সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

শান্তা মুখোপাধ্যায়

 


       জগৎগৌরী, বিষহরি অথবা মনসা 

 

“আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল……” বললেই নাগরিক জীবনে দেবব্রত কন্ঠ গমগম করে ওঠে। কিন্তু এখনও গ্রামদেশে যেখানে বর্ষায় লতাগুল্ম আগাছার আগ্রাসী সবুজে আদিম অরণ্য বাঙময় হয়ে ওঠে, সেখানে নীরবে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে আদিমতম সরীসৃপ তার চেরা জিহ্বা নিয়ে শিকারের সন্ধানে। তার প্রাণঘাতী বিষ এখনও মানুষের আতঙ্ক। আর এই আতঙ্ক মুক্তির উপায় হিসাবে ইতিহাসের কাল থেকে সে আত্ম সমর্পন করেছে সর্পদেবীর পায়ে। সর্পদেবী মনসা। নাগ-আভরণে ভূষিতা।

              “নাগ-আভরণে দেবী হইলা প্রচন্ড

               কালি-নাগিনী তার শিরে ধরে দন্ড।

              দুই ভিতে নাগদল ধরিল যোগান

              বাসুকি পঠেন কাছে শাস্ত্রপুরাণ

              অনন্ত তক্ষক নৃত্য করেন আপনি

              শঙ্খ মহাশঙ্খ করেন জয়ধ্বনি।“

 

দেবীর প্রথম ইঙ্গিত আছে ঋকবেদের একটি শ্লোকে।

       “ত্রী সপ্ত ময়ূর্যঃ সপ্ত স্বসারো অগ্রু বঃ

       তাস্তে বিষং বিজভ্রির উদকং কুম্ভিনীরিব।।

মানে তিন সাতে একুশ ময়ূরী, সাত কুমারী ভগিনী তোমার বিষ তুলে নিচ্ছে যেমন কলসী কাঁখে মেয়েরা কূপ থেকে জল তুলে নিয়ে যায়। এরই ছায়া দেখা যায় বিষ্ণু পাল আর রসিক মিশ্রের মনসামঙ্গলের বিষ ঝাড়া মন্ত্রে,

       ডাহুকার বহুড়ী তারা ঘটে পানি ভরে।“

ঋকবেদের অপর ভাবনায় তিনি জলদেবী “গৌরী”। তিনি বাস্তুদেবতা, আরোগ্যের দেবতা ও সম্পদের দেবতা বলে পূজিতা হতেন। আরোগ্য-পুষ্টির রূপকাশ্রিত দেবভাবনা। ইনি ইলা, পুষ্টি, শ্রী। ইনিই বাক, যিনি নারীরূপে গন্ধর্বদের ছলনা করে দেবতাদের সোম এনে দিয়েছিলেন। ইনি সরস্বতী। এই অভিন্নতা স্বীকৃত হয় উভয়েরই পঞ্চমীতে পূজাবিধি। প্রাচীন অভিন্নতা পরবর্তীকালে পরিবর্তিত হয়ে যায়। সরস্বতী বিদ্যারদেবী, মনসা বাক থেকে মূর্তিমতী বিষবিদ্যা। বৌদ্ধ মহাযান মতে বিষ বিনাশিনী দেবী মহাময়ূরী। আরও একজন বিষহরি দেবী আছেন,  তিনি জাঙ্গুলি তারা। এই নাম থেকেই কি পরবর্তীকালে মনসা জাগুলী নামে আখ্যাতা? মহাযান তন্ত্রের “সাধন” এ (উপাসনা পদ্ধতি) আর্যজাঙ্গুলী মহাবিদ্যার বর্ণনা আছে। তিনি পুণ্যলক্ষণা কুমারী। তাঁর পরিধানে মৃগচর্ম, সাপজড়ানো মেখলা, আশীবিষ হার, দৃষ্টিবিষ কর্ণাভরণ। তিনি বিষপুষ্প খান, মালুতালতার রস পান করেন। মহাযান তন্ত্রে দেবী একজটা তারার যে চিত্র পাওয়া যায়, তা মনসামঙ্গল কাব্যে মনসা মূর্তিতে প্রতিভাত। জাঙ্গুলী বিষবিদ্যা বলে বিষবৈদ্যের নাম ছিল “জাঙ্গুলিক।“ মনসাকে “চেঙ্গমুড়ি কানি” বলে বক্রোক্তি করা হয়। কেউ কেউ মনে করেন মনসার প্রতীক সিজ বৃক্ষ। আয়ুর্বেদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ভাবপ্রকাশে সিজ গাছের আরেক নাম “চেংমুড়ু”, সেখান থেকে নামটি এসে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে মনসার দক্ষিণযোগ প্রকাশ হয়ে পড়ে। তেলেগু ভাষায় সিজ গাছের নাম “চেমুড়ু” বা “জেমুড়ু”। কিন্তু দক্ষিণে জীবিত সর্পপূজার রীতি। প্রতীক পূজার রীতি নেই। “চেঙ্গমুড়ি কানি” আসলে শববাহনে ব্যবহৃত বাঁশে জড়ানো কাপড়। (ভাবুন একবার এখনো আমরা কাউকে অপছন্দ হলে মনে মনে অন্তত চেঙ্গদোলা করে তুলে ফেলে দেবার অভিপ্রায় রাখি।)

       মনসা শব্দের অর্থ মনের তীব্র বাসনা, কাম। মনসামঙ্গলের পালায় মনসা শিবের মানসপুত্রী। পদ্মপত্রে শিবের বীর্যপাতে উদ্ভূতা। একদিন কালীদহে ফুল তুলবার সময় তিনি প্রবল কামতাড়নায় আক্রান্ত হন। তখন তাঁর বীর্যপাত হল বিচিত্র পদ্মপাতে। এক কাক তা ছোঁ মারল, কিন্তু শিবের তেজবীর্য উদরে ধরে রাখতে পারল না। সে উগড়ে দিল। বীর্য পদ্মপাতা থেকে টলমল করে জলে পড়ে গেল। পাতাল ভেদ করে বাসুকির মা নির্মাণির মাথায় পড়ল। তিনি সেটি দিয়ে একটি পুতুল গড়লেন এবং জীবন দান করলেন। বাসুকি সেই মেয়েটিকে নাগেদের বিষভান্ডারের অধিকারিণী করে দিলেন। তাই তিনি শিবের মানসপুত্রী, পদ্মপাতায় উদ্ভূতা, পদ্মা। কিন্তু চন্ডীর তা বিশ্বাস হয় না। শিবের সাথে মনসা ঘরে এলে চন্ডীর সাথে তুমুল ঝগড়া, মারামারি, শেষে চন্ডী কুশের বাণ দিয়ে মনসার একচোখ কানা করে দিলেন। মনসাই বা কম কিসে? তিনি বিষ দিলেন চন্ডীকে। চন্ডী অজ্ঞান। কার্তিক, গণেশ কাঁদতে কাঁদতে শিবকে ডেকে নিয়ে এল। শিব এসে চন্ডীর অবস্থা দেখে কাঁদন জুড়লেন। তখন মনসা মন্ত্র পড়ে বিষ নামালেন। চন্ডী জ্ঞান ফিরে পেয়েই মনসার চুলের মুঠি ধরলেন। শিব বুঝলেন, খুব ঝামেলা! এদের আর একদন্ডও একসাথে রাখা যাবে না। অতএব, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও। এহেন মেয়ের পাত্র পাওয়াও কি চাট্টিখানি কথা! অনেক খুঁজে পাত্র পাওয়া গেল।  জরৎকারু মুনি। মুনির তিনকুলে কেউ নেই। বিয়ের পর চন্ডীর কুমন্ত্রণা বুঝতে না পেরে মনসা সাপের গয়না পরে স্বামীসম্ভাষণে গেলেন। মুনি ভয়ে তখনই পালালেন। সমুদ্রে গিয়ে শাঁখের মধ্যে লুকিয়ে রইলেন। সকালে শিব কন্যার অবস্থা দেখে রেগে আগুন। সমুদ্রের ধারে গিয়ে কোড়া পাখি হয়ে ডাক দিতেই শাঁখ জলের উপর ভেসে উঠল। শিব তখন ছোঁ মেরে শাঁখ থেকে জামাইকে বার করে নিয়ে মেয়ের কাছে এনে ফেললেন। মুনি দুদিন থেকে বাণপ্রস্থে চলে গেলেন। যাবার সময় মনসাকে বলে গেলেন, “তোমার গর্ভে সুসন্তান জন্মাবে।“ সেই সন্তান আস্তীক।

       নামমাত্র বিয়ের পর মনসা স্বাধীন। স্বাধীন, কিন্তু পেটের দায়? তাইই কি মনসামঙ্গলের মনসা পূজা পাবার জন্য এমন মরীয়া? চাঁদের নৌকাডুবি করে সর্বস্ব হরণ করেও শান্তি নেই। অশেষ দুর্গতির পর চাঁদ বা চাঁদো ঘরে ফিরল, আগে তো তার ছয় ছেলে মনসার কোপে বিষে নীল হয়েইছিল, এবার সে জ্বালা জুড়াতে লখীন্দর জন্মাল। লখীন্দরের বাসরঘরেই সর্পাঘাত ভবিষ্যবাণী হল। মা ছেলেকে বিয়ে দিতে চান না। বিয়ে না হলে আর সাপে কাটবে কি করে! তখন মনসা লখীন্দরকে কামে উন্মত্ত করল। লখীন্দর নিজের মামী কৌশল্যাকে ধর্ষণ করে বসল! এবার লজ্জিত চাঁদো পুত্রের বিয়ের ব্যবস্থা না করে পারে! অতএব লোহারবাসরে সর্প দংশন, বেহুলার স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে কলার মান্দাসে ভাসা…… কাহিনী এগিয়ে চলে যতক্ষণ না চাঁদো বাঁ হাতে হলেও দেবীকে পূজা দেন। এ কি মনসার আইডেন্টিটি ক্রাইসিস? না ক্ষমতালিপ্সা? না অতিবড় বিষবিদ্যা অধীগত থাকার অহংকার?

       সে জানা নেই। জানা আছে দেবী পূজার রীতি……

              “বরিষেক অন্তরে বরিষা সময়ত

              চারিদিন পুজিবেক শ্রাবণ মাসত।

              দুই সংক্রান্তির দুই পঞ্চমী পূজিবা

              পদুমাই সুপ্রসন্নে সুখত থাকিবা।“

 

তথ্যঋণঃ সুকুমার সেন রচিত বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খন্ড)

 

  

      


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ