে যখনই তার অভিনিবেশ তীক্ষ্ণ হল, সে তখন প্রতিটি নীল মমতার গভীরতা আলাদা আলাদা দেখতে সক্ষম হল। যেহেতু এখানে ব্রহ্মান্ডীয় সময়ের কোনো মানে হয় না, তাই অপার অব্রহ্মান্ডীয় শক্তিতে অতি দ্রুত মমত্বের পরিমাপ ও পছন্দে সে বোধ
নিবেশ করল। এবং প্রথম বোধ নিবেশে সে, যে যে নীল জীবনী
বুদবুদগুলি থেকে অন্ধ, অজ্ঞান, মিথ্যে, বিনিময়কারী, স্বার্থান্বেষী ও পশু সদৃশ নীল মমত্ব আলো নির্গত হচ্ছে, সেগুলোকে স্রোতে বইতে দিল। ওই জীবনী বুদবুদ থেকে সুদূর অতীত ও অদূর ভবিষ্যতের মমত্ববোধগুলি তার জানা হয়ে
গেছে এবং সেগুলি পার্থিব মানবজীবনীর অনুকূলে নয় সেটাও জানা হয়ে গেছে। যেহেতু এই অব্রহ্মান্ডীয় প্রণালীর পরিবর্তন একেবারেই অসম্ভব, এমনকি যে নিয়ামক সেও পারে না,তাই ওইসব ভুল
মমতাগুলিকে সেই একই খাতে বইতে দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
তার প্রাণ পুটুলি হঠাত্ মুহূর্তের জন্য তার অনুভবে এল। এবং এটা যে নির্ধারিত সেটা বুঝতে পারলো। সে দেখলো তার প্রাণ পুটুলি হঠাত্ একবার দীপ্তময় হয়ে উঠলো। সেই আলোর রঙ এক বিশেষ ধরনের নীল। যেটার ভাব আবেগময় বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞানময় প্রেমময় ও হুবহু পার্থিব প্রকৃতির অনুগামী। তাকে বহমান অনন্ত নীল জীবনী বুদবুদ থেকে এই রঙের সাথে রঙ মিলিয়ে যথার্থটিকে খুঁজে নিতে হবে, এই নির্দেশ। এবং অনেক অব্রহ্মান্ডীয় সময় ধরে নিরীক্ষণ করার পর তার যোগ্য জীবনী বুদবুদটি গোচরে এলো। বুদবুদের নিঃসরিত নীল মমত্বের আবহমণ্ডল ভেদ করে সে অন্ধ আবর্তগুলির স্রোতে ডুবে গেল। (ক্রমশ)
0 মন্তব্যসমূহ