রক্তিমের কথা:
রক্তিম পানমশলা খায় না। গুড়াক্ষুটা বেটার। বেশ একটা ঝাঁঝালো ব্যাপার আছে।পিক ফেললে ঠোঁটের কষটা বেশ জ্বালাপোড়া করে।মনে হয়,কেউ যেন গভীর একটা চুমু খেলো। আলতো কামড়ে ছুঁয়ে গেলো জিভের শেষতক। ধুর শালা! এসব ভেবে ভেবে খামোখা বারমুড়া ভিজিয়ে লাভ নেই। সকালে নিজেকেই সাবানে রগড়ে রগড়ে তুলতে হবে। বেকারের স্বপ্নদোষ!ভাই প্যাঁক দেবে।বাবা দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাবে। মা খানিকটা প্রশ্রয়। সে গুড়াক্ষুটা ঠোঁটে চেপে ঝড়াৎ ঝড়াৎ করে বিছানা পাটভাঁজ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কৃষ্ণচূড়ার মাথাটা কেমন আগুনরঙা হয়ে আছে। গাছতলায় ভুলু তার ছানাপোনা নিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে। পা টিপে টিপে রক্তিম রান্নাঘরে ঢুকলো। বিস্কুটের টিন থেকে খাবলে কটা বিস্কুট বার করে চোরের মত গ্রীলটা খুলতেই মা টের পেয়ে গেল। "কিরে, তুই আবার চললি ভুলুকে বিস্কুট দিতে? তোর বাবা রাগ করবেখন।লোকটা বিস্কুট এনে সারতে পারেনা" ধুস,মুডটাই খিঁচড়ে গেল। নাহ,আর বিস্কুট দেবে না ভুলোকে। আর ভুলোটাও নাছোড়বান্দা যাহোক। সে টিউশনে বেরোলেই লেজ নাড়তে নাড়তে হাজির। সাইকেলের প্যাডেলে মুখ ঘষে ঘষে ভালোবাসা জাহির করে। ভুলোকে ভালোবাসাটা আসলে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি। স্নেহা খুব কুকুর ভালোবাসে। রক্তিম তাই আজকাল কুকুর বেড়াল এসব নিয়ে ভাবছে।ওদের নিয়ে ভাবাটা খারাপ নয়। বরং পাড়ার কুকুর বেড়ালগুলো আজকাল রক্তিমকে ভালো চিনে গেছে। নিজেকে বেশ একটা
সেলিব্রিটি মনে হয় যখন ওরা তাঁর সাইকেলের পিছন পিছন ছোটে । রক্তিম আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরায়। পাকিয়ে পাকিয়ে ধোঁয়াটা ছাড়ে । বিড়ি খায় না,যদি স্নেহা টের পায়,কি ভাববে তাকে।মেয়েরা সিগারেট টা তাও সহ্য করে, বিড়ি দেখলেই কেমন খ্যাড়খ্যাড় করে ওঠে। যদিও একটাই সিগারেট,সারাদিনে। এর বেশী তাঁর ক্ষমতায় কুলায় না। বাবা আজকাল হাতখরচ দেয় না।টিউশনেও যে খুব বেশী আসে তাও না।এই স্নেহার মা ই তো ,মিষ্টি করে কথা বলেন। গত তিন বছরে একটি পয়সাও বাড়ান নি। রক্তিম স্রেফ স্নেহার কথা ভেবে কিছু বলেনা। মাইনে বাড়াতে বললে যদি
ছাড়িয়ে দেয়! তাঁর মরুভূমি জীবনে একটাই ওয়েসিস, স্নেহা! স্নেহার কথা : মোবাইলটায় টুং টাং মেসেজ ঢুকছে। স্নেহার তখনো ঘুমের চটকা কাটেনি। উপুর হয়ে বালিশটা আঁকড়ে শিশুর মত ঘুমোচ্ছে স্নেহা। নাইটিটা হাঁটুর ওপর উঠে আছে,তাঁর পা দুটো নাকি টু সেক্সি,উজান বলতো। স্নেহা আলতো হাতে মোবাইলটা
ছুঁতেই আবার টুং। বিরক্তিতে ভুরুটা ঢেউ হয় তাঁর। ঘুম না ভাঙতেই ঘন্টা বাজিয়ে ভক্তদের দেবী আরাধনা শুরু। যদিও ব্যাপারটা বেশ এনজয় করে সে।একটা মিচকে হাসি
খেলে যায় স্নেহার মুখে। তাঁর মুখের
আদল নাকি বাবার মত। শুনেছে, বাবা বেশ হ্যান্ডসাম ছিল অবশ্য বাবার মুখ এখন ঝাপসা। সেই কবে তারা বেহালার এজমালী বাড়ি ছেড়ে সুদূর নর্থে চলে এসেছে। মা একাই একশো।মাকে নিয়ে মনে মনে স্নেহার বেশ একটা চাপা অহংকার আছে। যখন কোন আনইজি সিচুয়েশন মা সেকেন্ডে নিজের ফরে নিয়ে আসতে
পারে। তাই কি বাবা... বাবা মনে হয় মাকে জাষ্ট নিতে পারেনি। উফ্,সকাল সকাল কিসব পুরোনো কাসুন্দি ঘাটতে বসলো স্নেহা।রাগটা একপাশে সরিয়ে রেখে টয়লেটে ঢোকে সে। টয়লেটের একপাশের দেওয়াল জুড়ে একটা আয়না। সেখানে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখা স্নেহার ফেভারিট টাইমপাস। শরীর গড়িয়ে জলের ফোঁটাগুলো নামছে,শিরশিরিয়ে ওঠে স্নেহা। তাঁর দুয়েকটি খুচরো বয়ফ্রেন্ড আছে , তাদের নিয়ে টুকটাক পার্কে বা কারোর ফাঁকা ফ্ল্যাটেও গেছে সে। কিন্তু চানঘরে একা সে শুধু রক্তিমের সাথে শরীরি হয় মনে মনে। অথচ রক্তিমদা এত নির্লিপ্ত! তাঁর দিকে ঠিক করে তাকায় ও না পড়াতে বসলে। একদিন দুম করে কারেন্ট অফ হয়ে গেলো সেই সময়! স্নেহা এক্সপেক্ট করেছিল রক্তিম দা তাকে হয়তো কোন অছিলায়
ছোঁবে! নাহ,ছুঁলোনা মোটেও। ভয়ানক রাগ হয়েছিল স্নেহার। আচ্ছা মালটা খাসি নয়তো! তবু কেন যে ওকেই বারবার পেতে ইচ্ছা করে। রক্তিমদার সাথে তাঁর কত মিল। সেও অ্যানিমাল লাভার, রক্তিমদাও। শুনেছে স্নেহা। রক্তিম দা বলেনি অবশ্য, সে শুনেছে। স্রেফ রক্তিম দার মন রাখতেই সে পড়তে বসে। নাহলে পড়াশোনা ভীষন বোরিং থিং মনে হয় স্নেহার। লাইফে আরো কত এনজয়মেন্ট আছে তাঁর! এই উইক এন্ডেই তো ভিকি একটা ফাঁকা ফ্ল্যাট জোগাড় করেছে। স্রেফ তারা দুজন যাবে। নতুন সব পোষ্চার ট্রাই করবে। নিউ ব্র্যান্ডের কন্ডোম ও। এক্সোটিক ফ্লেভারের! বেশ থ্রিল হচ্ছে স্নেহার। ভিকি কি স্টাউট! ভিকির কথা ভাবতেই হঠাৎ আবার রক্তিম দার গম্ভীর মুখটা ভেসে উঠলো মনে। ধুস্, এই লোকটা তাকে
ছাড়বে না,যত্ত জ্বালাতন। তাহাদের কথা:
আজ স্কুলে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস অফ। তাতে সুবিধেই হল স্নেহার। মাকে আগেই বলে এসেছে, রক্তিমদা গ্রুপস্টাডি করাবে আজ। মা যদিও অবাক হল একটু, "আজ তো ডেট নয় রক্তিমের?" "এক্সট্রা ডেট মা।পরীক্ষা আসছে না, মাঝেমাঝেই
এখন এক্সট্রা গ্রুপস্টাডি করাবে দাদা" "ও,টেক কেয়ার। ফোন কোরো আমাকে।আর দয়া করে টিফিনটা
খেয়ো। সেদিনের মত ফিরিয়ে এনো না" "ওক্কে মা।লাবিউ ,বাই।"মাকে আদর করে
বেরিয়ে পড়ে স্নেহা। নিজের সাইকেলটা ভিকিদের গ্যারাজে রেখে ভিকির বাইকে চাপলো স্নেহা। দারুন মজা হয়,বাইক রাইডে। ভিকি যত স্পীড তোলে,তত ভালো লাগে স্নেহার। তবে আজ তো বেশী দূর যাবে না,কাছেই ফ্ল্যাটটা। ভিকির ছোটমাসির। সবাই ওরা দক্ষিনেশ্বর মন্দিরে গেছে দল বেঁধে। ভিকি যায়নি। এমন সুযোগ চট করে পাওয়া যায় না। ফ্ল্যাটে ঢুকেই দরজাটা আটকাতেই তারা দুজন একলা
। ওয়াও! ভীষন মজা লাগছে স্নেহার! ভিকি নিজের হাতে স্মুদী
বানিয়ে খাইয়েছে স্নেহাকে। দুজনে একটু স্মুচ করতেই, কলিং বেলটা বাজলো! "ধুর বাল!এখন আবার কে জ্বালাতে এলো!" স্নেহা চটজলদী নিজেকে গুছিয়ে নিলো। দুপুরে একটু ভাতঘুম দেবার চেষ্টা করছে রক্তিম। মাথার
কাছে এফ এমে রোমান্টিক ডুয়েটস বাজছে"তোসে নয়না লাগে পিয়া সাঁবরে"। এসব গান শুনলেই তাঁর কেবল স্নেহাকে আদর করতে ইচ্ছা করে। অথচ স্নেহার সামনে গেলে কেমন গুটিয়ে যায় সে। আরো গম্ভীর হয়ে যায়,পাছে স্নেহা তাঁর মনের অবস্হা টের পেয়ে যায়! কেলেংকারীর একশেষ হবে। যা স্মার্ট মেয়ে ,শিওর ও এনগেজড্। ফালতু কেস খেতে চায় না রক্তিম। এমনিতেই বি টেক করে বসে আছে। ক্যাম্পাসিংএ শিকে ছেঁড়েনি তাঁর ভাগ্যে।তার
উপর এইসব লাফড়ায় জড়াতে শখ নেই। তবু আজ কি যে হচ্ছে ! ভীষন মন চাইছে ,স্নেহাকে একবার দেখতে! কিন্তু আজ তো ওদের বাড়ি যাবার দিন নয়।ওর মা যদি
কিছু ভাবে! নাহ,ফিজিক্সের হার্ডার প্রব্লেমের একটা বই চেয়েছিল স্নেহা।ঐ অজুহাতেই যেতে হবে। বিছানা ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠলো রক্তিম। নিজের বুকসেল্ফ খুঁজে পেতে বই নিয়ে বেরোতে বেরোতে সূর্য কৃষ্ণচূড়ার মাথায় লালচে আলো মাখিয়ে দিচ্ছে। গোধুলি
নাকি ? এত নরম লাগছে চারপাশটা? বেরোতেই ভুলো লেজ নাড়তে নাড়তে হাজির। আলতো করে হাতটা ভুলোর মাথায় বুলিয়ে দিল রক্তিম। বড় ভালো লাগছে তাঁর এখন। বেল দিতেই,দরজা খুলে স্নেহার মা বেশ অবাক হলেন! "স্নেহা তো তোমার কাছেই গেছে পড়তে। বললো স্কুল থেকে টানা যাবে,ফিরতে দেরী হবে। তুমি গ্রুপ স্টাডি করাবে!" আকাশ থেকে পড়লো রক্তিম। ভদ্রমহিলাকে এত ঘাবড়ে যেতে কোনদিন দেখে নি রক্তিম! "কোথায় গেল তবে মেয়েটা? তুমি একটু খুঁজে দেখবে?" "ওকে একটা ফোন করুন আগে" "হ্যাঁ,তাইতো।" ফোনটা নামিয়ে মুখটা আরো করুন হয়ে গেলো স্নেহার
মায়ের। কোনমতে বললেন, "সুইচড্ অফ বলছে। আমি এখন কি করবো রক্তিম? ওকে
কোথায় খুঁজবো?" "আপনি ঘাবড়াবেন না কাকিমা। আমাকে ওর বন্ধুদের
নাম্বার দিন।আমি দেখছি।" পাগলের মত একে তাকে ফোন করছে রক্তিম। মাথা আর কাজ করছে না। শেষে ওদের স্কুলে গিয়ে হাজির হোলো। গেটকীপার ছেলেটা মুখ চেনা।ওকে সব বলতেই,ও
বললো, " ঐ মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড তো ডাঃ সাহার ছেলে
বিক্রম। ওদের বাড়ি একবার যাও তো ভাই।" বিক্রম কে তাও একবার ফোন করলো রক্তিম। রিং হয়ে গেল,কেউ ধরলো না। বিক্রমদের ফ্ল্যাটের গ্যারেজেই চোখে পড়লো স্নেহার সাইকেল। সে চেনে। কি করবে ,এবার রক্তিম? যাবে ওদের ফ্ল্যাটে? দ্বিধা করেও বেল টিপলো সে। খবর জোগাড় করে পাখির মত উড়ে চললো সে ভিকির ছোটমাসির
ফ্ল্যাটে। দরজাটা হালকা ভেজানো। ভিতরে মনে হচ্ছে বেশ হইচই। মিউজিক
সিস্টেমও চলছে। কি দেখবে রক্তিম? টেনশনে হাতপা ঠান্ডা হয়ে আসছে
তাঁর। কলিংবেলে সেতার বেজে উঠলো। একটি অল্পবয়সী ছেলে দরজার কাছে আসতেই রক্তিম বলে
উঠলো, "স্নেহা,স্নেহা কোথায়?" ছেলেটির চোখে ভয় দেখলো রক্তিম। এই কি বিক্রম? স্নেহার
কি হলো! "আসুন,ভিতরে আসুন" রক্তিম ভিতরে ঢুকে দেখলো বিরাট বড় ড্রয়িংরুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোকজন। সবাই কোন একটা প্রসাদ খাচ্ছে। কোনার এক সোফায় স্নেহা বসে,তাঁর ঘাড়ে পিঠে দুটো বাচ্চা! রক্তিমকে দেখেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো স্নেহা! এক ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন,হাসিমুখে বললেন, "বসুন ভাই বসুন। আপনি নিশ্চয় স্নেহার
দাদা?" "না ,আমি স্নেহার দাদা নই" তীব্রস্বরে
বলে উঠলো রক্তিম। সে কোনদিন স্নেহার দাদা হতেও চায় না। ভদ্রমহিলা তখনো বলে চলেছেন, "ভারী মিষ্টি মেয়ে ,আপনার বোন। আমার ছেলেমেয়ের সাথে এত ভাব হয়ে গেছে। আমরা পুজো দিতে গেছলাম তো, ভিকি ঘর পাহারা দিচ্ছিল। স্নেহা তো কখন থেকেই চলে যেতে চাইছে। আমিই ওকে জোর করে বসিয়ে রেখেছি। কোনদিন আসেনা মেয়েটা। আপনাকেও
প্রসাদ না খাইয়ে ছাড়ছিনা ভাই" স্নেহা চোরা চোখে একবার চেয়েই মাথাটা নামিয়ে নিলো। রক্তিম
গম্ভীর মুখে তখনো চেয়েই আছে। সূর্য অস্ত যায় যায়। গোধুলির রং আরো গাঢ় হয়েছে। রক্তিম সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে আসছে। পাশে স্নেহা। পিছন পিছন ভুলো লেজ নাড়তে নাড়তে চলেছে ... |
0 মন্তব্যসমূহ