মিথ্যে প্রচারের থেকেই কি মিথের জন্ম হয়? না’কি মিথের জন্ম দেওয়ার জন্যেই মিথ্যের প্রচার শুরু হয়? মিথের জন্ম প্রক্রিয়া কতটা সমাজিক আর কতটা রাজনৈতিক? মানুষের ইতিহাস পর্যালোচনা করে এই প্রশ্নগুলির উত্তর কি আমরা খুঁজে দেখতে যাই? সম্ভবত নয়। আমাদের চারপাশে কিভাবে প্রতিনিয়ত ছোটবড়ো মিথের জন্ম প্রক্রিয়া চলতে থাকে, সেই বিষয়ে কতটুকু ওয়াকিবহাল থাকি আমরা? সম্ভবত কেন, নিশ্চয় ওয়াকিবহাল থাকি না। থাকি না বলেই আমাদের চেতনে অবচেতনে আরও একটা মিথ দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আর সেটা হলো, বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ও সন্ত্রাসবাদী যাবতীয় কার্যকলাপের বিরুদ্ধে একমাত্র রক্ষক আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। এবং সেই সাথে দ্বিতীয় যে মিথটি সংযুক্ত। সেটি হল, সন্ত্রাসবাদ আর ইসলাম পরস্পরের পরিপূরক। বিশ্বজুড়ে ইসলামিক মৌলবাদের বিস্তারের সাথে এই সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি ও তাদের যাবতীয় নাশকতামূলক কার্যকলাপ সংযুক্ত। এখন বর্তমান বিশ্বকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে একমাত্র কে রক্ষা করতে পারে? না আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। এই বিষয়ে কারুরই কোন দ্বিমত নাই। এই এক মিথ। বিশ্বজুড়ে প্রায় প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্কে আর চেতনায় বটবৃক্ষের মতো ঝুরি নামিয়ে দিয়েছে। পথে ঘাটে মাঠে ময়দানে যাকে খুশি জিজ্ঞাসা করলেই, একটাই নাম উঠে আসবে। বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস দমনে আমেরিকাই একমাত্র ভরসা। প্রতিটি মানুষেরই চোখে ভেসে ওঠে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস হওয়ার সেই ভয়াবহ চিত্র। যে চিত্রের সাথেই জুড়ে থাকে ইসলাম। সন্ত্রাস আর ইসলামকে মানুষ আর আলাদা করে ভাবতে চায় না। বিশেষ করে যে মানুষ যত বেশি সাম্প্রদায়িক। এবং যে মানুষ যত বেশি মুসলিম বিরোধী সেই মানুষ তত বেশি করেই মার্কিনপন্থী। আর তারই চেতনে অবচতনে একটাই ভরসাস্থল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার বিশ্বাস আর অন্ধভক্তিতে একজনই রক্ষাকর্তা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখানেই সাফল্যজনক ভাবে একটা মিথের গড়ে ওঠা। বা আরও একটু স্পষ্ট করে বললে সাফল্যজনক ভাবে একটি মিথকে গড়ে তোলা। কিন্তু সেই মিথের জন্ম দিতে নিরন্তর চব্বিশ ঘন্টা ধরে মানুষের সামনে মিথ্যের পর মিথ্যেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। সে কিন্তু এক দুই দিনের কাজ নয়। এক নিরলস সাধনা। আর সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে বিশ্বব্যাপী এক মিডিয়াতন্ত্র গড়ে তুলেছে পাশ্চাত্য মিডিয়া। আর আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের ধনতান্ত্রিক এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের দেশগুলির মিডিয়াও সেই পাশ্চাত্য মিডিয়ার বশংবদ আনুগত্য পালনে একনিষ্ঠ থেকে পাশ্চাত্য মিডিয়ার গড়ে তোলা মিথগুলিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে সংক্রমিত করতে থাকে নিরলস ভাবেই।
এই মিথের উপরে নির্ভর
করেই মানুষের চিন্তা ও চেতনায় এক ধরণের প্রতিক্রিয়া তৈরী হতে থাকে। যে প্রতিক্রিয়া
সম্পূর্ণ ভাবেই মিডিয়া নিয়ন্ত্রীত। এবং এক জনের প্রতিক্রিয়া থেকে আর এক জনের প্রতিক্রিয়াকে
আলাদা করে চিহ্নিতও করা যায় না। বিশ্বজুড়ে ঠিক সেইরকম প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলনই দেখতে
পাওয়া গেল সম্প্রতি। মার্কিন সৈন্যের আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়া এবং তালিবানদের কাবুল
দখলে। এই প্রতিক্রিয়ায় প্রথমতো আবার তালিবানের হাতে আফগানিস্তান চলে যাওয়ায় সে দেশের
নারী ও শিশুসহ সাধারণ মানুষের কি দুর্দশা হবে চিন্তা করে বিশ্বজুড়ে মানুষের রাতের ঘুম
দিনের খাওয়া নষ্ট হতে বসেছে যেন। এবং সেই সাথেই এই প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় পিঠে, বিশ্বজুড়ে
মানুষের একটাই আর্তি। বাইডেন সরকার যেন তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে আফগানিস্তানেই
থেকে যায়। আফগানদেরকে তালিবানদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু মার্কিনশক্তি তাদের
নিজেদের স্বার্থের বাইরে কিছুই করে না। করবেও না। ফলে দিনক্ষণ পাঁজি মিলিয়েই শেষ মার্কিন
সৈন্যসহ তারা রাতের অন্ধকারেই আফগানিস্তান ত্যাগ করে গিয়েছে। কিন্তু তাতে বিশ্বজুড়ে
টেররিজমের বিরুদ্ধে একমাত্র রক্ষকর্তার যে মিথ। তাতে একটুও চোট লাগেনি। মানুষের এখনো
দৃঢ় বিশ্বাস। মার্কিনশক্তিই আবিশ্ব টেররিজম থেকে বিশ্ববাসীর একমাত্র রক্ষাকর্তা। বিশ্বাস
যত দৃঢ় হয় ভক্তি তত অটল হয়ে ওঠে। দৃষ্টি তত ঝাপসা হতে থাকে। আর বোধ ততই অসাড় হয়ে পড়ে।
এ প্রকৃতির ধর্ম। আর সেখানেই এক একটি মিথ সুদৃঢ় ভাবে কাজ করতে থাকে। এখন বিশ্বাসকে
দৃঢ় করে তোলা, ভক্তিকে অটল হয়ে উঠতে মই জুগিয়ে দেওয়া। দৃষ্টিকে ঝাপসা করতে থাকা এবং
বোধকে অসাড় করে রাখার কাজই করতে থাকে মিডিয়াতন্ত্র।
না, সেই মিডিয়াতন্ত্রের
নাগপাশ থেকে প্রায় কারুরই মুক্তি নাই। নাই বলেই, মাত্র মাস কয়েক আগে গাজায় ইসরায়েলের
মুহুর্মুহ মিসাইল হানায়, সাধরণ মানুষের জীবন ও জীবিকা কিভাবে বিপন্ন হচ্ছিল তার জন্য
বিশ্বজুড়ে কোন মানুষেরই মাথাব্যথা ছিল না। মাথাব্যথা ছিল না, মিসাইল হানায় একের পর
এক রেসিডেন্সিয়াল বহুতল তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে ফেলে দেওয়ায় সেখানকার নারী ও শিশুসহ
সাধারণ গাজাবাসীদের রাত কাটবে কোথায় ভেবে। কিন্তু আজকে যখন কাবুলের রাজপ্রাসাদে তালিবানদের
চেয়ার দখল করে বসে পড়তে দেখা গেল। সাধারণ মানুষের রাতের ঘুম চলে যাচ্ছে, আফগান রমনীদের
ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আবার কি তবে তাদের পাথর ছুঁড়ে মারা হবে? মধ্যযুগীয় বর্বরতায় নারীদের
পাথর ছুড়ে মারার বিধান নিয়ে মানুষের যে চিন্তা। তার ছিটেফোঁটাও নেই আধুনিক যুগীয় বর্বরতায়
বছরের পর বছর গাজা ওয়েস্টব্যাঙ্ক সহ প্যালেস্টাইনের নারী পুরুষ শিশু কিশোরদের উপরে
ইসরায়েলি মিসাইল হানায়। যে হানার হাত থেকে নাগরিক আবাসন স্কুল কলেজ হাসপাতাল কোন কিছুই
রক্ষা পায় না। হাজার হাজার মুসলিম নারী পুরুষ শিশু কিশোর আহত নিহত হলেও বিশ্বজুড়ে মানুষের
রাতের ঘুম নষ্ট হয় না কোনদিন। শহরের পর শহর অত্যাধুনিক মিসাইল হানায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত
হলেও বাকি বিশ্বের মানুষের কিছুই এসে যায় না তাতে। কারণ সেই হানাদার বাহিনী কখনো ইসরায়েল।
কখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কখনো ন্যাটো বাহিনী। লক্ষ্য তাদের একটাই ইসলামিক কমিউনিটি।
অজুহাত তাদের একটাই ইসলামিক টেররিজম। আর তাদের মিসাইলের হানায় যারা আহত নিহত। ধর্ম
তাদেরও একটাই। ইসলাম। তাই মিসাইল হানায় সাধারণ মুসলিম মারা গেলে কিংবা আজীবনের জন্য
পঙ্গু হয়ে গেলে, সেটা টেররিজম নয়। যদি সেই হানাদার বাহিনীর নাম হয় ইসরায়েল কিংবা মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ন্যাটো বাহিনী। এটাই মিডিয়াতন্ত্রের বাহাদুরী। এটাই মিডিয়াতন্ত্রের
জাদু।
সকাল সন্ধ্যা টিভি খুলে
আফগান রমনীদের নিয়ে চিন্তা করতে বসে যাচ্ছে যারা। প্যালেস্টাইনের রমনীদের নিয়ে তাদের
কোন চিন্তা নেই। যারা আজ আট দশক ধরে দিনের পর দিন ইসরায়েলি টেররিজমের শিকার। আফগান
রমনীদের আবার বোরখা পড়ে পথে বার হতে হবে বলে যাদের এত চিন্তা। নিজেদের দেশের রমনীদেরকে
খোলামেলা পোশাকে চলাফেরা করতে দিতেই আবার তাদের ঘোরতর আপত্তি। যাদেরই মাথায় ঘোরে দেশের
মেয়েরা ধর্ষিত হয় পোশাকের কারণে। তারাই আবার টিভি খুলে মড়াকান্না শুরু করে দেয় আফগান
রমনীদেরকে বোরখায় দেখলে। এই যে দ্বিচারিতা। এটিও মিডিয়া নিয়ন্ত্রীত। মিডিয়াতন্ত্রের
নাগপাশে আটক প্রতিটি মানুষের চিন্তা চেতনার পদ্ধতিও তাই এক ছাঁচে গড়ে উঠেছে। যে দেশে
প্রতি দশ পনেরো মিনিটে একজন নারীকে ধর্ষিত হতে হয়। যে দেশে নাবালিকা ধর্ষণ বিশ্বে সবচেয়ে
বেশি। সেই দেশের মানুষ, তালিবানদের খপ্পরে পড়লে আফগান রমনীদের কি হবে তাই নিয়ে চিন্তায়
আকুল। তালিবানীরা নারীদেরকে নিজেদের জবরদখলের সম্পত্তি মনে করে। তাই তালিবানরা খারাপ।
কিন্তু ভারতবর্ষের নারীরা যখন সেই একই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার শিকার হয়ে বলি হয়।
তখন ভারতীয় সংস্কৃতি খারাপ হয়ে যায় না। ভারতীদের নতুন করে হিন্দু হয়ে উঠতে হবে। সেটাই
দেশপ্রেম। সেটাই ভারতীয়ত্ব। কিন্তু আফগানরা মুসলিম বলেই বিপদ। তারা মৌলবাদী। তাই তাদের
ভিতর থেকেই সন্ত্রাসবদীরা জন্ম নেয়। এই যে সরলকীরণ সব তত্ত্ব। এবং বদ্ধমূল সব ধারণা।
এইসবই মিডিয়া নিয়ন্ত্রীত। মানুষের মগজকে সংক্রমিত করাই যার প্রধান লক্ষ্য। আর সেই সংক্রমণকে
দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিতেই মিডিয়ার দৌরাত্ম দিনভর রাতভর। খবরের কাগজ থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেল।
এবং ইনটারনেট। এক এক সময়ে এক একটি মিথকে সামনে নিয়ে আসা। আর তার জন্য দিনভর রাতভর একদিকে
খবর পরিবেশনের বিশেষ কৌশল আর এক দিকে ফেক নিউজের কারবার। দুটি কাজই চলতে থাকে পরস্পর
হাত ধরাধরি করে। না হলে মিথের জন্ম হয় না। জন্ম দেওয়া যায় না।
ওয়ার্ল্ড ট্রেডসেন্টার
ধ্বংসের লাইভ সম্প্রসারণের ছবি দেখিয়েই একের পর এক মিথ্যের প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল।
এক, মানুষকে বিশ্বাস করিয়ে দেওয়া গিয়েছিল আলকায়দাই সেই হামলা চালিয়েছিল। যার পিছনে
ওসামা বিন লাদেন। ফলে তাকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে তালিবানদের শায়েস্ত করতে আফগানিস্তান
দখল করে নেওয়া যায় যুদ্ধ চালিয়ে। একটা মিথ্যের উপরে নির্ভর করে এতবড় একটা অন্যায়কে
ন্যায্যতা দেওয়া গিয়েছিল। এবং মানুষ সেই মিথ্যেকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করে আজও ভরসা
করে ইসলামিক টেররিজমের হাত থেকে রক্ষ পেতে গেলে মার্কিন অভিভাবকত্বই বিশ্ববাসীর একমাত্র
ভরসা। আর তাই মার্কিনদের আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার শোক কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না
বিশ্ববাসী। দ্বিতীয় যে মিথ্যেটির প্রতিষ্ঠা হয়ে গিয়েছিল, সেটি হলো ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার
ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল বিমান হানায়। নিউটনের তৃতীয় সূত্রসহ পদার্থ বিজ্ঞানের একাধিক
সূত্র লঙ্ঘন করে। মানুষ তাই বিশ্বাস করে আজও। সম্পূর্ণ মিথ্যের উপরেই বিমান হানায় ট্রেডসেন্টার
ধ্বংসের মিথ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল, তথ্যসূত্র। এবং পরবর্তীতে মার্কিনশক্তির
আফগানিস্তান দখল। মানুষ বিশ্বাস করে বসলো মার্কিনদের কথায়। তালিবানদের সমূলে বিনাশ
করে তারা আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করবে। আফগানিস্তান একটি সমৃদ্ধশালী দেশ
হয়ে উঠবে। মিডিয়াতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে বিশ্বজুড়ে উৎসব শুরু হয়ে গেল আফগানিস্তানে মুহুর্মুহ
মার্কিন মিসাইল ও বোমারু বিমান হানায়। লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ আফগানবাসীর প্রাণ চলে গেলেও
মিডিয়াতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত মানুষ টিভি খুলে আফগানবাসীর হত্যলীলায় চোখের জল ফেলতে বসলো
না। বরং টিভির পর্দজুড়ে মুহুর্মুহ মিসাইল গর্জনের শব্দে আর আগুনের বীভৎস তাণ্ডবে বিশ্বব্যাপী
মানুষের উল্লাস শুরু হয়ে গেল। মার্কিন সৈন্যদের আফগানিস্তানের দখল নিতে দেখে। বিদেশী
শক্তির কাছে আফগানিস্তানকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আটকা পড়তে দেখে বিশ্ববাসী নিশ্চিন্ত হল।
যুদ্ধবাজ হানাদার মার্কিনশক্তিকেই মানুষ অভিনন্দনে ভরিয়ে দিল। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস
করল। এবারে তালিবানরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আফগানিস্তান সহ গোটা পৃথিবীই তালিবানী সন্ত্রাস
মুক্ত হবে।
না, তাই বলে আজকে ঠিক কুড়ি বছর পড়ে যখন সেই তালিবানরাই আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতিতেই বিনা রক্তপাতে কাবুলের দখল নিয়ে নিল, তখনও মানুষের ঘুম ভাঙলো না। কেউ প্রশ্ন তুললো না, তাহলে তালিবানদের নিশ্চিহ্ন করার গল্পটা কি ঢপ ছিল? না’কি মার্কিনশক্তি তালিবানদের নিশ্চিহ্ন করতে না পেরে ব্যর্থ হয়েই আজ পরাজিত শক্তির মতো আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যাচ্ছে? তাহলে তো তালিবানদের কাছে মার্কিনশক্তির পরাজয় স্বীকার করে নেওয়া উচিত ছিল খাতায় কলমে। আর তা হলে বিশ্বজুড়ে ইসলামিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একমাত্র রক্ষকের সেই মিথই তো ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়ার কথা। উল্টোদিকে ঘটনা যদি তা না হয়। অর্থাৎ তালিবানরা যদি মার্কিনদের যুদ্ধে পরাস্ত করে হটিয়ে দিয়ে দেশ স্বাধীন না করে থাকে। তবে তো তালিবানদের নিশ্চিহ্ন করার মার্কিনী গল্পটাই ঢপ ছিল। এবং সেটাই যদি সত্য ঘটনা হয়ে থাকে। তাহলে আরও একটা মিথ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যাওয়ার কথা। তালিবানরা টেররিস্ট। মার্কিনরা তো টেররিজম বিনাশ করতেই আফগানিস্তান দখল করেছিল। দখল করেও যদি তালিবানদের বিনাশ না করে থাকে এবং সেই তালিবানদের সাথে করা চুক্তির ভিত্তিতেই যদি আফগানিস্তান ত্যাগ করে যায়, তাহলে আর তালিবানদের টেররিস্ট বলা কেন? না। সাধারণ মানুষ। মিডিয়াতন্ত্রে বাস করা মানুষ। সকালবিকাল মিডিয়ার পাঠশালায় হোমটাস্ক বুঝে নেওয়া মানুষ সেই সব সহজ কিন্তু অতি প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি করার মতো কোন সামর্থ্য রাখে না আর। মিডিয়াতন্ত্রে বাস করা নাগরিকরা সকলেই সেই হীরকরাজার দেশের নাগরিকদের মতো মগজধোলাইয়ের মেশিন থেকে রিফাব্রিশড হয়ে বেড়োনো। কোন প্রশ্নটা তারা করবে আর কোনটা করবে না, সেটিও ঠিক করে দেবে মিডিয়া। তাই একজন মানুষও ভাবতে বসবে না। আচ্ছা আমরা আজকে আফগান রমনীদের যদি আবার পাথর ছুঁরে মারা হয় বলে চিন্তিত হতে থাকি। তাহলে গাজার প্যালেস্টাইন রমনীরা, প্রতিবছর যাদেরকে ইসরায়েল মিসাইল ছুঁড়ে মারে। তাদের কথা ভাতেও শুরু করি না কেন? তালিবানী শাসনে আফগানবাসীর সকল মৌলিক অধিকার খর্ব হবে বলে যখন আমরা ভাবিত। তখন ইসরায়েলের অত্যাচারে আট দশক জুড়ে প্যালেস্টাইন বাসীদের সব কয়টি মৌলিক অধিকার যে খর্ব হয়ে বসে রয়েছে। সেটি নিয়েও কেন আমরা একইভাবে চিন্তিত হচ্ছি না? হই না? না একজন মানুষও যিনি এই মিডিয়াতন্ত্রের নাগরিক। তিনি এই কথাগুলি ভাবতে শুরু করবেন না। তাঁর আর সেই সামর্থ্য অবশিষ্ট নাই। মিডিয়াতন্ত্রের প্রতিদিনের মগজধোলাইয়ের যন্ত্রে তিনি তাঁর মস্তিষ্ক বন্ধক রেখে বসে রয়েছেন। তাই তিনি কত সহজে ভাবতে পারছেন, আফগানিস্তান ছেড়ে দখলদার হানাদার মার্কিনবাহিনী যেন ফিরে না যায়। তিনি ১৯৪৭ সালে এইরকম কোন এক মিডিয়াতন্ত্রের নাগরিক হলেও নিশ্চিত করেই ভাবতেন ব্রিটিশ যেন ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে চলে না যায়। সুখের কথা। তখনো মিডিয়াতন্ত্র এমন সর্বাত্মক ভাবে তার সাম্রাজ্যবিস্তার করতে পারেনি। পারলে হয়তো তখনও ভারতবর্ষের জন্য বাকি বিশ্বের মানুষ ব্রিটিশদেরকেই ফিরে আসতে বলতে চাইতো আবার।
যাঁরাই একবার মিডিয়াতন্ত্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। তাঁদের পক্ষে তখন আর সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকে না। কারণ যে মিথ্যের প্রচার ও প্রসারের উপরে মিডিয়া এক একটি মিথের জন্ম দিতে থাকে। তাঁরা তখন সেইসব মিথগুলিকেই প্রাণপণে আঁকড়িয়ে ধরে বাঁচতে শুরু করে দেন। এবং দিনে দিনে সেটা এমনই এক অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় যে, সেই অভ্যাসটাই তাঁদের কাছে একমাত্র ধ্রুব বাস্তব বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। না, সেই চক্রব্যূহ থেকে নিজেকে উদ্ধার করা তখন আর কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয় না। এখানেই মিডিয়াতন্ত্রের সাফল্য। সাম্প্রতিক আফগানিস্তানের ঘটনাবলী। এবং সেইসবকে কেন্দ্র করে আবিশ্ব মানুষের প্রতিক্রিয়া মিডিয়াতন্ত্রের এই সাফল্যের এক চুড়ান্ত নিদর্শন। তাই পিছনের দরজা দিয়ে সেই তালিবানকেই আফগানিস্তানের মসনদে বসিয়ে দিয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করলেও টেররিজম থেকে একমাত্র রক্ষকর্তার যে মিথ তা এতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। উল্টে মানুষই চাইছে সেই আফগানিস্তানের সম্পূর্ণ দখল যেন তাদের হাতেই থাকে যারা নিরন্তর বাকি বিশ্বকে টেররিজম নিয়ে ঢপ দিয়ে যেতে থাকে দুইবেলা, রাত্রি আর দিন। মিডিয়াতন্ত্রের এই সাফল্য আবার নির্ভর করে তার সাম্রাজ্যবিস্তারের পরিধির উপরেও। কিভাবে এবং কতটা সাম্রাজ্যবিস্তার নিশ্চিত করতে পারে তার উপরেই। ভারতীয় উপমহাদেশের কথাই যদি ধরা যায়। তবে দেখা যাবে পাশ্চাত্য মিডিয়ার বশংবদ অতি শক্তিশালী এবং প্রতিক্রিয়াশীল এক মিডিয়াতন্ত্র পাশ্চাত্য মিডিয়ার সাম্রাজ্যেরই অংশ হয়ে গিয়েছে। ফলে আমাদের দেশের মিডিয়াগুলিও সেই পাশ্চাত্য মিডিয়ার গোলামি করেই দিন কাটাচ্ছে। না, শুধু আমাদের দেশেই নয়। পাশ্চাত্য মিডিয়া দুই একটি মাত্র দেশ ছাড়া বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই এইভাবে তদের সর্বগ্রাসী সাম্রাজ্য বিস্তার করে বসে রয়েছে। মিডিয়াতন্ত্রের সাম্রাজ্যের পরিধি যত বিশাল। তার প্রচারিত মিথ্যের আকার ও প্রকারও তত প্রভাবশালী। আর তার প্রতিষ্ঠিত মিথগুলিও ততটাই সুদৃঢ়। বিগত পাঁচ দশক ব্যাপী মার্কিনশক্তির বিশ্বের প্রধান ও একমাত্র সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার পিছনে এই মিথের অবদান অনস্বীকার্য। সেই মিথ যেদিন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। মার্কিনশক্তিও সেইদিন তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বে। তাই মার্কিনশক্তির প্রাণভোমরা এই মিথের ভিতরেই লুকিয়ে রয়েছে। যার সুরক্ষায় অতন্দ্রপ্রহরীর মতো কাজ করে চলেছে পাশ্চাত্য মিডিয়া। আর আমরা যারা সেই মিডিয়াতন্ত্রের নাগরিক। অষ্টপ্রহর তারাই সেই মিডিয়াতন্ত্রকে অক্সিজেন জুগিয়ে চলেছি। আমাদের অন্ধ বিশ্বাসে। অন্ধ ভক্তিতে। অন্ধ দৃষ্টিতে আর অসাড় চেতনায়। জড়ভরত বোধে।
শ্রীশুভ্র
কর্তৃক সংরক্ষিত
0 মন্তব্যসমূহ