অভিঘাত
মহার্ঘ বাসভূমি ছেড়ে সারা জীবন তোমার মনটা পরিযায়ী পাখির মতো যেখানে অবিরাম পাখা ঝাপটায়, আমার বিশুষ্ক আত্মার অগ্নিপাত সেখানে এক মারাত্মক লুটতরাজে মেতে উঠবে; এই অশ্বখুরধ্বনি তোমাকে জাগাবে না জেনো, আর সেখানে জলের হাহাকার নগ্ন গোধূলিতে মরে পড়ে আছে আর সেখানে মধুমাছি ফুলের বদলে একেকটা স্তন ফুটে আছে, তবু দামাল বাতাসের বুকে অমূল্য আস্বাদ ভালোবেসে পাখিরা কি কোনদিন উড়ে যাবে না ...
এই অভিঘাত, এই অশ্রু-নিরোধ বুকের হেরেম খুলে লুপ্ত-প্রণালী পথে ফিরে যাবে শীর্ণ-চরায় আর তুমি পাথরে পাথরে ফেলে যাবে দীর্ঘশ্বাস আর তুমি বেভুল-গ্রন্থি ছিঁড়ে ঝরে যাবে গোলাপ শবরী
খুনসুখী, তুমি কত বিপুল মেনেছো হার; রক্তচর্মনীল-- গুচ্ছপালক এঁটে...
আক্রান্ত শব্দগুচ্ছ
একগুচ্ছ লাভের আগুন বয়ে ট্রেনটা লোকসুদ্ধ সড়সড়
ঢুকে যাচ্ছে রাতের গহ্বরে-- দগ্ধ তৃষ্ণার কোনো অন্ধপথ ছুটে।
আঁধারের বাঁধ কেটে বিধি ও বিশ্বাস মতো জোনাকি খুলতে লাগে
ফাঁদ, আধো আধো অরণ্য কিনারে। আমিরুল, তবে কি স্বপ্নই
সারাৎসার বিগত ভ্রমণব্যাপী মহামূল্য পাথর পাহাড় আর
পুরাতন হাড়ে হাড়ে! ঈশানের সিক্ত আলোকে তবে কি
ভাসবে না বঙ্কিম নদী, ফসলের মাঠ, ঘাসের শরীর
দিন কি এগুবে রাত সয়ে সয়ে!
হেমন্ত বুনে গ্যাছে শীত, কিছু শীত নিজেই মেনেছি
আমিরুল, ফুদিয়ে আগুন জ্বালো-- একচাল, ঊর্ধ্বমুখী...
বনসাই সংস্করণ
দু’চারজন অভ্যাগত আর আমাদের ঘরবাসিরার বিনোদনে সঙ্গ দিতে গিয়ে এ্যাকুরিয়ামের মাছগুলি বেঁচে চলছে বছরকে বছর ।
পানির উদ্দাম তোড় লেগে লাফিয়ে উঠার কথা তারা ভুলে গেছে, ভুলে গেছে বুকেবুক সঙ্গকাম, তারা যেন নতুন এক বনসাই সংস্করণ!
দেখি, চলনীতি ভুলে ছুটছে একটা মাছ-- মাথাটা দেহ ছাড়িয়েছে অন্যটার, ঘুরতে ঘুরতে অন্ধ হয়েছে আরেকটা মাছ। বাঁচতে বাঁচতে হাঁফিয়ে উঠেছে ওরা, মাছগুলি মরতে চায় অথচ ফাঁসিটা বাঁধবে কে-- লোক নেই, বিষ নেই, মন্ত্র নেই
কী নির্মম বেঁচে যাওয়া !
নগর রাখাল
সামনের সপ্তায় আর বাড়ি যাচ্ছি না রাসু। জানি কারো চিৎকারে হঠাৎ সুন্দর স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠা বিস্ময়ে তুমি বলবে, ‘এ তোমার কেমন কথা, একেবারে মায়াশূন্য’।
শুনেছি আমাদের গ্রামে নাকি চুরি হয়েছে। একেবারে হার্মাদি ঢঙে শেষবার ওরা-- গোয়াল ঘরের গরু, পুকুরের মাছ, নদীর পানি, আর শুদ্ধসুরের গানগুলি নিয়ে গেছে। আমার চতুর্দিকে চোখ ধাঁধাঁনো কৃত্রিম আয়েশ-- ঐতিহ্য মেশানো লোকাচার নেইতো কি জন্যে সেখেনে যাবো? তাছাড়া যত্রতত্র বাড়ি তৈরির প্রতিযোগিতায় থেমে গেছে দেহবাসের বাতাস, আমিতো এখন কলের বাতাসে কল্পনা করতেও অভ্যস্ত !
তার চেয়ে বই খুলি, খেয়ে আসি ফার্সি কবিতার শরাব, ঘুরে আসি প্রাচীন গ্রীস, হরপ্পা নগর কিংবা মেসোপটেমীয় সভ্যতার কুঁড়েঘর। মনে বাতাস দিলে দেহকে বলতেই হবে বেঁচে আছি অন্তত রাখালের কাতারে। মেষ নাই, বাঁশি নাই-- রাখাল! রাস্তার ধূলি মেখে হাঁটরে রাখাল...
আত্মখুনের স্কেচ
ছিঁড়ে গ্যাছে গাঁথনি, খিলান
চাক ভেঙে মধু-- নখে, পিঠে, বৃন্তে, ধূলিতে
রোদ ও রাগিণীর জ্বরে পাথর ছুঁয়েছে বুক
দুলতে লাগে হাওয়াই ভেসেল...
তারও ছিলো স্বপ্নমেঘ, ডানাপর্ব, অনন্ত তারাবীথি
তীর্থফুলে পাপড়ির গন্ধচেতনা
দীর্ঘ দেহবাস ভুলে রক্তজবা চোখ
পার্শ্বপৃথিবী কাঁপে গমগম
ইথারে ইথারে ধোঁয়া, পাপ ও অনুতাপ
ছেঁকে-ছেনে ঘন সবুজ মিলে
মিলে যদি রাগমুক্তি--
ঊষার নৌকাপালে
আরো নীল গুচ্ছগোলাপ...
নিসর্গ শ্রমণ
সারাদিন অবিশ্রাম চোখমেলে চরাচর
ওড়ে ওড়ে সোনার মেঘেরা
শালিধান, ঢালু, শৈল সবুজ
আর গোপনে গোপনে আমার ঈশ্বর
তুমি ঘোরকেটে নামো
যদি স্বপ্নপ্রমাদ কিছু জমা থাকে আধোনীল ছায়ার মতন
আদিগন্ত শিখরে শিখরে যদি পাতার বাহার মোছে জলকণা
আলোরা পরেছে যত পাড়-- মেলে দিবে হৃদরঙটুকু
যদি নদীর কোলে আসে রোদ, মৃদুনাদ, ঝর্ণা বিকুলি
বাহুভার উড়ার নিয়ম ছেড়ে
ফলন্ত দেহের রাগে গাছালি আরক নেবো
মৃৎপাত্র শীতল করেছে খুব --
ভোরের নিবাস আছে, ঘুম খাবো
নিসর্গ শ্রমণ নিরবতা...
সং অব ম্যাডনেস
না, তিনদিন ধরে চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি
ভিতর বাহির এঘর ওঘর গ্রাম-মহল্লা-রাষ্ট্র
যেহেতু গেল শতক ধরে দৃষ্টিকে অবসর দেয়া হয়েছে
সুতরাং অন্তরচক্ষু সংক্রান্ত উর্ধ্বতন সংলাপ এখানে অকার্যকর
শেষমেশ হাল ছেড়ে যখন বিছানায় যাবো
একি, মানতেই পারছে না অবিশ্বস্ত চোখেরা
কিন্তু একগোছা ভ্রু তুলতে গিয়ে যখন ককিয়ে উঠলাম
তখন রাতের আক্রমণে আলো
আর তীক্ষ্ম ক্যাকটাসে বিঁধে আছে মাথাটা
টপটপ রক্ত পড়ছে...
এবার মধুর নির্বাসনে যাবো
এও কী সম্ভব, কেবল শান্তির শাপ
কেবলি সুখের হা হুতাশ আর আমি
ভয় ভয় করে অবিরাম মাথা ঠুকে যাবো
এবার তিক্ততা চাই, চাই পরাজয়
ন্যুব্জ নতমুখ চিরদিন হাত পেতে পেতে আর জোড়াবো না বিজয় তিলক
চাই হেমলক, নীর নির্যাসে পেতে চাই অশ্রুপ্লাবন
হিম ও তুষার পরিধি ছেড়ে
এবার মধুর নির্বাসনে যাবো
সাথে নেই এক কড়ি স্বর্ণ-কমল তবু হেঁকে যাবো হৃদয়ের রথ
এবার শুষ্ক মিথিলায় যাবো, অগণ্য হরিণীর ভিড়ে বেছে নেবো একটি মোহিনী
ওর লঘুপায় পরাবো যে ফুলের ঘুংঘুর
এবার নির্বাসনে যাবো মণিহার ...
দিশা ভুলে, কন্ঠে নেবো বিষাদের লোর; একা নাবিক ভেসে ভেসে অচিন দ্বীপদেশে যাবো
প্রবীণ পালাকার হয়ে করে যাবো বেদনার পট
আমি কোনো স্বপ্নের সাথে নেই, আনন্দের উৎস খুঁজি না কোনোদিন
সুন্দরের স্পর্শ থেকে দূরে পেতে চাই প্রাণের রোদন
বারবার জিত হতে হতে ভুলে গেছি মরণের তৃষা
ঘিরে এসো বাঘিনীরা, খুব কিম্ভুত এসো
বিনাশের রক্তপাঠ শেষে--
আমি হবো অমর বিজিত !
ভালোবাসার গান
ফুলের কাছে মুখ লুকাতে যাবো
ঊষা যখন আনবে মৃদু প্রভা
মেঘের কাছে মন মিলাতে যাবো
বাদলঝরা বিজন কোনো রাতে
শিশুর কাছে শিখতে যাবো ভাষা
ভালোবাসার পরম অন্বেষণে
আছে মন্ত্র, কাছে পাহাড় যদি
চাঁদ ছেনে দাও আদিম আলোকমালা
গান মিলাতে আকাশ হবে সাথি
তারাবীথির মদির অঙ্গ-জ্বালা
সুরের কাছে ঠোঁট মিলাতে যাবো
মরতে চাওয়ার আবিল কামনাতে;
খেপা নদীর সুবাস নেবো চোখে
গাহনকালের ছন্দ যখন বাজে ।
পাখির কাছে প্রাণ জুড়াতে যাবো
সন্ধ্যা-নিশির প্রদীপ-জ্বলা সুখে
ঝর্ণা, তুমি একটু ভালোবেসো
গোলাপ-স্রোতের গোপন ধারাপাতে...
0 মন্তব্যসমূহ